আনন্দ বেদনার ঈদ—-মোঃ সোহরাব হোসেন বিটুল

শ্রাবণে যেন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়া যেন নিত্যদিনে পরিণত হয়েছে। আকাশে মেঘের লুকোচুরি এ প্রান্ত থেকে অসীম দূরে ছড়িয়ে পড়ছে। রুহিত বাস থেকে নেমে ভ্যানগাড়ি খোঁজার চেষ্টা করছে। অনেকদিন পর সে এবারের ঈদে গ্রামে যাচ্ছে। ঈদের আর কয়েকদিন বাকি। রমজানের শেষ মুহূর্তে সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত। গাংনী বাসস্ট্যান্ড বাস থেকে নেমে ভ্যানগাড়ি না হলে গ্রামে পৌঁছানো যাবে না। তাছাড়া ব্যাগপত্র একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে আজ রুহিতের কাছে। আসার সময় রুহিতের আববু ও আম্মু অনেক কেনাকাটার জিনিস ব্যাগে ভরে দিয়েছে। অনেকদিন আগে রুহিত তার গ্রামে দাদার বাসায় এসেছিল তারপর বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে আর আসা হয়নি। এবারও সে একা একা আসতে চায়নি কিন্তু বাবা মায়ের জোরাজুরিতে তাকে আসতে হলো। তাছাড়া শহরের ব্যস্ততম জীবন থেকে কয়েকদিনের কোলাহল মুক্ত গ্রামে গিয়ে ঈদ করতে পারবে বলে তার মনটা আনচান করছিল।

যাহোক অবশেষে রুহিত একটা ভ্যানগাড়ি  পেয়ে গেল। ভ্যানগাড়িতে যেতে যেতে সে গ্রামের অনেক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। গ্রামের সেই অাঁকাবাকা রাস্তা আজ পাকা রাস্তায় পরিণত হয়েছে। এমনকি দাদা বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় ইট বিছানো রয়েছে। রুহিতের দাদা বেঁচে নেই কিন্তু দাদি আছে, বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। চোখে স্পষ্ট দেখতে পায় না। আর দুই চাচা বড় আর ছোট। রুহিতের বাবা মেজো সবার ছোট রত্না ফুফু।

বাড়ির গেটে পৌঁছাতে ছোট ও বড় চাচা আর চাচিমাসহ সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে যেন আমার অপেক্ষায় ছিল। ছোট চাচা বলল, ‘কিরে রুহিত তুইতো দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছিস। অমনি ঝটপট আমার ব্যাগপত্র চাচা কাঁধে নিয়ে বলে তুই বাড়ির ভিতর যা আমি সবকিছু নামিয়ে আনছি।’

রুহিত বড় চাচাকে সালাম দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই অন্য ঘর থেকে দাদির ডাক ‘কে আসলোরে? রুহিত দাদুভাই নাকি?’ আমি দৌড় দিয়ে দাদির কাছে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ দাদি আমি রুহিত, তুমি কেমন আছো দাদি?’ দাদি আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে আমার মুখে হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুই আমার দাদুভাই রুহিত। কত্ত বড় হয়েছিসরে তুই! আমার কথা কি তোর একবারও মনে পড়ে না। তোর মা কেমন আছে রে?’ আমি বললাম, ‘ভালো আছে। বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে না দাদি?’ দাদি অমনি ইতস্তত করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘কইগো বউমা আমার দাদুভাইকে তার ঘরডা দেখাইয়া দাও। পোলাডা বাসে আইসা কেলান্ত হইয়া পড়েছে।’ আমিও আর এ বিষয়ে কথা না বলে উঠে দাঁড়ালাম।

