হাসিব অনেকক্ষণ ধরে আবদুল্লাহপুর ওভারব্রীজের কাছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড গরমে ঘামে তার শার্টের নীচের গেঞ্জি ভিজে গেছে। এখন চৈত্রের প্রায় শেষের দিকে, বৃষ্টির দেখা নেই। ধূলাবালি আর গরমের ভেতর মানুষ ছুটছে প্রতিদিনের কর্ম-যুদ্ধে।
বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, পিকআপ, পথচারীদের তোয়াক্কা না করেই রাস্তার ধূলা উড়িয়ে ছুটছে। ধুলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে অনেকেই নাকে রুমাল, মাস্ক ব্যবহার করছেন। হাসিবের নিজেরও ডাস্ট-এলার্জি আছে। ধূলায় তার শ্বাস কষ্ট হয়। তাই সে নাকে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে আছে আর ভেতরে ভেতরে রাগে গজ্ গজ্ করছে। এই ধূলা শ্বাসতন্ত্রের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। অ্যাজমা বা ডাস্ট এলার্জি যাদের আছে তাদের এই সড়কে যাওয়া-আসা কষ্টকর। তারপরও এই ধুলা ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থা রাস্তাগুলোতে কেন রাখা হয়নি ?
একটি প্রাইভেট কার হাসিবের সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ীটিকে দেখেই হাসিবের মনে হয় সে যা চাচ্ছে তা বোধহয় পেয়ে গেছে। ড্রাইভার একটু মাথা নিচু করে বামদিকের জানালার ভেতর দিয়ে হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, গুলশান দুই, গুলশান এক…
হ্যাঁ, হাসিবের ধারণা ঠিক। প্রায়ই সে এ রকম প্রাইভেটকারে গুলশান দুই-এ যায়। গাড়ীর মালিকের বা অফিসের অজান্তে মাইক্রো বা প্রাইভেটকারের ড্রাইভারদের কেউ কেউ তাদের যাওয়া আসার পথে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। তাতে তাদের কিছু বাড়তি রোজগার হয়। বিশেষ করে অফিস যাওয়া-আসার সময় এ রকম গাড়ী প্র্য়াই পাওয়া যায়। ভাড়া একটু বেশী হলেও যাত্রীরা এই সুয়োগটি গ্রহণ করেন। এতে কয়েকটি সুবিধে আছে যেমন, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থাকার কারণে যাত্রাকালিন বাইরের উষ্ণ আবহাওয়া এবং ধুলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। যাত্রার সময়টুকু আরামদাযক হয়। যাত্রীবাহী লোকাল বাস-মিনিবাসের চেয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। লোকাল যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাসে যে রকম ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। গুলশান যাওয়ার বেশ কয়েকটি বাস হাসিবের সামনে দিয়ে গেছে কিন্ত সুবিধাগুলো পাওয়ার জন্যে তাতে উঠেনি। যাওয়ার সময় হাসিবকে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো দেখে বাসের হেল্পার গুলশান দুই, গুলশান দুই বলে চিৎকার করে হাসিবের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু হাসিব তাতে সাড়া দেয়নি। অপেক্ষা করছিল এই রকম একটা প্রাইভেটকারের জন্যে।
হাসিব জানে আজকাল প্রায়ই এইসব প্রাইভেটকারেও ছিনতাই হয়। ছিনতাইকারীরা যাত্রীবেশে ছিনতাই করে। হাসিব কোনোদিন ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েনি। সে কতগুলো সুত্র মেনে চলে। গাড়ীতে উঠার আগে গাড়ীতে আগে থেকে বসা যাত্রীদের পোশাক পরিচ্ছদ খেয়াল করে। পোশাক-চেহারা দেখে যদি ভদ্র মনে হয় তাহলে সে গাড়ীতে উঠে। গাড়ীটি ঝকঝকে নতুন হলে সে মনে করে গাড়ীটি নিশ্চয়ই কোনো অফিসের কোনো বড় কর্মকর্তার বা কোনো টাকাওয়ালার গাড়ী। এ ধরণের গাড়ীর ড্রাইভার নিয়োগের ক্ষেত্রে ড্রাইভারের দক্ষতার পাশাপাশি নিশ্চয়ই চারিত্রিক দিকটিও যাচাই করে নিয়োগ দেয়া হয়। ছিনতাইকারীরা সাধারণত ঝকঝকে নতুন গাড়ী ব্যবহার করে না। হাসিব আর একটা সূত্র মেনে চলে তা হলো কোনো গাড়ীর জানালার গ্লাস যদি কালো থাকে তাহলে সে সেই গাড়ীতে উঠে না। অবশ্য বর্তমানে গাড়ীতে কালো গ্লাস ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেহেতু সে কোনোদিন কোনো ছিনতাইকারীর কবলে পড়েনি তাই তার বিশ্বাসের জায়গাটি এখনো অনড় আছে।
প্রাইভেটকারের ড্রাইভাররা এ রকম ভাড়ার ক্ষেত্রে পেছনের সিটে দুই জনের জায়গায় তিনজনকে বসায়। হাসিব দেখে পেছনের সিটগুলো ফাঁকা। সামনের সীটে ড্রাইভারের বাম পাশে এক তরুণী বসে আছে। মেয়ে যাত্রীরা সাধারণত এই রকম প্রাইভেটকারে যাতায়াত করে না। তারা সম্ভবত তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এ রকম গাড়ী এড়িয়ে চলে। একসাথে তিনজন মেয়ে যাত্রী পাওয়া কঠিন। ড্রাইভার নিশ্চয়ই পেছনে তিনজন পুরুষ যাত্রীদের বসাবে বলে তরুণী যাত্রীটিকে সামনের সিটে বসিয়েছে। এমনও হতে পারে তরুণী নিজে ইচ্ছে করেই সামনের সিটে বসেছেন। তরুণীকে দেখে হাসিবের মনে বিশ্বাস জন্মায়। প্রাইভেটকারে তরুণী ছিনতাইকারীর নাম সে এখনো শুনেনি। সে নিশ্চিন্তে উঠে বসে।
মেয়েটি তার চোখের কালো বড় গ্লাসের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে সোজা সামনের দিকে। একবারও সে পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। হাসিবের উঠার সময়ও সে হাসিবের দিকে তাকায়নি। সে নিজে একজন মেয়ে যাত্রী। কি ধরণের পুরুষ যাত্রী গাড়ীতে উঠছে এটা দেখার কি সে প্রয়োজন মনে করেনি ? হাসিব শুনেছে, মেয়েরা না তাকিয়েও নাকি দেখতে পায়। কিভাবে দেখতে পায় তা ওরাই জানে। বন্ধুদের কেউ কেউ বলে মেয়েদের মাথার পেছনেও একটা চোখ আছে। এটা ওদের মনের চোখ। এই চোখ দিয়েই বোধহয় ওরা পেছনে না তাকিয়েও পেছনের অনেক কিছু দেখতে পায়। হাসিব ভাবছে মেয়েটির কি সাহস ড্রাইভারের পাশে একা বসে থাকতে তার ভয় করেনি। এমনও হতে পারে গাড়ীর মালিক সে। কিন্তু মালিক হলে তো এভাবে পয়সার বিনিময়ে গাড়ীতে যাত্রীদের নিশ্চিয়ই উঠাতো না। হাসিব আবার ভাবে ঢাকা শহরে চলতে হলে তো কিছু ঝুঁকি নিতেই হয়। ঢাকা শহরে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি এই জাতীয় যুদ্ধ করে লোকাল বাসে চলাফেরা করতে হয়। কিন্তু মেয়েদের জন্যে এই কাজটি কঠিন। হয়তো এই যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্যে সে এই ঝুঁকি নিয়েছে। এটা-সেটা ভেবে এর কোনো সন্তোষজনক উত্তর হাসিব খুঁজে পায় না।
