দুই
ডিসেম্বর মাস।
সব ক্লাসের পরীক্ষা ও প্রমোশন হয়ে গিয়েছে। প্রথম বিবেচনা, দ্বিতীয় বিবেচনা, তৃতীয় বিবেচনা ও বিশেষ বিবেচনা ইত্যাদি সকল প্রকারের ‘বিবেচনা’ হয়ে গিয়েছে। ‘বিবেচিত’ প্রমোশন-প্রাপ্তের সংখ্যা অন্যান্য বারের ন্যায় সে-বারও পাশ-করা প্রমোশন-প্রাপ্তের সংখ্যার দ্বিগুণেরও ঊর্ধ্বে উঠেছে।
কিন্তু আদুভাই এসব বিবেচনার বাইরে। কাজেই তাঁর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। টেস্ট-পরীক্ষা দিয়ে আমরা টিউটরিয়েল ক্লাস করছিলাম। ছাত্ররা শুধুশুধি স্কুল-প্রাঙ্গণে জটলা করছিল- প্রমোশন-পাওয়া ছেলেরা নিজেদের কীর্তি-উজ্জ্বল চেহারা দেখাবার জন্য, না-পাওয়া ছেলেরা প্রমোশনের কোনো প্রকার অতিরিক্ত বিশেষ বিবেচনার দাবি জানাবার জন্য।
এমনি দিনে একটু নিরালা জায়গায় পেয়ে হঠাৎ আদুভাই আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমি চমকে উঠলাম। আদুভাইকে আমরা সবাই মুরুব্বি মানতাম। তাই তাঁকে ক্ষিপ্রহস্তে টেনে তুলে প্রতিদানে তাঁর পা ছুঁয়ে বললাম : কি হয়েছে আদুভাই, অমন পাগলামি করলেন কেন?
আদুভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। তাঁকে অমন বিচলিত জীবন আর কখনো দেখি নি। তাঁর মুখের সর্বত্র অসহায়ের ভাব!
তাঁর কাঁধে সজোরে ঝাঁকি দিয়ে বললাম : বলুন, কি হয়েছে?
আদুভাই কম্পিত কণ্ঠে বললেন : প্রমোশন।
আমি বিস্মিত হলাম; বললাম : প্রমোশন? প্রমোশন কি? আপনি প্রমোশন পেয়েছেন?
: না, আমি প্রমোশন পেতে চাই।
: ও, পেতে চান? সে ত সবাই চায়।
আদুভাই অপরাধীল ন্যায় উদ্বেগ-কম্পিত ও সংকোচ-জড়িত প্যাঁচ-মোচড় দিয়ে যা বললেন, তার মর্ম এই যে, প্রমোশনের জন্য এতদিন তিনি কারো কাছে কিছু বলেন নি; কারণ, প্রমোশন জিনিসটাকে যথাসময়ের পূর্বে এগিয়ে আনাটা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এবার তাঁকে প্রমোশন পেতেই হবে। সে নির্জনতায়ও তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে সেই কারণটি বললেন। তা এই যে, আদুভাইর ছেলে সে-বার ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পেয়েছে। নিজের ছেলের প্রতি আদুভাইর কোনো ঈর্ষা নেই। কাজেই ছেলের সঙ্গে এক শ্রেণিতে পড়ার তাঁর আপত্তি ছিল না। কিন্তু আদুভাইর স্ত্রীর তাতে ঘোরতর আপত্তি আছে। ফলে, হয় আদুভাইকে এ-বার প্রমোশন পেতে হবে, নয় ত পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আদুভাই বাঁচবেন কি নিয়ে?
