অস্ফুট রহস্য

আকাশটা রোদে খাঁ খাঁ করছে ! তার উপর একটু বাতাস নেই ! ঘরে বাইরে দুজায়গায়ই অসহ্য গরম ! এমন এক তপ্ত দুপুরে রাতিনের মা পাক ঘরে রান্না করছেন । ফলে আগুনের তাপ আর সূর্যের প্রখরতা দুয়ে মিলে তাকে একেবারে ঘেমে ভিঁজে নেয়ে দিয়েছে । একটু পর পর আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে নিচ্ছেন তিনি । সেইসাথে হাতের চামচটা দিয়ে তরকারির স্বাদ নিচ্ছেন, যেন ঠিক সময়ে নামানো যায় তরকারিটা । এদিকে ভাতটাও টগবগ করে উতরানি দিয়ে উঠছে । কাজেই একটু পরখ করে কাছে রাখা লোচনি দিয়ে ডেকসিটা ধরে মাড় গালতে শুরু করলেন তিনি । দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সবই দেখছিল রাতিন । সে এতক্ষণ ধরে এ সুযোগটাই চাচ্ছিল যে, তার মা যখন ভাতের মাড় গালায় ব্যস্ত থাকবেন; তখন সে চুপে চুপে ঘরে ঢুকে একটা হাপপ্যান্ট নিয়ে সোজা চলে যাবে নদীর ঘাটে । যাতে মা কিছুই টের না পান । কারণ রাতিন আজ স্কুলে যায়নি । তাই মনে তার কিছুটা ভয় কাজ করছে ।

যাইহোক, কোনমতে মাকে ফাঁকি দিয়ে ভালয় ভালয় একটা হাপপ্যান্ট নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে রাতিন ! এরপর ছুট লাগাল নদীর পানে । নদীটা বেশি দূরে নয় । রাস্তাটা পেরিয়ে সোজা পশ্চিম দিকে অবস্থান এর । রাতিনদের বাড়ির পশ্চিম সীমানায় দাঁড়িয়ে আলবাত্ দেখা যায় সেটি । গ্রামের ছেলে বুড়োরা সব ওখানেই গোসল সারে । মাঝে মাঝে মা চাচীরাও যান । বিশেষ করে যখন তাদের সঙ্গী জোটে । তবে একলা তারা কোনদিনও নাইতে যাননা । তাদের কিসের নাকি ভয় কাজ করে ! রাতিন এতশত বুঝেনা । সে নদীতে গোসল করবে এটাই পাক্কা । ভয় ডর বলতে তার কিছুই নেই । একা, একাই সই !

তো আজও একাই যেতে হচ্ছে তাকে । কারণ হাসু-গেসু দুজনেই স্কুলে । আর স্কুল ছুটি হবে সেই ১টায় । এখন মোটে ১২টা বাঁজে । এতক্ষণ বসে থাকার কোন মানেই হয়না তাদের জন্য । তাছাড়া ওদুটো ভিতুর ডিম । শেষে যদি বলে মা আজ বাড়িতে গোসল করিয়ে দেবেন- তখন ! হাসু-গেসু রাতিনের খেলার সাথী হলেও গোসল করার নিয়মিত সাথী নয় । খুব কমই ওরা নদীতে যায় । ওদের ভয়- নদীতে নাকি কিসব আজর টাজর বাস করে । আর ওরা নাকি সুযোগ পেলে মানুষ ধরে নিয়ে যায় ! রাতিনও জানে এসব । কিন্তু তবুও তার ভয় করেনা ! সে রোজ নদীতেই গোসল করে । কারণ নদীর পানির মত পানিই হয়না । ওরকম ঝরঝরে আর পাতলা আরামদায়ক পানি কি আর অন্য কোথাও মিলে ?

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাঁটে এসে পড়ল রাতিন । এরপর সাথে আনা হাপপ্যান্ট আর গায়ের গেঞ্জিটা একজায়গায় রেখে নেমে পড়ল পানিতে । নদীর ঘাঁট তখন পুরো ফাঁকা । উপরে দুটো উড়ন্ত চিল ছাড়া আর একটাও প্রাণির চিহ্ন মাত্র নেই । তবে প্রচন্ড সৌরতাপে নদীর পানি কেমন চিকচিক করছে ! যেন পানির সাথে সূর্যমামা দুল দুলানী খেলছে । কেননা ঢেউয়ের মৃদু তর্জনে সূর্যটাকেও ঢেউ খেলতে দেখা যাচ্ছে পানির নিচে । রাতিনও কিছুক্ষণের জন্য ওদের খেলার সাথী হল । তাকে আলতো করে পানির নিচের সূর্যটার উপর হাত রেখে দোল খেতে দেখা গেল । এসময় পানির নিচ থেকে হঠাত্ তার পায়ে কিসের যেন জোর অনুভব করল সে । কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রচন্ড জোরে টানতে টানতে তাকে পানির একেবারে অতলে নিয়ে যেতে থাকল কেউ । কিন্তু কাউকে দেখতে পেলনা সে । শুধু পানির পাক খেয়ে সৃষ্টি হওয়া একটা গভীর সুড়ঙ্গ চোখে পড়ল । এরপর আর কিছু মনে নেই তার । কেননা তখন সে জ্ঞান হারিয়েছিল ।

