আকাশলীনার মা—- ধ্রুব এষ

‘যুদ্ধে যাব।’
শুনেই মা কান্না শুরু করে দিল। তাও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে না, একেবারে হাউমাউ করে কান্না। টপটপ করে চোখের জল পড়ছে আর কাঁদছে। কান্না জড়িয়ে-মড়িয়ে বলল, ‘যুদ্ধে যাবা, হ্যাঁ? যাও! যাও-ও-ও-ও-ও-ড়ও! কে আটকায়? ও-ও-ও-ও-ও! কে তোমারে আটকায়, হ্যাঁ? ও-ও-ও-ও-ও! আমারে কে দেখব রে আল্লা? ও-ও-ও-ও-ওঃওঃ!’
ভাবলাম বলি, আমি দেখব। কিন্তু তাতে কান্না আরও বাড়বে।
হারিকেনের আলো মায়ের কান্নায় পড়েছে। বড়দাদা আর আমার মুখেও পড়েছে।
আমাদের এই তিনজনের সংসার। মা, বড়দাদা আর আমি। বাবা মারা গেছে যখন কিনা আমার বয়স দুইও হয়নি। বাবার কথা কিছুই মনে নেই আমার। তার কোনও ছবিও আমি দেখিনি। নানু বলে, বড়দাদা দেখতে অবিকল বাবার মতো হয়েছে। ঠিক এরকম লম্বা আর ফরসা, আর বড় বড় চোখ ছিল নাকি বাবারও। হয়তো। কিন্তু একজনের মতো অবিকল আরেকজন মানুষ হয় নাকি? কে জানে?
আমি এখন পড়ি এইটে। কৃষ্ণনগর বহুমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। বড়দাদা পড়ে টাউনের কলেজে। রোজ আট মাইল হেঁটে কলেজে যায়, হেঁটে ফেরে। টাউনে হোস্টেল আছে কলেজের। বড়দাদা সেই হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করতে পারে। কিন্তু থাকবে না। আসল কথা মাকে ছেড়ে পারবে না থাকতে। মা-ই আমাদের বাবা আর মা। পক্ষীমাতার মতো আগলে রেখেছে আমাদের।
আমার নাম চমন আফরোজ (লীনা)। চমন আফরোজ স্কুলের স্যার-আপারা ডাকেন। কিন্তু লীনা কেউই ডাকে না। মা আর অন্যরা ডাকে, লীনু। বড়দাদা ডাকে, আকাশলীনার মা। বলে, ‘তোর নাম হইল লীনা। তোর একটা মেয়ে হইব। তার নাম রাখবি আকাশলীনা।’ কী কথা! বড়দাদার নাম আবুজর গিফারী। ডাকনাম টুনু। বড়দাদার নাম রেখেছিল বাবা আর আমার নাম রেখেছে মা। এই নিয়ে বড়দাদা যে কিরকম খেপায় মাকে।
‘কাজটা তুমি ভালো কর নাই, খুকি।’

 
‘কোনটারে, বাপ?’
‘এই যে মেয়ের নাম লীনা রাখছ।’
‘ক্যান? তাতে কি দোষ হইল?’
‘দোষ? এ তো দিন দিন লীনই হইতেছে। হাওয়ায় না লীন হয়া যায় কোনদিন! এমনেই তো প্রায় দেখা যায় না।’
ঠিক, আমি একটু টিঙটিঙে আছি। তাই বলে আবার এতটাও না। সে নিজে যে ‘আকাশলীনার মা’ বলে! আচ্ছা, আকাশলীনার মা হলে তো আমি আকাশেই লীন হব, নাকি? হাওয়ায় লীন হতে যাব কোন দুঃখে? কিন্তু বড়দাদার সঙ্গে পারে কে কথায়? আমাদের কিছু ধানী জমি আছে। বরগা চাষ করে নুরুদ্দীন চাচা। তিন ভাগ এক ভাগ। কলেজ না থাকলে নুরুদ্দীন চাচার সঙ্গে ক্ষেতে নেমে পড়ে বড়দাদাও। ক্ষেত নিড়ায় কী হাল দেয়। নুরুদ্দীন চাচার হালের গরু দুটো নুরুদ্দীন চাচার কথা শোনে না, কথা শোনে বড়দাদার। নুরুদ্দীন চাচা এজন্য বলে, ‘হায়রে কপাল! ইয়া মাবুদ! আমার গাইয়ে আমার খায়, ছাওমোড়লে দুধ দোয়ায়। কেমন নিমকহারাম দেখছসনি, টুনু? ইয়া মাবুদ! এই দুইটারে তুই নিয়া যা, ব্যাটা। এরা আমার কথা শুনে না, তোর কথা শুনে, ইয়া মাবুদ! এরারে আমি গোয়ালে রাখব না। ইয়া মাবুদ!’
নুরুদ্দীন চাচা কথায় কথায় ‘ইয়া মাবুদ’ বলে।
যুদ্ধের জন্য অফিস কাছারি স্কুল কলেজ সব বন্ধ। টাউনে যুদ্ধ। যুদ্ধ বলে না, কলেজ বন্ধ বলে কিছুদিন ধরে বড়দাদা আর টাউনে যায় না। নুরুদ্দীন চাচার সঙ্গে ক্ষেতে হাল দেয় রোজ। এই তো এই লক্ষ্মীবারেই, কাদামাখা পায়ে সন্ধ্যার আগে আগে ক্ষেত থেকে ফিরে মাকে বলল, ‘ধানের ক্ষেতে এইবারে আর কাউয়াতাড়ানি বসান লাগব না, মা।’
মা বলল, ‘ক্যানরে, বাপ?’
বড়দাদা দাওয়ায় বসতে বসতে বলল, ‘তোমার মেয়ে গিয়া ক্ষেতে একলা দাঁড়ায়া থাকলেই হইব। অয়ই তো সাক্ষাৎ কাউয়াতাড়ানি।’
এ হল বড়দাদা। সারাক্ষণ মাকে আর আমাকে খেপায়। আবার চওড়া বুকভর্তি মায়া। বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখেছি, একদিনও আমাদের ছাড়া থাকেনি। পারে না থাকতে। আমরাও পারি না। সত্যি যুদ্ধে যাবে বড়দাদা? মাকে আর আমাকে ছেড়ে থাকবে? আমি বাদ, মাকে ছেড়ে থাকবে? থাকতে পারবে?
থাকবে। পারবে। দুপুরেই বলেছে আমাকে। কষ্ট হবে কিন্তু দেশও তো মা। মাকে রক্ষা করতে হবে না? যুদ্ধ করে দেশকে রক্ষা করবে তারা। বড়দাদা এবং তার মতো অনেকে। এর মধ্যেই যুদ্ধে চলে গেছে কতজন। কেন, আমাদের গায়েরই তো মনফর ভাই, ইয়াসিন মামা, শামসু বেপারী চাচা আর তারাপদ কাকা গেছে। এ বিপদের সময় যদি যুদ্ধে না যায় তবে বড়দাদা কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবে না নিজেকে। মানুষের মতো বাঁচতে পারবে না আর। তার কথা আমি বুঝেছি। একটু ভয় ভয় করলেও বুঝেছি। ভয় হয়েছিল যুদ্ধে গিয়ে যদি বড়দাদা মরে যায়! মরছে তো কতজন। কিন্তু বড়দাদা আমাকে বলেছে, পাকিস্তানিদের হাতে সে কখনও মরবে না। অবশ্যই পাকিস্তানি শয়তানদের হটিয়ে দেশ স্বাধীন করে ফিরবে। আমি বুঝেছি। যখন বলেছে তখন বুঝেছি। এখন আবার মনে হচ্ছে কি, ঃ কী মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। মা এমন হাহাকার করে কাঁদছে!
ইস্! বড়দাদা যদি না যায়! হতে পারে না মজা করছে সে? এরকম কত করে!

 
হারিকেনের আলো নিবু নিবু। কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে মনে হয়। কাঁপা কাঁপা অল্প আলোয় আমি বড়দাদার মুখটা দেখলাম। মজা করছে সে? হ্যাঁ, মজাই করছে। এই যে, হাসছে। ইস্, কী শয়তানরে, বাবা! মা এদিকে কান্নাকাটি করে আর উনি মিটমিট করে হাসছেন!
আমি মাত্র বলতে যাচ্ছিলাম ‘হইছে তো’, এ সময় বড়দাদা বলল, ‘গাঁওয়ের আর কেউ যুদ্ধে যায় নাই, খুকি? তারার মায়েরা তোমার মতন নি কান্দে?’
‘না কান্দুক! ওরে আল্লারে! ও-ও-ও-ও-ও! ও মাবুদ! আমি কি নিয়া বাঁচবরে? ও-ও-ও-ও-ও!’
বড়দাদা বলল, ‘বোকা খুকি। পাকিস্তানিদের হাতে আমি মরব না, বুঝছ? যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন কইরা ফিরব। বুঝছ? বুঝছ?’
আর বোঝে? মা কেঁদেই চলল, কেঁদেই চলল। বড়দাদা ‘খুকি’ মজা করে বলে। সত্যিও মায়ের নাম খুকি। নূরজাহান আক্তার খুকি। বড়দাদা কত করে যে বোঝাল, কিন্তু খুকি বুঝলে তো একটুও। বড়দাদাও হাল ছেড়ে দিল শেষে। কী যে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তোমার খুকি কিচ্ছু বোঝে না মা, তোমার খুকি ভারি ছেলেমানুষ।’
এ কবিতাটা আমি পড়েছি। তোমার খুকি কিচ্ছু বুঝে না মাঃ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা। অন্য সময় এটা মাকে অনেক মজা করে বলে বড়দাদা। মা হাসে। এখন আরও জোরে কেঁদে উঠল, ‘ওরে আল্লারে! ও-ও-ও-ও-ওঃ!’
কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে। হঠাৎ হারিকেন নিভে গেল এবং অন্ধকার হয়ে গেল আমাদের ঘর।
মা বিলাপ করল কতক্ষণ? আমার ঘুম ধরল, ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেও ভাবলাম কত কী। সত্যি যুদ্ধে যাবে বড়দাদা। মানে যেতে চায়। না যেতে পেরে তার কি খুব মন খারাপ হয়ে আছে? তার মতো আমিও বিশ্বাস করি যুদ্ধ করতে গিয়ে সে মরবে না। পাকিস্তানি হানাদাররা তাকে মারতে পারবে না কখনোই। দেশ স্বাধীন করে সে ফিরবে। আমি কি মাকে এ কথা বলব?
‘লীনুরে! লীনুঃ ও লীনু.. ও বেটিঃ!’
মা ডাকছে। কেন ডাকছে? ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠিয়ে ভাত খেতে বলবে এখন। পারব না। বললাম, ‘আমি খাব না, মা। বড়দাদা খাইছে? তুমি খাইছ?’
‘কোন বেলা! তুই খাবি না, তোর মর্জি খাবি না! এখন তোরে খাইতে কে ডাকে লো?’
‘ডাকো ক্যান তাইলে?’
‘উঠ। দেখ।
‘কী দেখব?’
‘ওরে আমার নবাবনন্দিনীরে!’ বড়দাদা বলল, ‘এই কাউয়াতাড়ানি, উঠ!’
কী হয়েছে? আমি উঠলাম। উঠে যা দেখলাম বিশ্বাস হল না। যা দেখলাম, যা শুনলাম। বড়দাদা বুঝিয়ে ফেলেছে খুকিকে! যুদ্ধে যাবে, দেশ স্বাধীন করে ফিরবে। কাঁদবে কী, মা উল্টো এখন ছেলেকে বোঝাচ্ছে, ‘দেশ স্বাধীন না কইরা ফিরবি না, বাপ। জল্লাদের ছাওগোরে তাড়ায়ে ফিরবি।’
‘তুমি এট্টু দোয়া দিয়া দেও, মা।’
‘এটটু নারে, বাপ, সব দোয়া দেই।’
এই কাণ্ড কী করে ঘটল?
‘যাইরে, পাগলি।’ বড়দাদা আমাকে বলল।
যাইরে, পাগলি! মানে কী এর? এক্ষুনি চলে যাবে নাকি সে?
‘আকাশলীনার মা! কাউয়াতাড়ানি!ঃ দেখো মা, কাউয়াতাড়ানির তো ঘুমই কাটে নাই এখনও। ও ঘুমাক, আমি যাই গিয়া।’
সঙ্গে সঙ্গে আমি লাফ দিয়ে উঠলাম, এই! এই! এই! ঃ না! না! না!
ভালো করে সকাল হয়নি এখনও। সকাল হবে কী রাতই ফুরোয়নি। অন্ধকারের রং জমাট আকাশে। এই অন্ধকারে মাকে আর আমাকে রেখে চলে গেল বড়দাদা। যুদ্ধ করবে। দেশ স্বাধীন করে ফিরবে।

 
দেশ স্বাধীন হল ষোলই ডিসেম্বর। দুপুরের মধ্যেই গাঁয়ের চারজন ফিরল, যারা যুদ্ধে গিয়েছিল। মনফর ভাই, ইয়াসিন মামা, শামসু বেপারী চাচা, তারাপদ কাকা। দেখতে যে কী হয়েছে একেকজন। একেবারে গোঁফ-দাড়িওয়ালা ডাকাত! কিন্তু ডাকাত না, তারা মুক্তি। মুক্তিবাহিনী। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে এ গোঁফ-দাড়িয়ালা মানুষরা। কিন্তু আমার বড়দাদা, যুদ্ধ করেছে আমরা তো শুনেছি এই মনফর ভাই, তারাপদ কাকাদের সঙ্গেই, সে কেন তাদের সঙ্গে ফিরল না? কী হয়েছে? আমার বড়দাদাকে কি মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী?
মনফর ভাই বলল, ‘না।’ ইয়াসিন মামা, শামসু বেপারী চাচা, তারাপদ কাকা বলল, ‘না।’ তাহলে? বড়দাদা কোথায়? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে মারতে পারবে না। বলেছিল সে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে মারেনি। তাহলে? তাহলে? ও মনফর ভাই? ও ইয়াসিন মামা? ও শামসু বেপারী চাচা? ও তারাপদ কাকা? তাহলে?
একটা মানুষও কিছু বলল না। কেন?
আমাদের উঠোনে একটা আমলকীগাছ আর একটা নিমগাছ আছে। এখন বিকেল। রোদ আছে, তবে হাওয়ায় শেষ শীত। আমাদের মা এখনও কিছু জানে না। জানে না, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং তার ছেলে ফেরেনি। দুই দিন ধরে মায়ের জ্বর। কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে ঘরে। আমি শুধু একা বসে আছি দুই গাছের মাঝখানে। বড়দাদার কী হয়েছে, শুনেছি। রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে তাকে। ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে! শুনে আমার বিশ্বাস হয়নি একটুও। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পারেনি, রাজাকাররা কি করে আবার মারতে পারে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে? মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু তো নেই! তাহলে? তাহলে আর কী? আমি অপেক্ষা করছি আমার বড়দাদার জন্য। একচল্লিশ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। সে ফিরবে।
ইতি, আকাশলীনার মা।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!