আমি আদুভাইর বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। তাঁর অনুরোধে আমি শিক্ষকদের কাছে সুপারিশ করতে যেতে রাজি হলাম।
প্রথমে ফারসি-শিক্ষকের কাছে যাওয়া স্থির করলাম। কারণ, তিনি একধা আমাকে মোট একশত নম্বরের মধ্যে একশ পাঁচ নম্বর দিয়েছিলাম। বিস্মিত হেড মাস্টার তার কারণ জিজ্ঞেস করায় মৌলবি সা’ব বলেছিলেন : ‘ছেলে সমস্ত প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর দেওয়ায় সে পূর্ণ নম্বর পেয়েছে। পূর্ণ নম্বর পাওয়ার পুরস্কার স্বরূপ আমি খুশি হয়ে তাকে পাঁচ নম্বর বখশিশ দিয়েছি।’ অনেক তর্ক করেও হেড মাস্টার মৌলবি সা’বকে এই কার্যের অসঙ্গতি বুঝাতে পারেননি।
মৌলবি সা’ব আদুভাইর নাম শুনে জ্বলে উঠলেন। অমন বেতমিজ ও খোদার না-ফরমান বান্দা তিনি কখনো দেখেননি, বলে আস্ফালন করলেন এবং অবশেষে টিনের বাক্স থেকে অনেক খুঁজে আদুভাইর খাতা বের করে আমার সামনে ফেলে দিয়ে বললেন : দেখ।
আমি দেখলাম, আদুভাই মোট তিন নম্বর পেয়েছে। তবু হতাশ হলাম না। পাসের নম্বর দেওয়ার জন্য তাঁকে চেপে ধরলাম।
বড় দেরি হয়ে গিয়েছে, নম্বর সাবমিট করে ফেলেছেন, বিবেচনার স্তর পার হয়ে গিয়েছে, ইত্যাদি সমস্ত যুক্তির আমি সন্তোষজনক জবাব দিলাম। তিনি বললেন, : তুমি কার জন্য কি অন্যায় অনুরোধ করছ, খাতাটা খুলেই একবার দেখ না।
আমি মৌলবি সাবকে খুশি করবার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবং অনাবশ্যক বোধেও খাতাটা খুললাম। দেখলাম : ফারসি পরীক্ষা বটে, কিন্তু খাতার কোথাও একটি ফারসি হরফ নেই। তার বদলে ঠাস-বুনানো বাংলা হরফে অনেক কিছু লেখা আছে। কৌতুহল-বশে পড়ে দেখলাম : এই বঙ্গদেশে ফারসি ভাষা আমদানি অনাবশ্যকতা ও ছেলেদের উহা শিখভার চেষ্টার মূর্খতা সম্বন্ধে আদুভাই যুক্তিপূর্ণ একটি ‘থিসিস’ লিখে ফেলেছেন।
পড়া শেষ করে মৌলবি সা’বের মুখের দিকে চাইতেই বিজয়ের ভঙ্গিতে বললেন : দেখেছ বাবা, বেতমিজের কাজ? আমি নিত্যন্ত ভাল মানুষ বলেই তিনটে নম্বর দিয়েছি অন্য কেউ হলে রাসটিকেটের সুপারিশ করত।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত মৌলবি সা’ব আমার অনুরোধ এড়াতে পারলেন না। খাতার উপর ৩ এর পৃষ্ঠে ৩ বসিয়ে ৩৩ করে দিলেন।
আমি বিপুল আনন্দে অংকের পরীক্ষকের বাড়ি ছুটলাম।
সেখানে দেখলাম : আদুভাইর খাতার উপর লাল পেন্সিলের একটি প্রকাণ্ড ভূমণ্ডল আঁকা রয়েছে। ব্যঅপারের গুরুত্ব বুঝেও আমার উদ্দেশ্য বললাম। অংকের মাস্টর ত হেসেই খুন। হাসতে হাসতে তিনি আদুভাইর খাতা বের করে আমাকে অংশ বিশেষ পড়ে শোনালেন। তাতে আদুভাই লিখেছেন যে, প্রশ্নকর্তা ভাল-ভাল অংকের প্রশ্ন ফেলে কতকগুলো বাজে ও অনাবশ্যক প্রশ্ন করেছেন। সেজন্য এবং প্রশ্নকর্তার ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে আদুভাই নিজেই কতিপয় উৎকৃষ্ট প্রশ্ন লিখে তার বিশুদ্ধ উত্তর দিচ্ছে,Ñ এইরূপ ভূমিকা করে আদুভাই যে সমস্ত অংক করেছেন, শিক্ষক মহাশয় প্রশ্ন-পত্র ও খাতা মিলিয়ে আমাকে দেখালেন যে, প্রশ্নের সঙ্গে আদুভাইর উত্তরের সত্যিই কোনো সংশ্রব নেই।
প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিল থাক আর নাই থাক, খাতায় লেখা অংখ শুদ্ধ হলেই নম্বর পাওয়া উচিত বলে আমি শিক্ষকের সঙ্গে অনেক ধস্তাধস্তি করলাম। শিক্ষক মশায়, যা হোক, প্রমাণ করে দিলেন যে, তাও শুদ্ধ হয়নি। সুতরাং পাসের নম্বর দিতে তিনি রাজি হলেন না। তবে তিনি আমাকে এই আশ্বাস দিলেন যে, অন্য সব সাবজেক্টের শিক্ষকদের রাজি করতে পারলে তিনি আদুভাইর প্রমোশন সুপারিশ করতে প্রস্তুত আছেন।
