অসংজ্ঞায়িত আজও

যে ঘটনার বর্ননা আমি করতে যাচ্ছি তা নিঃসন্দেহে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং
আমি ছিলাম সেই অভিজ্ঞতা বর্ননার একজন প্রত্যক্ষ শ্রোতা। ঘটনাটি নিম্নরূপঃ

তালুকদার বাবু ময়মনসিংহ শহরের একটি নামী কলেজের গনিতের শিক্ষক। এখন
অবসরপ্রাপ্ত। নিঃসন্দেহে বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী এবং কুসংস্কার মুক্ত।
কিন্তু তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার ব্যাখ্যা তিনি আজও খুঁজে বেড়ান।
কোনো প্রকার যুক্তি দিয়ে তিনি এর সংজ্ঞা দিতে পারেন না। তাই হয়তো
পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার সাথে ঘটনাটা শেয়ার করেন।

ঘটনা টা স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে-আগে। তালুকদার বাবুর ছোটো বোনের বিয়ে
হয়েছে ময়মনসিংহ জেলা অন্তর্ভূক্ত এক গ্রামে। বোনের জামাই মাছের
ব্যবসায়ী। নাম ছিল অরুন। বিশেষত, সাপ্তাহিক মঙ্গল বার রাতে ময়মনসিংহ
শহরে যে হাট বসত তাতেই তিনিগ্রাম থেকে মাছ নিয়ে আসতেন আর সেইদিনই তার
সর্বাধিক বিক্রি হত। আর তালুকদার বাবু ছিলেন তার সাপ্তাহিক বাঁধা
খরিদ্দার।ঘনিষ্ট ছিলেন, টাকা পয়সা ঠিকমত দিতেন কি না তা আমি বলতে পারব
না।

তা যাই হোক-

এমনই এক মঙ্গলবার তালুকদার বাবু গেলেন সেই হাঁটে। রাত্রি বেলা, সবাই ছোটো
ছোটো কুপি জালিয়ে নিজ-নিজ পন্যের পসরা নিয়ে বসে গেছে। তালুকদার বাবু
হাঁটে গেলে সবার আগে স্বভাবতই বোন জামাইয়ের কাছেই যেতেন। কিন্তু, এবার
হাঁটে গিয়ে হন্যি হয়েও বোন জামাই কে খুঁজে পেলেন না।

-“ব্যাপার কি? অরুন তো কোনো সমস্যায় না পড়লে হাঁট বাঁধা দেয় না! কোনো
সমস্যা হয়েছে বোধয়” চিন্তিত হয়ে গেলেন তালুকদার বাবু।

চিন্তা করতে করতে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। আরো ভাবতে লাগলেন, -” একবার
ওদের বাসায় যাওয়া দরকার। কিন্তু, এই রাতে কিভাবে যাই, ঠিক আছে, কাল
ভোরে না হয় রওনা হয়ে যাবো”

হঠাৎ তালুকদার বাবু রাস্তার পাড় থেকে একটা ডাক শুনতে পেলেন।

-“ও দাদাবাবু! ” তখন তালুকদার বাবু হাঁট থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

হতচকিত হয়ে তিনি তাকিয়ে দেখেন অরুন বাবু সম্পূর্ন একা, রাস্তার একপাড়ে
একটা মাত্র রুই মাছ নিয়ে বিক্রির জন্য বসে আছেন। বোন জামাইকে দেখে
আস্বস্ত হলেন তিনি। আবার কৌতুহল বসত জিজ্ঞেস করলেন হাঁটে না গিয়ে এইখানে
বিচ্ছিন্ন ভাবে বসে আছেন কেন। উত্তরে তিনি বললেন যে তিনি মাত্র তিনখান
মাছই এনেছিলেন, তাই আর হাঁটের ভেতরে না গিয়ে এখানেই বিক্রি করে চলে
যাবেন। তার মধ্যে আবার দুইটা মাছ বিক্রিও করে ফেলেছেন। তালকদার বাবু
বললেন-” তাহলে আমার ভাগ্যটা ভাল”

কথপোকথন শেষ করে একমাত্র অবশিষ্ট মাছটা নিয়ে স্বানন্দে বাড়ি চলে এলেন
তালুকদার বাবু। গিন্নিকে বললেন দারুন করে মাছ ভাজা করতে। গিন্নিও তার
পতিদেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে রাখলেন। দারুন তৃপ্তি করে সে রাত্রে মাছ
খাওয়া হল। ভালো খাওয়ার পর ভালো একটা ঘুমও হল।

কিন্তু ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘুমের ঘোর
নিয়ে দরজা খুলেই দেখলেন ছোটো বোনের দেবর দাঁড়িয়ে আছে।

-“কি ব্যাপার রতন- এত সকালে ! কোনো খবর আছে নাকি?” জিজ্ঞাস করলেন তালুকদার বাবু।

– ও পার থেকে উত্তর এলো “গত কাল সন্ধ্যায় দাদা মারা গেছে, দুদিন ধরে
জ্বরে ভুগছিল”।

তালুকদার বাবু তৎক্ষনাৎ জ্ঞান হারালেন। নিঃসন্দেহে নিজ বোনের বিধবা
চেহারাটা তার কাছে তখন যতটা না ভয়ংকর মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে তিনি এই
ভেবে বেশি ভয় পেয়েছিলেন যে, যেই ব্যাক্তি সন্ধ্যায় মারা গেছেন তার
হাতের মাছ তিনি রাত্তিরে কিভাবে কিনে আনলেন আবার তৃপ্তি করেও খেলেন।

আজও এর উত্তর তালুকদার বাবু খুঁজে বেড়ান।

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!