উত্তরার জ্যামে আটকে আছে তারা। হাসিব মেয়েটির পেছনের সীটে একটু ডান দিকে সড়ে বসেছে। যেখান থেকে সে দেখতে পাচ্ছে কি সুন্দর খোলা কাঁধ। ঘাড়ের নীচে পিঠের উপরের অংশ খোলা, মসৃণ। চুলগুলো পরিপাটি করে ক্লিপে আটকানো আছে। মেয়েটির শরীর থেকে হাসনাহেনার গন্ধ ভেসে আসছে। সেই গন্ধের মোহে মেয়েটির খোলা পিঠের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছে হাসিব। দক্ষ চিত্রকরের পর্যবেক্ষণ হয় নিখুঁত। হাসিবও তার দক্ষতা দিয়ে মেয়েটির বয়স অনুমান করার চেষ্টা করে। মেয়েটির খোলা পিঠের উজ্জলতা দেখে ধারণা করে মেয়েটির বয়স হয়তো আঠারো-বিশ হতে পারে। হাসিব একটা আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু ভদ্রতার কাছে সে অসহায়। নিজেকে গুটিয়ে রাখে।
পেছনে তাকানোর প্রযোজন নেই ভেবে মেয়েটি একবারও তার দিকে তাকায়নি। হাসিব ভাবছে এটা কি ভদ্রতা নাকি দেমাগ ! হাসিব খেয়াল করেছে মেয়েটি সামনের গ্লাসের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়েও তাকে দেখার চেষ্টা করেনি। হাসিবের তার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে মেয়েরা অন্যকে দেখার চেয়ে নিজেদেরকে দেখাতে বেশি পছন্দ করে। হয়তো এ রকম একটা ইচ্ছা তার মধ্যে কাজ করছে। তবে হাসিবের ভালই লাগছে। সময়টাকে আরো উপভোগ্য করার জন্যে সে কিছুটা ডানদিকে সরে বসে যেন মেয়েটিকে আরো ভালো করে দেখা যায়। এইবার মেয়েটির ডানপাশের মসৃণ, দুধে-আলতা গাল অনেকটা দেখা যাচ্ছে। চারুকলার ছাত্র সে। চোখে যা ভালো লাগে তাই তার আঁকতে ইচ্ছে করে। মেয়েটির পেছন দিকটি আঁকার ইচ্ছে হচ্ছে তার। ছবি আঁকার বা স্কেচ করার প্রয়োজনীয় সামগ্রী সবই তার ব্যাগে আছে। হাসিবের গন্তব্যে পৌঁছতে এখনো অনেক দূর বাকি। তা ছাড়া আরো দু-তিনটা সিগন্যালে জ্যামে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এই সময়ের মধ্যে সুন্দর একটা স্কেচ করা সম্ভব। কিন্তু মেয়েটি যদি কিছুদুর গিয়ে নেমে যায় ? ছবিটি অসমাপ্ত থেকে যাবে। না অসমাপ্ত থাকবে না। চোখের ভেতর ছবিটি ধারণ করা হয়ে গেছে। মেয়েটি সামনে নেমে গেলেও ছবিটি সমাপ্ত করা সম্ভব। এয়ারপোর্ট থেকে বনানী-গুলশান পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা অন্যান্য অনেক রাস্তার চেয়ে বেশ ভালো। অনেক মসৃণ। কেউ কেউ বলেন, যে সব রাস্তায় বিদেশীদের চলাচল বেশি সেসব রাস্তার অবস্থা ভালো। দেশের টাকায় গড়া দেশের লোক যেসব রাস্তায় চলাচল করে তাদের মধ্যে অনেক রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। হাসিব মনে করে এয়ারপোর্ট থেকে গুলশান পর্যন্ত মসৃণ রাস্তার কারণে গাড়ীতে খুব একটা ঝাকুনি হবে না। অতএব স্কেচ করতে তার অসুবিধে হবে না।
হাসিব ব্যাগ থেকে কাঠ পেন্সিল আর স্কেচবুক বের করে আঁকতে শুরু করে। মেয়েটির মাথা থেকে ঘাড়ের পেছনে পিঠের যতদূর খোলা মসৃণ জায়গা দেখা যায় সে স্কেচ করতে চায় । সতর্কভাবে সে বার বার মাথা তুলে মেয়েটির পেছন দিকটা দেখে নিচ্ছে। স্কেচবুকে সে একটার পর একটা দাগ দিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে মেয়েটি মনে হয় বুঝতে পারেনি সে কি করছে। মেয়েটি আগের মতই সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসিব মাঝে মাঝে গাড়ীর ভেতরে ড্রাইভারের সামনে ব্যাক মিররের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটি তাকে দেখছে কিনা। ব্যাক মিররে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে না কারণ গ্লাসটি ড্রাইভারের দিকে কাত করা আছে। গাড়ী চলছে। হাসিব তার কাজে ব্যস্ত। মনে মনে ভাবছে মেয়েটির ঘাড়ের নীচের খোলা জায়গাটি কত মসৃণ সুন্দর ! নীচের টুকু না জানি আরও কত সুন্দর। হাসিবের মনে পড়ে গাঁয়ের সরল বধূর উদোম পিঠ দেখতে পয়সা লাগে না, শহরে তার উল্টো।
এয়ারপোর্ট পার হওয়ার পর কুড়িলের কাছাকাছি ড্রাইভার গাড়ীটি রাস্তার বাম পাশে থামায়। গাড়ীতে ডান দিক থেকে একজন এবং বাম দিক থেকে আর একজন উঠে বসে। ডান দিক থেকে উঠার সময় লোকটি হাসিবকে ভদ্রভাবেই বলে, প্লিজ ভাই, একটু সরে বসেন। হাসিবকে বাম দিকে থেকে সরে আসতে হয়। মাঝখানে বসে আছে সে আর তার দুপাশে দুজন। দুজন যাত্রী উঠার সাথে সাথেই হাসিব ছবি আঁকা বন্ধ করে দেয়। স্কেচবুক উল্টে রাখে তার উরুর উপর। গাড়ী চলছে। সবাই চুপচাপ বসে আছে। হাসিব ভাবে মানুষ এত কাছাকাছি চুপচাপ বসে থাকে কিভাবে ! রক্ত-মাংস আর হৃদপিন্ড সমৃদ্ধ মানুষ এত কাছকাছি অথচ চুপচাপ ! মেয়েটি তো শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। এটা কি ব্যক্তিত্ব ধরে রাখার প্রতিযোগিতা নাকি কাউকে বিরক্ত না করার বধিরতা। গাড়ীটি সোজা না গিয়ে ফ্ল্ইাওভারের উপর দিয়ে বাড্ডার দিকে যাচ্ছে দেখে হাসিব চেঁচিয়ে বলে, ড্রাইভারসাব আপনি এদিক দিয়ে যাচ্ছেন কেন ?
