আত্মীয়—- সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

আলী হায়দার সাহেবকে গ্রামের একটা প্রবাদ শোনাতেই খুব জোরে হেসে উঠলেন। বলতে কী, এরকম জোরদার প্রতিক্রিয়ার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সে জন্য ঠোঁট একটুখানি আড়ষ্ট হল, হাসিও আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। শুধু মুখের ভুগোলে কিছু কুঞ্চন জাগল।
আমি বলেছিলাম, স্যার, আমার গ্রামের লোক বলে, সৈয়দকে বাড়ি চেনাবেন না, চেনালে খবর আছে। আলী হায়দার ১৯৫৪ সাল থেকেই জমিদার। সে বছর সরকার তার পিতার ত্রিগ্রাম-সাত্রা-নন্দনপুরে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে। ধলাই হাওরের পাশে ৩০০ বিঘা ধানী জমির মালিকানা ছিনিয়ে নিয়ে নাঙ্গাভুখা চাষীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। আজমিরিগঞ্জ বাজারের প্রায় অর্ধেকটা ছিল হায়দার-পিতার। সেগুলি কৌশলে বাগিয়ে নেয় ল্যান্ড রেভেন্যু অফিসের কেরানি কুটুম্ব মিয়া। চিরগরিব কুটুম্ব মিয়া মাত্র ছমাস হল চাকরিটা জুটিয়েছিল। হায়দার-পিতার কৃপাতেই। এমনি গরিব যে, একটা লুঙ্গি পরে সে পুরো একটা সপ্তাহ কাটিয়ে দিত। লোকে সেজন্য তাকে ডাকত … যা হোক, ওই শরমের সম্ভাষণ নাই বা জানালাম আপনাদের। তাতে কিছু না হোক, তার কন্যা, গুলনাহার রেখা, আমার স্ত্রী- অথবা তার আত্মা- কুপিত হবে না। কুটুম্ব মিয়া অবশ্য রাগ-বিরাগের ওপারে চলে গেছে। লুঙ্গি ছেড়ে সে পাজামা এবং পরে প্যান্ট ধরেছিল। ১৯৬৭ সালে সে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড টয়োটা করোলা গাড়িও কিনেছিল। একাত্তরে কুটুম্ব মিয়া দেহরক্ষা করে। না, যা ভাবছেন, তা নয়। যুদ্ধের কারণে নয়, তার প্রস্থানটা নিতান্তই মামুলি। ঘুমের মধ্যে তার হৃদযন্ত্রের ব্যাটারি ফুরিয়ে গিয়েছিল। রেখার বয়স তখন দুই।
১৯৫৪ সালে আলী হায়দারের বয়স ছিল ২৪। এখন সত্তরের ওপর। জমিদারি হারিয়ে হায়দার-পিতা উন্মাদ হয়েছিলেন। তারপর তাকে নিয়ে পরিবারটি ঢাকা চলে আসে। সেখানে অল্প এবং মাঝে মাঝে বিস্তর উন্মাদনা নিয়ে পাঁচ বছর তার কোনোক্রমে কাটে। তারপর তিনিও দেহরক্ষা করেন। আলী হায়দার অবশ্য বাবাকে ঢাকায় রেখে গ্রামে ফিরে জমিদারি উদ্ধারে আস্তিন গুটিয়ে নেমে পড়েন। ত্রিগ্রামে ছিল তার মূল বাড়ি। বাড়িটা ছিল একটা ১৯০৬ লেট ভিক্টোরিয়ান মডেলের শংকর স্থাপত্যের দরদালান। সেটি তার দখলেই ছিল। সেখানে একদিন তিন গ্রামের মাতবর মোড়লদের ডেকে বললেন, আমি এখন জমিদার। মাতবর মোড়ল হাসল। যে বেশি হাসল, তথা ইনসান আলী, তাকে পরদিন আঁখ ক্ষেতে ইন্তেকালরত অবস্থায় পাওয়া গেল। আলী হায়দার এরপর আরেকদিন মাতবর মোড়লদের ডাকলেন। অর্ধেক এলো, অর্ধেক এলো না। যারা এলো, তারা আর হাসল না। কিন্তু যারা এলো না, তাদের মধ্যে যার অনুপস্থিতি বেশি চোখে পড়ল উপস্থিতজনদের- যেহেতু সে ঘোষণা দিয়েছিল কোনো পাগলের ডাকে কোথাও সভায় সে যাবে না- সেই মকই মিয়া, পরদিন বাড়ির পুকুরে গোসল করতে গিয়ে লাশ হয়ে ভেসে উঠল।
আলী হায়দারের সভায় উপস্থিত-অনুপস্থিত প্রায় কেউ জানল না কেন ইনসান-মকই প্রাণ হারাল, কার হাতে, কীভাবে, ইত্যাদি। একজন অবশ্য জানল, সে অনিল চন্দ্র। হায়দার-পিতার সিন্দুকের চাবি হারিয়ে গেলে একবার অনিলের বাবা অসীম সেটি ভেঙেছিল। তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও, সে দেখেছে, সিন্দুকের ভেতরে একশ টাকার বাণ্ডিলের পাহাড়। অনিল দেখেছে দারোগা সাইকেলে চেপে আলী হায়দারের বাড়ি আসতে, আর সাইকেলের বাস্কেটে একটা বিস্কুটের টিনে একশ টাকার কতেক বাণ্ডিল নিয়ে যেতে। বিস্কুটের টিনের মুখটা তাড়াহুড়োতে ঠিকমতো লাগায়নি দারোগা। সেটি খুলে গেলে অনিলের চোখে, তার পিতার চোখের মতোই, একশ টাকার নোটের সৌন্দর্য ঠিকরে পড়েছে।
