আদ জাতির নবী হুদ (আঃ) – নূহ (আঃ) এর পরে

আমরা আগেই জেনেছি, নূহ (আঃ) এর সময় আল্লাহ্‌ তাঁর দ্বীনের শত্রুদের প্লাবন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কেবল হযরত নুহ (আঃ) আর তাঁর ঈমানদার সাথিদের। এই বেঁচে থাকা মুমিনরা আর তাদের বংশধরেরা অনেকদিন আল্লাহর বিধান আর নবীর আদর্শ মাফিক জীবন যাপন করেন।

কিন্তু দীর্ঘদিন পর লোকেরা আবার ভুল পথে চলতে শুরু করে। তাঁরা নবীর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। এক আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। এমনি করে তাঁরা ডুবে পড়লো শিরক আর মূর্খতার অন্ধকারে।

 

আদ জাতি

সেকালে আরবের সবচে’ শক্তিশালী জাতি ছিলো আ’দ জাতি। ইয়েমেন, হাজরামাউত ও আহকাফ অঞ্চল নিয়ে এরা এক বিরাট রাজ্য গড়ে তুলেছিলো। তাদের ছিলো অগাধ দৈহিক শক্তি আর ছিলো বিরাট রাজশক্তি। তাঁরা গড়ে তুলেছিলো বড় বড় শহর, বিরাট বিরাট গম্বুজধারী অট্টালিকা আর বিলাস সামগ্রী। নূহ (আঃ) এর পর আল্লাহ্‌ তায়ালা আ’দ জাতিকে ক্ষমতা প্রদান করেন। তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানান। নিজের অপার অনুগ্রহে তাদের চরম উন্নতি দান করেন। ফলে গোটা আরবের উপর চলতে থাকে তাদের দাপট। কিন্তু এ উন্নতির ফলে তাঁরা গর্ব ও অহংকারে নিমজ্জিত হয়। নূহ (আঃ) এর দেখানো পথ থেকে তাঁরা দূরে সরে যায়। মহান আল্লাহকে ভুলে গিয়ে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। নূহ (আঃ) এর তুফানের পর তারাই সর্বপ্রথম মূর্তি পূজা শুরু করে। তাদের জাতীয় নেতাগন ছিলও যালিম, স্বৈরাচারী। জনগনকে তাঁরা নিজেদের হুকুমের দাস বানিয়ে নিয়েছিলো। তাঁরা এতই অহংকারী হয়ে উঠেছিলো যে, কাউকেই পরোয়া করতো না। তাঁরা ঘোষনা করলো, “আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে?” (সূরা ৪১ হামিম আস সিজদাঃ আয়াত ১৫)

অথচ তাঁরা ভুলে গেলো যে, আলাহই সর্বশক্তিমান। আল্লাহই তাদের এতো উন্নতি দান করেছেন।

 

মুক্তির বার্তা নিয়ে এলেন হুদ

আদ জাতীকে সুপথ দেখাবার জন্যে আল্লাহ্‌ তাদের মাঝে একজন নবী পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেন। এ জাতির সবচে’ ভালো লোক হুদকে আল্লাহ্‌ তাদের নবী মনোনীত করেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ “আমি আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হুদকে রাসুল বানিয়ে পাঠালাম। হুদ আমার বানী পেয়ে তাঁর জাতির লোকদের ডেকে বললোঃ

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কি তোমাদের পাপ কাজের অশুভ পরিনতির ভয় করো না?” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৫)

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) তাদের বুঝালেন-

“ভাইয়েরা আমার, তোমরা তোমাদের দয়াময় প্রভূর কাছে ক্ষমা চাও। তাঁর দিকে ফিরে এসো। তাহলে তিনি তোমাদের বৃষ্টি বর্ষীয়ে পানি দেবেন। তোমাদের বর্তমান শক্তিকে আরো শক্তিশালী করবেন। দেখো। তোমরা অপরাধীদের মতো তাঁকে উপেক্ষা করো না।” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫২)

দরদভরা হৃদয় নিয়ে হজরত হুদ তাদের আর বললেনঃ

“তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? দেখো, আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমি যে তোমাদের বুঝাবার এতো চেষ্টা করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাইনা। এতে কি তোমরা বুঝতে পারছো না, এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই? আমিতো কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই। আমাকে প্রতিদান দেবেন তো আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন।” (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১২৪-১২৭)

