আমি বললাম, আমি …আমি … আমার নাম সৈয়দ এনামুল হক। আমি … মানে আমি ওয়াহেদের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালাম।
সেই কালো বেড়ালটাকে কোথাও দেখলামনা। ওটা গেল কোথায় ? আশ্চর্য!
অ। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ আমার মুখে দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, হ। এইবার বুঝলাম। আমার নাম হইল মোশাররফ হোসেন। ওয়াহেদে হইল গিয়াআমার চাচতো ভাইয়ের একমাত্র পোলা।তয় সুবহান ভাইয়ে মইরা গেলে পর আমি তার ফার্মেসিতে বসতাম। পরে ওয়াহেদের বোইনে বিদেশ থন আইসা দুকান বিক্রি কইরা দিল। আমি বুড়া মানুষ। আমি কই যামু বাবা কও। তখন শিউলীর হাতেপায়ে ধইরা প্রতিমাসে একতলা দুইতলা ভাড়া তুইলা ব্যাঙ্কে জমা দিমু এই শর্তে শিউলী আমারে এই বাড়িত থাকতে দিল। কইলাম ভাড়া দিমু। তয় এই বাড়িত ভাড়াইট্টা বেশি দিন থাকে না।
কথাটা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? এ বাড়িতে বেশি দিন ভাড়াটে থাকে না কেন?বলতে বলতে আড়চোখে ইত্তেফাক পত্রিকার দিকে তাকালাম। পেপারটা যেখানে গুটিয়ে রেখেছিলাম পেপারটা সেখানে নাই। আশ্চর্য! পেপারটা কোথায় গেল!
বৃদ্ধ যেন আমার প্রশ্ন শুনতে পান নি। কিংবা প্রশ্নের জবাব দিতে চান না। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে অনেককষ্টে সোফার ওপর বসলেন। তারপর বললেন, আইজ সকালে আমি কিছু মুখে দিয়া জায়নামাজে বসছিলাম। আইজকাল আমার যখন তখন ঘুম পায় বাবা। আমি বাবা জায়নামাজের উপর ঘুমায় পড়ছিলাম । দরজা বন্ধ করতে মনে আছিল না।
চাচা, দরজা তো খোলা ছিল না। বন্ধ ছিল।
বন্ধ ছিল? তয় তুমি ঘরের ভিতরে ঢুকলা কেমনে?
কেন দরজা তো সুরভী …মানে ওয়াহেদের বউই খুলে দিল।
অ বুঝছি। তাইলে তুমিও তারে দেখছ। মাইয়াডারে রাইতবিরাইতে মাঝেমইধ্যে আমিও দেখি বাবা। মাইনষেরে ডাইকা কথাডা কইলে আমারেকয় মিছা কথা কইতাছি। তারা আমারে কয় দূনঈয়ায় নাকি জিনভূত বইলা কিছু নাই । হায় আল্লা, দূনঈয়ায় জিনভূত না থাকলে এই বাড়িত ভাড়াইট্টা থাকে না কি দেইখা?
জিনভূত! কি বলছেন আপনি? আমার কন্ঠস্বর সম্ভবত তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছিল।
বৃদ্ধ ঘোলা চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর কাশতে লাগলেন। কাশির দমকে বৃদ্ধের চোখমুখ কীরকমকুঁচকে যাচ্ছিল। চোখ দুটি বুজে যাচ্ছিল। তখন বৃদ্ধকে অদ্ভূত দেখাচ্ছি। যেন বৃদ্ধ কোনও রহস্যময় যাদুকর। কাশি থামার পর বৃদ্ধ বললেন, তুমি আসল ঘটনা মনে হয় কিছু জান না বাবা।
কি ঘটনা চাচা? আমার কন্ঠস্বর কাঁপছিল। আমি খেয়াল করিনি যে আমি আবার সোফার ওপর বসে পড়েছি।
বৃদ্ধ বললেন, আইচ্ছা, তাইলে তুমি শুন বাবা। আমি বলতেছি। ওয়াহেদে সুরুভিরে বিয়া কইরা ঘরে তুলছিল। বিয়ার পরও সুরুভির চাচতো ভাই শাহনেওয়াজে এই বাড়িত মাঝেমইধ্যে আইত । ওয়াহেদে আর সুরুভির মইদ্যে এই লইয়া দিন রাইত কাইজ্জাকাটি লাইগাই থাকত। মাঝেমইধ্যে ওয়াহেদে রাগ কইরা বাড়িত থেইকা চইলা যাইত। চইলা গিয়া রাইতে থাকত রামপুরায় এক মসজিদে । তারপরও শাহনেওয়াজে মাঝেমইধ্যে আইত চাচতো বোইনের বাসায়। এই দুঃখে ওয়াহেদে একদিন গলায় দড়ি দিয়া মরল।
আমি শিউরে উঠলাম। কি বলছেন আপনি?