সেই সৌন্দর্যের কাছে ইনসান-মকইয়ের মতো মানুষের প্রাণভোমরাকে দেখায় খুবই বিবর্ণ, আকর্ষণহীন। অনিল চন্দ্রকে দারোগা ধমক দিয়ে বলেছিল, কাউকে কিছু বললে বাড়িঘর পুড়ায়া দেব। তদুপরি তোকে জেলে পুরাব।
আলী হায়দারকে এরপর মানুষ জমিদার নামেই ডাকতে থাকল। কেন ডাকবে না বলুন? ততদিনে আয়ুব খান পাকিস্তানের রাজা হয়েছেন, এবং আলী হায়দারের সত্যিকার সুদিন এসেছে। এবার সে ঘোষণা দিল, পৃথিমপাশার জমিদারের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক আছে। একবারেই বানোয়াট কথাটা, কিন্তু তাতে কি, সুধামঙ্গলের একসময়ের জমিদারের মেয়ে সুলতানা নার্গিসকে বিয়ে করতে তার তাতে সুবিধাই হল। পৃথিমপাশার জমিদাররা বরাবরই কুলীন। সেই কৌলিণ্যের প্রতিফলন ঘটাতেই আলী হায়দারের এই প্রতারণা। পৃথিমপাশার প্রকৃত (এককালীন) জমিদার পরিবারটি অবশ্য এ প্রতারণার মুখোশ খুলে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে সুলতানা নার্গিসের কোনো লাভ হয়নি। ১৯৬৫ সালে, পাক-ভারত যুদ্ধের বছরে, তার বিয়ে হয়েছিল; ছবছর পর, আরেক যুদ্ধের বছরে, যে যুদ্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদয় হয়েছিল, সুলতানা নার্গিসের জীবনসূর্য অস্তমিত হয়। তার মৃত্যুর কারণ: ১. স্বামীর অত্যাচার, ২. উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বহুমূত্র এবং ৩. মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র ভাইটির করুণ মৃত্যু।
কোনটি যে কতটা প্রভাব রেখেছিল ওই মৃত্যুর ওপর, একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন।
সুলতানা নার্গিস দুই মেয়ে এক ছেলে রেখে ধরাধাম ছেড়েছিলেন। ছেলেটি ছিল বড়- এমএ পাস করে সে লন্ডন চলে যায়, ১৯৯০ সালে। এক মেয়ে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে কোমর ভেঙে দীর্ঘ সাত বছর বিছানায় কাটিয়ে অবশেষে ১৯৮৯ সালে তার (পক্ষাঘাতে বিকল) দেহটি রক্ষা করে। দ্বিতীয় মেয়ে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে বিএ পাস করে ১৯৯১ সালে; তারপর শ ওয়ালেস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মকসুদুল হাকিমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু সেই বিয়ে না টেকে ৩টি বছর, না তাতে জন্ম নেয় কোনো সন্তান। দ্বিতীয় মেয়ে, যার নাম তানিয়া, আবার বিয়ে করে, হবিগঞ্জ গ্যাস পাইপলাইনের জেনারেল ম্যানেজার আশিক আলমকে। পরপর দুদুটি স্বামী জেনারেল ম্যানেজার! তারপরও না হয় তার সংসার অথবা বিয়ে ম্যানেজ, না কোনো সন্তান উৎপাদন।
তানিয়া এখন, (২০০২ সালে), বাবার সঙ্গে ত্রিগ্রামের জমিদার বাড়িতে থাকে। তার বয়স ৩২। অবশ্য দুদুটি বিয়ের ঝঞ্ঝা জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার পরও, তাকে দেখতে মনে হবে ২২। অথবা, কে জানে, ৩২।