হুদ (আঃ) তাঁদের আরো বুঝালেনঃ

“তোমাদের এ কি হলো? প্রতিটি স্থানেই কেন তোমরা অর্থহীন স্মারক ইমারত (ভাস্কর্য) বানাচ্ছো? কেনই বা এতো অট্টালিকা গড়ে তুলছো? এগুলো কি তোমাদের চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে ভাবছো? তোমরা যখন কাউকেও পাকড়াও করো, তখন কেন নির্বিচারে অত্যাচারীর ভূমিকা পালন করো? এবার এসো আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। সেই মহান প্রভূকে ভয় করো যিনি তোমাদের সবকিছুই দিয়েছেন। তোমরাতো জানোই তিনি তোমাদের দিয়েছেন অগনিত পশু, অসংখ্য সন্তান-সন্তুতি। দিয়েছেন কতোনা বাগ-বাগিচা, নদ-নদী, ঝর্ণাধারা। তোমাদের ব্যাপারে এক গুরতর দিনের শাস্তির আশংকা আমি করছি।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১২৮-১৩৫)

এভাবে হুদ (আঃ) তাঁর জাতির লোকদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন। তাঁদের তিনি মহান প্রভূ আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বস্তুগত উন্নতির আল্লাহকে ভুলে থাকতে নিষেধ করেন। পরকালের খারাপ পরিনতির কথা তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁদের ক্ষমা চাইতে বলেন। আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে বলেন। আল্লাহর হুকুম পালন করতে এবং নবীর পথে চলতে বলেন। তিনি তাঁদের বলেনঃ এটাই পার্থিব কল্যাণ আর পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ।

 

নেতারা নবীর প্রতিপক্ষ হলো

এতো আন্তরিক আহবান আর কল্যাণময় উপদেশ সত্ত্বেও আদ জাতি নবীর কথা শুনলো না। আল্লাহর পথে এলো না। দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে পারলো না। উল্টো তাঁরা নবীর সাথে বিতর্ক শুরু করলো। তাঁদের শাসকরা নবীকে বললোঃ

“আমরা মনে করি তুমি বোকা। তোমার কোন বুদ্ধি নেই। তাছাড়া আমাদের ধারনা, তুমি এসব মিথ্যা কথা বলছো।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৬)

তাঁরা আল্লাহর রাসুলকে আরো বললোঃ

“তোমার উপদেশ আমরা মানিনা। তোমার এসব উপদেশ সেকেলে লোকদের অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে আমাদের উপর কোন শাস্তিই আসবে না।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১৩৬-১৩৮)

তাঁদের প্রতিবাদের জবাবে আল্লাহর নবী বললেনঃ

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি কোন বোকা নির্বোধ ব্যাক্তি নই। বরং আমি বিশ্ব জগতের মালিক মহান আল্লাহর রাসুল। আমিতো কেবল তোমাদের কাছে মহান আমার আল্লাহর বার্তাই পৌছে দিচ্ছি। আর আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত কল্যাণকামী। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৭-৬৮)

হজরত হুদ তাঁদের আর বললেনঃ

“তোমাদের সতর্ক করার জন্যে তোমাদের জাতিরই এক ব্যাক্তির কাছে তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে ‘উপদেশ বার্তা’ এসেছে বলে কি তোমরা বিস্মিত হচ্ছো? স্মরণ করো নূহের জাতির পর আল্লাহ্‌ তো তোমাদেরকেই পৃথিবীর প্রতিনিধি বানিয়েছেন। তোমাদের জনবল ও দেহবলের অধিকারী করেছেন। সুতরাং আল্লাহর দানশীলতাকে স্মরণ রেখো। আশা করা যায়, তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৯)

পার্থিব কায়েমি স্বার্থ আর শয়তানের ধোঁকা আদ জাতির নেতাদের প্রতারিত করলো। তাঁরা আল্লাহর নবীকে বললোঃ

“হে হুদ, তুমি কি এ জন্যে নবী হয়ে এসেছো যে, আমরা কেবল এক খোদার ইবাদাত করবো আর আমাদের বাপদাদারা যে সব মা’বুদের (দেব দেবীর) পূজা করতো, তাঁদের ত্যাগ করবো? তুমি তো আমাদের কাছে কোন দলিল প্রমান নিয়ে আসো নি। আমরা কখনো তোমার কোথায় আমাদের খোদাগুলোকে ত্যাগ করবোনা। আমরা বলছি, আমাদের খোদাদের কোন একটির গজব তোমার উপর আপতিত হয়েছে।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭০, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৩-৫৪)