হ। আমি ঠিকই কইতাছি বাবা।
বৃদ্ধ ঠিক বললে তাহলে আমি তখন কাকে দেখলাম ?
বৃদ্ধ বলে চলেন, ওয়াহেদের মরণের পর শাহনেওয়াজে এই বাড়িত ঘনঘন আইতে লাগল। এই ঘরেই বইসা দুইজনে মিল্লা গল্পগুজব করত। তয় তাগো কপালে সুখশান্তি বেশিদিন দেয় নাইআল্লায়।
এক রাইতে খুব বৃষ্টি হইল। সুরুভি পাকের ঘরে খিচুরি পাকাইতেছে, শাহনেওয়াজে রাইতে খাইয়া যাইব। কাজের ছেমড়ি সব দেখছে … চুলার থন কেমনে আগুন লাফ দিয়া সুরুভির শাড়িত পড়ল। সুরুভীর চিৎকার না শুইনা শাহনেওয়াজে পাকের ঘরে ছুইটা গেলে আগুন তারেও ধরল। দুজনে পুইড়া কয়লা হইয়া গেল…আগুনে আর কুন ক্ষতি হয় নাই। কাজের ছেমড়ির গায়ে আগুনের টোকাও লাগে নাই।
আমার মাথা কেমন টলছিল। আর ভীষন অবশ লাগছিল। মুখে ঘাম টের পাচ্ছিলাম। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল … তাহলে তখন রিকশায় কে উঠল? আর দরজা-ই বা তখন কে খুলে দিল?
বৃদ্ধকে দেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হল। ছোট শরীরটা এক পাশে কাত হয়ে গেছে। মুখটা হা হয়ে আছে।অবশ্য তখনও শক্ত করে লাঠিটা ধরে আছেন। দৃশ্যটায় কী ছিল- আমার শরীর কেমন গুলিয়ে উঠল। বৃদ্ধকে ঝাপসা দেখছি। আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। ঘরে আতরের গন্ধটা কীরকম তীব্র হয়ে উঠছিল। ওই বৃদ্ধও এই জগতের কিনা কে জানে। এই গলিটাই অশুভ। আমার এই ঘরে থাকা উচিত নয়। আর কিছুক্ষণ এই ঘরে থাকলে ওরা তিনজন ফিরে আসবে। তখন আমার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে …বৃদ্ধের কাছ বিদায় নেবার আমার কোনও দায় নেই। এই বৃদ্ধও সম্ভবত এই অশুভ গলির প্রেতলোকের বাশিন্দা।
আমি প্রায় এক লাফেই ঘরের বাইরে চলে এলাম। বাইরে রোদের রং কেমন মরাটে। যেন অস্বচ্ছ কাচের ভিতর দিয়ে আসছে। গলির দু’ধারে পুরনো ফটোগ্রাফের মতন সাদাকালো ঘরবাড়ি। অনেক পুরনো দিনের …
আমি প্রায় দৌড়েই অশুভ গলিটা পেরিয়ে যখন রোদ ঝলমলে গলির মুখে এসে দাঁড়ালাম তখনও আমি ভীষণ কাঁপছিলাম …
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।