অষ্টম শতকের মধ্যভাগে মুসলিমরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নতুন এক উচ্চতায় উঠে আসে।বিভিন্ন অঞ্চল বিজয়ের সাথে সাথে সেইসব অঞ্চলের বিভিন্ন সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রের সংস্পর্শে আসা এর পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ।মূলতঃ মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক,লাতিন,পারস্য ও ভারতীয় নানা শাস্ত্র আরবীতে অনূদিত হতে শুরু করে।নানা প্রায়োগিক বিজ্ঞানের সাথে গ্রীসের দার্শনিক সক্রেটিস,এরিস্টটল,প্লেটোদের দার্শনিক শাস্ত্রও আরবিতে অনূদিত হয়।এই গ্রীক দর্শনের প্রভাবে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকে কেন্দ্র করে মুসলিম ধর্মশাস্ত্রে নতুন ঘরানার এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হল।এদেরকেই আমরা মুতাজিলা হিসেবে চিনে থাকি।
মুতাজিলাদের উৎপত্তিঃ
মুতাজিলারা এত দ্রুত ও ব্যাপকহারে বিস্তার লাভ করে যে এদের আবির্ভাব ঠিক কোথা থেকে কিভাবে শুরু হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল।তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে মুতাজিলারা গ্রীক দর্শন দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিল।মুতাজিলারা ইসলামের বিভিন্ন প্রসঙ্গ অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করতে গ্রীকদের যুক্তিবিদ্যা ও কার্যকরণকে গ্রহণ করে।তারা মনে করতো,সত্য উপলব্ধির জন্য কেবলমাত্র কুরআন ও সুন্নাহ যথেষ্ট নয়।পৃথিবীর নানা বিষয় বুঝতে তারা বুদ্ধি ও যুক্তিকে আসমানি প্রত্যাদেশ(ওহী) এর সাথে এক কাতারে বা কোন কোন ক্ষেত্রে তারও উপরে স্থান দেয়।আল্লাহ সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিবিদ্যার এমন যথেচ্ছা ব্যবহার এর ফলে মূলধারার ইসলামী পণ্ডিতরা একমত হন যে মুতাজিলারা আসলে ইসলাম থেকেই বেরিয়ে গেছে।মুতাজিলাদের চিন্তাধারাকে পাঁচটি মূলনীতির মধ্যে সংক্ষিপ্ত করা যায়ঃ
১.আর সব মুসলিমদের মত মুতাজিলারারাও আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহীদের ধারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত।কিন্তু পার্থক্যটা হচ্ছে তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী তথা সিফতকে আল্লাহর সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে স্বীকার করে না।যেমনঃ আমরা আল্লাহকে ‘আর –রাহমান’ বা পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু হিসেবে জানি।তারা এইসব গুণাবলীকে অস্বীকার করে এবং বিশ্বাস করে যে আল্লাহর একত্বের ধারণার সাথে এইসব নাম ও গুণাবলীর অন্তর্ভুক্তিকরণ সাংঘর্ষিক।এতে করে আল্লাহর একত্ববাদের বদলে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ ও বহু ঈশ্বরবাদ এর ন্যায় ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
২.প্রাচীন গ্রীকদের মত মুতাজিলারাও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস করে।তারা মনে করে যে আল্লাহ মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারণ করতে পারেন না।বরং মানুষ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরেও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।এর ফলে নিজ স্বাধীন ইচ্ছার ফলে কৃতকর্মের ফলস্বরূপ শেষ বিচারের দিন আল্লাহর ন্যায়বিচারের দ্বারা প্রত্যেকের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।মুতাজিলারা তাদের যুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে আল্লাহর কোন দয়া বা অনুকম্পা হবে ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন ও তাঁর প্রকৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
৩.মুতাজিলারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার করতে বাধ্য।
৪.মুতাজিলারা মনে করে যে একজন মুসলিম যদি সর্বোচ্চ পাপ বা কবিরা গুনাহ করে তাওবা করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে,তবে ঐ ব্যক্তিকে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী-এই দুইয়ের কোনটির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।ঐ লোকের অবস্থান হবে এই দুইয়ের মধ্যবর্তী অবস্থানে এবং আল্লাহ পৃথকভাবে তার বিচার করবেন।
৫.রাসুল সাঃ এর বর্ণিত ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ ধারণাকে মুতাজিলারা গ্রহণ করে।এই লক্ষ্যে শক্তিপ্রয়োগকে তারা বৈধ মনে করে যা মিনহা নামে নতুন এক ধারণার সাথে পরিচিত করায়।
মিনহা
আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন মুতাজিলাদের মতবাদকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করেন।এর ফলশ্রুতিতে মুতাজিলারা রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।বায়তুল হিকমাহ এর প্রতিষ্ঠাতা(এবং তার পরবর্তী খলিফা আল মুতাসিম ও আল ওয়াসিক) এই মতবাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ভিন্ন মতালম্বীদ আলেমদের উপর নির্যাতন,গ্রেফতার,কারারুদ্ধ এমনকি হত্যাও করতে শুরু করেন।মুতাজিলা মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে বিরুদ্ধ পক্ষকে দমনের এই ধারণা ‘মিনহা’ নামে পরিচিত।মূলত মুতাজিলাদের ধারণা “পবিত্র কুরআন আল্লাহর বাণী নয়, বরং তা সৃষ্ট”কে অস্বীকার করার ফলেই সেই সময়ের আলেমদের উপরে এই নির্যাতনের স্টিমরোলার নেমে আসে।
অনেক আলেমই পরাস্ত হয়ে এই মতবাদকে স্বীকার করে নেন এবং অনেকে এই প্রসঙ্গে চুপ করে যান।কিন্তু এর প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেন বিখ্যাত হাদিসবিশারদ ও ফকিহ ইমাম আহমেদ ইবন হাম্বল।কুরআন আল্লাহর বাণী এবং ইসলামের প্রতিষ্ঠিত ক্ল্যাসিক্যাল ধারার ব্যাপারে অটল থাকার কারণে তাঁকে দীর্ঘ সময় কারারুদ্ধ করে রাখা হয় ও অবর্ণনীয় নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়।
মিনহা’র এই ঘটনা জনরোষের সৃষ্টি করে।বাগদাদের পথে পথে আরম্ভ হওয়া দাঙ্গা আব্বাসিয় খিলাফতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।অবশেষে ৮৪৮ খৃস্টাব্দে খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল ‘মিনহা’র সমাপ্তি ঘোষণা করেন ও ইমাম হাম্বলকে মুক্তি প্রদান করেন।কিন্তু ততদিনে মিনহা’র বদৌলতে মুতাজিলা মতবাদের ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।মুতাজিলা মতবাদ প্রতিষ্ঠার এমন নৃশংস কায়দা গোটা মতবাদের অনিবার্য পতনের দিকে নিয়ে যায়।কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া এই মতবাদ আর কখনোই গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী মতবাদ হিসেবে উঠে আসতে পারেনি।মুতাজিলা মতবাদের বিরুদ্ধে আলেমদের শক্ত অবস্থান এবং তাদের কুযুক্তির বিপরীতে কুরআন-সুন্নাহসম্মত গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী যুক্তি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল।আলেমদের সেইসব মতামত আমরা জানাতে পারবো সামনের পর্বে।ইনশাআল্লাহ সে পর্ব আসছে খুব শীঘ্রই।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।