জ্বী, চাচা। রাজারহাট শহরে। রাহাপাড়া পানির ট্যাঙ্কির কাছে।যেখানে নদী গবেষনার ইন্সিস্টিটিউট-এর যে নতুন ভবন হচ্ছে ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। জায়গাটা আমি চিনি। রাজার হাটে আমার এক মামা থাকেন। আব্বাস মামা আফগানিস্তান থেকে আখরোট আর নাশপাতি ইমপোর্ট করেন। আর আমি থাকি মিঞাবাড়ির বালাই দীঘির পাড়। ওখানেই আমাদের পৈত্রিক ভিটে।
উবাইদ মালিক- এর কথা শেষ হল না সেই ছোট ছেলেটি দুটি কাপ নিয়ে এল। নীল রঙের বড় চিনেমাটির কাপ। কাপে চা আছে মনে হল। কী অদ্ভূত সুন্দর নিষ্পাপ বালক। টলটলে হলদেটে গায়ের রং। চায়ের কাপ দুটো আমাদের দিয়েই ছেলেটি আবার দৌড়ে চলে গেল। উবাইদ মালিক চায়ের কাপে চুমুক দিলেন দেখে খটকা লাগল। কারণ চায়ের কাপে তখনও ধোঁওয়া উঠছিল।ভদ্রলোক অত গরম চায়ে চুমুক দিলেন কীভাবে? আশ্চর্য!
উবাইদ মালিক বললেন, এই ছেলেটি আমার ছোট ছেলে, নাম শাহিদ। আমার মেয়েই বড়। ওর নাম আফসানা । ক্লাসটেন পর্যন্ত স্কুলে পড়েছে। এখন ঘরে বসেই আরবি ফারসি পড়ছে। বলে ভদ্রলোক দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। ওনার বিবির নাম যে খুশনুদ খানম কথায় কথায় সেটিও জানিয়ে দিলেন। খুশনুদ খানম- এর মা-ই স্ট্রোক করেছেন।
কয়েক বার ফুঁ দিয়ে চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিলাম। অসাধারণ টেস্ট। কী বলব! মশলা মেশানো ঘন দুধের চা। বুঝলি এমনটা এর আগে কখনও খাইনি। দুধটা উটের দুধ মনে হল।
রবিন জিজ্ঞেস করে, মামা, তুমি কীভাবে বুঝলে যে ওটা উটের দুধ ছিল?
ওহ! আমি স্কাউটিং করতাম। কলেজে পড়ার সময় একবার দলবল নিয়ে তাজাকিস্তানে গিয়েছিলাম। ওখানেই ফেরগানা উপত্যকায় জীবনে প্রথম উটের দুধ খেয়েছিলাম।
ওহ্ ।
আমি মশলাদার চায়ে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বললাম, ইয়ে চাচা, মানে … মানে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
চায়ের চুমুক দিয়ে উবাইদ মালিক বললেন, বল, বাবা, বল।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। মধ্যরাতের স্টেশনে প্রায় অপরিচিত কাউকে তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেয়াটা কি অশোভন দেখায় না? তবে আফসানা মেয়েটি এতই রূপবতী যে আমার সমস্ত বুদ্ধি বিবেচনা কেমন যেন গুলিয়ে গিয়েছিল। তাছাড় পরিবারটিও বেশ চমৎকার। আন্তরিক। কেমন চা খাওয়ালো। উবাইদ মালিকও বেশ অমায়িক আর আন্তরিক।
আমি বললাম, চাচা, আমাদের বাড়ি নবীগঞ্জের দরগাবাড়ি। আমাদের কিছু পৈত্রিক সম্পত্তিও আছে। তবে আমার বাবা নেই, তিনি ডাকবিভাগে চাকরি করতেন। আমার মা অবশ্য বেঁচে আছেন। আমিই পরিবারের বড় ছেলে। আমার দুই ছোট বোন আছে। ওরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে।
বেশ তো। বুঝলাম।
আমি…আমি
হ্যাঁ বাবা, বলো।
আমি … আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
আমার এই কথায় ভদ্রলোকের মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। ধবধবে ফর্সা মুখে শ্রাবণের মেঘ জমে উঠল যেন। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ভিড়শূন্য মধ্যরাতে স্টেশন শুনশান করছিল। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে কুয়াশা ছড়িয়ে ছিল। দু জোড়া রেললাইনের ওপর জ্যোস্না আর কুয়াশার চাদর মোড়ানো।
উবাইদ মালিক আমাকে জিগ্যেস করলেন, তুমি আফসানাকে বিয়ে করতে চাও?
জ্বী। চাচা।
সে তো সম্ভব নয়।
মধ্যরাতের নির্জন স্টেশনে বিনা মেঘে বজ্রপাত হল যেন। আমার মাথা কেমন টলে উঠল। আফসানা মেয়েটি এত সুন্দর। আমি কোনওমতে বললাম, সম্ভব নয়? কেন? আমার কন্ঠস্বর কেমন যেন ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনালো। আমি চা কী খাব। কাঁপা- কাঁপা হাতে কাপটা বেঞ্চির ওপর রেখে দিলাম।
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এক বিশেষ কারণে আমি আফসানাকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারব না।
কেন? আপনার কি শিয়া চাচা?
উবাইদ মালিক বললেন, না বাবা। আমরা সুন্নী।
তাহলে বিহারী?
না, বাবা। আমরা দীর্ঘকাল ধরে ইস্ট পাকিস্তানেই বাস করছি। পারস্য থেকে আমাদের পূর্বপুরুষ খাজা ইবরাহিম আজম বাংলায় এসেছিলেন পারস্যের প্রখ্যাত সুফি সাধক দরবেশ শাহ মোল্লা মিসকিন- এর সঙ্গে ।
তাহলে? আমার কন্ঠনালী ভীষণ শুকিয়ে আসছিল।
আমরা জিন। উবাইদ মালিক বললেন। ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনালো।
জিন! মানে? আশ্চর্য! কী বলছেন উবাইদ মালিক। আমার মনে হল মধ্যরাতের এই নির্জন স্টেশনটি একটা প্রকান্ড হিমঘরে ঢুকে গেছে। প্রকান্ড বড় একটা শব্দহীনহিমঘরে। আর আমি প্রগাঢ় নৈঃশব্দেহিসসিম খাচ্ছি। বার বার তলি য়ে যাচ্ছি … আবার ভেসেও উঠছি।
আপনারা জিন মানে? আমার কন্ঠস্বর খানিকটা উত্তেজিত শোনালো।
উবাইদ মালিক মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ। আমরা জিন। জান তো পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তাঁর ইবাদতের জন্য জিন এবং ইনসান সৃষ্টি করেছেন।
গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।