আনন্দভায়া বলল, “এই চমৎকার দুর্গটা থাকতে লোকে এখানে ভীড় করতে আসে কেন, বুঝলাম না ।”
সরাইখানার মালিক বলল, “ওখানে যারা রাত কাটাতে যায় তারা আর বেঁচে ফেরে না।”
আনন্দভায়া বলল, “আমি ভয় পাই না । ওখানেই চললাম রাত কাটাতে ।”
সরাইখানার মালিক বলল, “আমার কথা শোনো । ওখানে যেও না । গেলে ফাঁসির দড়িতে লটকে যাবে।”
আনন্দভায়া বলল, “সেটা দেখা যাবে । দুর্গের চাবি আর কিছু খাবার-দাবার আমায় দাও ।”
সরাইখানার মালিকের কাছ থেকে সেগুলো নিয়ে আনন্দভায়া গেল সেই দুৰ্গে । সেখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে মেঝেয় সে শুয়ে পড়ল, কারণ খাট-পালঙ্ক সেখানে ছিল না । শোবার সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু বিকট একটা শব্দে মাঝরাতে ভেঙে গেল তার ঘুম । চোখ রগড়ে ভালো করে তাকিয়ে সে দেখে ন’টা ভয়ংকর চেহারার দানব হাতে হাত লাগিয়ে তাকে ঘিরে নাচছে ।
আনন্দভায়া তাদের বলল, “যত পার নাচো—কিন্তু আমার কাছে আসবে না ।”
দানবগুলো কিন্তু তার কথায় কান না,দিয়ে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল । আর একটু হলেই তাদের কুৎসিত পায়ের আঘাতে তার মুখ থেতো হয়ে যেত ।
সে বলল, “শয়তানের দল, শান্ত হও বলছি ।” কিন্তু তার কথায় তারা কান দিল না । ক্রমশ বেড়েই চলল তাদের উৎপাত ।
শেষটায় আনন্দভায়া দারুণ চটে বলল, “এবার তোমাদের শায়েস্তা করছি ” এই-না বলে একটা চেয়ার তুলে দানবদের সে পেটাতে শুরু করল। কিন্তু নটা দানবের সঙ্গে একটা মানুষ তো আর বেশিক্ষণ যুঝে উঠতে পারে না । একটাকে সে মারলে অন্যটা এসে মুঠো-মুঠো তার চুল ছিড়ে নেয়।
আনন্দভয়া তখন চেঁচিয়ে বলল, “এটা নেহাত বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে । তোমাদের মজা টের পাওয়াচ্ছি। এই মুহুর্তে সবাই আমার ঝুলির মধ্যে সেধোও।” কথাগুলো বলতে না বলতেই দানবগুলো ঝুপঝুপ করে ঢুকে পড়ল তার ঝুলির মধ্যে । আর সঙ্গে সঙ্গে ঝুলিতে কুলুপ এঁটে ঘরের এক কোণে সেটা সে ফেলল ছুড়ে ।
দানবদের দাপাদাপি শান্ত হয়ে যেতে আনন্দভায়া আবার শুয়ে পড়ল । ঘুম ভাঙল তার পরদিন সকালে ।
যে জমিদারের সেই দুর্গ, তাকে নিয়ে খানিক পরে সরাইখানার মালিক এল সে কেমন আছে দেখতে । তাকে সুস্থ সবল দেখে অবাক হয়ে তারা প্রশ্ন করল—দানবগুলো তার উপর অত্যাচার করেছে কি না।
আনন্দভায়া বলল, “তেমন কিছু নয় । তাদের আমি আমার ঝুলির মধ্যে ভরেছি । এখন তুমি নিশ্চিন্ত মনে তোমার দুর্গে থাকতে পার । কেউ আর উৎপাত করবে না।”
জমিদার তাকে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অনেক টাকাকড়ি দিয়ে প্রশ্ন করল—তার কাছে আনন্দভায়া চাকরি করতে রাজি কি না ।
সে বলল, “না, ঘুরে বেড়াতেই আমি ভালোবাসি ৷ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতেই আমি অভ্যস্ত ।”
এই-না বলে সেখান থেকে আবার সে বেরিয়ে পড়ল। যেতে যেতে সে পৌছল এক কামারশালায় । সেখানকার নেহাই-এর উপর নিজের ঝুলিটা রেখে কামার আর তার সাকরেদদের বলল সেটা হাতুড়ি দিয়ে পিটতে। বিরাট বিরাট হাতুড়ি দিয়ে দমদম সেটা পিটে চলল তারা আর সেই ন’টা দানব আর্তনাদ করতে লাগল । খানিক পরে ঝুলিটা খুলে সে দেখলে একটা ছাড়া বাকি আটটাই দানবই মরেছে । যে দানবটা মরে নি সেটা আশ্রয় নিয়েছিল বুলির একটা ভাঁজের মধ্যে । বুলি থেকে বেরিয়ে পড়ি মরি করে সেটা ছুটে পালাল নরকে ।