ড্রাইভার কোনো কথা বলছে না। কেউই কোনো কথা বলছে না। সবাই চুপচাপ। হাসিব আবার বলে, আরে আপনি তো বনানী হয়ে গুলশান-২ এ যাবেন। এ দিক দিযে যাচ্ছেন কেন ?
এবার ডানপাশে বসা লোকটি হাসিবের তলপেটে একটা পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, এক্কেরে চুপ কইরা বইয়া থাক্। কোনো সাউন্ড করবি না।
হাসিব এবার বুঝতে পারে সে কাদের খপ্পড়ে পড়েছে। মূহুর্তেই তার শরীর শীতল হয়ে যায়। লোকগুলোকে প্রথমে ভদ্রই মনে হয়েছিল। এখন তারা তাদের আসল চেহারায় ফিরে এসেছে। ডানপাশের লোকটি পিস্তলটা দেখিয়ে আবার বলে,
এই মালে কইলাম সাউনই অয় না। তরে গুল্লি করলে কেউ টেরও পাইবো না।
এবার লোকটি বাম পাশের লোকটির নাম উচ্চারণ করে কি যেন ইঙ্গিত করে, লোকমান
ইঙ্গিত পেয়ে লোকমান বলে, আমরা যা কমু লক্ষীপুলার মতন ঐইডাই করবি। তাইলে তরে কিছু করুম না। নেইলে কাইট্টা এক্কেরে বুড়িগঙ্গায় বাসাইয়া দিমু।
জানা গেল বাম পাশের লোকটির নাম লোকমান। ডান পাশের লোকটির নাম কি। সে কি লোকমানের বস ? এবার ডানপাশের লোকটি হাসিবের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নেয়। মোবাইলের সুইচ অফ করে দেয়। বলে,
পকেটে মালপানি যা আছে বাইর কর। জলদি বাইর কর।
হাসিব বলে, ভাই আমি ছাত্র। আমার কাছে টাকা পয়সা তেমন কিছু নাই।
আবে কসকি ! যাগর ট্যাকা আছে অরাই তো ছাত্র অয়া পারে। পেরাইভেট ভার্সিটিতে মালদার বাপের পুলা-পাইনেরা লাক লাক ট্যাকা খরচা কইরা পড়তাছে। আমাগো পকেট ফাঁক্কা, রাস্তায় খাঁড়ায়া খাঁড়ায়া মাক্ষি মারি। যা আছে জলদি বাইর কর।
সত্যি বলছি ভাই আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই।
এবার লোকটি হাসিবকে একটা চড় মারে।
হালা মিছা কতা কস্। অ্যাহনি স্যুট কইরা দিমু। মানিব্যাগ বাইর কর জলদি।
হাসিব পেন্টের পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেয়। লোকটি তাড়াতাড়ী মানিব্যাগটা খুলে দেখে বলে, মানিব্যাগ দেহি এক্কেরে ফাঁক্কা। মানিব্যাগ তো বালাই লইছস্ মাগর মানিব্যাগে খালি একশ ট্যাকার একটা নোট। মানিব্যাগের ইজ্জত তো মাটিতে মিশায়া দিছোত।
ভাই টাকার জন্যে পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরী করি।
খোমা দেইখা তো মনে অইতাছে মালদার বাপের পোলা।
লোকমান বলে, হালায় মনে হয় ট্যাকা সাইট কইরা রাখছে।
এই বলে লোকমান হাসিবের পকেটগুলোতে টাকা খুঁজতে থাকে। টাকা খুঁজতে গিয়ে লোকমান বুকে থাপ্পর দেয়ার পর বুঝতে পারে হাসিবের টি শার্টের বুকপকেট নেই। হাসিবের মোবাইল পেন্টের পকেটগুলোতেও খুঁজে কিছু পায় না। হাসিব না দেখানোর জন্যে সতর্কতার সাথে উরুর উপর স্কেচবুকটা ধরে রেখেছে। তাই দেখে ডানপাশের লোকটির সন্দেহ হয়।
তর আতে এইডা কি ?
স্কেচবুক
স্কেচবুক কি বা কেন লোকটি বুঝতে পারেনি। সে মনে করেছে হাসিব স্কেচবুকের নীচে বা ভেতরে দূর্লভ বা মূল্যবান কিছু লুকিয়ে রেখেছে। সে স্কেচবুকটা ছিনিয়ে নেয়। স্কেচ দেখে বলে,
সময় তো বালাই জাইতাছিল তর। গাড়ীতে বইয়া বইয়া মাইয়া মাইনষের ছবি আঁকতাছোস্।
স্কেচকরা ছবিটার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আবার বলে, আরেঃ এইডা দেহি আমগো বিপাশার ছবি।
সামনের সীটে বসা মেয়েটি বলে, তাইনি ?