নিতান্ত বিষণœ মনে অন্যান্য পরীক্ষকদের নিকটে গেলাম। সর্বত্র অবস্থা প্রায় একরূপ। ভূগোলের খাতায় তিনি লিখেছেন সে পৃথিবীর গোলাকার এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, এমন গাঁজাখুরি গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না। ইতিহাসের খাতায় তিনি লিখেছেন যে, কোন রাজা কোন সম্রাটের পুত্র এসব কথার কোনো প্রমাণ নেই। ইংরেজির খাতায় তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের ছবি পাশাপাশি আঁকবার চেষ্টা করেছেন- অবশ্য কে যে সিরাজ কে যে ক্লাইভ, নিচে লেখা না থাকলে তা বুঝা যেত না।
হতাশ হয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম। আদুভাই আগ্রহ-ব্যাকুল চোখে আমার পথপানে চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
আমি ফিরে এসে নিস্ফলতার খবর দিতেই তাঁর মুখটি ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
: তবে আমার কি হবে ভাই?
-বলে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
কিছু একটা করবার জন্য আমার প্রাণও ব্যাকুল হয়ে উঠল। বললাম : তবে কি আদুভাই আমি হেডমাস্টারের কাছে যাব?
আদুভাই ক্ষণিক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন : তুমি আমার জন্য যা করেছ, সেজন্য ধন্যবাদ। হেডমাস্টারের কাছে তোমার গিয়ে কাজ নেই। সেখানে যেতে হয় আমিই যাব। হেডমাস্টারের কাছে জীবনে আমি কিছু চাই নি। এই প্রার্থনা তিনি আমার ফেলতে পারবেন না।
-বলেই তিনি হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।
আমি এক দৃষ্টে দ্রুত গমনশীল আদুভাইর দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি দৃষ্টির আড়াল হলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলাম।
সব ক্লাসের পরীক্ষা ও প্রমোশন হয়ে গিয়েছে। প্রথম বিবেচনা, দ্বিতীয় বিবেচনা, তৃতীয় বিবেচনা ও বিশেষ বিবেচনা ইত্যাদি সকল প্রকারের ‘বিবেচনা’ হয়ে গিয়েছে। ‘বিবেচিত’ প্রমোশন-প্রাপ্তের সংখ্যা অন্যান্য বারের ন্যায় সে-বারও পাশ-করা প্রমোশন-প্রাপ্তের সংখ্যার দ্বিগুণেরও ঊর্ধ্বে উঠেছে।
কিন্তু আদুভাই এসব বিবেচনার বাইরে। কাজেই তাঁর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। টেস্ট-পরীক্ষা দিয়ে আমরা টিউটরিয়েল ক্লাস করছিলাম। ছাত্ররা শুধুশুধি স্কুল-প্রাঙ্গণে জটলা করছিল- প্রমোশন-পাওয়া ছেলেরা নিজেদের কীর্তি-উজ্জ্বল চেহারা দেখাবার জন্য, না-পাওয়া ছেলেরা প্রমোশনের কোনো প্রকার অতিরিক্ত বিশেষ বিবেচনার দাবি জানাবার জন্য।
এমনি দিনে একটু নিরালা জায়গায় পেয়ে হঠাৎ আদুভাই আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমি চমকে উঠলাম। আদুভাইকে আমরা সবাই মুরুব্বি মানতাম। তাই তাঁকে ক্ষিপ্রহস্তে টেনে তুলে প্রতিদানে তাঁর পা ছুঁয়ে বললাম : কি হয়েছে আদুভাই, অমন পাগলামি করলেন কেন?
আদুভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। তাঁকে অমন বিচলিত জীবন আর কখনো দেখি নি। তাঁর মুখের সর্বত্র অসহায়ের ভাব!
তাঁর কাঁধে সজোরে ঝাঁকি দিয়ে বললাম : বলুন, কি হয়েছে?
আদুভাই কম্পিত কণ্ঠে বললেন : প্রমোশন।
আমি বিস্মিত হলাম; বললাম : প্রমোশন? প্রমোশন কি? আপনি প্রমোশন পেয়েছেন?
