আনন্দভায়া — জার্মানের রূপকথা — দ্বিতীয় অংশ

সে বলল, “না—আমি খাই নি ।” জল তখন উঠে এল তার মুখ পর্ষন্ত । আবার সে চেঁচিয়ে উঠল, “বন্ধু, সাহায্য করো, সাহায্য করো ।” কিন্তু সেন্ট পিটার আবার প্রশ্ন করলেন, “স্বীকার করবে কি ভেড়ার ছানার কলজেটা তুমি খেয়েছ ?”

সে বলল, “না,—আমি খাই নি ।” তাকে ডুবিয়ে মারার ইচ্ছে দয়ালু সেন্ট পিটারের ছিল না । তাই তিনি বন্যার জল সরিয়ে তাকে টেনে তুললেন ।

যেতে-যেতে তারা পৌছল এক শহরে । সেখানে শুনল রাজার মেয়ে খুব অসুস্থ ।

তাই শুনে আনন্দভায়া সেন্ট পিটারকে বলল, “বন্ধু, মস্ত একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। রাজকণ্যেকে সারাতে পারলে জীবনে আমাদের আর কোনো ভাবনা থাকবে না ।”

সেণ্ট পিটার কিন্তু তার বন্ধুর কথা কানে না তুলে চলতে লাগলেন খুব ধীরে-ধীরে । শেষটায় খবর এল. রাজকন্যে মারা গেছে ।

খবর শুনে আনন্দভায়া চেঁচিয়ে উঠল, “দেখলে তো, তোমার গেঁতোমির জন্যে কী ঘটে গেল ।”

সেণ্ট পিটার বললেন, “শান্ত হও । আমি শুধু যে রোগ সারাতে পারি তা নয়, মরা মানুষকে বাঁচাতেও পারি।”

আনন্দভায়া বলল, “তা হলে তো কোনো কথাই নেই । পুরস্কার হিসেবে অর্ধেক রাজত্ব নিশ্চয়ই আমরা পাব ।”

রাজপ্রাসাদে গিয়ে তারা দেখল শোকে-দুঃখে সবাই ভেঙে পড়েছে । তাই দেখে সেণ্ট পিটার বললেন, রাজকন্যেকে তিনি বাঁচিয়ে তুলবেন । রাজকন্যের শোবার ঘরে গিয়ে তিনি বললেন এক কেতলি জল আনতে আর ঘর থেকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে । তার সঙ্গে রইল শুধু আনন্দভায়া। তার পর তিনি কেতলিটা উনুনে চড়িয়ে রাজকন্যের সব অঙ্গগুলো কেটে ফেলে দিলেন ফুটন্ত জলে । অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে সব মাংস খসে যাবার পর সুন্দর সাদা হাড়গুলো তিনি সাজালেন একটা টেবিলে

আর তিনবার বললেন, “ঈশ্বর, একে বাঁচিয়ে তুলুন ।” আর তার কথা তৃতীয়বার শেষ হতেই সুন্দর সুস্থ শরীর নিয়ে রাজকন্যে উঠল বেঁচে ।

রাজার আনন্দ আর ধরে না । সেণ্ট পিটারকে তিনি বললেন, “কী পুরস্কার নেবে বলো । অর্ধেক রাজত্ব চাইলেও তোমাকে দেব ।”

কিন্তু সেন্ট পিটার উত্তর দিলেন, “আমি কোনো পুরস্কার চাই না ।” আনন্দভায়া ভাবল, “কী হাদা লোক রে বাবা ” তার পর সেস্ট পিটারের পাঁজরে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল, “বোকার মতো কথা বোলো না । তোমার কোনো জিনিসের দরকার না থাকতে পারে, “আমার আছে ৷”

সেণ্ট পিটার কিন্তু কিছুই নিতে রাজি হলেন না । রাজা দেখলেন “তার সঙ্গী খুব অসন্তুষ্ট হয়েছে । তাই তিনি আদেশ দিলেন কোষাগার থেকে মোহর এনে আনন্দভায়ার ঝুলিটা ভরে দিতে ।

সেখান থেকে যাত্রা করে এক বনে পৌছলে আনন্দভায়াকে সেন্ট পিটার বললেন, “এবার মোহরগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়া যাক ৷”

আনন্দভায়া বলল, “বেশ কথা ।” সেণ্ট পিটার তখন মোহরগুলো তিন ভাগ করলেন । আনন্দভায়া ভাবল, “লোকটার মতলব কী ? যেখানে দু ভাগ করার কথা সেখানে তিন ভাগ করছে কেন ?”

