একবার এক দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অনেক সৈন্যকে বরখাস্ত করা হয় । তাদের মধ্যে একজনকে লোকে ডাকত আনন্দভায়া বলে । তাকে সামান্য রুটি আর গোটা চারেক পয়সা দিয়ে বিদেয় করা হয় । এই পুঁজি নিয়ে সে পড়ল বেরিয়ে ।
পথের পাশে সেন্ট পিটার বসেছিলেন ভিখিরির ছদ্মবেশে । আনন্দভায়া তার পাশ দিয়ে যাবার সময় তিনি ভিক্ষে চাইলেন ।
সে বলল, “ভিখিরিভাই, কী তোমায় দিই ? এক সময় আমি সৈনিক ছিলাম । এখন চাকরি গেছে । আমার এখন সম্বল এই সামান্য রুটি আর গোটা চারেক পয়সা । সে যাই হোক, এর থেকেই তোমায় কিছুটা দিচ্ছি। কিন্তু এগুলো শেষ হলে তোমার মতো আমাকেও ভিক্ষা করতে হবে।” এই বলে সেই সাধুকে রুটির খানিকটা টুকরো আর একটা পয়সা সে দিল।
সেণ্ট পিটার তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খানিক দুরে গিয়ে আর-এক ভিখিরির ছদ্মবেশ ধরে আনন্দভায়ার কাছে আবার ভিক্ষে চাইলেন । আনন্দভায়া আগের মতোই কথা বলে তাকে দিল খানিকটা রুটি আর একটা পয়সা ।
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু দূরে গিয়ে ভিখিরির ছদ্মবেশ ধরে পথের ধারে বসে সেন্ট পিটার তৃতীয়বার তার কাছে ভিক্ষে চাইলেন ।
আনন্দভায়া আবার তাকে দিল খানিকটা রুটি আর একটা পয়সা । সেন্ট পিটার তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন ।
তখন সম্বলমাত্র এক টুকরো রুটি আর একটা পয়সা । একটা সরাইখানায় গিয়ে রুটির টুকরোটা সে খেল আর বাকি পয়সাটা দিয়ে কিনল বিয়ার ।
খাওয়া-দাওয়া সেরে হাঁটতে-হাঁটতে তার সঙ্গে আবার দেখা হল সেস্ট পিটারের l তখন তিনি ছদ্মবেশ ধরেছিলেন এক বরখাস্ত-হওয়া সৈনিকের । আনন্দভায়াকে তিনি বললেন, “শুভদিন কমরেড । আমাকে এক টুকরো রুটি আর বিয়ার কেনার জন্যে একটা পয়সা দিতে পার ?”
আনন্দভায়া বলল, “অসম্ভব । আমাকেও বরখাস্ত করে দেওয়া হয়েছিল সামান্য রুটি আর গোটা চারেক পয়সা । পথে আসতে আসতে আমার সঙ্গে তিন ভিখিরির দেখা । তাদের প্রত্যেককে আমি একটা করে পয়সা আর রুটির তিন ভাগ দিয়েছি । এক সরাইখানায় রুটির শেষ টুকরোটা খেয়ে বাকি পয়সাটা দিয়ে কিনেছিলাম এক গেলাস বিয়ার । এখন সম্বল বলতে আমার কিছুই নেই। আমার মতোই ষদি তোমার অবস্থা হয় তা হলে আমার সঙ্গে এসো । একসঙ্গে ভিক্ষে
করা যাবে ।”
সেণ্ট পিটার বললেন, “ভিক্ষে করার দরকার নেই । লোকের রোগ সারাবার কিছু-কিছু ওষুধ-বিষুধ আমার জানা আছে । মানুষের রোগ সারিয়ে যা কামাই তাইতেই মোটামুটি আমার চলে যায়।”
আনন্দভায়া বলল, “তাই নাকি ? কিন্তু আমি তো ও বিষয়ে কিছুই জানি না । আমাকে তাই একাই ভিক্ষেয় বেরুতে হবে।”
সেণ্ট পিটার বললেন, “তাতে কিছু যায় আসে না । আমার সঙ্গে চলো । যা রোজগার করব তার অর্ধেকটা হবে তোমার।”
আনন্দভায়া বলল, “বাঃ, এ তো আমার পক্ষে তোফা ব্যবস্থা! চলো, এগুনো যাক ৷”
যেতে-যেতে তারা পৌছল এক চাষীর বাড়িতে । সেখান থেকে ভেসে আসছিল মড়া-কান্না । বাড়ির ভিতরে গিয়ে তারা দেখে একটা লোক মরতে বসেছে আর তার বউ স্বামীকে বাঁচাবার কোনো উপায় না দেখে আমুরি-কুমুরি হয়ে কাঁদছে ।
সেন্ট পিটার বললেন, “কান্না থামাও । তোমার স্বামীকে আমি সুস্থ করে দিচ্ছি ।” এই-না বলে পকেট থেকে এক শিশি মলম বার করে সেটা দিয়ে চক্ষের নিমেষে রোগীকে তিনি সারিয়ে দিলেন । সুস্থ হয়ে বিছানায় উঠে বসল রোগী ।
স্বামী-স্ত্রী খুব খুশি হয়ে বলল, “কী করে এর প্রতিদান আপনাকে আমরা দিই ? বলুন, কী আপনাকে দেব ।”
সেণ্ট পিটার যত বলেন কিছু দেবার দরকার নেই তত তারা কিছু নেবার জন্য তাকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে।