এখন আলী হায়দারের শখ হয়েছে, আত্মজীবনী লেখার। কিন্তু নিজে যে লিখবেন, সেই বিদ্যা বুদ্ধিতে রয়েছে ঘাটতি। হায়দার-পিতা ছেলেকে অতি আস্কারা দিতেন, ফলে সে বখাটে হয়েই বেড়ে উঠল। সেজন্য তার পড়াশোনাটা আর হয়নি। জনশ্র“তি এক: এক বাবা বাঘ শিকারে নেমে দলবল নিয়ে জঙ্গলে যাওয়ার পথে স্কুল থেকে ছেলেকে তুলে নিয়ে গেলেন। ছেলের স্কুলে ইয়ার্লি পরীক্ষা চলছিল। হেড মাস্টার বাধা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, স্যার, ছেলেটা পরীক্ষা দিচ্ছে। পরীক্ষাটা শেষ করুক, তখন না হয় যাবে ।
হায়দার-পিতা বলেছিলেন, জমিদারের ছেলে, ওর পড়ালেখার কাজটা নাহয় একটা চাকরই করুক। ওর স্কুলে বসে বদ্ধ বাতাসে সময় কাটানোর দরকার নেই। পরীক্ষা আবার কী? পরীক্ষা আপনিই দিন।
জনশ্রুতি দুই : আঠারো বছর বয়সে আলী হায়দার ঘরের ১৪ বছরের কাজের একটি মেয়েকে …….। মেয়েটির রং ছিল কালো। খবর পেয়ে হায়দার-পিতা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তারপর থেকে আলী হায়দারের ফাই ফরমাশ খাটত দুটি ১৪/১৫ বছরের মেয়ে। তাদের রং ছিল ফর্সা।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঘটনাগুলি জনশ্রুতি, না সত্যি?
আলী হায়দার কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, শোনো নাই, লোকে যে বলে, যাহা রটে, তাহা ঘটে?
আমি বৃন্দাবন কলেজে ইংরেজি পড়াই। বিকালে টিউশনি করি। তাতে কিছু অর্থ আসে, কিন্তু তার থেকেও বেশি, টিউশনি করে যে ক্লান্তি আসে, তাতে রাতের ঘুমটা অভঙ্গুর হয়। রেখার সঙ্গে আমার জীবন ছিল একটা ছায়ার সঙ্গে কাটিয়ে দেয়ার মতো। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তার থ্যালাসিমিয়া ধরা পড়ে। তারপর রেখার স্বাস্থ্য ক্রমেই খারাপ হয়েছে। তার মনে স্ফূর্তি ছিল না, সারাদিন বিছানায় কাটত তার। বিছানায় স্বামী থাকলে সে ভয় পেত, তার প্রিয় একটি চিৎকার ছিল, আমার প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে রাজু, পারছি না। আমার ধারণা হয়েছিল, থ্যালাসিমিয়ার সঙ্গে ওর মেরুদণ্ডে ক্ষয় দেখা দিয়েছিল। তার আত্মরক্ষার একটি উপায় এ চিৎকারটিকে আমি সম্মান করতাম, ফলে, এক ধরনের সন্যাস জীবনযাপন করেছি আমি। শুধু রেখা যখন শুয়ে থাকত, তার মাথার পাশে একটা মোড়া টেনে বসলে সে খুব খুশি হতো। আমার একটা হাত টেনে ধরে সে নিদ্রা-আচ্ছন্নতা-জাগরণের সময়গুলো পার করে দিত।
রেখার শিয়রের পাশের ওই জায়গাটি ছিল আমার খবরের কাগজ, বইপত্র পড়া, খাতা দেখা এসবের জায়গা। আমার অফিস স্পেস।
একদিন আমি অফিস স্পেসে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করছিলাম। আর মাঝে মাঝে ফ্যানের বাতাসে রেখার কপালে উড়ে এসে পড়া এলোমেলো চুল সরাচ্ছিলাম। এক সময় আমার হাত জোরে চেপে ধরল রেখা। আমি প্রশ্নপত্র ফেলে দুহাতে রেখার হাতটি ধরলাম। সে একটুখানি হাসল, অতি অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, কাছে এসো। আমি ঝুঁকে তার কপালে চুমু খেলাম। রেখা তার একটি হাত আমার চুলে রেখে আঙুল দিয়ে কিছুক্ষণ বিলি কেটে দিল। তারপর তার হাত নিস্তেজ হয়ে গেল। চোখ বুজে গেল। কিন্তু হাসিটা স্থির রয়ে গেল ঠোঁটে। যেন সে মহা-আমোদ পাচ্ছে এভাবে চলে যেতে।
এরপর সে চিরনিন্দ্রায় গেল।
বহুদিন আমার একটা ধারণা ছিল, রেখার চলে যাওয়াটা ছিল খুব স্বার্থপরের। আমাকে একা ফেলে। এখন আর সে ধারণাটা নেই। এখন মনে হয়, রেখা খুব অসহায় ছিল। আমি ছিলাম তার একটুখানি সহায়। আমাকে আর কঠিন কোনো পরীক্ষায় না ফেলেই সে চলে গেল।
এই দর্শনে ভুল থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। কিন্তু এর বিকল্প কোনো চিন্তা আমার ভেতরে জাগেনি। জাগলে দেখা যাবে।
২.
