ঘরে-পরে, ভেতরে-বাইরে, উপরে-নিচে, ডানে-বায়ে, সামনে-পেছনে প্রতি পদক্ষেপে, প্রতি মুহূর্তে যে জিনিসটি আমাদের সাথে ছায়ার মত ঘুরছে তা হল আঘাত, আপনি যদি গৃহী হন তাহলে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে গৃহিণীর ফরমায়েশি কণ্ঠস্বরে আপনার ঘুম ভাঙবে। শয্যা ত্যাগের মুহূর্তে সে যে বাজারের তালিকা আপনার হাতে ধরিয়ে দেবে তা দেখে আপনার মন ভাঙবে এবং পুনরায় শয্যাশায়ী হওয়ার দারুণ ইচ্ছা আপনার মধ্যে কাজ করবে। কিন্তু সে শয্যা তখন আর ফুলশয্যা থাকবে না কারণ রণসজ্জায় সজ্জিতা গৃহিনীর রণমূর্তি দর্শনে ফুলশয্যা ততক্ষণে কণ্টক শয্যায় পরিণত হবে।
বাজারের তালিকা হাতে নেয়ার অর্থ একটি জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড হাতে নেয়া। যা আপনাকে প্রতি মুহূর্তে দগ্ধ করবে। তালিকার প্রথমে মাছ-মাংস এই জাতীয় অগ্নিমূল্যের দফাটি দেখে আপনার দফারফা হতে পারে। আমিষের চাহিদা মেটাতে আপনার তখন মনে হতে পারে ইস্ নিরামিষভোজী হলে কতই না ভালো হতো। অন্তত এই মুহূর্তে আমিষের জন্য অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করতে হতো না। ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আপনি তখন প্রতি দফার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে হয়ত গলদঘর্ম হচ্ছেন। আর পত্মীকে ভাবছেন এ যেন একটা সাক্ষাত পেত্মী যার কাজ পতিকে ভূপাতিত করা। অগ্নিমূল্যের দরুণ যে দফাটি আপনাকে সর্বাগ্রে পেরেশান করবে তা হল মাছ, মাংস। নাকাল করা দফাটিকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব করলে পত্মী দপ করে জ্বলে উঠতে পারে এবং আপনার অক্ষম পৌরুষে মোক্ষম আঘাত হানতে পারে। বলতে পারে মাছ মাংস খাওয়ানোর মুরোদ নেই তো বিয়ে করা কেন? পৌরুষে আঘাত লাগলে নাকি অনেকের টনক নড়ে। আসলে আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে হলে টনক নড়ে। টনক নড়লে আপনার মনে হবে পত্মী তো আসলে হস্তিনী। পত্মী পোষা হস্তিনী পোষারই নামান্তর। তখন মনে হবে আপনি এমন হস্তিনী গৃহে এনেছেন যেটা পোষা নয় বুনো। এই হস্তিনী আপনাকে বিভিন্নভাবে আঘাত করছে কখনও হস্ত, কখনও পদ, কখনও বৃংহন দ্বারা। আর আপনি এমন মাহুত যার কাছে হস্তিনী নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র অংকুশ অনুপস্থিত। এই অবস্থায় হস্তিনীর নিরংকুশ প্রাধান্যে মাহুত আহত বা কালে ভদ্রে নিহতও হতে পারে। সুতরাং এই মুহূর্তে হবু পতিদের জন্যে আমার একটা পরামর্শ থাকবে তারা যেন অংকুশ যোগাড় করে পত্মী গ্রহণ করে, আর যারা সপত্মীক অংকুশ না থাকলে তারা যেন শিগগির তা যোগাড় করে নেয়। তা না হলে ওই মাহুত বেচারির মত আপনিও বহুত আঘাত পেতে থাকবেন যেটা একান্তই অকাম্য।
এতো গেল ভেতরের আঘাত, এবার বাইরের আঘাতের কথা বলি। যানবাহন দুর্ঘটনা আমাদের দেশে এতটাই নিয়মিত যে এটাকে এখন আর দুর্ঘটনা না বলে স্বাভাবিক ঘটনাই বলা উচিত। বাস, ট্রাক, লঞ্চ, ফেরি, ট্রেন, বিমান ইত্যাদি যানের বেপরোয়া চালনায় কখন যে আপনার মূল্যবান জানমালের বিনাশ ঘটবে তা আপনি মালুম করতে পারবেন না। আঘাতের ক্ষেত্রে একশ্রেণীর যানবাহন এতটাই দুর্নাম অর্জন করেছে যে সেগুলোকে এখন ঘাতক বলে সম্বোধন করা হয়। যেমন- ঘাতক ট্রাক। জুতার হরেক রকম ব্যবহার সমাজে প্রচলিত। প্রথমতঃ পরিধান সামগ্রী জুতা সর্বদাই শীর্ষস্থানীয় এজন্য ইংরেজিতে একটি প্রবাদের চল আমরা লক্ষ করি ” A gentleman is known by his shoes” তার মানে একজোড়া জুতসই জুতা একজনকে যেমন জাতে ওঠাতে পারে তেমনি ওই জুতা অন্যের জাতও মারতে পারে। অবশ্য জাত মারার কাজটি বজ্জাত লোকেরাই করে থাকে। তারা চটি দিয়ে চোট দেয়, বুট দিয়ে হুট করে যাকে তাকে হিট করে। মোকাসিনের আঘাতে অবস্থা কেরোসিন করে। হিলের গুতোয় হ্যাংলাদের দেহে হিল্লোল তোলে। নাগরা দিয়ে নিরীহ নাগরিকদের বাগড়া দেয়, পাদুকাঘাতে পথচারীদের অপদস’ করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে জুতা জেতায় আবার জাঁতায়।
ঝকঝকে দাঁতের ঝলমলে হাসি দর্শনে দর্শকমনে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দাঁতের ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি নেতিবাচক ভূমিকাও আমরা প্রায় দেখতে পাই। বিভিন্ন পশু-পাখির মাংস কর্তনে যে দাঁত সক্রিয় থাকে সেই দাঁত যদি মানুষের মাংস ছেদনে মুখিয়ে থাকে তাহলে দাঁতের অপব্যবহারই প্রশ্রয় পায়। এক চড়ে বত্রিশ দাঁত ফেলানোর মত হুঁশিয়ারি আমরা এন্তার উচ্চারণ করি। কিন্তু লক্ষ করি না বত্রিশটা দাঁত ঠিকমত আছে কিনা। কারণ দাঁত রক্ষা করা রীতিমত সাধনার ব্যাপার। এরকম সাধক বাংলাদেশে কেন সারা পৃথিবীতেই দুর্লভ। সুতরাং দাঁত ফেলিয়েদের দুর্ভাগ্য যে তারা প্রায়শই তাদের মনোবাঞ্ছা থেকে বঞ্চিত হয়। আমাদের কামনা সমাজে যেন এইরকম বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। গাছের জন্য যেমন পাতা সন্তানের জন্য তেমনি পিতা অতি গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে পিতার নাম যে কত প্রয়োজনীয় তা বলাই বাহুল্য। ওজু যেমন নামাজের চাবি তেমন পিতার নাম কোন সনদ বা আবেদন পত্রের চাবি-কাঠি হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু সেই নাম ভুলিয়ে দেবার জন্যে যদি কেউ আঘাত দেয়ার পাঁয়তারা করে তবে সেই ঘাতকদের ঘা-কতক বসিয়ে দিতে হবে। আঘাত দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিতে চাইলে বাপ-মা-বেটা-বেটি মিলে সেই আঘাত প্রতিহত করার প্রচেষ্টায় সম্মিলিত ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে পুত্র তার পিতা, নাতি তার প্রপিতার নাম স্মরণ রাখতে পারে।
ওষুধ যেমন জীবন রক্ষা করে তেমন নাশও করে, অভিজ্ঞ ডাক্তার রোগীর রোগ লক্ষণ ভালো ভাবে শনাক্ত করে তা প্রতিরোধের জন্য উপযুক্ত ওষুধ নির্বাচন করে। এই সমাজের মাথাওয়ালারা সমাজের দুষ্টক্ষত নিরাময়ের জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপরূপে মারকে সবচেয়ে পছন্দনীয় ব্যবস্থা বলে গ্রহণ করে। তাদের নীতিমালা হল ‘মারের উপরে ওষুধ নাই’ এই জন্য তারা সহজেই অন্যান্য ওষুধকে অগ্রাহ্য করে।