এদিকে দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল । তবুও রাতিনকে ঘরে ফিরতে না দেখে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল তার বাবা-মা । এক এক করে পাড়ার প্রতিটি জায়গায় খোঁজ নেয়া হল, কোথাও পেলনা তাকে ! শেষে নদীর পাড়ে যেয়ে তার হাপপেন্ট আর গেঞ্জি দেখতে পেয়ে ভীষণ কান্না জুড়ে দিল তারা । এরই মধ্যে সমস্ত পাড়ায় খবর হয়ে গেছে যে, রাতিন নদীতে ডুবে মারা গেছে । একে একে নদীর ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল । আনানো হল ডুবুরি । কিন্তু রাত পর্যন্ত চেষ্টা করেও লাশের কোন হদিস দিতে পারলনা তারা । শেষে সিদ্ধান্ত দিল, হয়তো নদীর জোয়ারে লাশ ভেসে গেছে । তাই পাওয়া যায়নি ! কিন্তু ডুবুরিদের কথা মানতে নারাজ গ্রামের সহজ সরল মানুষেরা । তাদের দাবি রাতিনকে আজরই নিয়ে গেছে । তাই লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা । এ নিয়ে ডুবুরিদের সাথে একচোট তর্কাতর্কিও হল তাদের । শেষে বুঝাতে অক্ষম হয়ে ডুবুরির দল তাদের পাওনা নিয়ে স্থান ত্যাগ করল । একে একে ঘরে ফিরে যেতে লাগল গ্রামবাসীও কিন্তু তখনো ঘাঁটে বসে বিলাপ করতে থাকল রাতিনের বাবা মা !

ঠিক দশ বছর পরের ঘটনা । বিশ একুশ বছরের একটি ছেলে পড়ে আছে নদীর ঘাঁটে । অর্ধেক তার পানির মাঝে আর অর্ধেকটা ডাঙায় । সময়টা সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই । এসময় একজন মাঝবয়সী লোক নদীর ঘাটেঁ এল পেট সাফ করার জন্যে । কাজ সেরে যখনি সৌচকার্য সম্পাদনের জন্য পানির কাছাকাছি হল । ওমনি একটা ছায়া মূর্তি দেখে আঁতকে উঠল সে ! একটু ভাল করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারল একজন মানুষ । কিন্তু একা একা ছুঁয়ে দেখার সাহস হলনা । কাজেই পাড়ায় এসে আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পুনরায় ঘাঁটে এল লোকটি । তারপর সবাই মিলে ধরাধরি করে পুরোপুরি ডাঙায় তুলল ছেলেটিকে । এরমধ্যে একজনের চেনা চেনা ঠেকল তাকে । ভাল করে তাকাতেই পরিচয়ও মিলে গেল । এ আসলে আর কেউ নয়, আজ থেকে দশ বছর আগে এ ঘাঁটেই নদীর পানিতে ডুবে যাওয়া সেই ছোট্ট রাতিন । খবর গেল রাতিনদের বাড়ি । ছুটে এল তার বাবা মা । এসে চিনতে পারল তাদের ছেলেকে । ফলে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল তারা ।

প্রায় দুদিন পর চোখ খুলে তাকাল রাতিন ! দেখতে পেল তার বাবা মাকে । চিনতেও পারল তাদের । কিন্তু এতগুলো বছর কোথায়, কিভাবে ছিল- তার কিছুই মনে করতে পারলনা সে । ফলে লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ল, তাকে নিশ্চয়ই পরীদের কেউ ধরে নিয়ে গিয়েছিল । কারণ, পরীরা নাকি সুন্দর সুন্দর ছেলেদের প্রেমে পড়ে ! আর তাদের বিয়ে করে চিরদিনের মধ্যে পরী রাজ্যে রেখে দিতে চায় ! কিন্তু যারা বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তাদেরকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত আঁটকে রাখে । এরপরও যদি রাজি না হয়, শেষে অক্ষেম হয়ে রেখে যায় ! তাদের বিশ্বাস, যেহেতু রাতিন সুন্দর এবং ফুটফুটে একটা ছেলে; তার জীবনেও হয়তো ওরকম ঘটনাই ঘটে থাকতে পারে ! কিন্তু আসল ঘটনা যে, কি ছিল তা আজ পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেনি ! পুরো ঘটনাটা একটা অস্ফূট রহস্য হিসেবেই রয়ে যায় !

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!