এমন সময় রাইলা এসে বলল, ‘রুহিত ভাইয়া তুমি এই দিকে আসো।’ আমি বললাম, ‘তুমি কে? সে অমনি হেসে বলে, ‘আমি রাইলা।’ আমি হতবাক তুমি মানে তুই রাইলা। এতো বড় হয়ে গেছিস তুই, মোবাইলে বারবার তোর একই প্রশ্ন আমাকে, ভাইয়া তুমি কবে আসবে, কবে আসবে ভাইয়া এই বলেতো অস্থির হয়ে যেতি। এবার তুই যেন কোন ক্লাসে?’  ক্লাস সেভেনে ভাইয়ার জবাবে রাইলা বলে। চল।

ঘরে ঢুকে মনটা আরো ভালো হয়ে গেল। দেয়ালে দাদার ছবি টাঙানো। ঘরটা পরিপাটি করে গোছানো। ছবি যেন সত্যি কথা বলে। দেখে যেন মনে হয় নিরলস, প্রাণবন্ত, আপসহীন, জীবন্ত কিংবদন্তি আমার সামনে তার জলজল চোখ দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করছে। গ্রাম আর এখন অজ পাড়া গাঁয়ের মত নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে।

এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠল। দেখলাম আম্মু ফোন করেছে। সর্বনাশ আমি তো ভুলেই গেছিলাম আম্মুকে তো আমারই ফোন করার কথা ছিল। ফোন ধরতেই আম্মু বলল, ‘বাবা রুহিত তুমি কি পৌঁছে গেছ? আমি জবাবে বললাম, ‘হ্যা আম্মু এই মাত্র পৌঁছালাম। আমার বাসা চিনতে কোন অসুবিধা হয়নি আম্মু। তোমরা সবাই ভালো আছোতো? এরপর ফোন রেখে দিই।

‘আচ্ছা ভাইয়া তোমার আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো? কতদিন পরে এলে, মায়ের ও দাদির কাছ থেকে তোমার কথা শুনেছি, রাইলা আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি ঝটপট উত্তর দিই, নারে আমার কোন কষ্ট হয়নি।

আচ্ছা রাশেদ কবে আসবে?’ আমি রাইলাকে জিজ্ঞেস করলাম। কালকে আসবে ভাইয়া, জবাব দেই রাইলা। তাহলে ও এলে খুব মজা হবে তাই না? হ্যাঁ ভাইয়া, রাইলা বলে। আমি বললাম, ‘আচ্ছা তুই এখন যা আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি। আচ্ছা তুই একটু দাঁড়া এই নে তোর জন্য চকলেটের বাক্স আর একটা গল্পের বই।’ উহ ভাইয়া তুমি খুব ভালো, এই কথা বলে রাইলা হাসতে হাসতে চলে গেল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম চাচিমা ইফতারি তৈরির আয়োজনে ব্যস্ত।

পরদিন রাশেদ পৌঁছাল বিকাল ৫টায়। আমরা দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি আর রাশেদ অনেক অনেক না বলা কথা বললাম। রাতে তারাবীর নামায শেষ করে খেতে বসলাম দু’জন। খেতে খেতে সবার সাথে কথা হল। কাল চাঁদ উঠলে পরশু ঈদ।

রাতের খাওয়া শেষে আমি সবার জন্য কেনা ঈদের পোশাক হাতে তুলে দিলাম। সবার শেষে দাদির ঘরে গেলাম। দাদিকে ঈদ উপহার দিতেই সে তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করায় আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। তারপর আমি দাদিকে বললাম, ‘এটা তুমি নেবে না কেন? আমি ও আম্মু এটা তোমার জন্য পছন্দ করে কিনেছি? তুমি যদি আমার কেনা এ জিনিস না নাও তাহলে তুমি আমাকে এতো ভালোবাস কেন? এ তো পছন্দ করো কেন? ঠিক আছে তুমি এটা না নিলে কাল সকালে আমি ঢাকায় চলে যাবো।’ এ কথা বলতেই দাদি আমাকে বলল, ‘হে দাদু ভাই আমি ওটা নেব। তবুও কাল তুই আমাকে ছেড়ে যাইবি না।’