তার পর আনন্দভায়া পৃথিবীর দূর-দূরান্তরে ঘুরে ঘুরে বেড়াল । তার সব অ্যাডভেঞ্চারের কথা লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে । শেষটায় সে বুড়ো হয়ে পড়ল আর ভাবতে লাগল নিজের মৃত্যুর কথা । তাই সে এক জ্ঞানীগুণী সাধুর কাছে গিয়ে বলল, “ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। স্বর্গে যাবার পথটা খুঁজে বার করতে তাই আমার ইচ্ছে করছে।”
সাধু বললেন, “দুটো পথের কথা আমি জানি । একটা পথ চওড়া আর সুন্দর । সেটা গেছে নরকে । অন্যটা সরু আর খাড়া । সেটা গেছে স্বৰ্গে ।”
আনন্দভায়া বলল, “যে পথ খাড়া আর দুর্গম সে পথ ধরে যাওয়া তো মূর্থের কাজ ।” এই-না বলে প্রশস্ত আর সুন্দর পথটা ধরে সে হাঁটতে লাগল ।
যেতে যেতে সে পৌছল একটা কালো আর বিরাট ফটকের সামনে । সেটা নরকের প্রবেশপথ ৷ তাতে টোকা দিতে কে এসেছে দেখার জন্য দ্বাররক্ষী উকি মেরে তাকাল ।
আনন্দভায়াকে দেখে দ্বাররক্ষী ভয়ে কাঁপতে লাগল । কারণ সে হচ্ছে সেই নবম দানব, আনন্দভায়ার ঝুলি থেকে যে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিল । সঙ্গে সঙ্গে ফটকে হড়কো দিয়ে দানব-প্রধানের কাছে ছুটে গিয়ে সে বলল, “বাইরে ঝুলি-কাঁধে নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে । সে ভেতরে আসতে চায় । কিন্তু, দোহাই—তাকে ঢুকতে দিয়ো না । দিলে গোটা নরকটাকে সে তার ঝুলিতে ভরে ফেলবে । সেই ঝুলির মধ্যে একবার হাতুড়ির বাড়ি খেতে খেতে কোনোমতে আমি বেঁচে গেছি।”
তাই আনন্দভায়াকে বলা হল সেখান থেকে চলে যেতে । সে ভাবল, ‘এরা যদি এখানে আমাকে না চায় তা হলে স্বর্গে গিয়ে দেখি সেখানে একটা আস্তানা মেলে কি না । কারণ কোনো-একটা জায়গায় আমাকে তো বিশ্রাম নিতেই হবে ।’
সেখান থেকে ফিরে তাই সে স্বর্গের ফটকে গিয়ে টোকা দিল । সেখানে দ্বাররক্ষী ছিলেন সেন্ট পিটার । তাঁকে দেখেই চিনতে পেরে আনন্দভায়া ভাবল, “এই তো আমার সেই পুরনো বন্ধু ! নিশ্চয়ই আমাকে এ আসতে দেবে।”
কিন্তু সেণ্ট পিটার বললেন, “আমাকে কি বিশ্বাস করতে বল তুমি স্বর্গে আসতে চাও ?”
“হ্যা, বন্ধু। আমাকে আসতে দাও। নরকে আমায় ঢুকতে দেয় নি। দিলে তোমায় আর বিরক্ত করতাম না ।”
সেণ্ট পিটার মাথা নাড়িয়ে বললেন, “না, এখানে তুমি আসতে পাবে না ।”
আনন্দভায়া বলল, “বেশ কথা। আমি যদি আসতে না পারি তা হলে ফিরিয়ে নাও তোমার ঝুলি । তোমার কোনো উপহার আমি রাখতে চাই না।”
সেণ্ট পিটার বললেন, “দাও।” আনন্দভায়া ফটকের উপর দিয়ে ছুড়ে দিল তার ঝুলিটা। সেন্ট পিটার লুফে নিয়ে নিজের আরাম কেদারার উপর সেটা ঝুলিয়ে রাখলেন ।
আনন্দভায়া তখন বলে উঠল, “আমার ইচ্ছে করছে আমার ঝুলিটার মধ্যে যেতে।” আর কী আশ্চর্য—চক্ষের নিমেষে বুলিটার মধ্যে সে চলে এল । স্বর্গে প্রবেশ করতে সেণ্ট পিটার তাকে আর বাধা দিতে পারলেন না।
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।