ছোট্ট পুরানো রেডীওটায় ঘ্রার ঘ্রার শব্দ । মফিজ খবর শোনার বৃথা চেষ্টা করছে ।অনেক জোরে দুই তিনটা চড় মারতেই বেশ শোনা যাচ্ছে । মফিজ ভাবছে এবার হাতে টাকা পেলে নতুন একটা কিনে নেবে। রেডীও ছাড়া থাকা যায় নাকি ! নাহ্ কিছু ভাল লাগছে না তার। এ চ্যানেল সে চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে হঠ্যাৎ ভেসে আসে একটা গান “মোরা একটি ফুঁলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি মোরা একটি ফুলের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি”- মফিজ যুদ্ধে যেতে চায়, দেশটাকে শত্রুমুক্ত করতে চায় । গানটা শুনতে শুনতে সে হারিয়ে যায় এক অচীন দেশে । পাঁচ বছরের মেয়ে ময়না,বৌ জমিলা আর ওদের ছেলেকে নিয়ে একটা বড় লাল সবুজের পতাকা হাতে সবাই দৌড়ে যাচ্ছে সবুজ ঘেরা মাঠের মধ্য দিয়ে ।ওর বাচ্চা দুটো বলছে “বাজান আমাগো ধরতে পারবা না …হা হা হি হি” মফিজের মনে হল যেন পাখীর কলকাকলিতে সমস্ত পরিবেশটা একটা বেহেস্তে রুপান্তরিত হয়েছে। সে একপাশ থেকে ঘুরে অন্যপাশে শুয়ে ভাবতে লাগল, ওতো এখনও ছেলের নামটাই ঠিক করেনি কি বোকা সে ।কথাটা ভাবতেই আপন মনে হেসে উঠে ।ওর সুন্দর এই জগতে বিঘ্ন ঘটে একটা বোমা ফাঁটবার শব্দে । বুম্!!! মফিজ লাফ দিয়ে পুরোন চৌকিটায় উঠে বসে ।ভয় পেয়ে যায় ভাবে মিলিটারি বুঝি এসে পড়েছে । শুনেছে পাশের দুইটা গ্রাম পরে যে গ্রামটা সেই গ্রামে এসেছে । চেঁচিয়ে বলে “ময়না, ও ময়না কি হইছে এতো জোরে শব্দ হইল কেন্ মা”?! ওর কথা শেষ হতে না হতে জমিলার অস্ফুট চিৎকার শোনা যায় “ আল্লারে মরি গেলাম রে …কলসি ডা ভাঙ্গি গেলোরে … ও মা রে ও বাবা রে !” মফিজ দেখে বারান্দাতে বসে কোমর ধরে জমিলা কাঁদছে আর ময়না মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছ্, কি হয়েছে ভেবে পাচ্ছে না। সে দৌড়ে এসে জমিলাকে ধরে “বউ কি অয়েছে…?” “ঠিক বুঝবের পারতেছি না ……অরে আল্লারে কি ব্যাথা… ওমাগো আমারে বাঁচাও” জমিলার ভীষন কষ্ট হচ্ছে । মফিজ ভেবে পায়না কেবল তো সাত মাস, এখন তো বাচ্চা হবার কথা না । কিন্তু ……ভেবে পেলনা কি করবে ।“ময়না অ মা ময়না যা তোর দাদিরে ডাকি নিয়ে আই”! ময়না দৌড়ে দাদিকে ডেকে নিয়ে এল। “চাচী ও চাচী দেকো দিকিনি কি অয়েছে তোমাগের বউমার” বুড়ী বেশ ডাক্তারদের মত করে পেটের উপরে একটু চাপ দিয়ে কি যেন পরিক্ষা করলেন । “অরে বউ তোর কি চুকা চুকা ডেকুর উডে” জমিলা মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে “তালি ফরে অম্বলের দোস অয়েছে । এই সময় এই রামের এট্টূ আধটু অইবের পারে, তোর ছাওয়াল (ছেলে) একুনি হবি নানে ।” কিন্তু জমিলা ব্যাথা সহ্য করতে পারছে না । প্রায় বেশ কিছুদিন ধরে এমন ব্যাথা অনুভব করছে কিন্তু আজ ব্যাথাটা একটু বেশিই অনুভুত হচ্ছে। সহ্য করতে পারছে না আর তাই বলে ফেলল কথাটা “অরে ময়নার বাপ আমারে বাচাঁও আমি মরে গেলাম গো” ওর কষ্ট দেখে মফিজ এর কান্না পেল …।“অ চাচী আমি কি করুম কউ ছেন দেহি” “এককাম করেক অরে তোর নরেশ কাহা রে দেকাই নিয়ে আয় ……দুই পোটা পানি খাইয়ে দিলি ফরে ব্যাতা পরে যাবে নে” কথাটা মফিজের ভাল লাগল ।ময়না ভাবল ওরা গঞ্জে যাচ্ছে তাই জেদ ধরল সেও যাবে ।সারা রাস্তা্য ময়নার একটাই কথা “বাজান ও বাজান আমারে হলাম হাদা(সাদা) এক্কান বেলুন কিনে দিতি অবেনে ……অ বাজান দিবানে ! কউনা বাজান” “আচ্ছা রে মা দেবোকনে একন তো চুপ করেক, জোরে পা চালা একটাও ভ্যান দেখচি নে”। একটা গাছের নিচে ওরা তিনজন অনেক ক্ষন ধরে বসে রইল…জমিলা পেট চেপে ধরে কুকিয়ে কুকিয়ে বিড় বিড় করে কি সব বলছে ।
রহিমের বাসায় একফোঁটা খাবার নেই ৪টা বাচ্চা, বুড়া মা বাবা ছোট দুটো ভাইবোন নিয়ে ওর অভাবের সংসার ।গ্রামের মেঠো পথে ভ্যান চালিয়ে কোন রকমে জীবন বাচায় । যুদ্ধের কারনে বেশ কিছুদিন ভ্যান চালাতে পারছে না । আজ দুদিন একফোটা খাবার বাসার কারো পেটে পড়েনি । ওদের পাশের গ্রামে আজ দুদিন হল মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে । ওদের গ্রামের এনায়েত চাচা রাজাকারের দলে নাম লিখিয়েছে । আজ বেশ সাহস করে ভ্যান নিয়ে নেমেছে রহিম ।যদি দুটো টাকা পাওয়া যায় তাহলে সবার পেটে কিছু পড়বে এই আশায়। পাশের প্রামে যেতেই দেখে কারা যেন গাছের নিচে বসে আছ্, কাছে যেতেই দেখে মফিজ ।“অরে দোস্ত কিমন আছস?”শুকনো কন্ঠে বলে সে। “দোস্ত এট্টূ ভ্যানে করে নিয়ে যা তর দোস্তানীর পোলা হবে তই মাস পোরে নায় পেডের বেত্নায় কান্তাছে”কথা বলতে বলতে ভ্যানে উঠল সবাই ।রহিমের মনটা বেশ খারাপ দেখলেই বোঝা যায় ।মফিজ তাই জিজ্ঞাসা করে “কিরে দোস্ত কতদিন বাদেক দেকা হল কতা কইতাছস না কেনে ?” রহিম একটা শুকনো হাসি দিয়ে ভ্যান চালাতে থাকে । মফিজ আপন মনে বলে যায় “কিযে শুরু হয়েছে দেশে ,আমিও যুদ্ধে যাইবাম পোলাডা হয়ে গেলি ফরে ।আমার দেশডারে তো আমারই ছত্রুমুক্ত করতে হবিনে । আমার গরের মদ্যি অরা ডুকে পরতি চাচ্ছে এইডে হতি দেবার পারবিক নানে ” ।রহিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বলে না মুখে ।
ডাক্তার দেখে বলেছে সব ঠিক আছে । এইটা গ্যাস্টিকের ব্যাথা। দুই বোতল ঔষধ দিয়েছে খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ময়না কাঁদছে কেননা সাদা বেলুন কিনে দেয়নি ওর বাবা। বিকাল হয়ে গেছে সন্ধ্যার আগেই বাড়ীতে যেতে হবে। রহিম যায়নি আবার ওদেরকে নিয়ে ভ্যানে উঠতে যাবে দেখে এনায়েত চাচা । সাথে ৪ জন মিলিটারি । “ঐ রহিম্মে এধার আ, সাব লগোকো ভ্যানে উডা” এনায়েত কথাটা শেষ করার আগেই সবাই মিলে উঠে বসেছে ।
মফিজ বউকে নিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই এনায়েত বলে উঠল “ কিধার যাইতেচো এধার আও” সাথে সাথে মিলিটারিরা নিজেদের মধ্যে কি সব আলাপ করে এনায়েতকে কি যেন ফিস্ ফিস্ করে বলল । এনায়েত একটা বিস্রি হাসি দিয়ে বলল “ঠিক হায সাব” তারপর ঘটে গেল এক অনাকাংক্ষিত ঘটনা । জমিলাকে নিয়ে টানতে টানতে মিলিটারিরা নিয়ে গেল পাশের জঙ্গলের ভীতরে । ময়না মায়ের হাত ধরে ছিল সেও মায়ের সাথে চলে গেল । মফিজ অনেক বাঁধা দেবার চেষ্টা করল কিন্তু ওর বুকে বন্ধুক ধরে রইল এনায়েত । জঙ্গলের ভিতর থেকে জমিলার আর্তচিৎকার সমস্ত পরিবেশটাকে কম্পিত করে তুলল । রহিম আর মফিজ নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে ইশারায় কথা বলছে যে কি করবে।তারপর ভেসে এল এক পাঁচ বছরের পাখীর করুন আর্তনাদ “ও বাজান আমারে বাঁচাও, বাজানগো আমারে বাঁচাও” পৃথীবির সব শক্তি যেন দুজন পিতার গায়ে এসে ভর করল। রহিম বন্দুকটা কেড়ে নিতে চাইল এনায়েতের কাছ থেকে কিন্তু আনাড়ি রাজাকার এনায়েতের গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল আর সেই ফাঁকে মফিজ বন্ধুকটা কেড়ে নিয়ে এনায়েতের মাথায় খুব জোরে বাড়ি মারতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।বুলেটের শব্দে জঙ্গল থেকে বৃষ্টির মত গুলি আসতে লাগল । ওরা দুই বন্ধু জঙ্গলে প্রবেশ করবার আগেই বুলেটের আঘাতে দুজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।মফিজ একজন মিলিটারিকে লক্ষ করে গুলি ছুড়েছিল । মফিজ খুব অস্ফুট একটা কথা শুনতে পেল “বাজান আমারে সাদা বেলুন কিন্না দিবা না”! একঝাক সাদা পায়রার সাথে উড়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার সাদা বেলুন । মফিজ এক হাতে ময়নার হাত অন্য হাতে ছেলের হাত ধরে দৌড়ে যাচ্ছে আর জমিলা সুখের হাসিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছে ।মফিজের মুখে এক তৃপ্তির হাসি । যে দেশদ্রোহীদের জন্য আজ পরদেশীরা মায়ের বুকে কলন্ক লেপন করার স্পর্ধা পেয়েছে তাদের অন্তত একজনকে সে মারতে পেরেছে । এক সাগর সুখের অনুভূতিতে মফিজ চিরতরে ঘুমিয়ে গেল প্রিয় মায়ের বুকে ।।
শেষ………?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।