বিকেল ৪ টা ০৫ মিনিট। লেগে গেছে ইফতারি বানানোর ধুম! এসময় কত রকমের ইফতারি যে শোভা পায় দোকানে দোকানে- তা কেবল বাইরে থেকে কিনতে গেলেই চোখে পড়ে! তাছাড়া সেগুলো এতটাই মুখরোচক হয় যে অন্তত একদিন হলেও নেওয়া চাই বাড়িতে! তাই এক দিক দিয়ে ইফতারের সময় ঘণিয়ে আসে আর অন্য দিকে ক্রেতা সাধারণের আগমণ ঘটে দোকান গুলোতে। বিকি-কিনি তাই মন্দ হয়না! বেশ ভালোই জমে ওঠে তখন!
“রাফসান হোটেল”- সাধারণত ভাত তরকারি বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ। তবে নানা ধরণের ভাঁজা পুড়া, যেমন: সিঙারা, পুরি, সমচা, ডালের বরা- এগুলোও বিক্রি হয় এখানে। তাছাড়া অন্যদের মতো অতিরিক্ত লাভের আশায় এখানেও বিক্রি হয় বাহারি রঙের ইফতারি। আর সেটা প্রতি রমযান মাসেই।
এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। পয়লা রোযা থেকেই বিক্রি হচ্ছে ইফতারি। তাই দুপুর গড়াতেই ইফতারি বানানোর চাপ পড়ে হালিম বাবুর্চির ওপর। এসময় একটু জিরোবার ফরসত হয়না তার। আগুনের তাপে বসে একটার পর একটা ইফতার আইটেম প্রস্তুত করতে থাকেন তিনি। তাপে শরীর ঘেমে আসে, তবু ক্লান্তি হয়না তার। বোধ হয় কাজের খাতিরেই প্রকাশ পায়না তা। সে যে সামান্য বেতনের একজন বাবুর্চি! হোটেলে রান্না-বান্না করেই সংসার চালাতে হয় তাকে!
বাড়িতে তিন তিনটা মেয়ে আছে হালিম বাবুর্চির। দু’বছরের বড় ছোট একেক জন। যাদের মধ্যে ছোট মেয়েটার বয়স ১১ বছর। খুব আদুরে মেয়েটা। বাবা ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা সে। তাই যত আবদার তার বাবার কাছেই। হালিম বাবুর্চিও মেয়ের সাধ মেটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যান। এখনো পর্যন্ত মেয়ের সমস্ত আবদার রক্ষা করে চলেছেন তিনি। তবে বড় দুটো অবশ্য তেমন কিছুই আবদার করেনা তার কাছে। বোধ হয় বাপের কষ্টটা একটু হলেও বুঝতে পায় তারা। তাই আর এটা সেটা চাই বলে বলে বাবাকে চিন্তায় ফেলেনা ওরা। কিন্তু ছোট মেয়েটা যে এতকিছু বুঝেনা। তার যেটা চাই, সেটা দিতেই হবে। আর তা যেমন করেই হোক। এইতো, কদিন ধরেই মেয়েটা বলে যাচ্ছে- “বাবা, ও বাবা! তুমি দোকানে যে যে ধরণের ইফতারি তৈরি কর, তা বাড়ি আননা কেন? আমার যে খেতে মন চাচ্ছে!”
এদিকে মেয়ের আবদার শুনে হালিম বাবুর্চি মহা ফাঁপরে পড়ে। না পারে মেয়েকে না বলতে আর না পারে ঐসব দামি দামি ইফতারি কিনে আনতে। ওগুলো অন্তত একদিন আনলেও যে অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে তার। এদিকে রোযার পরেই ঈদ। কাজেই সামনেতো খরচ রয়েছেই- মেয়েদের জামা-কাপড় কেনা, বাজার খরচ; তাছাড়া একটু মাংস-পোলাওয়েরওতো ব্যবস্থা করতে হবে, নাকি! তাই ভেবে কি করবে- কিছুই ঠিক করে ওঠতে পারেনা হালিম বাবুর্চি।
এদিকে কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরলেই মেয়ে জিজ্ঞেস করে বসে- “বাবা, ও বাবা! আজ এনেছ? তোমার হাতে বানানো মজার মজার সব ইফতারি!” এতে হালিম বাবুর্চি লজ্জিত হয়। সে যে একদিনও আনতে পারেনা সাথে করে। সেগুলো কিনে আনা যে তার সমর্থের বাইরে। তাই মিথ্যে বলে কয়ে মেয়েকে বোঝ দেয় সে- “হায় আল্লাহ! আজকেও ভুলে গেছি! একদম ভুলে গেছি মা!” বাপের কথায় কিছুটা মন খারাপ হয় মেয়ের। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সে। সাথে গাল ফুলানো থাকে অভিমানে। অবশেষে বাপের কথায়ই মান ভাঙে তার। জন্ম নেয় পুর্নআশা। বাবা নিশ্চয়ই কাল এনে দেবে। তাই ভেবে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে সে।
কথাগুলো মনে করে হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে যায় হালিম বাবুর্চির। মনোযোগ সরে যায় চূলা থেকে। এসময় একটা কর্কশীয় গলায় মনোযোগ ফিরে তার- “ঐ মিয়া, কি ভাব এতো? হাত চালাও, তাড়াতাড়ি হাত চালাও! সময় যে বয়ে গেল। শুনি…..,তোমার শেষ হবে কখন!” হালিম বাবুর্চি জবাব দেয়- “এইতো, হয়ে গেলো বলে।” – “হ্যা, হ্যা; তাই যেন হয়।” বলে নিজের কাজে মন দেয় হোটেল ম্যানেজার। কাজ বলতে তার- টাকা পয়সার হিসেব রাখা আর চেয়ারে বসে বসে ঝিমুনো! এখন অবশ্য হিসেব নিয়ে ব্যস্ত তিনি!
