আখের জন্য ভালোবাসা — ডা. সোনিয়া সাইমুম বন্যা

ডিম এবং কলা বিষয়ের পর ভাবছিলাম এবারের লেখার বিষয় কি হবে? ভাবতে ভাবতে একটা গল্প মনে পড়লো। এক জামাই গেছে শ্বশুরবাড়ি। শাশুড়ী দেখলো জামাইয়ের দাঁতের অবস্থা একেবারে করুণ। যেমন নোংরা তেমন হলুদ। কিন্তু লজ্জায় জামাইকে বলতেও পারছেনা যাও বাবা ব্রাশ করে আসো। অবশেষে জামাই বাবাজীর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললো, যাও বাজারে গিয়ে আখ কিনে খাও। জামাই ভাবলো আখ এর চেয়ে সেদ্ধ ডিম আর কলা খাই। এতে পুষ্টিও বেশী (সম্ভবত আমার লেখা দু’টো তার পড়া ছিলো) অবশেষে সে ডিম আর কলা খেয়ে শ্বশুরবাড়ি যেয়ে ক্লোজআপ মার্কা হাসি দিলো। হাসিটা ক্লোজআপ মার্কা হয়েছিলো কিনা সেটার ভার দিলাম পাঠকদের হাতে। তবে টাকাগুলো যে পানিতে পড়েছিলো এ বিষয়ে কোন দ্বি-মত নেই। কারণ আখ হলো প্রাকৃতিক ব্রাশ।

আর তাই এবার ডিম কলা ছেড়ে আখ নিয়েই বসলাম। তবে কলার মতো খেতে খেতে নয় কারণ আখ বিষয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।

১২ বছর আগের কথা। আমি তখন মেডিক্যাল স্কুলে পড়ি। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাই। এমন এক ছুটির সময় ভাগ্নে জান্নাত এসে বলল খালামণি ‘‘কুষুরটা ছুইলি দ্যাওতো।’’ কুষ্টিয়াতে আমরা আখ কে কুষুর বলি। কুষ্টিয়ার কুষুরের আর একটা নামও অবশ্য আছে, লোহাড্যাঙ কুষুর। নাম শুনেই নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে এর কেরামতি। তবে এই লোহাড্যাঙ কুষুর থেকেই কিন্তু চিনি হয়।

কুমির আর শিয়ালের গল্পে শুনেছিলাম দু’জন মিলে ক্ষেত করেছিলো। কথা ছিলো ফসল উঠলে শিয়াল পাবে নিচের অংশ আর কুমির পাবে উপরের অংশ। শিয়াল পন্ডিত সেবার নিচের অংশ পেয়ে খুব মজা করে খেয়েছিলো কিন্তু আমি নিশ্চিত সে যদি কুষ্টিয়ার এই লোহাড্যাঙ কুষুরের চাষ করতো তবে পরবর্তী বছর তাকে হয় বালির চাষ করতে হতো নয়তো ডেনটিস্টের আশে পাশে ঘুরঘুর করতে হতো দু’পাটি দাঁত বাঁধিয়ে নেয়ার জন্য।

আমি সাধারণত কুষুরের এই গুণের জন্য কখনো দাঁত দিয়ে ছিলে খাইনা। যথারীতি দাঁ দিয়ে ছিলে ছিলেই খাই। তো ভাগ্নে এসেছে তাকে তো আর বলতে পারি না দাঁ নিয়ে এসো। হাতে নিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে সোফায় বসে আয়েশী ভাবে দিলাম একটা কামড় কুষুরের গিটে। তারপর একটা কড়াৎ শব্দ। দেখলাম কুষুরের গিটটা ঠিকই আছে তবে আমার চোয়ালের গিটু আলগা হয়ে গেছে। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। মুখ হা করতে পারিনা, কথা বলতে পারিনা, কিছু খেতেও পারিনা চিবিয়ে। শুধু তরল খাবার কোনরকমে গলাধকরণ করতাম। ভাগ্যিস জান্নাত ততোদিনে ফিডার ছেড়ে দিয়েছেলো, নয়তো গলায় গামছার বিব বেঁধে আমাকে ওর ফিডারে ভাগ বসাতে হতো। (ওর ফিডারে দুধ দিয়ে গলায় গামছা রেখে চুপি চুপি খেতে গিয়ে একবার ধরা পড়েছিলাম। আববু দেখে আম্মুকেও ডেকে দেখিয়েছিলো। মান সম্মান তলানীতে ছুঁই ছুঁই অবস্থা।)

যাই হোক, এতো বড় মেয়ের জন্যতো আর বাজার থেকে ফিডার কিনে আনা যায়না। সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক আমি। জ্বর নেই, জন্ডিস নেই, মুখে অরুচিও নেই, ব্যথাও নেই কিন্তু খেতে পারছিনা। মনে হলো ‘‘ফাবি আইয়্যি আলায়ি রাবিবকুমা তুকায্যিবান’’ (তোমরা আল্লাহ্র কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?)