সেণ্ট পিটার তখন বললেন, “মোহরগুলো আমি সমান করে ভাগ করেছি। তোমার ভাগ, আমার ভাগ আর ভেড়ার ছানার কলেজে যে খেয়েছিল তার ভাগ ।”

এক গাল হেসে আনন্দভায়া বলল, “আমিই খেয়েছিলাম ভেড়ার ছানার কলজে ।” এই-না বলে মোহরের দুটো ভাগ সে নিয়ে নিল ।

সেণ্ট পিটার প্রশ্ন করলেন, “তুমি খেলে কী করে ? ভেড়ার ছানাদের তো কলজে থাকে না ।”

আনন্দভায়া বলল, “তুমি বলছ কী, দোস্ত ? ভেড়ার ছানাদের কলেজে থাকে না ? সব জন্তুরই তো কলজে থাকে ।

সেণ্ট পিটার বললেন, “বেশ কথা—তুমিই মোহরগুলো রাখো । কিন্তু আর তোমার সঙ্গে থাকছি না । চললাম।”

আনন্দভায়া উত্তর দিল, “দোস্ত, তোমার,যা মর্জি—টা-টা ।” সেন্ট পিটার চলে গেলেন অন্য পথে ।

আনন্দভায়া ভাবল, “যাকগে, ভালোই হল । কিন্তু লোকটার য়ে আশ্চর্য ক্ষমতা তাতে সন্দেহ নেই ।” হাতে তখন তার প্রচুর অর্থ । কিন্তু অত অর্থ নিয়ে কী যে করবে সে ভেবে পেল না । দু হাতে টাকাকড়ি উড়িয়ে অল্প দিনের মধ্যেই আবার সে কর্পদকশূন্য হয়ে পড়ল ।

সেই অবস্থায় একটা শহরে পৌছে সে শুনল—সেখানকার রাজার মেয়ের মরণ-দশা । খবরটা শুনে সে ভাবল, “আমার কপাল খুব ভালো—রাজকন্যেকে বাঁচিয়ে অনেক ধনদৌলত পাওয়া যাবে।” তাই রাজার কাছে গিয়ে জানাল মৃত রাজকন্যেকে সে বাঁচিয়ে দেবে ।

কানাঘুষোয় রাজা শুনেছিলেন—এক বরখাস্ত-হওয়া সৈনিক মরা মানুষ বাঁচাতে পারে। তিনি ভাবলেন, আনন্দভায়াই সেই সৈনিক । কিন্তু তার অলৌকিক ক্ষমতার কথা তিনি বিশ্বাস করেন নি । তাই রাজকন্যেকে বাঁচাবার ভার তাকে দেবার আগে মন্ত্রীদের পরামর্শ তিনি চাইলেন ।

মন্ত্রীরা রাজাকে পরামর্শ দিল—রাজকন্যে যখন মারাই গেছে তখন এ-লোকটাকে বাঁচাবার চেস্টা করতে দিতে কোনো ক্ষতি নেই । তাই রাজকন্যেকে বাঁচাবার চেস্টা করার অনুমতি আনন্দভায়াকে দেওয়া হল । সেণ্ট পিটারের মতোই আনন্দভান্না বলল রাজকন্যের শোবার ঘরে এক কেতলি জল দিতে । তার পর ঘর থেকে সবাইকে বার করে রাজকন্যের অঙ্গপ্রতঙ্গ কেটে কেতলিতে ভরে সেটা চড়াল সে উনুনে । জল ফুটতে শুরু করল, মাংস আলাদা হয়ে গেল । তার পর হাড়গুলো সে রাখল একটা টেবিলে । কিন্তু কী ভাবে হাড়গুলো রাখতে হয় সে জানত না । সেগুলো সে সাজাল একেবারে ভুল করে । তার পর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সেন্ট পিটারের মতোই তিনবার সে বলল, “ঈশ্বর, একে বাঁচিয়ে তুলুন।” কিন্তু হাড়গুলো যেমন পড়েছিল তেমনি পড়ে রইল—নড়ল-চড়ল না। আবার কথাগুলো সে আওড়াল, কিন্তু কোনোই ফল হল না । তখন অধৈর্ষ হয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, “উঠে পড়ো রাজকন্যে, নইলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”