রেখার মৃত্যু হয়েছে থ্যালাসিমিয়ায়- ঠিক আছে, কিন্তু কুটুম্ব মিয়ার ছেলেমেয়েদের একটা ভূমিকা আছে ওই মৃত্যুর পেছনে। খুব অদ্ভূত মানুষজন, কুটুম্ব মিয়ার পরিবারের। তার মুত্যুর পর বড় ভাই আকিল দায়িত্ব নিয়েছিল সম্পত্তি দেখাশোনার। এ দেখাশোনা করতে গিয়ে নিজের দখলেই নিয়ে নিল সব সম্পত্তি। কিন্তু কুটুম্ব মিয়ার বড় ছেলে হারেছ ম্যাট্রিক পাস করে দশ বছর সৌদিতে চাকরি সেরে দেশে ফিরে ছোট চাচার ছেলে এখলাসকে সঙ্গে নিয়ে সব সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করল। আকিল মিয়া বাধা দিতে গেলে কোথা থেকে এক টেঁটা এসে তার বুকটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। হারেছ এক সময় ছোটভাই মমিনকে একটুখানি, দুই বোন নূরুননাহার পাতা ও শামসুন্নাহার লতাকে অল্পখানি সম্পত্তি দিয়ে বাকিটা নিজের নামে লিখিয়ে নিল।
সে বছর রেখার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু হারেছ রেখাকে এক ফোঁটা সম্পত্তি দিল না। পরিপূর্ণ বঞ্চনা। আমি অবশ্য এ বঞ্চনার কারণ জানি। হারেছ আমাকে ঈর্ষা করত। একবারে দেখতে পেত না। আমাকে বলেওছিল একদিন, ও মাস্টার, ভার্সিটিত পড়িয়া নিজের খুব পণ্ডিত মন করইন না কিতা?
এরকম গ্রাম্য লোকের সঙ্গে যেখানে কথাই বলতে রুচিতে বাধে, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ করতে যাব কোন দুঃখে?
রেখা অতিশয় আঘাত পেয়েছিল ওই আচরণে, বিশেষ করে বড় দুই বোন পাতা আর লতার শীতল ব্যবহারে।
বিয়ের প্রথম বছর থেকেই, বলতে কী, রেখার সঙ্গে বাপের বাড়ির কোনো সম্পর্ক ছিল না। একবারও সে ভাই বোনদের অথবা মায়ের কথা বলত না, ভুলক্রমেও না। শুধু কুটুম্ব মিয়ার কথায় তার আবেগ উঠত। বাবাকে সে ভালোবাসত – এটা জেনেও যে, বাবা জালিয়াতি করে হায়দার-পিতার জমি আত্মসাৎ করেছিলেন।
অদ্ভূত। মানুষের এই মন!
আলী হায়দার লোক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার ত্রিগ্রামের জমিদার বাড়িতে। তিনি তার আত্মজীবনী লিখে দেয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন। বললেন, তোমাকে এক লাখ টাকা দেব। তবে, সময় পাবে মাত্র এক বছর।
ঘরে তার চেয়ারের পেছনে তার কাঁধে একটা হাত রেখে সাদা সালোয়ার কামিজ পরা তানিয়া একটা পরীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল, তার (সম্ভবত শ্যাম্পু করা) চুল হাওয়ায় উড়িয়ে। গলায় যৎসামান্য উদ্বেগ ঢেলে সেও আমাকে বলল, প্রফেসর সাহেব, অফারটা ফিরিয়ে দেবেন না।
মফস্বলের কলেজগুলোর সব শিক্ষকই প্রফেসর, আমি দেখেছি; তবুও, তানিয়ার সম্বোধনে একটা আলাদা জাদু ছিল। তাকে দেখে, টাকার অংকটি শুনে এবং টেবিলের ওপর খোলা হুইস্কির বোতল থেকে ভেসে আসা টক মিষ্টি ঘ্রাণ শুঁকে আমার ইন্দ্রিয়গুলো হঠাৎ তীক্ষè হয়ে উঠল। আমি হুইস্কির বোতলের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে আলী হায়দার মেয়েকে বললেন, ট্যানি, আরেকটা গ্লাস।
ট্যানি বলল, সুধীন, আরেকটা গ্লাস।
সুধীন আলী হায়দারের খাস বেয়ারা। সে গ্লাস নিয়ে এলো, গ্লাস ভর্তি হল। আমি প্রথমে কুণ্ঠিত, পরে কুণ্ঠাহীন খেলাম। খেতে খেতে আলী হায়দার বললেন, যখন পানাভ্যাস আছে, তখন ইচ্ছা হলেই চলে আসবে। লজ্জা করবে না। তখনই আমি বলেছিলাম প্রবাদটা : সৈয়দরে ঘর ডাকইন্যা যাইন; ডাকলে খবর আছে।
আলী হায়দার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আমার আত্মজীবনীর ভাষাতে যেন এই অশুদ্ধতা, এই গ্রাম্যতা থাকে না, কেমন?