নিজের কাজ শেষ করে হালিম বাবুর্চি হাত-মুখ ধুয়ে এসে ম্যানেজারের সামনে অতি বিনম্রভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে! বোধ হয় কিছু একটা বলতে চায় সে। কিন্তু সেদিকে একবারের জন্যও চোখ পড়েনা ম্যানেজারের! তিনি ব্যস্ত তার আপন কাজে! যেন কলম পিষে এখনি সমস্ত হিসেবের গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়বেন, যাতে পরে অনেকটা সময় ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাটাতে পারেন!
হালিম বাবুর্চি বেশ বুঝতে পারছে ম্যানেজারের ব্যস্ততার বিষয়টা। কিন্তু তবুও মেয়ের কচি মুখটা মনে করে আর না বলে পারলোনা সে। বলেই ফেললো- “সাহেব, একখান কথা বলার ছিল আমার!” কথাটা শুনে এক পলকের জন্য হালিম বাবুর্চির দিকে তাকিয়েই আবার নিজের কাজে মন দেয় ম্যানেজার। তবে বলার সুযোগ করে দেয় হালিম বাবুর্চিকে। বলে- “হ্যা, বলো! কি যেন বলবে তুমি!” – “বলছিলাম, আমার মেয়ে- ছোটটা; আমার হাতের বানানো ইফতারি খেতে চেয়েছে! তাই বলছিলাম, যদি অল্প অল্প করে হলেও আমাকে কিছু ইফতারি দিতেন…..তাহলে মেয়েটার জন্য নিয়ে যেতাম!” কথাটা শুনেই ফুঁসে ওঠল ম্যানেজার- “ঐ মিয়া, কি কইলা? এইসব ইফতারি নিবা মেয়ের জন্য! এগুলোর কত দাম জানো…..? যত্তসব বেখেয়ালী আবদার!” এইসব বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল হালিম বাবুর্চিকে। কত কাকুতি-মিনতি করল সে, তবু মন গললোনা ম্যানেজারের! তার সে এক কথা- “ওসব বড়লোকী খাবার গরীবের জন্য না!” ম্যানেজারের কথা শুনে দুঃখে অন্তর ফেটে যায় হালিম বাবুর্চির। ভাবে- “কত যত্ন করে এতসব ইফতারি বানায় সে। অথচ নিজে একটাও মুখে দিতে পারেনা। পারেনা নিজের মেয়ের আবদার পর্যন্ত মেটাতেও!” ভাবতে ভাবতে চোখ বেয়ে পানি এসে যায় তার। তাই আর কথা না বাড়িয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় সে।
এদিকে বাবার আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে মেয়েটা। কখন তার বাবা আসবে, তার জন্য মজার মজার সব ইফতারি নিয়ে। কিন্তু হালিম বাবুর্চি কি পারবে তার মেয়ের আবদার মেটাতে !তাই বলে কয়ে আবারো ম্যানেজারের হাতে পায়ে ধরতে! নাকি আজও কোন মিথ্যের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে তাকে! অথবা নিজের অসমর্থের কথা বলে মেয়েকে এই প্রথম বারের মতো শাসন করবে সে- যে, “ওসব বড়লোকী খাবার আমাদের জন্য না! আমরা গরীব মানুষ, আমাদের রোযা আছে কিন্তু ইফতারি নেই! আছে কেবল রোযা ভাঙার জন্য এক গ্লাস কলের পানি! তাই ফের যদি ওসব আবদার করেছিস-তো, টেনে জিভটা ছিঁড়ে দেব! যাতে আর কখনো কিছু খেতে মন না চায়!”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।