তার মুখ থেকে কথাগুলো খসতে-না-থসতেই সেই সৈনিকের ছদ্মবেশে জানলা দিয়ে সেণ্ট পিটার এসে তাকে বললেন, “মূর্খ কোথাকার । করেছ কী ? হাড়গুলো য়ে ভুল করে সাজিয়েছ । এতে মরা মানুষ কখনো বাঁচে ?

আনন্দভায়া বলল, “দোস্তু, সঠিকভাবে সাজাবার সবরকম চেস্টাই তো করেছিলাম ।”

সেন্ট পিটার বললেন, “এবার তোমায় বিপদ থেকে বাঁচাচ্ছি । কিন্তু আবার এ ধরনের কাজ করলে তুমি বিপদে পড়বে । আর একথাটাও মনে রেখো—রাজকণ্যেকে আমি বঁচিয়ে তুললে রাজার কাছ থেকে এক পয়সাও পুরস্কার নিতে পারবে না।” এই-না বলে হাড়গুলো সঠিকভাবে সাজিয়ে ঈশ্বরের কাছে তিনবার তিনি প্রার্থনা জানালেন আর সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ সবল শরীরে রাজকন্যে বেঁচে উঠল ।

যে পথে সেন্ট পিটার এসেছিলেন সে পথেই তিনি অদৃশ্য হলেন আর বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে আনন্দভায়া হাফ ছেড়ে বাঁচল । কিন্ত রাজার কাছ থেকে এক পয়সাও না নেবার কথাটা তার মনে ধরল না । সে ভাবল, ‘হাদা লোকটার কথাগুলোর কোনো মানেই হয় না । কাজ করে পারিশ্রমিক কে না নেয় ?” তাই রাজার কাছ থেকে তার ঝুলি ভরে মোহর সে নিল ।

রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সে দেখে সিংহদ্বারের কাছে সেন্ট পিটার তার জন্য অপেক্ষা করছেন ।

তিনি বললেন, “তোমাকে এক পয়সাও না নিতে বলেছিলাম । কিন্তু ঝুলি ভরে তুমি মোহর নিয়েছ দেখছি।”

আনন্দভায়া বলল, “ওরা জোর করে আমার ঝুলিতে মোহর ভরে দিলে কী করতে পারি, বলো ?”

সেণ্ট পিটার বললেন, “তোমাকে দ্বিতীয়বার সাবধান করে দিচ্ছি— আর কখনো কোনো অলৌকিক কাজ করতে যেয়ো না ।”

সে বলল, “তা নিয়ে তোমায় মাথাব্যথা করতে হবে না । আমার এখন ঝুলি-ভরা মোহর-কোন দুঃখে হাড়গোড় ধোয়াধুয়ি করতে যাব ?” সেণ্ট পিটার বললেন, “কিন্তু ঐ মোহরগুলো তো একদিন-না একদিন খরচ হয়েই যাবে। যাতে তুমি আর নিষিদ্ধ কাজ না কর তাই বর দিলাম—যখন যা চাইবে সেই জিনিসে ভরে উঠবে তোমার ৰুলি।”

আনন্দভায়া বেজায় খুশি হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ?” তার পর মনে-মনে বলল, “আমি এখন সম্পূর্ণ তৃপ্ত। আমি এখন বড়োলোক। তোমার সঙ্গের আর দরকার নেই।”

তার কাছে তখন রাশিরাশি মোহর । তাই সে সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেল তার ঝুলির আশ্চর্য ক্ষমতার কথা ।