আমার কিছুটা রাগ হল। হুইস্কি আমার শরীরে সাহস জুগিয়েছে। তাছাড়া বহুদিন পর পেটে পড়েছে ওই বস্তু, সাহসের সঙ্গে একটু দুর্বীনিত ভাবও তাই চলে এলো। বললাম, আমার ভাষাজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না।
আলী হায়দারের বাঁহাতে একটা চুরুট ছিল- মাঝে মাঝে যেন অখেয়ালবশত তাতে টান দিচ্ছিলেন, সেটি এবার খসে মাটিতে পড়ে গেল। তিনি উত্তেজনা ও রাগের মিশ্রিত একটি অনুভূতি দেখালেন, যা আমাকে কিছুটা ভয় পাইয়ে দিল। তিনি সহুংকারে বললেন, কিতা কইলায় তুমি মিয়া? আমার মুখর উপরে কিতা জানি কইলায়?
আমি বিচলিত শরীরটা টেনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দুচার পেগ হুইস্কির আর কীইবা দাম, অথচ তা সেবন করার আনন্দ ও মূর্খতায় গেল আমার ১ লাখ টাকা উপার্জনের সুযোগ। টাকাটা পেলে ভেবেছিলাম দেশ ছেড়ে চলে যাব। ইংল্যান্ডে আমার বাল্যবন্ধু ময়না রেস্টুরেন্ট দিয়ে বেশ আছে। সে বলেছে চাকরি জুটিয়ে দেবে একটা। সে সম্ভাবনাও গেল। গুডবাই ময়না।
কিন্তু না, দ্রুতপায়ে দৃশ্যপটে ঢুকল তানিয়া। দরজার পাশেই যেন দাঁড়িয়ে ছিল, আমাদের দেখছিল, কথা শুনছিল। আলী হায়দারের উত্তেজিত হাত ধরে সে তাকে শান্ত করল। মেঝে থেকে চুরুট তুলে তার দুআঙুলের ফাঁকে গলিয়ে দিল। তাকে বলল, এরকম করছ কেন বাবা? ভদ্রলোক তোমার মেহমান, খেয়াল আছে?
আলী হায়দার বৃদ্ধ হয়েছেন। মেজাজটাও বার্ধক্যের ভারে ক্লান্ত, বেশিক্ষণ উত্তেজনা ধরে রাখতে পারে না। তিনি ক্লান্ত স্বরেই বললেন, ঠিক আছে, তুমিই কর মেহমানদারি। আমি যাই।
তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। পেছন পেছন সুধীন গেল, আমার দিকে কুপিত দৃষ্টি মেলে।
তানিয়া বলল, আমাকে উদ্দেশ করে, কিন্তু বারান্দার পাশে ঝুঁকে পড়া কামিনী গাছটির দিকে তাকিয়ে, বুড়ো মানুষ, একটা কথা না হয় বললেন আপনাকে, সেজন্য এরকম রিয়্যাক্ট করা উচিত?
না, মোটেও উচিত না, আমি নিজেকে বললাম, বাড়ি যেতে যেতে।
সৈয়দকে বাড়ি ডেকে ভুলই করেছিলেন আলী হায়দার। সৈয়দ পরদিন ক্ষমা চেয়েছিল। আলী হায়দার সদয় উদারতায় তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। আত্মজীবনী লেখার কাজ শুরু হয়েছিল পরদিন সন্ধ্যা থেকেই। দুতিন ঘণ্টার শোনা এবং লেখা, অতঃপর দুএক পেগ হুইস্কি সেবন। অতঃপর শোবার ঘরের উদ্দেশে আলী হায়দারের যাত্রা, এবং দৃশ্যপটে তানিয়ার আবির্ভাব।
সংক্ষেপে, এভাবে, তানিয়ার সঙ্গে সৈয়দের একটা সম্পর্ক হয়ে গেল। সে দৃষ্টিকোণ থেকেই বাড়ি ডেকে ভুল করার কথাটা বলা হল। সেই সম্পর্কের প্রকাশটাও ছিল সংক্ষিপ্ত। প্রথমে কিছু গভীর দৃষ্টি বিনিময়, কিছু স্পর্শ, কিছু … ইত্যাদি …….