এরপর দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। আমি বললাম, ‘দাদি আববুকে ক্ষমা করে দাওনা। তুমি একবার বললে তারা এখানে এসে ক্ষমা চাইবে। আমি জানি আমার বাবা মা কত কষ্ট এতো বছর বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। তুমি ক্ষমা না করলে তো তারা আজীবন এই কষ্ট বয়ে বেড়াবে। তুমি না বাবাকে অনেক ভালবাসতে। যেমনটা আমাকে বাসো। জানো দাদি আববু-আম্মু অনেক বেশি আমাকে ভালবাসে। তাই তাদের কষ্ট, আমাকেও কষ্ট দেয়।’

জবাবে দাদি কিছুই বলে না শুধু চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। ইতোমধ্যে আমার চোখে কখন যে পানি চলে এসেছে তা টের পায়নি। আমি দাদির চোখের পানি মুছে দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলাম।

‘‘আমার আববুর উপর দাদির অভিমান এ জন্য যে দাদু ও দাদির মত না থাকা সত্ত্বেও আমার মায়ের সাথে আববুর বিয়ে হওয়া। অনেক বছর আগে আববু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র আর আম্মু তখন ১ম বর্ষে। হঠাৎ করে আম্মুর আববু অর্থাৎ আমার নানার টিউমারের অপারেশনের পর ‘ও পজিটিভ’  রক্তের প্রয়োজন হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন সবে মাত্র আত্মঃপ্রকাশ করেছে। আমার বাবা ছিলেন সেই সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য। আমার আম্মুর আত্মীয়রা অনেক খোঁজাখুঁজির নির্দিষ্ট সময়ে রক্ত ম্যানেজ করতে না পারলে আম্মু এই সংগঠনে খোঁজ নেয়। তারপর বাবার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে যায় এবং বাবার রক্ত দিতে রাজি হয়। শেষমেষ নানা সুস্থ হলে বাবাকে বাসায় ডেকে নিয়ে যায়।

এরপর থেকে আস্তে আস্তে তাদের পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাবাকে আম্মুর ভাল লেগে যায়। ক্যাম্পাসে মাঝেমাঝে তাদের দেখা ও কথা হতে থাকে। এক সময় বাবাও মনের মাঝে ঠাঁই দেয় তাকে। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারে না তাদের পছন্দের কথা, ভাল লাগার কথা। ইতোমধ্যে বাবার মাস্টার্স শেষ হলে চাকরির চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু চাকরি জুটছিল না। এদিকে আম্মু নানাকে সব কথা খুলে বললে নানা প্রথমে রাজি না হলেও আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে আর বাবার কথাবার্তা, চলাফেরা সবকিছু বিবেচনা করে শেষে বিয়েতে রাজি হয়।

এরপর বাবাকে ডেকে পাঠান আমার নানা। বাবাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কিছু করার পরিকল্পনা করেছো কী?’ বাবা জবাবে বললেন, ‘ভাল চাকরির চেষ্টা করছি। আমার জন্য দোয়া করবেন আংকেল।’ এরপর নানা বললেন, ‘‘আমার এক পরিচিত বন্ধুর কোম্পানিতে ভালো একটা পদে চাকরির লোক খুঁজছে।’’ আমাকে বলেছে, আমার পরিচিত কেউ থাকলে পাঠিয়ে দিতে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে সেখানে পাঠাবো অবশ্য তুমি যদি কিছু মনে না কর। তারা তোমার সাথে কথা বলবে আর তুমিও তাদের সাথে বিস্তারিত কথা বলো। তারপর তোমাকে তাদের পছন্দ হলে আর তুমিও যদি তাদের প্রস্তাবে রাজি হও। তবেই না চাকরি। তবে তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো।

এরপর বাবার চাকরিটা খুব পছন্দ হয় আর কোম্পানি বাবার এক্সিল্যান্ট রেজাল্ট আর কথাবার্তায় পছন্দ হলে ভালো বেতনে নিয়োগ দেয়। মাস খানেক পর বাবা মিষ্টি নিয়ে নানার সাথে দেখা করতে গেলে নানায় তার মেয়ে তাকে পছন্দ করে বলে তার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। নানা বললেন, ‘যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে তবে তোমার বাবা মায়ের সাথে আমি বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।’ এ কথা শুনে বাবা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলনা।