আর আগের মতোই সে অল্পদিনের মধ্যে দু হাতে উড়িয়ে দিল মোহরগুলো.। তার যখন মাত্র চারটে পয়সা সম্বল তখন একদিন এক সরাইখানায় পৌছে সে ভাবল, “টাকা-পয়সা চিরকাল থাকে না । খরচ করার জন্যেই তো টাকা-পয়সা ।” তাই সে এক পয়সার রুটি আর তিন পয়সার বিয়ার কিনে খেতে শুরু করে দিল । খেতে-খেতে তার নাকে এল হাঁসের মাংস ঝলসানোর গন্ধ । আনন্দভায়া সেই গন্ধ শুকতে-শুকতে এদিক-ওদিক উকিঝকি মেরে অল্প সময়ের মধ্যেই আবিষ্কার করল সরাইখানার মালিক উনুনে নধর দুটো হাঁস ঝলসাতে দিয়েছে । তখন তার মনে পড়ল তার বন্ধু বলেছিল, যা চাইবে সেটা দিয়ে ভরে যাবে তার ঝুলি। সে কথা সত্যি কিনা পরখ করে দেখার জন্য সরাইখানার বাইরে বেরিয়ে সে বলে উঠল, “আমি চাই উনুনের ঐ দুটো ঝলসানো হাঁস যেন আমার ঝুলির মধ্যে চলে আসে ।” সঙ্গেসঙ্গে খুট করে একটা শব্দ হল আর ঝুলি খুলে সে দেখল ঝলসানো হাঁস দুটো সেখানে চলে এসেছে । তাই-না দেখে সে ভাবল, “যাক । আমাকে আর কোনো কিছুর জন্যে দুর্ভাবনা করতে হবে না ।”

খানিক এগিয়ে এক জায়গায় বসে মনের আনন্দে সে খেতে শুরু করে দিল ঝলসানো সেই হাঁস দুটো । সে যখন একটা হাঁস খাচ্ছে তখন সেখানে হাজির হল দুটি ছাত্র । বাকি হাসটার দিকে তারা চাইতে লাগল লোলুপ দৃষ্টিতে । আনন্দভায়া ভাবল, একজনের পক্ষে একটা হাঁসই যথেস্ট । তাই ছাত্র দুজনকে ডেকে বাকি হাঁসটা তাদের সে দিয়ে দিল ।

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছাত্ররা সেই সরাইখানায় গিয়ে বিয়ার আর রুটির অর্ডার দিয়ে বার করল সেই হাসটা ।

সরাইখানার মালিকের বউ তাদের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার স্বামীকে গিয়ে বলল, “ছেলে দুটোর কাছে একটা ঝলসানো হাঁস রয়েছে । আমরা যে-দুটো হাঁস উনুনে ঝলসাতে দিয়েছিলাম, দেখ তো, সেটা তাদের একটা কিনা৷”

সরাইখানার মালিক ছুটে গিয়ে দেখে উনুনটা খালি। তাই-না দেখে রাগে গরগর করতে করতে ছাত্রদের কাছে এসে সে বলল, “হতভাগা, নচ্ছার, চোর। ভেবেছ কি—বিনা পয়সায় হাঁস পাবে ? এক্ষুনি দাম চুকিয়ে দাও, নয়তো মজা দেখাচ্ছি।”

ছাত্ররা বলল, “আমরা চোর নই ৷ ঐ ওখানকার মাঠে এক সৈনিক হাঁসটা আমাদের দিয়েছে।”

ভীষণ রেগে সরাইখানার মালিক বলল, “বাজে কথা বলে পার পাবে না । সেই সৈনিক এখানে এসেছিল । সৎ লোকের মতোই খালি হাতে তাকে চলে যেতে স্বচক্ষে দেখেছি । তোমরা চোর, দাম তোমাদের দিতেই হবে ।” কিন্তু হাঁসটার দাম দেবার পয়সাকড়ি তাদের ছিল না । তাই সরাইখানার মালিক একটা লাঠি দিয়ে তাদের আচ্ছা করে উত্তম-মধ্যম দিয়ে সেখান থেকে দূর করে দিল ।

এদিকে আনন্দভায়া হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় পৌছল । সেখানে ছিল চমৎকার এক দুর্গ আর ছন্নছাড়া চেহারার এক সরাইখানা । সরাইখানায় গিয়ে সে শুনল সেখানে আর জায়গা নেই।

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!