যাহোক, মানব সম্পর্কের, আরও বিশেষ ভাবে মানবমানবী সম্পর্কের, সব খুটিনাটি বর্ণনাটা একটা নিষ্প্রয়োজন কাজ। শোভনও নয়।
৩.
তানিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা তিন মাসে গড়াল। কিন্তু সৈয়দের ওপর কোনো দাবি খাটায়নি তানিয়া। কখনও বলেনি, তোমাকে চাই। অথবা, চলে এসো সব ছেড়ে। যতক্ষণ তার সঙ্গে থাকে সৈয়দ তার মনটা প্রসন্ন থাকে, খুব খুশি থাকে। কিন্তু চলে আসার সময় তানিয়া কখনও বলে না, আরেকটু থাক, অথবা, চিরদিন থাক।
এরকম কিছু শোনার আশা করে সৈয়দ। না শুনে হতাশ হয়, তবে স্বস্তিও পায়। তাসের একটা ঘর দাঁড়িয়েছে মাত্র, একটু হাওয়া দিলেই যদি তা ভেঙে পড়ে।
বাসায় ঢুকতেই কাজের ছেলেটা বলল, মেহমান আইছে।
কে মেহমান?
না, হারেছ মিয়া। রেখার বড় ভাই। বদ লোক, বোন-ঠকানো প্রতারক, রুচীহীন গ্রাম্য মোড়ল। সে কেন এসেছে?
হারেছ মিয়া একটা চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেকক্ষণ হয় এসেছে। আমার গলা শুনে জেগে উঠে সোজা হয়ে বসল। কি চান, হারেছ মিয়া?- আমি একটু কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
কিছুই চাই না, মাস্টার- সে বরাবর আমাকে তাচ্ছিল্য করে মাস্টার বলে ডাকে – শুধু একটা কথা কইতে আইছি।
কথাটা এই : হারেছ শুনেছে আলী হায়দারের বাড়িতে আমি ঘনঘন যাতায়াত করি। হবিগঞ্জ ছোট শহর- পাঁচ মাইল দূরের ত্রিগ্রাম আরো ছোট জনপদ। কার বাড়িতে কে যায়, কখন যায়, এসব মানুষ খেয়াল করে, বিশেষ করে সে বাড়িতে যদি সুন্দরী, স্বামীহীনা, তরুণী থাকে। মানুষ খেয়াল করে আর বলাবলি করে। আর ইচ্ছেমতো কথা সাজায়, গুজব ছড়ায়।
হারেছের কান শোনা-কথায় ভারি। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে খুব স্পষ্ট ভাষায় আমাকে বলে দিল, আলী হায়দার তার মেয়েকে আমার হাতে গছিয়ে দেয়ার মতলব এঁটেছে, কিন্তু সে, হারেছ মিয়া, জীবিত থাকতে এ বিয়ে মেনে নেবে না।
হারেছ মিয়াকে আমার মনে হল একটা বড়সড় পোকা, অথবা প্যাঁচা। এত কুৎসিৎ। আমি তেড়ে গেলাম তার দিকে, প্রথমত কথাটা ডাহা মিথ্যা। দ্বিতীয়ত, যদি সত্যিও হয় এবং তানিয়ার সঙ্গে আমার বিয়েও হয়, তাতে আপনি কথা বলার কে? হু আর ইউ?
আমার গলায় খুব ঝাঁঝ ছিল, তাতে হারেছ মিয়া কিছুটা গুটিয়ে গেল। সে জন্মনিরীহ সাধাসিধা মাস্টার থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি।
আমার রক্তে আলী হায়দারের হুইস্কি ইন্ধন যোগাচ্ছে। আমি হারেছ মিয়াকে প্রায় দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে বললাম, আরেকবার ওই সুরে কথা বলবেন, অথবা আমার জীবনে নাক গলাবেন, তো আপনার জন্য খবর আছে। এখন যান।
হারেছ মিয়া একটু বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাল। তারপর আমার হাত সরিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। তবে এ বসে পড়ায় যে ধপাস শব্দ হল, তাতে মনে হল, তার মুডের পরিবর্তন হচ্ছে।
হারেছ মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিছু মনে করিও না মাস্টর, কথাগুলো কইছি একটা কারণে।
কি কারণে?
আমার বইন- তোমার বৌ,- রেখা, আমার বাবা কুটুম্ব মিয়ার মেয়ে না।
আমি তড়িতাহতের মতো তার দিকে তাকালাম। বলে কী লোকটা?
ওর বাবার নাম আলী হায়দার, যদি জানতে চাও। তবে মা আমাদের একজনই।
একটু খুলে কন হারেছ মিয়া- আমার কণ্ঠে তুমূল উত্তেজনা। হারেছ মিয়া মাথা নিচু করেই জানাল পরিবারের লজ্জার কাহিনীটি। কুটুম্ব মিয়া আলী হায়দারের জমি-জেরাত দোকানপাট দখল করে নিয়েছিল। আলী হায়দার তার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। কুটুম্ব মিয়ার স্ত্রী বিষ খেয়েছিলেন, কিন্তু পরিমাণে যথেষ্ট না খাওয়ায় বেঁচে গিয়েছিলেন। কুটুম্ব মিয়া তাকে সেবা শুশ্রূষা করে ভালো করে তুলেছিল। রেখা পেটে এলে তিনি আবার মরতে চেয়েছিলেন, আবারও কুটুম্ব মিয়ার ভালোবাসা তাকে বাঁচিয়ে দিল। রেখার জন্ম হলে কুটুম্ব মিয়া তাকে আপন মেয়ের মতো দুই বাহু মধ্যে টেনে নিয়েছিল।
আপনি জানলেন কি করে? আমি স্তম্ভিত ভাব কাটিয়ে হারেছ মিয়াকে জিজ্ঞেস করি।
মা মারা যাওয়ার আগে আলী হায়দার তারে দেখতে আইছিল। তুমি তো জানো মাস্টার, মা টাইফয়েডে মারা যায়। যাই হোক, মা তার টাইফয়েডে জ্বরজ্বর শরীর নিয়া আলী হায়দাররে দা দিয়ে কুপাতে গিয়েছিল। আলী হায়দার তখন পাতা-লতার সামনে মারে ওই ঘটনাটা মনে করিয়ে দিয়েছিল। শয়তান। তার ভাগ্য ভালো আমি সে সময় ছিলাম না।
রেখা জানত?
রেখাও জানত। আলী হায়দার তারে নিয়া যাইতে চেয়েছিল। নিজের মেয়ে বলে কথা।
আমি কিছুক্ষণ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম। হারেছের যত ক্রোধ তার বাবা কুটুম্ব মিয়ার ওপর। একটা ভীতু লোক, নিজের স্ত্রীকে একটা শয়তান এমনভাবে…. যা হোক। অথচ কোনো প্রতিশোধ নেয়ার সামান্য ইচ্ছাও জাগেনি মানুষটার মনে। আমার হঠাৎ মনে হল, কুটুম্ব মিয়া লোকটা আসলে একটা বিশাল মানুষ ছিল। অসাধারণ মানুষ ছিল।
আপনি যেখানেই থাকুন, কুটুম্ব মিয়া, এই অধমের সালাম নিন, আমি তার আত্মার উদ্দেশে বললাম। এতদিন আপনার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেছি, সে জন্য ক্ষমা করে দিন।
৪.
আলী হায়দার আমাকে দেখেই বললেন, কাজটা এখন জোরে এগিয়ে নিতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর ইংরেজি অনুবাদটাও বাকি।
আমি বললাম, কুটুম্ব মিয়ার ওপর একটা চ্যাপ্টার লিখতে হবে। আপনি বলবেন কিছুটা, বাকিটা আমি লাগিয়ে দেব।
আলী হায়দার বিস্ময়ে/ক্রোধে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার শরীর কাঁপতে লাগল। তানিয়া এসে তাকে নিয়ে গেল। পরে তানিয়া আমাকে বলল, কুটুম্ব মিয়ার ব্যাপারটা কী?
আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এ প্রশ্নের উত্তর কি তুমি জান না?
তানিয়া কিছু বলল না। তবে তার নীরবতা আমার ভালো লাগল না।
তানিয়া কদিন পর আমাকে বলল, আমি কি কোনো অপরাধ করেছি যে আমার সঙ্গে তোমার ব্যবহার এতটা বদলে গেছে?
আমি বললাম, এর উত্তরটাও তোমার জানা আছে।
আলী হায়দার আমাকে বললেন, শুনেছি তোমার স্ত্রী গত হয়েছে। আমি নিজেও গত হওয়ার পথে। তারপর মঞ্চটা তোমার।
আমি কিছু না বুঝতে পেরে বললাম, একটু খুলে বলুন, কী বলবেন।
তিনি হেসে বললেন, তুমি একটা প্রবাদের কথা বলেছিলে না, সৈয়দকে বাড়িতে ডাকা না-ডাকা নিয়ে?
