অভ্যাস

আমি একজন স্টুডেন্ট। মেসে থাকি। মেসের বাকি সবাই আমার মতই স্টুডেন্ট। যেহেতু সবাই পড়াশোনা নিয়ে বিজি থাকে, ক্লাসে যেতে হয়, টিউশনি করতে যেতে হয়, তাই আমরা আর রান্না বান্নার ঝামেলা না করে সিদ্ধান্ত নেয় যে একটা বুয়া রেখে নিবো। সে শুধু রান্না বান্না করবে আর ঘর ঝাড়ু দেবে। মেস লাইফ শুরু হবার আগে কত কথাই না শুনতাম বুয়াদের নামে! বুয়ারা চোর, ফটকাবাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নতুন বুয়া আসার পর দেখলাম উনি একদমই তেমন নন। বরং পুরোই বিপরীত।

এভাবে দিন যেতে থাকে। বুয়া আমাদের মেসে কাজ করেন প্রায় ৩ মাস যাবত। বুয়ার টাইম শিডিউল ছিল অনেকটা এইরকম। উনি দিনে ২ বার আসতেন। সকালে এসে দুপুরের খাবার এবং সন্ধ্যায় এসে রাতের খাবার রান্না করে দিয়ে যেতেন। যেই রাতের ঘটনা বলছি, সেই রাতে বুয়া সকালে এসে দুপুরের খাবার রান্না করে দিয়ে গেলেন কিন্তু সন্ধ্যায় আর আসলেন না। আমরা বুয়ার বাসায় গেলাম খোঁজ করার জন্য। গিয়ে দেখলাম উনি খুবই অসুস্থ। মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আমরা দেরি না করে ডাক্তার ডাকলাম এবং ঔষধ যা লাগে সব কিনে দিয়ে বাসায় চলে আসলাম।

আসার পর বুঝতে পারলাম যে আজ রাতে খাওয়া হবে না। তখন মোটামুটি অনেক রাত। রাত ১১ টা সাড়ে ১১ টা হবে। আমরা খাবারের হোটেলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। কোনও দোকানেই খাবার পেলাম না। বেশিরভাগই বন্ধ। যেগুলো খোলা আছে তাতে খাবার শেষ। কি আর করা! ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসায় ফিরে এলাম। আমি ঐ মাসের জন্য মেসের ম্যানেজার ছিলাম। মেসের কিছু দায়িত্ব আমার উপর ছিল। যেমন, কয়টা খাবার হবে তা বুয়াকে জানানো। কি রান্না করতে হবে তা বাজার করে দেয়া। দিনের খরচ হিসেব করা ইত্যাদি। এসব কাজ ঘুমনোর আগে করতাম।

তাই প্রায়ই ঘুমুতে দেরি হয়ে যেত। সেদিনও দেরি করেই ঘুমুতে গিয়েছিলাম। রাতে সব দরজা জানালা চেক করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হটাত আমার মনে হল, সদর দরজায় কে যেনও নক করছে। আমি পাত্তা দিলাম না। এতো রাতে আবার কে আসবে! কিন্তু বারবার দরজায় নক করা চলতেই থাকল। আমি বিরক্ত হয়ে কে দরজা নক করছে দেখার জন্য উঠে যাই।

আমি দরজার কাছাকাছি যেতেই নক করা বন্ধ হয়ে গেলো। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকল। আমি দরজা না খুলে ভেতর থেকে কয়েকবার কে? কে? বলে চিৎকার করলাম। কিন্তু কোনও উত্তর পেলাম না। শেষে বিরক্ত হয়ে এসে বিছানায় আবার শুয়ে পড়লাম। এক মিনিট যেতে না যেতেই আবার নকের আওয়াজ পেলাম। এবার মেজাজ গেলো খারাপ হয়ে। নির্ঘাত কোনও বদমাশ পোলাপানের কাজ।

আমি বিছনা থেকে খুব সাবধানে উঠে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, এবারো আমি দরজার কাছাকাছি পৌঁছুতেই নক বন্ধ হয়ে গেলো। এবার আর কে? বলে ডাক দিলাম না। সরাসরি দরজা খুলে ফেললাম! দরজা খুলতে ম্যাক্সিমাম ৩ সেকেন্ড সময় লেগেছিল আমার। খুলে দেখি করিডর ফাঁকা। দরজাটা একটু চাপিয়ে আমি মেইন দরজার কাছাকাছি এলাম (আমরা নিচতলায় থাকতাম) মেইন গেট বন্ধ ছিল।

এতো দ্রুত নক করে, দেয়াল তপকিয়ে চলে যাওয়া কারো পক্ষে আসলে সম্ভব ছিল না। ধরে নিলাম, যেই করুক, সে উপরে গিয়েছে। আমি দরজা খোলা রেখে উপরে যাওয়ার সাহস পেলাম না। চোর এসে ঘর সাফ করে দিয়ে যেতে পারে এই ভয়ে। ঘরে ঢুকে দরজা ভালো করে লাগিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। আমাদের মেসের দরজা আর আমার রুমের দরজার মাঝে আর একটা দরজা আছে। সেই দরজাটাও লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম এবার।

রাত তখন ৩.৩০ এর মত বাজে। শুতে না শুতেই মনে হল আমার আমার রুমের দরজায় কেউ নক করছে। এবার আমি প্রচণ্ড অবাক হলাম। এতো রাতে আমার রুমে কে নক করবে? মনে করলাম, পাশের রুমের হিমেল সম্ভবত টয়লেটে যাবার জন্য উঠে নক করেছে। উঠে দরজা খুলে দিলাম। কেউ নেই! রুমের সামনে বারান্দার মতন জায়গাটা পুরোপুরি খালি।

আমি অবাক হলেও ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো। কার কাজ জানার চেষ্টা না করে, সামনের রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে আবারো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সামনের রুমের লাইট জ্বালানো থাকলে তা আমার রুমে থেকে বোঝা যায়। কিন্তু, শোওয়ার সাথে সাথে খেয়াল করলাম, সামনের রুম থেকে কোনও আলো আসছে না। এবার সত্যি সত্যি ভয় করতে লাগলো।

কারন আমার রুমে কারেন্ট আছে। তাই কারেন্ট চলে গেছে এটা ভাবা যায় না। তার উপর সামনের রুমের লাইটটা নতুন। যাই হোক, আমি একটা চারজার লাইট হাতে নিয়ে সামনের রুমের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখে লাইটের সুইচ অফ করা। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি নিজ হাতে সুইচ অন করে আলো জ্বালিয়েছিলাম। লাইটটা অন করলাম। সাথে সাথে কিচেন থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ আসতে লাগলো। কেউ যেনও বটি দিয়ে কিছু কাটছে।

আমি ভয়ে ঢোক গিললাম কয়েকটা। আসতে আসতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। রান্নাঘরের সুইচটা অন করে আমি যা দেখলাম, তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখি, কয়েকটা পেয়াজ আর মরিচ বটির উপর উঠে সুন্দর ভাবে নিজ থেকেই কাটছে। তারপর কুচি পেয়াজ গুলো নিচে রাখা বাটিতে আপনাআপনি জমা হচ্ছে। আমি একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।

সকালে জ্ঞান ফেরার পর আমাকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করলাম। মেস মেম্বাররা সবাই আমার মাথার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হয়েছিলো জিজ্ঞেস করতেই আমি ওদের পুরো ঘটনা খুলে বললাম। শুনতে শুনতে ওদের মুখ কেমন যেনও গম্ভীর হয়ে গেলো। তারপর এক মেস মেম্বার পারভেজ বলল, “বুয়া খালা আর নেই! সকালে উনার মেয়ে এসেছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলে গিয়েছে কথাটা!”

আমি শোকে আর ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। রাতে যা দেখেছিলাম তা কি বুয়া খালার আত্মা? হয়তবা মারা যাবার পরও অভ্যাসবশত রাতের খাবার তৈরি করার জন্য চলে এসেছিলেন। কিংবা অন্য কিছু! কেই বা বলতে পারে! ঘটনার অংশটুকু আমরা এভাবেই বুঝে নিয়েছিলাম। আপনাদের কি মনে হয়?

একটি ডাক্তারী অভিযান এবং আমার অভিজ্ঞতা

পরিবর্তন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *