পিসির বাড়ি বেড়াতে এসে একদিনের মধ্যেই বেশ বুঝলাম যে এই জায়গাটা অদ্ভূত। এমনটা যেন আগে কোথাও দেখেনি। প্রথমেই যেটা চোখে লাগল তা হচ্ছে এখানে মিষ্টির দোকানের নাম ‘সরকার জ্ঞানভান্ডার’। প্রথমে মনে হল বোধহয় শখ করে দিয়ে থাকবে। তারপরে দেখি আরেকটা দোকানের নাম ‘জ্ঞানের মজারু সন্দেশ’, তারপর আরেকটায় ‘জ্ঞানগম্যি মিষ্টান্ন ভান্ডার’। দেখছি আর ভাবছি এ আবার কেমন ধারা মিষ্টির দোকান। ভুল দেখছি না তো? তারপর দেখি না – দিব্যি থরে থরে সাজানো রয়েছে রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলিপি।
পটাশকে জিজ্ঞেস করতে সে অম্লান বদনে বললে, ‘বাহ রে, তাই তো নাম হওয়া উচিত। নইলে বুদ্ধি বাড়বে কেমন করে?’
পটাশের সাথে আলাপ হয়েছে সকালেই। এ বাড়িতে আমার বয়সী বলতে দুজন – পটাশ আর ফটাশ। যমজ ভাই। আমার চেয়ে এক ক্লাস নিচুতে পড়লে কি হবে, কোন অংশে তারা কম যায় না। আমি পটাশের উত্তর শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললাম, ‘মিষ্টির দোকানের নামের সাথে বুদ্ধির কি সম্পর্ক?’
উত্তরে কিছু না বললে পটাশ এমন করে তাকাল যেন এই কথাটা বলা কি সাংঘাতিক অন্যায় হয়েছে, একথার কোন উত্তরই হয় না।
শুধু এটুকু হলেও না হয় কথা ছিল। পটাশকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের ইস্কুলেও গরমের ছুটি পড়েছে বুঝি?’
‘না না, এখন তো গরমের ইস্কুল।’
‘গরমের ইস্কুলটা আবার কি?’
‘কেন? গরমটা বাদ যাবে কেন?’
‘তার মানে সারা মাস ধরে ছুটির কাজ করো, আবার ছাতাপড়া রোদ্দুর মাথায় নিয়ে ইস্কুলেও যাও?’
‘না না, তা কেন? গরমের ইস্কুল তো বেশ মজার-’
‘সে কেমন?’
‘অতশত এক্ষুনি বলা যাবে না। তবে তোমার যদি ইচ্ছে করে, ওবেলা যেও না হয় আমাদের সঙ্গে -’
তাহলেই বোঝ কি গোলমেলে ব্যাপার। এই দুপুর গরমে যেতে হবে কিনা ইস্কুল? এদিকে আমাকে প্রায় একরকম জোর করেই পাঠানো হয়েছে পিসির বাড়ি। কেন? সে আরেক বৃত্তান্ত। অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা। ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষায় মেরে কেটে পেয়েছি উনচল্লিশ। তার পর থেকে কপালে দুঃস্বপ্নের মত এল বীজগণিত। ইস্কুলের প্রথম পরীক্ষা দিয়ে বুঝলাম এবারে উনচল্লিশ কেন, নয় ও পাবো না।
সব শুনে টুনে বাবা আর দেরী করতে চাইলেন না। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন পিসির বাড়ি। আমার পিশেমশাই আবার বেশ নামকরা অঙ্কের মাস্টারমশাই। গ্রামে থাকলে কি হবে, মহা বড় বড় অঙ্ক উনি নাকি একেবারে মুখে মুখে করে দিতে পারেন তা সে হিসেবের খাতা হোক, কি বর্গমূল হোক বা ভগ্নাংশই হোক। শুনেছি ওনার নাকি ক্যালকুলেটর লাগে না। যে কোন সংখ্যার নামতা এমনিই বলে যেতে পারেন। কি করে পারেন কে জানে, তবে আমার রেজাল্টের এই অবস্থা শুনে উনি নিজেই নাকি বলেছেন যে আমি যেন গরমের ছুটিটা পিসির বাড়ি গিয়ে কাটিয়ে আসি, উনি তাহলে আমাকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে পারবেন আর কি! বাবা মা শুনে খুব খুশি। এর চেয়ে ভালো যেন কিছুই হতে পারে না। তাই যেমন কথা তেমন কাজ। গরমের ছুটি পড়তে না পড়তেই আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল এখানে।
আমাদের ইস্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই গোবিন্দ স্যারের কথা ভেবে আমি একটু ভয় ভয়েই ছিলাম। প্রত্যেক মাস্টারের ছাত্রদের ভয় দেখানোর কিছু না কিছু ভয়ঙ্কর শাস্তির উপায় থাকে। চড় চাপড়, স্কেলের বাড়ী, বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো বা কানমলা এইসব তো এখন পুরনোই হয়ে গেছে বলতে গেলে। আর সত্যি কথা কি, ঐসব কোনদিনই আমার ওপর তেমন কাজ করেনি। বরাবর কানমলা খাওয়ার পর দেখি অঙ্কটা আমার আরো গুলিয়ে যায়। অঙ্ক করাতে বসলে তো পিসেমশাই পিশেমশাই থাকবেন না, অঙ্ক স্যার হয়ে না জানি কি রূপ ধরবেন এই ভয়েই আমি অস্থির। ওদিকে পিসির বাড়ি সবাই জেনে যাবে, বা হয়তো জেনেই গেছে, যে আমি অঙ্ক পারি না, এই সব ভেবেই আমার হাত পা যেন পেটের ভেতর সেঁধিয়ে আসছিল।
অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে আসার পর থেকে কেউ আমাকে পড়তে বসতেই বলেনি। ভোর ভোর ছোটকাকুর সাথে এখানে এসেছি আর আমাকে পৌঁছে দিয়ে কাকু একটু বাদেই ফিরে গেছে। সবার আগে পিসিমা একটু মাথায় হাতটাত বুলিয়ে বাইরের ঘরে পাঠালেন। পিসেমশাই তখন বাইরের ঘরে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একখানা বইয়ের পাতা উলটোচ্ছিলেন। আমি কিছু বলার আগে উনি নিজেই আমায় বললেন, ‘এই সবে এলে এখন একটু ঘোরাঘুরি করো, পটাশ আর ফটাশ আমার দাদার ছেলে। তোমারই বয়সী হবে। তোমরা বরং আগে আলাপ টালাপ করে নাও। খেলাধুলো করো। তুমি আসবে বলে তোমার পিসিমা অনেক রান্নাটান্না করেছেন। সেসব খাওদাওয়া করো-’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আর অঙ্ক?’
‘ওহ অঙ্ক, কেন অঙ্কে বুঝি তোমার ভীষন ভয়’
থতমত খেয়ে বললুম, ‘হ্যাঁ, মানে না, তবে ঐ একটু’
পিসেমশাই হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘সে হবে এখন। দিকশূন্যপুরে থাকতে আর তোমায় আর অঙ্কে ভয় পেতে হবে না’।
পিসেমশাইয়ের কথা শুনে আমার মনটা একটু চনমনিয়ে উঠেই আবার থমকে গেল। আমাকে বাড়িতে কোনদিন পড়া শেষ না করে খেলতে দেওয়া হয় না। এখানে যে দেখি উলটো নিয়ম। কে জানে কি আছে আমার কপালে।
পটাশ আর ফটাশ যে যমজ সে কথা কি আগেই বলেছি? দেখতে সহজ সাধাসিধে হলে কি হবে ভেতর ভেতর তারা যে কি পরিমান বিচ্ছু তার ধারনা পেলাম একটু পরেই। তাদের দুপুরের ইস্কুলের সাথে পড়াশুনোর কোন সম্পর্ক নেই, আদতে তা হচ্ছে গিয়ে রাজ্যের ডানপিটেমো করার অবাধ জায়গা আর সে শুধু তাদের দুজনেরই নয়, তাদের মত আরো একপাল ছেলেপুলের আড়ত। এই ইস্কুল বসে ইস্কুল বাড়িতেই, আর সেখানে কচিকাঁচাদের অভিজ্ঞরা বদমায়েসির নানা প্যাঁচ পয়জার শেখায়। ইস্কুলের চারদিকে পাঁচিল থাকলে কি হবে, সব্বাই পিছনের দিকে একটা ছোট্ট ফাঁক দিয়ে এসে ঢুকে পড়ে। কয়েকটা ক্লাসরুম খালি থাকে, কেউ সেখানে বোর্ডে চক দিয়ে খেলার মাঠের ছক বোঝায়, কেউ অন্য কোন রকমের ফন্দী বাতলায়।
পটাশ বা ফটাশ দুজনেই এই ইস্কুলের হর্তা কর্ত্তা আর কি। একজন ঢিল ছুঁড়ে টিপ করা শেখাচ্ছে, তো একজন গাছে চড়া। একজন গুলতি বানানো শেখায় তো আরেকজন তীর-ধনুক।
সত্যি কথা বলতে কি এক পলকেই আমার ভালো লেগে গেল দুপুরের ইস্কুল। কিন্তু সেই সঙ্গে একটু ভয়ও করল। বাড়িতে থাকতে কাউকে না বলে খেলতে যাইনি কক্ষনো, তাও সপ্তাহে তিনবার। বাকী সময়টুকু এই ঐ ক্লাস করতে কেটে যায়। এখানে এসে খেলে বেড়াচ্ছি এইসব খবর যদি বাড়িতে পৌঁছয় তবে কি হবে?
একটা সময় আমি পটাশকে আলাদা করে ধরে বললাম, ‘হ্যাঁ পটাশ, রে তোদের বাড়িতে বকবে না জানলে?’
সে একগাল হেসে বললে, ‘আরে আমি তো ফটাশ, এই দেখো মাঝের চুল গুলো খাড়া হয়ে রয়েছে!’ দুজন কে দেখতে তো হুবহু একরকম। খালি নাকি দুজনের চুল দুরকম। ফটাশের মাথার মাঝে খানিকটা চুল টিনটিনের মত উঁচু হয়ে থাকে। সত্যি থাকে না টিনটিনের গপ্প পড়ে এইরকম বানিয়েছে কিনা কে জানে, এই দুপুর রোদ্দুরে কারো চুল দেখে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই।
আমি বললাম, ‘আচ্ছা ফটাশ, তুইই বল বাড়িতে যদি জানে যে তোরা দুপুর বেলা ইস্কুল এসে এত হল্লা করছিস জানলে তোদের বাড়িতে বকবে না?
-‘সে কি বকবে কেন?’
-‘বাহ রে, বাড়ির ছেলেরা দুপুরবেলা এরকম হইচই কান্ড বাঁধাচ্ছে জানলে বকবে না? আর ইস্কুল থেকে যদি কমপ্লেন করে দেয়?’
-‘তুমিও যেমন! আমাদের তো বাড়ি থেকেই এইখানে পাঠায়। আর এসব তো আমাদের বাবা-কাকা তাদের বন্ধুরাও এককালে খুব করেছে। এখন আমরা করছি। বলি, ছেলের হইচই করবে না তো কি বুড়োরা করবে?’
উত্তর শুনে আমি তো থ। মনে মনে বললাম – তাও ঠিক। আমাকে তো বাড়িতে তেমন খেলতে দেওয়া হয় না। এক ঐ ইস্কুলের টিফিন, নইলে ইস্কুল বাস আসার আগে কিছুক্ষন। কতগুলো বিকেল অঙ্কের বই খুলে গালে হাত দিয়ে বসে কেটে গেছে। আজকে আর সেসব কিচ্ছু মনে রইল না। কিছুক্ষনের মধ্যে আমিও ওদের একজন হয়ে খেলায় মেতে উঠলাম। ঘামে জামা ভিজে চপচপ করছে, অথচ সেদিকে খেয়াল নেই।
বিকেল হতে না হতে বুঝলাম, আমার হাতে বেশ টিপ – তা সে গুলতি নিয়ে মাটির গুলিতেই হোক, কি ঢিল ছুঁড়েই হোক। একটা খেলা হচ্ছিল টিপ প্র্যাকটিসের। খেলা অনেক নিয়ম, অনেক কায়দা। প্রথমে সব্বাই কাছ থেকে ছুঁড়ে টিপ করবে। সেখানে যারা ঠিক ঠিক লাগাতে পারবে, তারা পরের রাউন্ডে আবার আরেকটু দূর থেকে টিপ করবে। এই খেলা আমি আগে কক্ষনো খেলিনি। তিন নম্বর রাউন্ডে ত্রিশ পা দূর থেকে যখন গাছ থেকে ঝোলা লেবু, টিনের ফলা আর কাচের বোতল সবকটাই লাগিয়ে দিলাম গুলতি ছুঁড়ে তখন দেখি চারপাশে হইচই পড়ে গেছে। কেউ বললে, ‘শাবাশ!’, কেউ বললে, ‘কেয়াবাত’, ‘কেউ বললে, এতদিন কোথায় ছিলে ওস্তাদ!’
সব্বাই এক এক করে এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেল। সব দেখে শুনে আর নিজেকে বাইরের কেউ মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আমিও ওদেরই একজন। বাবা মাকে ছেড়ে, নিজের বাড়ী ছেড়ে অন্য কোথাও আছি সে কথা মনেই নেই।
খানিক বাদেই দুভাই মিলে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চললে ফুটবল মাঠের দিকে। আমি বললাম, ‘এখন আবার কি?’
-‘আরে, আজকে ফুটবল ম্যাচ আছে যে!’
-‘তাই নাকি, এরপরে আবার ফুটবল খেলবি তোরা?’
-‘আরে শুধু আমরা কেন, তুমিও খেলবে। এও তো টিপ করে বল লাথানো ছাড়া তো আর কিছু নয়’
আমি ফুটবল আগে তেমন খেলিনি। আমাদের পাড়ায় একটাই ফুটবল মাঠ ছিল, সেখানেও এখন বাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ফুটবল বাবার সঙ্গে বসে দেখেছি অনেক, কিন্তু মা বার বার বলে ফুটবল খেলতে নামলে নাকি পা ছড়ে যাবে, হাঁটু ঘুরে যাবে, গোড়ালি মচকে যাবে। কিন্তু আজকে যখন মাঠ ছেড়ে হই হই করতে বেরোচ্ছিলাম, ততক্ষনে জেনে গেছি আমার বাঁ পায়ে দারুন শট আছে। বলতে গেলে আমার গোলেই কিন্তু পটাশরা এই ম্যাচটা ৩-০ য় জিতল। ওদের ডিফেন্ডার মারকুটে মিনেশ যখন আমার মালাইচাকি লক্ষ্য করে একটা লাথি চালিয়েছিল, তখন দেখলাম কেমন নিজের অজান্তেই হালকা লাফে সেটা কাটিয়ে গেছি আর শুধু তাই ই নয়, আমার বাঁ পায়ের ছোঁয়ায় বলটা তখন ওদের গোলে লুটোপুটি খাচ্ছে।
পিসিমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আহা রে, মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে বুঝি?’
আসলে আমি তখন সবে সবে দুধের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে সাবাড় করছি। অন্যান্য সময় বাড়ি ফিরে দুধের গ্লাস তেমনই থেকে যায়। মা বলাবলি করতেই থাকে। আজকে খেলে ধুলো মেখে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। বাড়ির কথা বা মার কথা একটুও মনে নেই। কিন্তু পিসির কথায় একটু লজ্জা পেয়ে ঘাড় নাড়লাম। এখানে আমি পড়াশুনো করতে এসেছি, খেলে বেড়াতে নয়। বীজগণিত যদি শিখতে না পারি তাহলে মহা মুশকিল। দুধ, টোস্ট আর মিষ্টি খেতে খেতে আবার মনে পড়ল, এখানে মিষ্টির দোকানে অদ্ভূত নামের কথা। তাই ভাবলাম পটাশ আর ফটাশ দুটো যা ফাজিল ওদের কাছ থেকে হয়তো কোনদিনই সত্যিটা জানতে পারব না, বরং পিসিকেই জিজ্ঞেস করি।
‘আচ্ছা, তোমাদের এখানে মিষ্টির দোকানে নাম এরকম কেন?’
‘সে এক গল্প। এখানে মানুষের বিশ্বাস যে মিষ্টি খেলে নাকি বুদ্ধি বাড়ে-’
‘তাই নাকি? সত্যি বাড়ে?’
‘সত্যি মিথ্যে তো জানি না। তবে শুনেছি এই গ্রামের এক মহা পন্ডিত ছিলেন। তিনি মিষ্টি খেতে বড় ভালোবাসতেন। একটা দোকান থেকে মিষ্টি কিনে রোজ বাড়ি ফিরতেন রাত্রিবেলা। তখনকার দিনে এত পড়াশুনো জানা লোক আর এই গ্রামে ছিলেন না। তাই সেই মিষ্টি দোকানের নাম রাখে জ্ঞানভান্ডার। আর আজকাল এইটেই হুজুগ হয়ে গেছে। তবে এসব তো আমার শোনা গল্প। তোমার পিশেমশাই বরং ভালো করে গুছিয়ে বলতে পারবেন এই নিয়ে-’
আমি মনে মনে ভাবছিলাম একটা সময় তো পড়তে বসতে হবেই। এবার বোধহয় পিসেমশাই ডাকবেন। ডাকলেন বটে, তবে সেটা দেখতে যে আমি খেলাধুলো করে বাড়ি ফেরেছি কিনা দেখার জন্য। তারপর খাবার টেবিলে এসে আমার পাশেই পড়লেন। আমি একটু ঢোক গিলে বললাম, ‘অঙ্ক বইটা কি আনব পিসেমশাই?’
উনি একটু চমকে বললেন, ‘বই আনবে কেন? তা আনো’
আমি একছুটে গিয়ে ব্যাগ থেকে অঙ্ক বইটা নিয়ে এসে হাজির হলাম। এই সেই বই যা নিয়ে আমার দুঃস্বপ্নের শেষ নেই। কানগুলো কিরকম চনমন করে উঠল, স্কেলের বাড়ির কথা মনে পড়ে হাতের চেটোদুটোও একটু টনটন করে উঠল। শেষমেষ বইখানা পিসেমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘এই যে-’
উনি নরম গলায় বললেন, ‘তা কোন জায়গাটা ঠিক বুঝতে পারছো না?’
-‘এই যে বীজগণিতটা বিশেষ করে’
-‘আচ্ছা, তুমি বরং এক কাজ কর। আজকে নিজে নিজে অঙ্কগুলো একবার দেখো। আমায় জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, আমার মনে হয় তুমি নিজেই পারবে। কোথাও যদি আটকে যাও, তাহলে ফুটবল মাঠের কথা মনে করে দেখো। অঙ্কটা যেন বিপক্ষ দলের গোল। তোমাকে ওদের ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে বলটায় কেবল আলতো করে পা ছুঁইয়ে দিলেই ব্যাস। তারপর যদি একেবারেই হচ্ছে না, তাহলে কালকে তোমায় নিয়ে বসব, কেমন?’
আমিও ভালো ছেলের মত ঘাড় নেড়ে বললাম। পিসেমশাই বলেন কি? তবে অঙ্ক বইটা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বুকটা ভয়ে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল সেই ভাবটা কোথাও মিলিয়ে গেল। আজকে বিকেলেই দুটো গোল নিজে করেছি আরেকটা হয়েছে আমার বাড়ানো পাসেই। ওফফ কি দুর্দান্তই ছিল ম্যাচটা। এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি অঙ্ক বই খুলে প্রথম অঙ্কটা পড়লাম, খাতা টেনে নিয়ে দু লাইন লিখে অঙ্কটা করেও ফেললাম। বীজগণিতের সব ছোট্ট ছোট্ট অঙ্ক। এক দু লাইনেই নেমে যাচ্ছে। এক সময়ে দেখি সবকটা অঙ্কই হয়ে গেছে। এবার কি করব কি করব ভাবছি, অমনি পটাশ আর ফটাশ লাফাতে লাফাতে এসে হাজির। ব্যস আর কি, পড়া মাথায় উঠল।
পরদিন সকালে পিসেমশাইয়ের কাছে অঙ্ক বই নিয়ে আবার হাজির হলাম। পিসেমশাই তখন নিজে নিজে দাবা খেলছেন, মানে সাদা আর কালো দুপক্ষের হয়ে নিজেই চাল দিচ্ছেন। আমি অঙ্কের বইটা এগিয়ে দিলাম। বললাম, ‘অঙ্কগুলো হয়ে গেছে’
‘বাহ বাহ, এ তো খুব আনন্দের কথা। আর হবে নাইই বা কেন? অঙ্ক তো হওয়ার জন্যেই’
-‘তাহলে এবার কি করব?’
-‘কি করবে? আচ্ছা, আরেকবার বইটা খুলে পরের প্রশ্নমালার অঙ্কগুলো দেখো তো ঠিক বুঝতে পারছো কিনা-’
আমি বই খুলে বীজগণিতের নতুন প্রশ্নমালার একটা অঙ্ক দেখতেই চোখের সামনে ছবির মত অঙ্কটা ভেসে উঠল। আমি ভ্যাব্যাচাকা খেয়ে পিসেমশাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি দাবার বোর্ড থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ‘কি হল? কিছু বলবে?’
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম না। ভয়ে ভয়ে পরের অঙ্কটার দিকে তাকালাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই অঙ্কটাও কেমন যেন নিজেই নিজেকে করে ফেললে। তারপর আরেকটা। তারপর আরও একটা। এরকম করে এক এক করে দেখি অনেক গুলো অঙ্কই নিজে নিজে হয়ে গেল। চোখ তুলে তাকাতে দেখি পিসেমশাই হাসছেন, ‘কি মনে পড়ছে না বুঝি? বেশ বেশ। পরে হবে এখন’
আমি তখন ভাবতে শুরু করেছি – ব্যাপারটা কি হল? এই কদিন আগেও অঙ্ক বইটা খুললে জ্বর আসছিল। আজকে সবকটা অঙ্ক কি মুখে মুখেই হয়ে গেল? পিসেমশাই কি ম্যাজিক জানেন নাকি? আচ্ছা, তোমরাই বল, এরকম হয়?
ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে গেল। তার মানে আজকে ক্লাস শেষ। হইহই করে উঠল সব্বাই।
‘কি করে হল?’ ‘
‘তার মানে কি দিকশূন্যপুরের মিষ্টি খেলে কি সত্যিই বুদ্ধি বাড়ে?’
‘দিকশূন্যপুরটা ঠিক কোনদিকে?’
‘তারপর কি হল?’
কারো প্রশ্নের আর শেষ নেই।
আজকের দিনটা ওদের বছরের প্রথম ক্লাস আর আমি ওদের অঙ্কের মাস্টারমশাই। ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘না মিষ্টি খেলে বুদ্ধি বাড়ে এমন প্রমান বিজ্ঞানীর এখনও অবধি পেয়েছেন বলে তো জানি না’
একজন বলে উঠল, ‘তবে যে অঙ্ক গুলো মুখে মুখে করে দিলেন?’
আমি হেসে উঠলাম, ‘আরে দূর, সে কি মিষ্টি খেয়ে নাকি? আমার মনে জড় হয়ে ছিল ভয়। অঙ্ক নিয়ে অনেকের অনেক ভয় থাকে। বিভিন্ন রকমের ভয় অঙ্ক বুঝতে না পারার ভয়, পরীক্ষার হলে গিয়ে অঙ্ক করে না আসতে পারার ভয়, অঙ্ক ভুল করলে মারের ভয় – এইসব গিয়ে জড় হয় অঙ্ক বইয়ের পাতায়। আসলে অঙ্কটাকে ভয় করার কিছু নেই। ভয়টা দূর করাই আসল। অঙ্ক তো এমনিই হয়ে যাবে। ব্যাপারটা আমার বাড়ির কেউ ধরতে পারেন নি, ধরতে পারেন নি আমাদের ইস্কুলের গোবিন্দ স্যারও। বুঝেছিলেন আমার পিশেমশাই।’
প্রথম দিনটা আমি বই টই কিছুই আনি না। খালি চক দিয়ে বোর্ডের ওপর লিখি – অ্যালজেব্রা। তারপর অঙ্কএর বই না খুলে বীজগণিত পড়ানো শুরু করার আগে, প্রত্যেক বছর আমি এই গল্পটা আমার সব ছাত্রদের একবার করে বলি। অনেক বছর ধরে বলে আসছি, তবু গল্পটা পুরনো হয় না।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।