এবার আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) তাঁদের বললেনঃ

“তোমাদের উপর তোমাদের মালিক আল্লাহর অভিশাপ আর গজব এসে পড়েছে। তোমরা কি আমার সাথে সেই সব মনগড়া খোদাদের ব্যাপারে বিতর্ক করছো, যেগুলোর নাম তৈরি করেছো তোমরা নিজেরা আর তোমাদের বাপ দাদারা? অথচ সেগুলোর পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রমান নেই। তোমরা যদি আমার কথা না শোনো, তবে অপেক্ষা করতে থাকো। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭১)

হজরত হুদ (আঃ) এর দীর্ঘ দাওয়াতের ফলে জনগনের মধ্যে একটা নাড়া পড়েছিল। তাঁরা শিরক করছিলো ঠিকই কিন্তু আল্লাহকে তাঁরা জানতো। আর হুদ (আঃ) যেহেতু তাঁদের আল্লাহর দিকেই ডাকছিলেন, সুতরাং তাঁর দাওয়াতের একটা বিরাট প্রভাব জনগনের উপর পড়ছিল। তাই জনগণ হজরত হুদের প্রতি ঈমান এনে ফেলতে পারে এই ভয়ে ক্ষমতাসীন শাসক ও নেতারা ময়দানে নেমে এলো। জনসভা করে তাঁরা হজরত হুদ (আঃ) এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করতে লাগলো। তাঁরা জনগণকে বললোঃ

“এ ব্যাক্তি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। তোমরা যা খাও, সেও তাই খায়। তোমরা যা পান করো, সেও তাই পান করে। কেমন করে সে নবী হতে পারে? তবে তাঁর কথা মেনে নিলে তোমাদের দারুন ক্ষতি হবে। হুদ যে তোমাদের বলছে, তোমরা যখন মরে গিয়ে মাটির সাথে হাড়-গোড়ে পরিণত হবে, তখন তোমাদের আবার কবর থেকে বের করে আনা হবে। তাঁর এই অঙ্গীকার অসম্ভব। আমাদের এই পৃথিবীর জীবনটাই তো একমাত্র জীবন। আমাদের মরন বাচন সব এখানেই শেষ। আসলে আমাদের আর কখনো উঠানো হবে না। আল্লাহর নাম নিয়ে হুদ মূলতঃ মিথ্যে বলছে। আমরা তাঁর কথা মানি না। ”(সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৩-৩৮)

 

কিছু লোক ঈমান আনলো

বিবেকবান লোকদের মনে সত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলেও যালিম অত্যাচারী শাসকদের ভয়ে তাঁরা সত্য গ্রহন করতে এগিয়ে আসেনি। কেবল কিছু সংখ্যক সাহসী যুবক যুবতীই আল্লাহর পথে এগিয়ে এলো। তাঁরা নবীর সাথি হলো। জীবন বাজী রেখে তাঁরা আল্লাহর পথে কাজ করতে থাকলো। এখন জাতি সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক পক্ষে রয়েছেন আল্লাহর নবী আর তাঁর সাথী একদল যুবক যুবতী। গোটা জাতির তুলনায় এদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। প্রতিপক্ষে ছিল শাসক গোষ্ঠী আর ঐ সব লোক, বাতিল সমাজের সাথে জড়িয়ে ছিলো যাদের স্বার্থ। নবীর নেতৃত্বে এ সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গঠিত হলে এদের স্বার্থ নষ্ট হবে বলে এরা সবাই নবী ও নবীর সাথীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো।

 

সময় ঘনিয়ে এলো

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) অবশেষে তাঁদের চরম বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মোকাবেলায় বলে দিলেনঃ “আমি তোমাদের সামনে সাক্ষী হিসেবে স্বয়ং আল্লাহকেই পেশ করছি। আর তোমরা সাক্ষী থাকো, আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় তোমরা যাদের অংশীদার বানাচ্ছো আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে যা করার করো। আমার ভরসা তো মহান আল্লাহর উপর। তিনি আমারো মালিক, তোমাদেরও মালিক। সমস্ত জীবের ভাগ্য নিয়ন্তা তো তিনিই। তিনি যা করেন, তাই সঠিক। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৪-৫৬)