হ, এই দেক্ পোলায় পিছে বইয়া বইয়া তর ছবি আঁকতাছিল। অহন বুজছোস্ তরে কেলা আগে পাঠাইছি? পাবলিক তো মাইয়া দেকলেই কাইত অয়া যায়গা। রাস্তা-ঘাটে যে আমরা আছি এইডাও ভুইল্লা যায়গা।
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ডানপাশের লোকটির কাছ থেকে স্কেচবুকটা নিয়ে নেয়। দেখে বলে, বাহ্ ! সুন্দরই আঁকছে। বছ্
কি ?
পুলাডারে আমগো আস্তানায় লিইয়া যাই ?
কেলা ?
আমার একটা জব্বর ছবি আ্ইঁকা দিব।
চুপ কর, তর তো খায়া-দায়া হারাদিন কুনো কাম নাইক্কা, খালি ছবি আর ছবি
লোকমান বলে, বছ্ এক্কেরে পারফেট কইছেন। মাইয়া মাইনষের কাম একটাই, খালি ছবি খিচো আর ফেসবুকে সীল মারো।
বসের কথা লোকমান সমর্থন করে আরো কিছু যোগ করে দেয়। বিপাশাকে সমর্থন না করার কারণে বিপাশা লোকমানকে ভেংচি দিয়ে তার প্রতি অসমর্থন এবং রাগ প্রকাশ করে। হাসিব বুঝতে পারে মেয়েটি কেন এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। সেও যে ছিনতাইকারী দলের একজন তা হাসিব একটুও বুঝতে পারেনি। মেয়েটির নাম বিপাশা। বাম পাশের লোকটির নাম লোকমান। কিন্তু তাদের বসের নাম এখনো জানা হল না। এদের নাম কি আসলেও লোকমান, বিপাশা ? নাকি এগুলো এদের ছদ্দনাম ? যাই হোক, এগুলো যাচাই করার চেয়ে এখন যা করলে এদের কাছ থেকে মুক্তি পেতে পারে সেটা করাই শ্রেয় মনে করে হাসিব। তাদের বস্ বলে, ছবি খিঁচতে তো পারমিসন লাগে। আঁকবার লিগা পারমিসন লাগে না ?
আমি ভেবেছিলাম, উনার সম্পূর্ণ মুখ তো আমি আঁকছি না, শুধু মুখের একপাশ, চুল আর ঘাড়ের পেছনের দিক স্কেচ করলে উনার তো কোনো ক্ষতি হবে না। তারপরও আমি সরি বলছি।
না জিগায়া আমগো মাইয়ার ফোটু আঁকবি, আবার আমগরে মালপানিও দিবি না ?
ভাই, আমি ছাত্র মানুষ, আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই
গাড়ী চলছে। কোনদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে হাসিব কিছুই বুঝতে পারছে না। সেদিকে তার কোনো মনোয়োগ নেই। তার মনোযোগ পেটে ঠেকানো পিস্তলটার দিকে। কোন সময় না একটা গুলি বের হয়ে তার পেট ফুঁটো করে দেয়। পিস্তলের ট্রিগারে যেন কোনো প্রকার চাপ না লাগে তাই সে একটুও নড়াচড়া করছে না। পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছে। হাসিবের আতংকিত মুখ দেখে বস্ লোকটির হয়তো একটু মায়া হয়েছে। বলে,
কোন কেলাসে পড়েন ?
ফ্যাকালটি অব ফাইন আর্টস
লোকটি এর অর্থ বুঝতে পেরেছে কিনা সেই জানে। বলে, হু, কোন ভার্সিটিতে পড়েন ?
আমি একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ি
ভার্সিটির নাম কি ?
এরা ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। ঢাকায় আসার পর এর আগে কেউ হাসিবের সাথে এই ভাষায় কথা বলেনি। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের সাথে কথা বলতে বলতে ভাষার আঞ্চলিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। তৈরী হচ্ছে শুদ্ধ, অশুদ্ধ বাংলা, ইংরেজী, আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে এক ধরণের ভাষা যা হাসিবের মোটেই ভালো লাগে না। ম্গ্ধুকর মনে হয় না। হাসিব মনে করে ভাষা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। ভাষার মাধ্যমে মানুষের রুচি, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। তাই হাসিব সব সময় চেষ্টা করে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করে প্রমিত উচ্চারণের মাধ্যমে কথা বলতে। আজকের এই ভয় এবং আতঙ্কের মধ্যেও ছিনতাকারীদের সাথে হাসিব তার এই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এটাকে তার অভ্যেসও বলা যেতে পারে। ছিনতাইকারীরা তার সম্পর্কে আরো কিছু জানার চেষ্টা করছে। হাসিব খেয়াল করে লোকটি এখন তাকে আপনি করে সম্বোধন করছে। হয়তো এরপর জানতে চাইবে বাড়ি কোথায়, বাবা কি করেন ? কিন্তু প্রশ্ন করলে তো উত্তর দিতেই হবে। তা না হলে মারধর করবে। হাসিবের মুখ থেকে ইউনিভার্সিটির নাম শোনার পর লোকটি বলে, ওহ ! আপনেও ঐ হানের মাল !
হাসিব বুঝতে পারে লোকটি হয়তো তাদের ইউনিভার্সিটির নাম আগেও শুনেছে। হয়তো বা সে এই ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে কিছু জানে। লোকমান বলে, বছ্ গত সপ্তাহে যে মালডারে ধরছিলাম হেও এই ভার্সিটির ইস্টুডেন্ট আছিল
এইডাই তো কইলাম, হেও ঐ হানের মাল। কপালডাই খারাপ। কয়দিন ধইরা খালি ছাত্র মানুষ হাতে পড়তাছে। আব্বাস ?
ড্রাইভার বলে, জী বছ্ ।
এতদিন ধইরা ডিউটি করতাছোস, কোনহানে জাল ফালাইলে কি ধরা পড়বো এইডা অহনো জানস না ?