ভূত আছে কি নেই সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে ভূতুড়ে কান্ড ঠিকই আছে। যাকে আমরা অন্যভাবে অদ্ভূত কান্ডও বলতে পারি। তবে বাংলাদেশে যে ভূতের অস্তিত্ব বেশ তীব্র তা কয়েকটি প্রবাদ বা বাগধারার মধ্যে দারুণভাবে ক্রিয়াশীল। তা না হলে সর্ষের মধ্যে ভূত থাকে কি করে? তবে ভূতের অভয়ারণ্য সর্ষে ক্ষেত এখন দারুণভাবে কমে যাওয়ায় সর্ষে ভূত থাকার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এতে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই, কেননা ভূতেরা এখন সর্ষের মত অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র অন্যান্য মাধ্যমে সদর্পে ঢুকে পড়েছে। মানুষ মরলে নাকি ভূত হয় তবে জীবিতাবস্থায় কেউ ভূত হলে তার ভৌতিক কার্যকলাপে সংসারে অশান্তি নেমে আছে। এক্ষেত্রেও কি প্রতিকার হিসাবে মারকে পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে রাখা যায়? কেননা কথায় বলে “মারের আগে নাকি ভূত পালায়”।
ঢিল মারলে পাটকেল খেতে হয়। তার মানে লঘুপাপ গুরুদণ্ড নিয়ে আসে। এখন পাটকেল খাওয়ার জন্য ঢিল ছুঁড়তে হয় না। রাস্তাঘাটে, খেলার মাঠে, মিছিল মিটিং জনসভা ইত্যাদি জায়গায় নিরীহ দর্শকগণের উপর আচানক পাটকেল, পটকা এমনভাবে এসে পড়ে যে সটকে পড়ার কোনও উপায় থাকে না। এ ধরনের আকস্মিক আঘাতে হতভাগা দর্শকগণ মাঝে মাঝে পটল তুলে, আর যারা জখম হয় তারা তাদের দর্শনেচ্ছা চিরদিনের জন্য শিকেয় তোলে।
কেলি করতে করতে কিলাকিলির মত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে শিশু কিশোরদের মধ্যে আঘাত দেয়ার এই দফাটি বেশ জনপ্রিয়। কোলাকুলিরত শিশুরাই আবার কিলাকিলিতে লিপ্ত হয়। কিলাকিলিটা যদি কেলির মধ্যে সীমিত থাকে তাহলে কোন সমস্যা থাকে না। কিন্তু কখনও সখনও তা কেলেঙ্কারির পর্যায়েও চলে যায়। কোলাহল ভালো কিন্তু কেলেঙ্কারি নয়। চৌর্যবৃত্তি যে সর্বদা নিন্দাই তা কিন্তু নয়। কিল খেয়ে কিল চুরি করার মত লোক কদাচিৎ দেখা যায়। সুতরাং কিল চোরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ পক্ষান্তরে জনসমাজে ধৈর্যের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া যেটা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। আমরা চাই আমাদের সমাজে কিল চোরের পাশাপাশি কিল ডাকাতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হোক। গাছ পাকা কাঠালের স্বাদ অতুলনীয় কিন্তু সেই কাঠাল যদি আগেই পাকানো হয় তা হলে তা বিস্বাদ হওয়াই স্বাভাবিক। একটা জিনিসকে পরিপক্ক করতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সে ধৈর্য বা অপেক্ষার অভাব আমাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রকট। এজন্য আমরা অনেক সময় কিলিয়েই কাঠাল পাকাই। আর এই অকালপক্ক কাঠাল আমাদের পাকস্থলীতে গিয়ে যে ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি তাতে ওই যন্ত্রে পচন শুরু হয়। আর ওই পচনকে কোন পাঁচন দিয়েই রোধ করা যায় না।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।