বলেছিলাম।
তোমাকে আমিই ডেকে এনেছিলাম। আত্মজীবনী লেখাটা একটা উছিলা মাত্র। কারণটা জানবে আমার মৃত্যু হলে। দুই কিম্বা দশ বছর পর। হয়তো আরও আগে।
এখনি বলুন।
আলী হায়দার রাগলেন। তার রাগ বাড়তে থাকল। বাড়তে থাকা রাগ নিয়েই তিনি তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জানালেন। এবং এ-ও জানালেন, রেখাকে তিনি ওই বাড়িসহ কিছু সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন। অনেক আগেই দিয়েছিলেন। এখন রেখা যেহেতু পরপারে ওই সম্পত্তি আসবে আমার অধিকারে।
তাহলে তানিয়া? সে কি পাবে?
আলী হায়দার শীতল গলায় জানালেন, তানিয়ার ব্যবস্থা করা আছে, ও নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে না। তবে, আমি যখন এসব সম্পত্তি পাব, তখন তানিয়াকে বিয়ে করতে পারি, তাতে তার আপত্তি নেই। আফটার অল, তিনি বললেন, ইউ আর অ্যাজ ওয়ার্থলেস অ্যাজ দি আদার টু।
আদার টু অর্থাৎ ওই দুই জেনারেল ম্যানেজার।
৫.
আলী হায়দারের মুখের ওপরেই বলে দেয়া উচিত ছিল আমার, ঠিক আছে, দেখা যাবে কে কতটা ওয়ার্থলেস। কিন্তু বলা হয়নি, কারণ তানিয়া তখন (হয়তো দরজার আড়ালে থেকে) দৃশ্যে এসে ঢুকেছে। ঢুকেই বলেছে, এ ভাঙ্গা বাড়িটা কিন্তু আমার খুব, খুব প্রিয়। তাহলে তো সবই শুনেছে তানিয়া! যা হোক, আলী হায়দারকে কথাগুলো বলা হয়নি বলে একটা আফসোস থাকল, কারণ মাত্র দুসপ্তাহের মধ্যে তার হৃদযন্ত্র সব কর্মকান্ডে ইস্তফা দিয়ে তাকে পরপারে পাঠিয়ে দিল। এখন তাই আমার এক উকিল বন্ধুকে ডেকেছি। সে এলে সম্পত্তি উদ্ধারের মতলব কষা যাবে। কে কতটা ওয়ার্থলেস তা দেখা যাবে। তানিয়ার ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত- হারেছ মিয়া যেদিন আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ওই ভয়ানক কথাগুলো বলে- সেদিনই নেয়া হয়ে গিয়েছিল। রেখার বোন! তাছাড়া রেখাকে কেন জানি হঠাৎ খুব পেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। তার হাতটা ধরে আমার ওই অফিস স্পেসে বসে একটা বই অথবা কাগজ পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। ওই ইচ্ছাটাতে সারা জীবনের জন্য অপূর্ণতার হাহাকার লেগে থাকবে, আমি জানি। তা থাকুক, কিন্তু হঠাৎ আমার ওই একান্ত অফিস স্পেসে আর কারও ছায়া আমার সহ্য হচ্ছিল না।
কি বিচিত্র মানুষের মন। তাই না?
উকিল বন্ধু বলল, উইলটা কোথায়?
কোন উইল?
আলী হায়দারের।
নেইতো!
উকিল বন্ধু হেসে বলল, সেই উইলটা দেখতে হবে না, সর্বপ্রথম?
উইলের সন্ধানে নামতে হয়।
৬.
এরই মধ্যে কুরিয়ার ডাকে একটা বিয়ের কার্ড এসে পৌঁছাল। তানিয়া বিয়ে করছে এক উকিল আনিসুর রহমানকে।
এই প্রথম দেখা যাচ্ছে কোনো জেনারেল ম্যানেজারকে বিয়ে করছে না তানিয়া। গুড লাক তানিয়া।
কিন্তু একটা খটকা লাগল। এত দ্রুত বিয়ে। তার ওপর এক উকিলকে!
খটকাটা ভাঙলেন উকিল নিজে। আমার কলেজে ফোন করলেন ঢাকা থেকে। বললেন, আলী হায়দার মারা যাওয়ার আগে উইল বদল করেছেন। রেখার নামে কোনো সম্পত্তি রেখে যাননি। একটা পয়সাও না। এবং আমার কারণেই ক্রুদ্ধ হয়ে তা করেছেন। বস্তুত ওই ক্রুদ্ধতার কারণে হৃদযন্ত্র তার বেসামাল হয়ে উঠেছিল।
তারপর বললেন বিয়েতে আসবেন কিন্তু। আমি বললাম, উকিল সাহেব, সৈয়দকে দাওয়াত দিয়ে কোথাও নেবেন না। নিলে খবর আছে।
এই কথাটা বলেছিলাম, কারণ আমার সামনে টেবিলে একটা পত্রিকায় একটা সংবাদ বেরিয়েছিল সেদিন, কবর থেকে তিন মাস পর লাশ তুলে পুনঃপরীক্ষা। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, হত্যা।
দেখা যাক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!