আল্লাহ্ কত সুন্দর করে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। কোন কিছুই অপ্রয়োজনে তিনি সৃষ্টি করেননি। অথচ আমরা বেশীরভাগ সময়ই তার নিয়ামতের শোকর আদায় করতে ভুলে যাই।

এলাকার ডাক্তার রেফার করলো কুষ্টিয়া, সেখান থেকে ঢাকা। ডাক্তার দেখে শুনে কিছু টেস্ট করাতে দিলেন। ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডের একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সব টেস্ট করিয়ে আবার ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখালাম। ডাক্তার বললো ‘এক্সরে রিপোর্ট পরিস্কার আসেনি।’ আবার করতে হবে। কিছু কিছু মানুষ এখনো যে ভালো তার প্রমাণ দিলো সেই ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যখন জানলো ডাক্তার তাদের রিপোর্ট ভালো বলেনি তখন এক্সরের সার্ভিস চার্জ ফিরিয়ে দিলো। ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক থেকে আবার করিয়ে ডাক্তারকে দেখালাম। ডাক্তার বললো, রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়েছে। অর্থাৎ চোয়ালের দুই হাড় ম্যাক্সিলা ও ম্যান্ডিবুল এর সংযোগস্থল এর জোড়া (ঞগ ঔড়রহঃ) স্থানচ্যুত। এর ফলেই মুখ খুলতে পারছিনা। কিছু মেডিসিন আর এক্সরসাইজ দিয়ে বললো এতে কাজ না হলে পরবর্তীতে অপারেশন করতে হবে গাল কেটে। টেনশনে আম্মুর ব্লাড প্রেশার গেলো বেড়ে। মেয়েটার এখনো বিয়ে হয়নি। এখন অপারেশন করতে হলে বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ কি বলবে?

অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগে আমি যখন ক্লাশ এইটে পড়তাম তখনও তার ব্লাড প্রেশার বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আম্মু বলতো আমি নাকি ‘‘পুকাইড়ি মেয়ে।’’ ডান হাতের তর্জনীতে টিউমার হলো। নাটোরের বনপাড়া মিশন হাসপাতাল থেকে অপারেশন করিয়ে সাত দিনের মাথায় যখন সেলাই কাটতে গেলাম তখনই মনে হলো টিউমারটা রয়েই গেছে। তারপর থেকে আরো দ্রুত সেটা বাড়তে থাকলো। ডাক্তার দেখে বললো, ৬মাস পার না হলে হাতটাকে বাঁচানো যাবে না। আঙ্গুল কেটে ফেলতে হবে। এদিকে টিউমারটাও বাড়তে থাকলো তার চাপে আঙ্গুলের হাড় চিকন হয়ে গেলো। হাত দিয়ে কলম ধরতে পারতাম না। আমি তর্জনী বাদ দিয়ে মধ্যমা দিয়ে লেখার প্র্যাকটিস করতাম। অবশেষে ৪মাস পরেই ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেয় দ্বিতীয় অপারেশনের। এখানেও মজার ব্যাপার হলো দ্বিতীয়বার মিশন হাসপাতালের ডাক্তাররা আর অপারেশন চার্জ নেয়নি। কারণ ভুলটা তাদের ছিলো।

যাই হোক, আম্মু টেনশন করতে থাকলো। আর আমি মুখের ব্যায়ামগুলো করে যেতে থাকলাম। ব্যায়ামগুলো এতোটা বিচ্ছিরি ছিলো যে আমাকে বেশির ভাগ সময় লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে করতে হতো। নইলে যে কেউ হঠাৎ দেখে ভাববে হয়তো আমি বাঁদর প্রজাতীর কেউ নয়তো বাঁদর হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। বিভিন্ন কিসিমের ভেংচি কাটতে হতো সারাক্ষণ। সেই সময় পরিচয় সাইমুমের সাথে। আমার তখন শক্ত কোন কিছু খাওয়া, জোরে হাসা নিষেধ। সাইমুম আমার ভেংচিগুলোর বিভিন্ন নাম দিলো। কোনটা ক্যাট ভেংচি, কোনটা র‌্যাট ভেংচি, কোনটা বা মানকি ভেংচি। তবে আল্লাহ্র অশেষ কৃপায় সুস্থ ও স্বাভাবিক হলাম অপারেশন ছাড়াই। ভেংচি থেরাপীতে কাজ হলো।

তার বছরখানেকের মধ্যে বিয়ে হলো। আমার শ্বশুরমশাই দেখতে এসে প্রথমেই বললো- ‘‘আম্মু তোমার ৩পাটি দাঁত?’’ পরে শুনলাম সবাই যখন জানতে চেয়েছে মেয়ে কেমন? সাইমুম বলেছে সবকিছু ভালই তবে দাঁত ৩পাটি।

ব্যাপারটা হলো ছোটবেলায় যখন দাঁত পড়া শুরু হলো একটা নড়লেই আম্মুকে দেখাতাম। আম্মু দেখে শুনে সুতোয় একটা বিশেষ ধরনের গিট দিয়ে দাঁতে লাগিয়ে দিতো। তারপর আস্তে আস্তে টান দিতো। আমি ভাবতাম এই বুঝি টান দিলো এই বুঝি টান দিলো। চিৎকার করতাম। এমন করতে করতে যখন বুঝতাম আজ হয়তো আর তোলা হবেনা ঠিক তখনই হ্যাঁচকা টান। দাঁতটা হাতে ধরিয়ে আম্মু রক্ত বন্ধ করার ঔষধ তুলায় চেপে লাগিয়ে দিতো। দাঁতগুলো এখনো জমা আছে। শুনেছি ইঁদুরের গর্তে ফেলে দিতে হয় কিন্তু ইঁদুরকে দেওয়ার মতো অতবড় বিশাল মনটা ছিলোনা হয়তো তাই নিজের সম্পদ নিজের কাছেই রেখে দিতাম। অথবা ইঁদুরের গর্ত খোঁজার মতো দস্যিও ছিলাম না। যাই হোক, দাঁত তোলার এই রকম অভিজ্ঞতার জন্য অনেক সময় দাঁত নড়লেও আম্মুকে জানাতাম না (আবার সেই সুতা আবার সেই টান)। পরে কিছু দাঁত ডাক্তার তুলে দিয়েছিলো। আর কিছু তুলতে দেরী হওয়ায় পাশ দিয়ে নতুন দাঁত বেরিয়েছে অাঁকা বাঁকা হয়ে। এই হলো আমার ৩পাটি দাঁতের গল্প।

তো বিয়ের পরও অনেকদিন আমি আখ খাইনি দাঁত দিয়ে ছিলে। সাইমুম ছোট ছোট করে কেটে দিতো। আমিও খুব মজা পেতাম, উপভোগ করতাম ওর এই আন্তরিকতাটুকু।

অবশ্য ছোট বেলা থেকেই ছোট মেয়ে হিসেবে আদরের কমতি ছিলোনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘আমার ছেলেবেলা’’ গল্পের মতো তিনি যেমন ইচ্ছে করে ঘর বাধাবার জন্য চেষ্টা করতেন যেন ইস্কুলে যেতে না হয় তেমন বুদ্ধিও করতাম মাঝে মাঝে। কোনদিন পেট ব্যাথা বলে অথবা মুখে আঙ্গুল দিয়ে বমি করে স্কুল ফাঁকি দিয়েছি তার হিসেব নেই। আম্মু এখনও জানেনা তবে লেখাটা পড়ার পর কিছু বকুনী যে কপালে আছে বেশ বুঝতে পারছি। ছাত্রী হিসেবে প্রথম বেঞ্চের ছিলাম না। আবার একেবারে পিছনের বেঞ্চে বসার মতোও ছিলাম না। প্রতি ক্লাসেই উতরে যেতাম ভালভাবেই। কিন্তু আপু বরাবর ফার্স্ট হতো। ভালো ছবি অাঁকতো, ইসলামী সঙ্গীত, হামদ-না’ত-এর প্রথম প্রাইজও আপুর দখলে থাকতো। তাই হয়তো মনে মনে একটু হিংসেও ছিলো। মনে হতো সবাই যেনো আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে জ্বর হতো। সবাই আমাকে নিয়ে টেনশন করতো। আমি খুব মজা পেতাম। মনে হতো প্রতি মাসে জ্বর হোক। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকার দূরত্ব এখন কমলেও তখন অনেক সময় লাগতো। মনে পড়ে আমি অসুস্থ হলে আববু-আম্মু রাজশাহী-ঢাকা একাকার করে ফেলতো। অথচ আববু অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর সময়ও পাইনি তার আগেই সে চলে গেছে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে।

আবার দাঁতের প্রসঙ্গে আসি। দাঁত ২পাটি বা ৩পাটি হোক অসুবিধা নেই। কিন্তু দাঁতের ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত, প্রতিটি মানুষের। কারণ বেশির ভাগ মানুষেরই ভুল ধারণা থাকে ৩২টা দাঁতের ২/১টি তুলে ফেললে ক্ষতি নেই। কিন্তু তোলার পর বুঝতে পারে কি হারিয়েছে।                আর তাই দাঁত ও মুখের সঠিক যত্ন, পরিচর্যা ও আত্মসচেতনাতার মাধ্যমে দাঁতের কিছু সাধারণ রোগ প্রতিকার করা সম্ভব।

জিনজিভাইটিস ও পেরিওডটাইটিস

জিনজিভাইটিস হলো মাড়ি যা দাঁতকে চারপাশে ঘিরে রাখে সেই মাড়ির কোষকলার (টিস্যু) ইনফ্লামেশন। একে পাইরিয়াও বলে।

সাধারণত নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করলে বা তাড়াহুড়া করে অসাবধানে ব্রাশ করার ফলে দুই দাঁতের মাঝে বা দাঁত ও মাড়ির সংযোগ স্থলে যে প্লাক জমে তা পরিষ্কার হয় না। এভাবে খাদ্যকণার সাথে ব্যাকটেরিয়া ও মিউকাস মিশে শক্ত পাথরের মত হয়। একে ক্যালকুলাস বলে। এই ক্যালকুলাস জিনজিভাল টিস্যুতে ইনফ্লামেশন শুরু করে।

আর জিনজিভাইটিস যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে ক্যালকুলাস আরো নিচে নেমে দাঁতের শিকড় ও হাড়ে ক্ষত সৃষ্টি করে তাকে পেরিওডন্টাইটিস বলে।

বয়স্কদের দাঁত পড়ে যাওয়ার এই প্রধান কারণ পেরিওডন্টাইটিস। সাধারণত দাঁত শিরশির করা, মাড়ি ফুলে যাওয়া, ব্রাশ করার সময় রক্তপড়া, মুখে দুর্গন্ধ বা খাদ্যদ্রব্যে স্বাদ না পাওয়া, মাড়ি দিয়ে পুঁজ পড়া, দাঁত আলগা হয়ে যাওয়া এসব রোগের লক্ষণ। প্রতিদিন সকালে খাওয়ার পরে ও রাতে ঘুমানোর আগে নরম টুথব্রাশ দিয়ে সঠিকভাবে ব্রাশ করে, ফ্লোরাইড যুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করে, ক্লোরোহেক্সিডিন যুক্ত মাউথ ওয়াশ দিয়ে কুলি করে, অধিক চিনি যুক্ত খাবার না খেয়ে, তামাক এলাকোহল পরিত্যাগ করে আমরা দাঁতের এসব রোগকে দূরে রাখতে পারি।

আবার ফিরে আসি কুষুরের প্রসঙ্গে। সম্মানিত পাঠক আমার কসুর মাফ করবেন। জুন সংখ্যায় আশীষ-উর-রহমান তার বাজার ভরা মধুর ফল এ লিখেছেন আম, জাম, কাঁঠাল,তালশাষ, লিচু এগুলো বছরের ফল। সে হিসেবে কুষুর নিশ্চয়ই বছরের লাঠি। আমার পিচ্চিটা কুষুর খেতে খুব পছন্দ করে। তার বাবার সামনে অবশ্য কুষুর বলা যাবে না। কারণ বললেই তার একটা বাঁকা হাসি আমার জন্য বরাদ্দ হয়ে যাবে। যার অর্থ- কুষ্টিয়ার মেয়ে আমি। আর কুষ্টিয়ার ভাষা অনেক মিষ্টি (কুষুরের মতো) ও রাজকীয়। কিন্তু ভাষায় অপভ্রংশ তো প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে আর আঞ্চলিকতা বা শব্দ ও তো একেক জায়গায় একেক রকম। কুষ্টিয়ার অনেকেই বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলে, কুইষ্টি। বরিশালে বারান্দাকে বলে ‘‘হাইতন্যা।’’ এমন অনেক শব্দ আছে ওদেরও যা দোভাষী লাগে বুঝতে। জাম্বুরাকে আমরা বলি বাদাম। কেন বলি জানিনা, চীনাবাদাম এর সাথে গাছেও মিল নেই, ফলেও মিল নেই, স্বাদেও মিল নেই তবু বলি।

তো সুহাকে শিখিয়েছি আখ বলবে। সে বলে কাক। কাকের সাথে ওর মিলও আছে। শুনেছি কাকেরা ৩এর বেশি গুনতে পারেনা। সুহারও সেই অবস্থা। এক, দুই, তিন, পাঁচ, ছয়, সাত পড়ে। চার বলেনা কখনোই। কাকের সাথে আমার বড় মেয়েরও অনেক সখ্যতা ছিলো। ছোট বেলায় প্রিয় পাখির নাম জিজ্ঞেস করলেই বলতো কাক আর পেঁচা। আসলে ইট, কংক্রীটের ঢাকা শহরে কাক ছাড়া অন্য কোন পাখির বিচরণ নেই বললেই চলে।

আর তাই কবিতার কাককে সরিয়ে নিজেই সে স্থান দখল করেছিলো। বলতো-

‘‘আয়রে খোকন ঘরে আয়

দুধ মাখা ভাত সাবা খায়।’’

রাস্তার পাশে ডাস্টবিন গুলোতে যখন কাকেরা সভা সেমিনার করতো সাবা দাঁড়িয়ে পড়তো ওদের মূল্যবান বক্তব্য শুনতে। একবার সাবার দাদু একটা কাকের বাচ্চা ধরে আনলো, বাসার সামনের নারিকেল গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলো সে। সাবার আনন্দ তখন আর ধরেনা কি খাওয়াবে কোথায় রাখবে সে এক হুলস্থুল ব্যাপার। তো কুষুর মশাই এখন কাক হিসেবে আমাদের বাসায় নিমন্ত্রিত হন। কারণ, সুহা তার বাবাকে বাজার থেকে কাক আনতে বলে দেয়।

এই আখের রয়েছে বেশ পুষ্টিগুণ। শর্করা সমৃদ্ধ, খনিজ লবণ ও অল্প ভিটামিন আছে এতে। অতিরিক্ত পরিশ্রমের পর আখের রস খেলে দ্রুত এনার্জি ফিরে পাওয়া যায়। অাঁখের রস-

ঠান্ডা, জ্বর, গলার ক্ষত সারায়, জন্ডিস ও চোখ জ্বালাপোড়াতে কার্যকরী,

দেহকে ঠান্ডা রাখার পাশাপাশি শক্তি বাড়ায়,

কিডনী, হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্ক ভাল রাখে,

বিপাক ও হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে,

ক্যান্সার প্রতিহত করে

দাঁতের ক্ষয় রোধ করে ও

প্রস্রাবের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে।

তবে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য এটি নিষিদ্ধ।

আখের আরো কিছু গুণ আছে। বর্তমানে যেভাবে হরতাল হচ্ছে পিকেটাররা লাঠির পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারে। অবসরে এনার্জিও পাবে প্রয়োজনে পিকেটিংও করতে পারবে। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে মিষ্টিমুখ (আখমুখ) করানো যাবে। আবার বন্ধু হিসেবেও আখকে রাখা যায় কাছে। নির্দিষ্ট স্টপেজের আগের স্টপেজে বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় একটি আখ হতে পারে ভাল বন্ধু। প্রতিদিন নির্দিষ্ট ১৫ অথবা ৩০ মিনিট হাঁটার সময়টুকু আখ খেতে খেতে নির্ভাবনায় চলে যেতে পারেন।

সবশেষে একটা গল্প বলে শেষ করি। দুলা ভাই গিয়েছে তার শ্যালককে নিয়ে কোন এক পাত্রী দেখতে। শ্যালকের পাত্রী পছন্দ হয়নি। কিন্তু দুলাভাইকে বলতে পারছেনা। এদিকে বাড়িতে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। শ্যালক বদনা নিয়ে চলে গেলো বাড়ির পাশের আখ খেতে। সবাই ভাবলো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছে। অনেকক্ষণ তার কোন সাড়া শব্দ নেই। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে বদনা পেলো কিন্তু ততক্ষণে শ্যালক উধাও। অাঁখ খেতের পাশেই ছিলো রেল লাইন। কিছুক্ষণ আখ খেতে লুকিয়ে কোন এক মেল ট্রেনে উঠে পগার পার। ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধের কিছু পরের। আর ঘটনার নায়ক আমার আববু। আর তাই আমার ঞগ লড়রহঃ খুলে দেওয়ার জন্য আখ দায়ী থাকলেও আখের জন্য ভালোবাসা কমতি নেই।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!