হজরত হুদ তাঁদের আর বলে দিলেনঃ

“তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও, নাও। কিন্তু জেনে রেখো, আল্লাহ্‌ আমাকে যে বার্তা নিয়ে পাঠিয়েছেন তা আমি তোমাদের কাছে পুরোপুরি পৌছে দিয়েছি। এখন আমার প্রভূ তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে বসাবেন এবং তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৭)

অতঃপর সবধরনের চেষ্টা শেষ করার পর হজরত হুদ (আঃ) যখন দেখলেন এদের সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নাই, তখন মনে বড় কষ্ট নিয়ে তিনি দোয়া করলেনঃ

“আমার প্রভূ, এরা তো মিথ্যা বলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন তুমিই আমাকে সাহায্য করো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৯)

জবাব এলোঃ

“ অচিরেই এরা নিজেদের কৃতকর্মের (নিষ্ফল) অনুশোচনা করবে। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪০)

 

ধ্বংস হলো আ’দ জাতি

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সংকেত পেলেন যে, তিনি এখন এ জাতিকে ধ্বংস করে দেবেন। বড় মনোবেদনার সাথে তিনি তাঁদের জানিয়ে দিলেনঃ “আল্লাহর রোষ এবং আযাব তোমাদের জন্যে অবধারিত হয়ে পড়েছে। ” জাতির শাসকরা অহংকার করে বললো, “আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে? ” তাঁরা হজরত হুদকে আরো বললো- “তুমি যে আমাদের শাস্তি দেয়ার অংগীকার করছো, তুমি সত্যবাদী হলে সেই শাস্তি দিয়ে দেখাও। ”

অবশেষে তাঁদের উপর আল্লাহর আযাব এসে পড়লো। উপত্যকার দিক থেকে আযাব তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছিলো। তাঁরা বললো- এতো মেঘ, অনেক বৃষ্টি হবে। হুদ বললেনঃ

“এই সেই অংগীকার, যার জন্যে তোমরা তাড়াহুড়ো করছিলে। এটা প্রচণ্ড ঝড়। এতে রয়েছে চরম যন্ত্রনাদায়ক আযাব। এটা প্রতিটা বস্তুকে ধ্বংস করে রেখে যাবে। ” (সূরা ৪৬ আহকাফঃ আয়াত ২৪)

অল্প পরেই ধেয়ে এলো মেঘ। ধ্বংস করে দিয়ে গেলো সব কিছু। ধ্বংস হয়ে গেলো আল্লাহদ্রোহী শক্তি। আল কুরআনে তাঁদের ধংশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

“আর আ’দ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ঠাণ্ডা ঝড় বায়ু দিয়ে। সে বায়ু তিনি তাঁদের উপর দিয়ে চালিয়ে দেন একাধারে সাত রাত আট দিন। অতঃপর সেখানে তাঁরা চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকলো যেন উপড়ানো খেজুর গাছের কাণ্ড। কোন পাপীই তা থেকে রক্ষা পায়নি। ” (সূরা ৬৯ আল হাক্কাহঃ আয়াত ৬-৮)

“এক বিকট ধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। আর আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম খড় কুটোর মতো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪১)

এভাবে ধ্বংস হয়ে গেলো তৎকালীন বিশ্বের মহা শক্তিশালী আ’দ জাতি। আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন, ধ্বংস করে দিলেন তাঁদের দেশ ও সুরম্য শহর। ধূলিস্যাত হয়ে গেলো তাঁদের অহংকার। বিরান হয়ে গেলো তাঁদের জনবসতি। তাঁদের শহর ‘আহকাফ’ এখন এক বিরাট মরুভূমি। এখনো সেই ভূতুরে মরুভূমি অতিক্রম করতে লোকেরা ভয় পায়। শোনা যায়, সেই মরুভূমিতে যা কিছু পড়ে সবই তলিয়ে যায়।

প্রাচীনকালে এতই নাম করা ছিলও যে, এখনো লোকেরা তাঁদের নাম অনুযায়ী যে কোন প্রাচীন জাতিকে ‘আদি জাতি’, ‘আদি বাসী’ বলে থাকে। প্রাচীন ভাষাকে ‘আদি ভাষা’ বলে থাকে। এতো প্রতাপশালী একটি জাতিকেও মহান আল্লাহ্‌ ধ্বংস করে দিলেন তাঁর আয়াতকে অস্বীকার করা ও তাঁর নবীকে অমান্য করার ফলে। তাঁদের ধ্বংসের ইতিহাসের মধ্যে পৃথিবীর সকল জাতির জন্যেই রয়েছে উপদেশ।