তারপর বাবা ১০ দিনের সময় নিয়ে আমার দাদু আর দাদির সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তারা বেঁকে বসে। মেয়ে পক্ষে আসার কথা বললেও তারা রাজি হল না। অন্য চাচারাও তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। তাদের একই কথা তারা শহরের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিবে না। অনেক কষ্ট করেও তাদেরকে রাজি করতে ব্যর্থ হলে বাবা ঢাকায় এসে একা একা বিয়ে করে ফেলে। আর এতে খুব কষ্ট পায় দাদি আর দাদা।

এর কয়েক বছর পর আমার জন্ম হয়। আমার আম্মু কয়েকবার দাদির কাছে আসতে চেয়েছে, কথা বলতে চেয়েছে। কয়েকবার চিঠিতে ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই। কয়েকবছর পর দাদা মারা গেল। আববু আম্মু সেই প্রথমবার আমাকে নিয়ে এখানে মাটি দিতে আসে। এরপর আববু আম্মু দাদির সাথে কথা বলতে গেলে দাদি শোকে পাথর হয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘আর কোনদিন এ বাড়িতে আসবি না। তোর মুখ দেখাও পাপ, এরপরও যদি তুই আসিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি।’

এই কথার পর থেকে বাবা মা আর কোন দিন এখানে আসেনি। তবে দাদি ঐ দিন আমার ছোট্ট কচি মুখে নাকি মায়া জড়ানো চেহারা দেখতে পেয়েছিল। আমার চেহারার মধ্যে নাকি দাদুর চেহারা দেখতে পেয়েছিল। তারপর থেকে আমার উপর তার মনে অন্য রকম ভালোবাসা জন্মায়।  তারপর বেশ কয়েক বছর আগে আমি এখানে ছোট চাচুর সাথে একবার এসেছিলাম।

যাহোক রাশেদ ও আমি একই বয়সের। ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয় ৪ বছর আগে ও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে আসে। এরপর ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিদ্যায় ভর্তি হয়ে গেলাম। তারপর দেখতে দেখতে চার বছর পার হয়ে গেছে। দেখা সাক্ষাত না হলেও অবশ্য মোবাইল আর ফেসবুকে আমাদের মাঝেমাঝে যোগাযোগ হতো।

ঈদের দিন সকাল সাড়ে ৬ টা। ফজরের নামায শেষে আজ আর যেন ঘুম আসছে না। তাই রাশেদ আর আমি আজকে কে কি করবো, কোথায় কোথায় ঘুরতে বেরুবে, তার হিসাব কষতে লাগলাম। রাইলা এসে বলল, ‘ভাইয়া তোমাদের ছোট চাচ্চু ডাকছেন।’

ছোট চাচ্চু, রাশেদ আর আমাকে ডেকে পাঠালো। সকালে ভেড়া জবাই দেবে তাই রাশেদ থাকলে ভালো হয় এজন্য ছোট চাচ্চু ডেকেছেন। আমি ভেড়া জবাইতো দূরে থাক ভেড়ার গোশত এর আগে কোন দিন খেয়েছি কিনা আমার মনে পড়ে না। ছোট চাচ্চু আর রাশেদ কসাইয়ের কাজটা প্রায় ভালোভাবে রপ্ত করেছে।

এই সেই ছোট চাচ্চু যে কিনা আমার বাবা মায়ের বিপদে, আপদে সব সময় পাশে থেকেছে। আমার জন্মের আগে ছোট চাচ্চু আর চাচিমাতো বাবা মাকে সবরকম সাহায্য করেছে। তাছাড়া ছোট চাচ্চু বাবাকে খুব পছন্দ ও সম্মান করেন। আমাকেও খুব পছন্দ করেন। ছোট চাচ্চু এক ছেলে, নাম শাফায়েত সম্ভবত ক্লাস টুতে পড়ে। থাকে নানির কাছে। ঐখানেই সে বড় হচ্ছে। এখানে আসে না বললেই চলে। আর প্রথম একটা মেয়ে হয়েছিল সে কি যেন একটা রোগে অনেক আগেই মারা যায়।