জানা গেল ড্রাইভারের নাম আব্বাস। আব্বাস লজ্জায় কোনো কথা বলল না। পিছনে একবার তাকিয়ে তার লজ্জিত মুখখানা বস্কে দেখিয়ে আগের মতই গাড়ী চালাচ্ছে সে। ছিনতাই করার জন্যে সঠিক লোককে চিনতে না পারার কারণে কেউ লজ্জা পেতে পারে হাসিব এই প্রথম দেখল। গাড়ী চালাতে চালাতে এবার আব্বাস বলে, আমি তো মনে করছি হে বড় লোকের পোলা। গরীর মাইনষের পোলারা তো লাম্বা লাম্বা চুল রাহে না। বড় লোকের পোলা যারা বিদেশ তেন আহে অরাই তো লাম্বা লাম্বা চুল রাহে।
তাদের বস্ হাসিবকে আবার বলে, আপনেগর ভার্সিটির কথা মাইনষের মুখে বহুত হুনছি। হুনছি, আপনেরা পরীক্ষায় নাম্বার বালাই পান মাগার ইন্টারভিউতে কিছু জিগাইলে পুরাডাই অফ। এত নম্বর পান ক্যামনে ?
বস্ হেরা ট্যাকা দেয় আর স্যারেরা দেয় নাম্বার
লেখাপড়া তো করেন না। খালি রাস্তার কিনারে, পুটপাতে খাঁড়ায়া খাঁড়ায়া ছেরিগো লগে টাংকি মারেন। আপনেগো ক্যাম্পাসে তো কুনো জায়গা নাই। এর লাইগ্যা রাস্তার কিনার আর ফুটপাত ছাড়া আপনেগো সময় কাটানের কুনো জায়গাভি নাইক্কা।
হাসিব কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিবাদ করলে যদি চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে তাই সে চুপচাপ শুনতে থাকে তাদের কথা। এদের কখনো একটু ভালো মানুষ আবার কখনো ভয়ংকর মনে হচ্ছে। তাদের বস্ আবার বলে, ছাত্র মানুষ, মাইয়া মাইনষের মতন এত লাম্বা লাম্বা চুল রাখছেন কেলা ?
হাসিবের কিছু বলার আগেই লোকমান বলে উঠে, হেগো একটা ভাব আছে না, মাইনষেরে বুজাইতে হইবো না যে হেরা শিল্পী মানুষ। পোলারা মাইয়া মাইষের মতন লাম্বা লাম্বা চুল, হাতে চুড়ি, গলায় শিকল, উল্টা-পাল্টা দাঁড়ি রাইখ্যা ভাব লিয়া থাকে।
বস্ বলে, আচ্ছা আপনেই কন, যারা শিল্প-সাহিত্য লিয়া থাকে, মাইনষেরে সুন্দর কিছু দেয় মাগার নিজেরাই আউলা-ঝাউলা গিদরের মতন থাকে কেলা ? শিল্প-সাহিত্য লিগা লাম্বা চুল, উল্টা-পাল্টা দাঁড়ি, হাতে চুড়ি, গলায় শিকল, চার-পাঁচ দিন গোসল না কইরা গিদরের মতন থাকা এটির কুনো দরকার আছে ?
হাসিব বুঝতে পারে শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের লোকদের সম্পর্কে এদের একটা ভুল ধারণা আছে। তাই সে বলে, না দরকার নেই। এভাবে সবাই থাকে না, কেউ কেউ থাকে। স্টাইল করার জন্যে…
হাসিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধমক দিয়ে উঠে বস্ লোকটি। আরে মিয়া, আউলা-ঝাউলা থাকা, চাইর-পাঁচদিন গোসল না কইরা গিদরের মতন থাকুন কিয়ের স্টাইল ? আমরা তো ছিনতাইকারী তাওভি আমগো চেহারা-সুরত, জামা কাপড় আপনেহগর চে ভালা আছে। আমগরে দেইখ্যা আপনেও তো পরথমে ভরকায়া গেছেন। আমগরে ভাবছেন ভালা মানুষ।
বসের কাজ আর কথাকে সমর্থন করে নিজেকে যোগ্য শিষ্য জাহির করার কাজে ব্যস্ত আছে লোকমান। বলে, সাহাবাগ-ছবিরআটে লাম্বা লাম্বা চুলওয়ালা গিদর পোলাগো দেহা যায়।
বস্ লোকটি লোকমানের কথায় মনে হয় আমাকে আরো লজ্জা দেয়ার একটা বিষয় পেয়ে যায়। চট্ করে জিজ্ঞেস করে, ছবির আটের লগের পার্কটার নামটা জানি কি ?
হাসিব বলে, সোহরাওর্য়াদী উদ্যান
হ ঠিক কইছেন, সুরায়ারদী উদ্যান। ওহনের বাতাসে তো খালি গ্যাঞ্জার গন্ধ। এই গন্ধের মইদ্যে শিল্পী-সাহিত্যিক মাইয়া পোলারা বইয়া বইয়া গল্প করে। চা-বিড়ি খায়। গান-বাজনা করে। দাঁত কেলায়া হাসে। হেগর নাকে কি গ্যাঞ্জার গন্ধ লাগে না ?
লোকটি ঠোঁট-মুখ বিকৃত করে দাপটের সাথে কথাগুলো বলল। সে যেন বোঝাতে চায় এখানে যারা আসে সবাই গাঁজাখোর। এই উদ্যান যেন শুধু গাাঁজা খাওয়ার জায়গা। হাসিবের বলতে ইচ্ছে করে এই উদ্যানকে এ রকম মনে করা ঠিক না। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক গুণী মানুষের আসা-যাওয়া, উঠা-বসা আছে এই উদ্যানে। এই উদ্যানের ঐতিহ্য আছে। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেসকোর্স নামে পরিচিত ছিল। এখানে ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব ছিল। প্রতি রোববার ঘোড়দৌঁড় প্রতিযোগিতা হত। এটি একটি জাতীয় স্মুতিচিহ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানেই ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এখানেই আত্মসমর্পণ করেছিল মিত্র বাহিনীর কাছে। এই উদ্যানে আছে জাতীয় তিন নেতা শেরে-বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধি। এখানে এখনো শিখা-চিরন্তন জ্বলছে। কিছু নেশাগ্রস্ত লোক আজকের এই পরিবেশের জন্যে দায়ী। কিন্ত হাসিব এইসব কিছুই বলতে পারিনি। তার কথার প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। আবার যদি ধমক দিয়ে উঠে, আবার যদি চড় থাপ্পড় মারতে শুরু করে তাই সে চুপ থাকে। হাসিবকে চুপ থাকতে দেখে লোকটি আবার বলে, আপনের জবান বন্ অয়া গ্যালো কেলা ? বুঝছি আপনেও মনে অয় ওহানের মাল। যাউকগা এইসব কথা কওনের টাইম নাইক্ক্যা। তাড়াতাড়ী মালপানি বাইর কর।
হাসিব খেয়াল করে লোকটি এখন তাকে তুই করে বলতে শুরু করেছে। এরা একেক সময় একেক রকম আচরণ করছে। নিজেদের চরিত্র বদলাচ্ছে। হাসিব বলে,
ভাই, সত্যি বলছি, আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই।
এত পকেটয়ালা পেন্ট পিনছোস মালমানি কোন পকেটে রাখছোস জলদি ক কইলাম
ভাই বিশ্বাস করেন, আমার কাছে আর টাকা নেই।
লোকমান বলে, আবার মিছা কথা কস্ । জাইঙ্গার বিত্বে হান্দায়া রাহস নাই তো ? খুল খুল পেন্ট খুল
না না, আন্ডার ওয়ারের ভেতরে কিছু নেই।
লোকমান পেন্টের জিপার খুলে আন্ডারওয়ারের ভেতরে হাত চালিয়ে খুঁজতে থাকে। কিছু পায় না। এবার ওরা হাসিবের মোবাইল পেন্টের পকেটগুলোতে হাত ঢুকিয়ে সন্ধান করতে থাকে। কাঙ্খিত কিছু পাওয়া যায় কিনা।
কি তামশা ! যেই পকেটে হাতদি ঐইটাই খালি। পকেট যহন খালিই রাখবি তাইলে এত পকেটয়ালা পেন্ট পিনছোস কেলা ? জানস না রাস্তাঘাটে আমরা থাকি। আমগর লাইগ্যা কিছু রাখবি না ?
আমি তো ভাই আপনাদের সত্যি কথাই বলেছি আমি ছাত্র মানুষ। আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই।
বছ্, মানিব্যাগে ট্যাকা উঠানের একটা কার্ড পাইছি।
হালায় মনে হয় সাথে কুনো ট্যাকাই রাখে না। সব থাকে এই কার্ডে।
লোকমানের হাত থেকে বস্ লোকটি ডেভিড কার্ডটি নিয়ে বলে, এইডা দেহি ভিসা কার্ড। এইবার লক্ষীপুলার মতন কইয়ালা, এইডার পাসওয়ার্ড কত ?
ভাই, আমার একাউন্টে মাত্র একহাজার টাকা আছে।
হাসিবের ধারণা টাকার পরিমাণ সামান্য মনে করে লোকটি হয়তো কার্ডটি তাকে ফেরত দিয়ে দেবে। এ কারণে সে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেছে।
কার্ডে কত ট্যাকা আছে এইডা মেশিনে ঢুকাইলেই বুঝাপারুম। তুই পাসওয়ার্ড ক।
হাসিব চাপের মুখে পাসওয়ার্ড বলে দেয়।
আব্বাস ?
জী বস্ ?
একটা শুনশান এটিএম বুথের লগে গাড়ীটা খাড়া করা।
ড্রাইভার গাড়ীটিকে একটা বুথের প্রায় একশ হাত সামনে দাঁড় করায়। এটিএম বুথটা দেখে হাসিব বলে, এই বুথ থেকে আমার কার্ড দিয়ে টাকা তোলা যাবে না।
লোকটি হাসিবের কথা বিশ্বাস করে না। বলে, দেইখ্যা আহি তুলুন যায়নি
তাদের বস গাড়ি থেকে নেমে এটিএম বুথে যায়। যাওয়ার আগে পিস্তলটা লোকমানকে দিয়ে যায়। বলে যায়, লোকমান, মালডারে দেইখ্যা রাহিস। বেশি তিড়িং বিড়িং করলে ফ্টুাইয়া দিস।
লোকটির এই নির্দেশ শুনে হাসিব আর কিছু বলার বা করার সাহস পায় না। ছিনতাইকারীদের কাছে ধৃত ব্যক্তির জীবনের কোনো মূল্য নেই। তারা নিজেদের ঘৃণ্য স্বার্থের জন্যেও মানুষকে খুন করতে একটুও দ্বিধা করে না। একটি গুলি বা ছুরির একটি আঘাতই যথেষ্ট জীবন অবসানের জন্যে। তাই এই অবস্থায় বীরত্ব দেখানো নেহায়েত বোকামি হবে ভেবে হাসিব চুপচাপ বসে থাকে গাড়ীতে। লোকমান তার তলপেটে পিস্তলটা ঠেকিয়ে রেখেছে। হাসিব স্বচ্ছ কাচের জানালার ভেতর দিয়ে দেখে। জায়গাটা অনেকটা নীরব। ঢাকার অন্যান্য রাস্তার চেয়ে এখানে লোকজনের চলাচল অনেক কম। গাড়ির সংখ্যাও অনেক কম। মাঝে মাঝে দু একটা প্রাইভেট কার, পিকআপ, রিক্সা, সিএনজি, ভ্যান দেখা যাচ্ছে। কোন জায়গা কোন সময় নীরব আর কোন জায়গা সরব ছিনতাইকারীরা বোধহয় সব জানে। নিরাপদ মনে করে এখানে গাড়ীটা দাঁড় করানো হয়েছে। এটি কোন জায়গা হাসিব চিনতে পারছে না। আশে-পাশে কোনো সাইনবোর্ডও দেখা যাচ্ছে না যা দেখে জায়গার নাম জানা যাবে। হাসিব ঢাকা শহরে দুই বছর আগে এসেছে। এর মধ্যে ঢাকার সব জায়গায় তার যাওয়া হয়নি। যাওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি। তাই ঢাকার অনেক জায়গা তার অদেখা, অচেনা রয়ে গেছে। হাসিব ভাবছে, গাড়ীর জানালার দুই পাশ দিয়ে ব্যস্ত মানুষ ছুটছে। ওরা গাড়ীর এত কাছে দিয়ে যাচ্ছে অথচ কেউই বুঝতে পারছে না গাড়ীর ভেতর কি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তাদের বস্ ফিরে আসে। গাড়িতে উঠে বসে। বলে, তুই ঠিকই কইছোস। এই মেশিন থাইক্কা কার্ড রিজেক্ট কইরা দিছে। এবার ক কুন ব্যাংকের এটিএম বুথ থাইক্কা ট্যাকা তুলুন যাইবো। মিছা কইলে তো বুজছোসসি !
হাসিব অসহায় এবং নিরুপায়। সে এ পর্যন্ত সব কথাই সত্য বলেছে। কিন্তু ওরা কেউই তার কথা বিশ্বাস করেনি। এখন সত্য বললেও মিথ্যে মনে করে মারধর শুরু করে কিনা এই আশংকায় ভয়ে হাসিব নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।
আমি তো এতক্ষণ সব সত্য কথাই বলেছি। আপনারা আমার কোনো কথা বিশ্বাস করছেন না।
আরও একবার হাচা কইরা ক
যে বুথ থেকে টাকা তোলা যাবে হাসিব তা বলে দেয়।
এবারও তার কথায় তাদের সন্দেহ হয়। মানুষকে সন্দেহ করতে করতে মানুষের কথাকে বিশ্বাস না করা যেন তাদের একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। বস্ বলে, হাচা কইছোস তো ?
জি আমি সত্যি বলেছি।
এটিএম বুথের আশেপাশে লোকজনের বিচরণ কম এমন বুথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। গাড়ী চলছে একটি নিরাপদ বুথের খোঁজে। গাড়ী কোথায় যাচ্ছে হাসিব কিছুই বুঝতে পারছে না। সে এটাও বুঝতে পারছে না তার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি আছে। তাকে কি ছিনতাইকারীরা ছেড়ে দেবে নাকি আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করবে। মুক্তিপণ যদি দিতে না পারে তাহলে কি হবে ? হাসিব মনে মনে সৃষ্টি কর্তাকে স্মরণ করছে আর ভাবছে বাবা এখন অসূস্থ। টাকার অভাবে প্রতি মাসে তার নিজেরই ঔষধ নিয়মিত কেনা হয় না। মায়ের কাছে শুনেছে বাবা তার চাকরি জীবনের শুরুতে বিয়ে করেননি। চাকরির টাকা জমিয়ে প্রথমে তার নিজের দুই বোনের বিয়ে দিয়েছেন। নিজে বিয়ে করেছেন চাকরি পাবার আরও প্রায় আট বছর পর যাকে বলে লেট ম্যারিজ। বড় আপার চার বছর পর মেঝ আপার জন্ম। ছেলের আশায় মেঝ আপার আরও চার বছর পর আমার জন্ম হয়। বাবার প্রফিডেন্ট ফান্ড আর গ্রাচুয়িটির টাকা অনেক আগেই আমাদের ভাই-বোনদের লেখাপড়ার জন্যে, বড় আপার বিয়েতে আর বাবার চিকিৎসার পেছনে শেষ হয়ে গেছে। বড় আপা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতো। বিয়ে করতে চায়নি। বলতো, ‘আমি চলে গেলে সংসার চালাবে কে ? হাসিব তো এখনও ছোট। ওর পড়ালেখা এখনও শেষ হয়নি।’ বিয়ের পড় বড় আপাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন মেঝ আপার রোজগারে কোনোমতে সংসার চলছে। ভাগ্যবান নারীর মতো স্বামী, সন্তান, সংসার এসব নিয়ে আনন্দের বন্ধন কে না চায়। এই বন্ধন চাওয়ার অধিকার মেঝ আপারও আছে। কিন্তু দায়িত্বের চাপে তার এই অধিকার থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছে। অপেক্ষায় আছে সময়ের যখন তার এই অধিকার চাওয়ার সুযোগ হবে। মেঝ আপা আত্মত্যাগের এক অনন্য উপমা। সে বড় আপার মতই বলে, হাসিব পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করে সংসারের দায়িত্ব নেয়ার মতো উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না। আমাকে নিয়ে মা-বাবা, বড়আপা, ছোটআপার কত স্বপ্ন। মানুষকে নিয়ে মানুষ কত স্বপ্ন দেখে, মানুষের উপর মানুষ কত নির্ভরশীল এই ছিনতাইকারীরা কি তা বোঝে ? আমাকে আটকে রেখে যদি মুক্তিপণ দাবী করে তাহলে মেঝ আপা কি পারবে আমার মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে। আর যদি না পারে তাহলে ওরা কি আমাকে মেরে ফেলবে ? ভাবতে ভাবতে হাসিব বুঝতে পারে তার বুকের ভেতর কোথাও ব্যথা হচ্ছে। জলে দু’চোখ ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
ড্রাইভার একটা বুথের সামনে গাড়ী থামাতে চায় কিন্ত তাদের বস্ ধমক দিয়ে উঠে, আবে হালার পুত দেহছ না এই হানে মানুষ জন ভীড় কইরা রইছে। একটু নিরিবিলি জায়গায় বুথ আছে এমন বুথে লইয়া যা। এতদিন ধইরা কাম করস অহনো এইড্যা হিকস নাই ?
গাড়ী আবার আগের মতো চলতে থাকে। কিছুক্ষণ গাড়ী চলার পর একটা বুথের সামনে গাড়ীটা দাঁড়ায়। বস্ লোকটি জানালার গ্লাসের ভেতর দিয়ে ডানে-বামে, সামনে-পেছনে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হয় যে এখানে লোকের আনাগোনা অনেকটা কম। তারপর সে গাড়ি থেকে নামে। বুথে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে। হাসিবের পাশে বসে। বলে, এক্কেরে হাচা কইছেন। খালি এক হাজার ট্যাকাই আছিল।
হাসিব বলে, এক বছর আগে বাবা চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন। বাবা এখন অসূস্থ। নিজের পড়ালেখার খরচ যোগাড় করার জন্যে পার্টটাইম চাকরী করি।
তাদের বস্ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। হাসিব বুঝতে পারে না এটি লোকটির হতাশার দীর্ঘশ্বাস নাকি তার প্রতি সহানুভুতি প্রকাশের নিশ্বাস। বলে, এই অপারেশনে আমগো তেমুন কুনু লাভ হইলো না। লস্ হইয়া গেল। গাড়ীভাড়া, তেলের খরচা আর আমগো খাটাখাটনি সব বেকার হইয়া গেল। আপনে অহন কন এই লসের লাইগ্যা কেঠা দায়ী আপনে না আমরা ?
হাসিব ভয়ে আছে। তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। কোন উত্তর তাদের মনের মতো হবে বুঝতে পারছে না। সে ভয়ে ভয়ে বলে, আমার তো কোনো দোষ নেই। আমি তো আপনাদের সব সময় সত্য কথা বলেছি
এইডা ঠিক আপনি হাচা কথা কইছেন। আর হাচা কওনের লাইগ্যা আপনেরে ছাইড়া দিমু। আপনে ছাত্র মানুষ, দ্যাশের ভবিষ্যত, লেখাপড়া শেষ কইরা বড় চাকরি করবেন আর মানিব্যাগে বেশি বেশি ট্যাকা লইয়া রাস্তায় বাইর হইবেন। রাস্তায় যে আমরা আছি এইডা একটু মাথায় রাইখেন।
মুক্তির কথা শুনে হাসিবের মুখে কিছুটা হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু তাকে এখনও ছেড়ে দেয়া হয়নি। তাই সে হাসতে চেয়েও হাসতে পারে না। হাসিটাকে চেপে রাখে। তাদের বস্ লোকমানকে ঈশারা করে। ঈশারা পেয়ে লোকমান পকেট থেকে একটা মাস্ক বের করে নিজের মুখে পড়ে নেয়। হাসিব দেখে তাদের বসও একটা মাস্ক পড়েছে। হাসিব এবার সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। সে বলে উঠে, প্লিজ আমাকে মারবেন না। প্লিজ আমাকে মারবেন না।
চুপ, চুপ চিইল্যা চিল্লি করবি না। কতা কইছস্ তো মাইরা হালামু। চুপ কইরা বইয়া থাক।
লোকমান একটা ছোট্ট কাগজের পুড়িয়া বের করে খুলে ধরে হাসিবের নাকের সামনে। তাদের বস্ হাসিবের মাথাটা সামনের দিকে সোজা করে চেপে ধরে রাখে। লোকমান কাগজে ফুঁ দেয়। কাগজের পাউডারগুলো সব হাসিবের নাকের ভিতর প্রবেশ করে। কয়েকটা কাশি দেয়ার পর হাসিব বেহুশের মতো হয়ে পড়ে। তার চোখ বুজে আসে। হাসিব টের পায় তার চোখের পাতার উপর মলম জাতীয় কিছু একটা লাগানো হচ্ছে।
হাসিব ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেকে একটা রুমের ভেতর দেখতে পায়। সে দেখে তার বাম হাতে লিকোপ্লাষ্ট লাগানো আছে। লিকোপ্লাষ্টের নীচ দিয়ে শিরার ভেতরে একটা ক্যানুলা ঢুকানো আছে। পাশে স্ট্যান্ডে গ্লুকোজ সেলাইনের ব্যাগ ঝুলছে। স্যালাইন প্রায় শেষের পথে। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে হাসিবের হাত থেকে স্যালাইন দেয়ার সুই বের করে নেয়। বলে, স্যার আসছিলেন। আপনি ঘুমোচ্ছেন দেখে চলে গেছেন। কাল সকালে স্যার আপনার সাথে কথা বলবেন।
নার্স আর কোনো কথা না বলে চলে যায়। নার্স চলে যাওয়ার পর হাসিবের মনে একটার পর একটা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। দরজা-জানালা সব বন্ধ। রুমের ভেতর আলো জ্বলছে। এখন কি দিন নাকি রাত ? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আজ কি বার ? আজ কত তারিখ ? এখন কয়টা বাজে ? দেয়ালে কোনো ঘড়ি টাঙ্গানো নেই। রুমের ভেতর তো সে ছাড়া আর কেউ নেই। কাকে জিজ্ঞেস করবে ? এই হাসপাতালে তার কি আজই প্রথম ঘুম ভাঙ্গলো ? নাকি এর আগেও ঘুম ভেঙ্গেছিল। হাসিব বন্ধুদের কাছে শুনেছে ছিনতাইকারীরা যাদের অজ্ঞান করে তাদের ঘুম ভাঙ্গলেও চেতনা ফিরে আসতে নাকি সময় লাগে। হাসিবের এখন সব মনে পড়ছে। সে বুঝতে পারে কেন সে এখানে। সে বুঝতে পারে সে এখন কোনো ক্লিনিক বা কোনো হাসপাতালে আছে। কিন্তু কোন্ ক্লিনিক বা হাসপাতাল এখনো জানতে পারেনি। জানার জন্যে রুমের ভেতরের চারদিকে তাকায়। কোথাও সে এই ক্লিনিক বা হাসপাতালের নাম লেখা দেখতে পায় না। কোথাও কোথাও রোগীর বিছানার পাশের টেবিলের উপর ট্রিটমেন্ট ফাইল রাখা থাকে। হাসিব সে ফাইলটা পাওয়ার জন্যে আশে-পাশে তাকায়। সে কোথাও ফাইলটা দেখতে পায় না। নিজেকে সে নিজে শান্তনা দেয় – ফাইলটা নিশ্চয়ই নার্সদের রুমে আছে। ফাইলটা পাওয়া গেলে এই হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নামটা জানা যেত।
পরের দিন সকালে ডাক্তার এসে হাসিবকে বলে, এখন কেমন আছেন ?
জী ভালো আছি।
ডাক্তার কানে স্টেথেস্কোপ লাগিয়ে হাসিবের হার্টবিট পরীক্ষা করেন। হাত ধরে পার্লস পরীক্ষা করেন। রক্তচাপ কত তা দেখেন। হাসিবের চোখের পাতা নীচের দিকে টেনে ধরে চোখ দেখেন। তারপর বলেন, আপনি আমাদের হাসপালের সামনে বেহুশ হয়ে পড়ে ছিলেন। আমাদের সিকিউরিটি গার্ড আপনাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আজ তিন দিন ধরে আপনি আমাদের হাসপাতালে আছেন। এখন আপনি সূস্থ। বাড়ী যেতে পারবেন।
এর মধ্যে নার্স একটা খাম হাসিবের হাতে ধরিয়ে দেয়। ডাক্তার সাহেব আবার বলেন, একটু হিসেব করে পথ চলবেন। কাউন্টারে বিলটা দিয়ে ছাড়পত্র নিয়ে যাবেন।
হঠাৎ সাইরেনের শব্দে বুকের ভেতর যেমন কেঁপে উঠে হাসিবের বুকের ভেতরটা ঠিক সেরকম করে কেঁপে উঠে। রুমের ভেতরের আসবাব পত্র, এসি, ডেকোরেটিং দেখে হাসিবের ধারণা হচ্ছে এখানে চিকিৎসার খরচ অনেক বেশী। ডাক্তার এবং নার্স চলে যাওয়ার পর সে খামের ভেতর থেকে বিলের কাগজটা বের করে। বিলের পরিমাণ দেখে হাসিবের চোখ বড় হয়ে যায়। বুকে একটা চাপ অনুভব করে। চারপাশে কৃষ্ণকালো মেঘ নেমে আসে। কোথায় কার কাছে সে এত টাকা পাবে। তার সেই নির্ভরতার মুখ, সেই দুখী মেঝ আপা কিভাবে এত টাকা জোগাড় করবে। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার বিল সে কিভাবে শোধ করবে !