আনন্দভায়া কিন্তু তাকে কনুই দিয়ে আস্তে আস্তে গুঁতো মেরে বলল, “কিছু নাও । আমাদের যে দরকার ”
শেষটায় চাষীর বউ ভেড়ার একটা ছানা এনে সেণ্ট পিটারকে বলল, সেটা নিতেই হবে। সেণ্ট পিটার কিন্তু কিছুতেই নিতে চাইলেন না ।
আনন্দভায়া আবার কনুই দিয়ে আস্তে গুঁতো মেরে ফিসফিস্ করে বলল, “আচ্ছা বোকা তো ! এটা নেবে বৈকি ! আমি বলছি এটা আমাদের খুব কাজে লাগবে ।” g
সেণ্ট পিটার তখন বললেন, “বেশ, ভেড়ার ছানাটা নিলাম। কিন্তু এটা আমার দরকার নেই। তাই তোমাকে এটা বয়ে নিয়ে যেতে হবে ।”
আনন্দভায়া বলল, “তাতে আমার আপত্তি নেই । ভেড়ার একটা ছানা বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব একটা শক্ত কাজ নয় ।” এই-না বলে সেটাকে সে কাঁধে তুলে নিল ।
একসঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে তারা পৌছল এক বনে ৷ আনন্দভায়ার কাঁধে তখন ভেড়ার ছানার চাপ খুব বেড়ে উঠেছে । তা ছাড়া ক্ষিদেও পেয়েছে তার খুব । তাই সেণ্ট পিটারকে সে বলল, “শোনো, এখানে বিশ্রাম নেওয়া যাক । ভেড়ার ছানাটাকে রেঁধে এবার খাওয়া-দাওয়া সারি ।”
সেণ্ট পিটার বললেন, “আমার কোনো আপত্তি নেই । কিন্তু রান্নাবান্নার ঝামেলার মধ্যে যেতে পারব না । তুমি রাঁধতে জানলে— এই নাও সসপ্যান । যতক্ষণ-না রান্নাবান্না শেষ হয় ততক্ষণ খানিক ঘুরে আসি । কিন্তু একটা কথা—আমি ফেরার আগে রান্নাবান্না শেষ হয়ে গেলে আমাকে বাদ দিয়ে খবরদার একলা খেতে বসবে না ।”
আনন্দভায়া বলল, “তুমি বেড়াতে যাও। রাঁধতে আমি খুব ভালোই পারি।”
সেণ্ট পিটার বেড়াতে চলে গেলেন আর আনন্দভায়া আগুন জালিয়ে ভেঁড়ার ছানাটাকে কেটেকুটে সসপ্যানে করে রাঁধল।
রান্নাবান্না শেষ হল । কিন্তু সেন্ট পিটারের দেখা নেই । তাই আনন্দভায়া আগুন থেকে সসপ্যান নামিয়ে ভেড়ার ছানার কলজেটা বার করে খেয়ে ফেলল ।
খানিক পরে সেণ্ট পিটার ফিরে এসে বললেন, “ভেড়ার ছানার সবটাই তুমি খাও । আমাকে দাও শুধু কলজেটা । সেটা থেয়েই আমি তৃপ্ত হব ।”
আনন্দ ভায়া ছুরি-কাটা নিয়ে ভেড়ার ছানার কলজেটা খোঁজার ভান
করতে লাগল ।
কয়েক মিনিট পরে সে বলল, “কলজে তো দেখছি না ।” সেণ্ট পিটার বললেন, “আশ্চর্য ব্যাপার তো ! কলজেটা যাবে
কোথায় ?”
আনন্দভায়া বলল, “তা তো জানি না ।” খানিক থেমে সে যোগ করে দিল, “আরে—আমরা দুজনেই ভারি বোকা । আমরা কলজে খুঁজছি—কিন্তু ভেড়ার ছানাদের যে কলজেই থাকে না ।”
সেন্ট পিটার বললেন, “তাই নাকি ? সে কথা তো জানতাম না । সব জন্তুরই তো কলজে থাকে । ভেড়ার ছানার কলজে থাকবে না কেন ?”
আনন্দভায়া বলল, “বিশ্বাস করো বন্ধু—ভেড়ার ছানার কলজে থাকে না ।”
সেণ্ট পিটার বললেন, “কলজে না থাকলে ভেড়ার ছানার মাংস আমি খাব না। তুমিই সবটা খাও।”
আনন্দভায়া বলল, “যে-মাংসটা খেতে পারব না সেটা আমার ঝোলায় রাখব। পরে খাওয়া যাবে।” এই-না বলে অর্ধেকটা মাংস সে খেল আর বাকি অর্ধেকটা তার ঝোলায় ভরে আবার যাত্রা করল।
তার পর সেণ্ট পিটার তাদের পথের সামনে ভয়ংকর বন্যার জল এনে সঙ্গীকে বললেন, “তুমি আগে যাও ।”
আনন্দভায়া বলল, “না-না, তুমিই যাও আগে ।” সে ভাবল, জল খুব গভীর হলে যেখানে আছি সেখানেই থাকব ।
সেণ্ট পিটার তাই জল ভেঙে প্রথম গেলেন । তার হাঁটু পর্যন্ত জল উঠল । কিন্তু আনন্দভায়া যখন পেরুতে গেল জল উঠে এল তার গলা পর্যন্ত । তাই সে চেঁচিয়ে উঠল, “বন্ধু, সাহায্য করো, সাহায্য করাঁ – উত্তরে কিন্তু সেন্ট পিটার বললেন :
“স্বীকার করবে কি ভেড়ার ছানার কলজেটা তুমি থেয়েছ ?”
গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।