হজরত হুদ ও তাঁর সাথিরা বেঁচে গেলেন

কিন্তু এই সর্বগ্রাসী ধ্বংস থেকে আল্লাহ্‌ হুদ (আঃ) ও তাঁর সাথিদের (ঈমানদার) বাঁচিয়ে দিলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

“ যখন আমার হুকুম এসে গেলো, তখন আমি নিজ রহমতে হুদ ও তাঁর সাথে ঈমান গ্রহনকারীদের রক্ষা করলাম আর এক কঠিন আযাব থেকে তাঁদের বাঁচালাম। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৮)

আযাব আসার পূর্বক্ষণে আল্লাহ্‌ পাকের নির্দেশে হুদ (আঃ) তাঁর সাথিদের নিয়ে নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। মহান আল্লাহ্‌ আ’দ জাতির যে সব পাপিষ্ঠদের ধ্বংস করে দিয়েছেন, তাঁরা ছিলো প্রথম আ’দ। ” (সূরা ৫৩ আন নাজমঃ আয়াত ৫০)। আর হজরত হুদ (আঃ) এর সাথে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন দ্বিতীয় আ’দ। পরবর্তীকালে এই দ্বিতীয় আদ’ই আবার বড় আকার ধারন করে।

 

হুদ (আঃ) কিসের দাওয়াত দিয়েছেন?

হুদ (আঃ) তাঁর জাতিকে কি দাওয়াত দিয়েছেন? আসুন কুরআন মাজীদ দেখি। কুরআন বলে হজরত হুদ (আঃ) তাঁর জাতিকে বলেছিলেনঃ

১। হে আমার জাতি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর হুকুম পালন করো।

২। আল্লাহ্‌ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই।

৩। নিজেদের অপরাধের জন্যে তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।

৪। তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে এসো।

৫। আমি তো কেবল আমার প্রভূর বার্তা তোমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছি।

৬। আমি কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই।

৭। আমি বোকা নই আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের রাসুল।

৮। কল্যাণ চাও তো মহান আল্লাহর দান সমূহকে স্মরণ করো।

৯। আমার প্রভূ সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

১০। সমস্ত প্রানীর ভাগ্য আল্লাহর হাতে।

১১। আমি আমার মালিক ও তোমাদের মালিক আল্লাহর উপর ভরসা রাখি।

১২। তোমরা বিবেক খাটিয়ে চলো।

১৩। তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহ্‌ অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থানে বসাবেন।

১৪। আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় তোমরা যাদের শরীক করছো, আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি।

১৫। আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো।

১৬। আমি তোমাদের উপর এক কঠিন দিনের শাস্তির ভয় করছি।

১৭। মহান আল্লাহই সমস্ত জ্ঞানের উৎস।

১৮। এ কাজের বিনিময়ে আমি তোমাদের কছে কোন প্রতিদান চাই না। আমাকে প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব মহান আল্লাহর। (হুদ আলাইহিস সালামের এই আহবানগুলি কুরআন থেকে নেয়া হয়েছে)

 

কুরআনে হজরত হুদ ও আ’দ জাতির উল্লেখ

কুরআন মাজীদে হিজরত হুদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ আছে সাত বার। আ’দ জাতির নাম উল্লেখ হয়েছে চব্বিশ বার। হুদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে সূরা আ’রাফ আয়াত ৬৫ ; হুদ আয়াত ৫০,৫৩,৫৮,৬০, ৮৯ এবং সূরা শোয়ারা; আয়াত ১২৪। হজরত হুদ হজরত হুদ (আঃ) ও আ’দ জাতির কথা উল্লেখ যে সব সুরায় – সূরা আরাফ, সূরা তাওবা, সূরা হুদ, সূরা ইবরাহীম, সূরা হাজ্জ, সূরা শোয়ারা, সূরা ফুরকান, সূরা আনকাবুত, সূরা সোয়াদ, সূরা মুমিনুন, সূরা হামিম আস সিজদা, সূরা আহকাফ, সূরা কাফ, সূরা যারিয়াত, সূরা আন নাজম, সূরা আল কামার, সূরা আলহাক্কাহ এবং সূরা আল ফজরে। এসব সূরা থেকেই হজরত হুদ (আঃ) এর জীবন কথা লেখা হলো।

৫।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!