: না, আমি প্রমোশন পেতে চাই।
: ও, পেতে চান? সে ত সবাই চায়।
আদুভাই অপরাধীল ন্যায় উদ্বেগ-কম্পিত ও সংকোচ-জড়িত প্যাঁচ-মোচড় দিয়ে যা বললেন, তার মর্ম এই যে, প্রমোশনের জন্য এতদিন তিনি কারো কাছে কিছু বলেন নি; কারণ, প্রমোশন জিনিসটাকে যথাসময়ের পূর্বে এগিয়ে আনাটা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এবার তাঁকে প্রমোশন পেতেই হবে। সে নির্জনতায়ও তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে সেই কারণটি বললেন। তা এই যে, আদুভাইর ছেলে সে-বার ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পেয়েছে। নিজের ছেলের প্রতি আদুভাইর কোনো ঈর্ষা নেই। কাজেই ছেলের সঙ্গে এক শ্রেণিতে পড়ার তাঁর আপত্তি ছিল না। কিন্তু আদুভাইর স্ত্রীর তাতে ঘোরতর আপত্তি আছে। ফলে, হয় আদুভাইকে এ-বার প্রমোশন পেতে হবে, নয় ত পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আদুভাই বাঁচবেন কি নিয়ে?
আমি আদুভাইর বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। তাঁর অনুরোধে আমি শিক্ষকদের কাছে সুপারিশ করতে যেতে রাজি হলাম।
প্রথমে ফারসি-শিক্ষকের কাছে যাওয়া স্থির করলাম। কারণ, তিনি একধা আমাকে মোট একশত নম্বরের মধ্যে একশ পাঁচ নম্বর দিয়েছিলাম। বিস্মিত হেড মাস্টার তার কারণ জিজ্ঞেস করায় মৌলবি সা’ব বলেছিলেন : ‘ছেলে সমস্ত প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর দেওয়ায় সে পূর্ণ নম্বর পেয়েছে। পূর্ণ নম্বর পাওয়ার পুরস্কার স্বরূপ আমি খুশি হয়ে তাকে পাঁচ নম্বর বখশিশ দিয়েছি।’ অনেক তর্ক করেও হেড মাস্টার মৌলবি সা’বকে এই কার্যের অসঙ্গতি বুঝাতে পারেননি।
মৌলবি সা’ব আদুভাইর নাম শুনে জ্বলে উঠলেন। অমন বেতমিজ ও খোদার না-ফরমান বান্দা তিনি কখনো দেখেননি, বলে আস্ফালন করলেন এবং অবশেষে টিনের বাক্স থেকে অনেক খুঁজে আদুভাইর খাতা বের করে আমার সামনে ফেলে দিয়ে বললেন : দেখ।
আমি দেখলাম, আদুভাই মোট তিন নম্বর পেয়েছে। তবু হতাশ হলাম না। পাসের নম্বর দেওয়ার জন্য তাঁকে চেপে ধরলাম।
বড় দেরি হয়ে গিয়েছে, নম্বর সাবমিট করে ফেলেছেন, বিবেচনার স্তর পার হয়ে গিয়েছে, ইত্যাদি সমস্ত যুক্তির আমি সন্তোষজনক জবাব দিলাম। তিনি বললেন, : তুমি কার জন্য কি অন্যায় অনুরোধ করছ, খাতাটা খুলেই একবার দেখ না।
আমি মৌলবি সাবকে খুশি করবার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবং অনাবশ্যক বোধেও খাতাটা খুললাম। দেখলাম : ফারসি পরীক্ষা বটে, কিন্তু খাতার কোথাও একটি ফারসি হরফ নেই। তার বদলে ঠাস-বুনানো বাংলা হরফে অনেক কিছু লেখা আছে। কৌতুহল-বশে পড়ে দেখলাম : এই বঙ্গদেশে ফারসি ভাষা আমদানি অনাবশ্যকতা ও ছেলেদের উহা শিখভার চেষ্টার মূর্খতা সম্বন্ধে আদুভাই যুক্তিপূর্ণ একটি ‘থিসিস’ লিখে ফেলেছেন।
পড়া শেষ করে মৌলবি সা’বের মুখের দিকে চাইতেই বিজয়ের ভঙ্গিতে বললেন : দেখেছ বাবা, বেতমিজের কাজ? আমি নিত্যন্ত ভাল মানুষ বলেই তিনটে নম্বর দিয়েছি অন্য কেউ হলে রাসটিকেটের সুপারিশ করত।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত মৌলবি সা’ব আমার অনুরোধ এড়াতে পারলেন না। খাতার উপর ৩ এর পৃষ্ঠে ৩ বসিয়ে ৩৩ করে দিলেন।