ঈদের দিনে নামাযের আগে মোবাইলে আববু-আম্মুর সাথে কথা বললাম। তারপর আববু আমাকে বলল, ‘বাবা রুহিত তোমার কথায় যেন ও বাড়ির কেউ কোন কষ্ট না পায় আর সবাইকে আমার ঈদের শুভেচ্ছা দিও। তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি কথাটি বলেই ফেললাম, ‘আচ্ছা আববু আমরা যদি সবাই অর্থাৎ সবাই মিলে এখানে একসাথে ঈদ করতে পারতাম তাহলে কেমন হতো?। কথা শোনামাত্র মোবাইলের ও পাশ থেকে চাপা ও কান্না জড়িত কণ্ঠে আববু বলে, ‘রুহিত এসব কথা বাদ দাও। সবাই মিলে ঈদে আনন্দ কর, মজা কর। এখন ফোন রাখছি।’

মোবাইল রাখার সাথে সাথেই আমার বুঝতে বাকি রইল না যে বাবার চোখে পানি এসেছে।

এরপর আমি, রাশেদ আর ছোট চাচ্চু  ঈদগাহে গেলাম। বড় চাচা আগেই ঈদগাহে চলে গিয়েছে। নামায শেষে রাশেদ আর আমি গোরস্থানে গেলাম দাদু ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে। আমার দুর্ভাগ্য, বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পর তাকে দেখতে পাইনি। যখন আমি খুব ছোট তখন তিনি মারা যান। কবর জিয়ারত শেষ করে সবার সাথে কুশল বিনিময় হল।

আমি ও রাশেদ দাদির ঘরে গেলাম। দাদি খুব বেশি চলাচল করতে পারে না। লাঠিতে ভর দিয়ে চলাচল করে। দেখতে পেলাম দাদির মুখখানা আজ খুব খুশি খুশি। তাই আরেকবার বললাম,‘‘দাদি তুমি আজ খুব খুশি তাই না? দাদি বলল, কেনরে দাদু ভাই? আমি বললাম, ‘না এমনি জিজ্ঞেস করলাম।’ দাদি বলল, ‘কিরে দাদু ভাই আজ তোর মন খারাপ কেনরে, কি হয়েছে? না দাদি কিছু না, আমি খুব খুশি আজ, তোমার খুশি দেখে।’ বুঝতে পেরেছি তোর মনডা খারাপ, তুই কি চাস বল, আমি তাই দিয়ে তোর মন ভালো কইরা দিমনে’ দাদি আমাকে বলে। ‘আমি যা চাই, তুমি তাই করবে দাদি? আমি আরো একবার জিজ্ঞেস করলাম। হ্যাঁ বলেছিতো, তুই তাড়াতাড়ি বইল্যা ফ্যালাতো দাদু ভাই।’ আমি সাহস করে বলে ফেললাম, ‘দাদি তুমি আজ এই ঈদের খুশির দিনে, আববু ও আম্মুকে ক্ষমা করে দাওনা।’ অমনি দাদির হাসিমাখা মুখ খানি আষাঢ় মাসের আকাশের ঘুটঘুটে কালো মেঘের অন্ধকারে ঢেকে গেল। আমি বললাম, ‘দাদি আমি তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য কথাটি বলিনি কিন্তু তুমি কষ্ট পেলে যে আমিও কষ্ট পাই।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আমরা যখন উঠে চলে আসবো হঠাৎ দাদি বলল, ‘দাঁড়া দাদু ভাইয়েরা, আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম আজ। এবার খুশিতো?’ আমি কি বলবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না।  আমার মুখের ভাষা গলায় আটকে গেল। অমনি দাদিকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘দাদি তুমি খুব ভালো। আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আগামী ঈদ করবো সবাই এক সাথে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!