আমি বিপুল আনন্দে অংকের পরীক্ষকের বাড়ি ছুটলাম।
সেখানে দেখলাম : আদুভাইর খাতার উপর লাল পেন্সিলের একটি প্রকাণ্ড ভূমণ্ডল আঁকা রয়েছে। ব্যঅপারের গুরুত্ব বুঝেও আমার উদ্দেশ্য বললাম। অংকের মাস্টর ত হেসেই খুন। হাসতে হাসতে তিনি আদুভাইর খাতা বের করে আমাকে অংশ বিশেষ পড়ে শোনালেন। তাতে আদুভাই লিখেছেন যে, প্রশ্নকর্তা ভাল-ভাল অংকের প্রশ্ন ফেলে কতকগুলো বাজে ও অনাবশ্যক প্রশ্ন করেছেন। সেজন্য এবং প্রশ্নকর্তার ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে আদুভাই নিজেই কতিপয় উৎকৃষ্ট প্রশ্ন লিখে তার বিশুদ্ধ উত্তর দিচ্ছে,Ñ এইরূপ ভূমিকা করে আদুভাই যে সমস্ত অংক করেছেন, শিক্ষক মহাশয় প্রশ্ন-পত্র ও খাতা মিলিয়ে আমাকে দেখালেন যে, প্রশ্নের সঙ্গে আদুভাইর উত্তরের সত্যিই কোনো সংশ্রব নেই।
প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিল থাক আর নাই থাক, খাতায় লেখা অংখ শুদ্ধ হলেই নম্বর পাওয়া উচিত বলে আমি শিক্ষকের সঙ্গে অনেক ধস্তাধস্তি করলাম। শিক্ষক মশায়, যা হোক, প্রমাণ করে দিলেন যে, তাও শুদ্ধ হয়নি। সুতরাং পাসের নম্বর দিতে তিনি রাজি হলেন না। তবে তিনি আমাকে এই আশ্বাস দিলেন যে, অন্য সব সাবজেক্টের শিক্ষকদের রাজি করতে পারলে তিনি আদুভাইর প্রমোশন সুপারিশ করতে প্রস্তুত আছেন।
নিতান্ত বিষণœ মনে অন্যান্য পরীক্ষকদের নিকটে গেলাম। সর্বত্র অবস্থা প্রায় একরূপ। ভূগোলের খাতায় তিনি লিখেছেন সে পৃথিবীর গোলাকার এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, এমন গাঁজাখুরি গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না। ইতিহাসের খাতায় তিনি লিখেছেন যে, কোন রাজা কোন সম্রাটের পুত্র এসব কথার কোনো প্রমাণ নেই। ইংরেজির খাতায় তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের ছবি পাশাপাশি আঁকবার চেষ্টা করেছেন- অবশ্য কে যে সিরাজ কে যে ক্লাইভ, নিচে লেখা না থাকলে তা বুঝা যেত না।
হতাশ হয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম। আদুভাই আগ্রহ-ব্যাকুল চোখে আমার পথপানে চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
আমি ফিরে এসে নিস্ফলতার খবর দিতেই তাঁর মুখটি ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
: তবে আমার কি হবে ভাই?
-বলে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
কিছু একটা করবার জন্য আমার প্রাণও ব্যাকুল হয়ে উঠল। বললাম : তবে কি আদুভাই আমি হেডমাস্টারের কাছে যাব?
আদুভাই ক্ষণিক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন : তুমি আমার জন্য যা করেছ, সেজন্য ধন্যবাদ। হেডমাস্টারের কাছে তোমার গিয়ে কাজ নেই। সেখানে যেতে হয় আমিই যাব। হেডমাস্টারের কাছে জীবনে আমি কিছু চাই নি। এই প্রার্থনা তিনি আমার ফেলতে পারবেন না।
-বলেই তিনি হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।
আমি এক দৃষ্টে দ্রুত গমনশীল আদুভাইর দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি দৃষ্টির আড়াল হলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলাম।