অভিশপ্ত ডাক বাংলো

শীতের বিকেল, খোলা মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে হিমেল, পলাশ আর রকি। ঢাকার এক নামকরা কলেজে পড়ে ওরা। সবাই আলোচনায় ব্যস্ত। বিষয় – ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষ শেষ। কিছুদিনের ছুটি আছে। ঘুরতে যাবে তিন বন্ধু। কিন্তু কোথায় যাবে তা ভেবে পাচ্ছে না ওরা। এটা নিয়েই আলোচনা। অনেকক্ষণ আলোচনার পর হঠাৎ রকি বলে উঠল,

– সিলেটে আমাদের পুরানো এক ডাক বাংলো আছে। ওখানে যাবি ? বাংলোর চারিদিক জুড়ে শুধু চায়ের বাগান। খুব মজা হবে।

প্রস্তাবটা পছন্দ হয়ে গেল হিমেল আর পলাশের। রকি বলল যে ও বিষয়টা বাসায় গিয়ে ওর আম্মুকে বলবে। আর কি হল তা রাতে ওদের ফোন করে জানিয়ে দেবে।

বাসায় গিয়ে সন্ধ্যার পর রকি ভাবল, যেভাবেই হোক আম্মুকে পটাতেই হবে। তাই আম্মুর কাছে গিয়ে পেছন থেকে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে খুব আহ্লাদ করে রকি বলল-

– আ-আ-আ-ম-ম-মু।

– আরে আরে কি করছিস ? পাগল ছেলে। কি হয়েছে বল।

– জানো আম্মু, তুমি কত্ত সুন্দর ?

– হয়েছে হয়েছে। কত লাগবে বল ?

– না মানে আম্মু টাকা লাগবে না। আসলে হয়েছে কি…..

– বল না, এত আমতা আমতা করছিস কেন ? কি বলবি বল।

– না মানে হয়েছে কি, আম্মু ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম তো শেষ, তাই আমরা বন্ধুরা ভাবছিলাম যে কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসব।

– ও ভালো তো। যা। তা কোথায় যাবি ?

– আসলে আমরা আমাদের সিলেটে যে ডাক বাংলোটা আছে না, ওখানে যেতে চাচ্ছিলাম।

– এত জায়গা ছেড়ে ওখানেই কেন ?

– ওহ, আম্মু, তুমি তো জানো আমি কোনদিন সিলেট যাই নি। আর তোমরাই তো বলেছিলে যে ওখানে আমাদের একটা ডাক বংলো আছে। আর তার চারপাশে চা বাগান।

– হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু তুই তো জানিস যে ওটা তোর দাদার আমল থেকে খালি পড়ে আছে। সবাই বলে যে ওই বাংলোতে নাকি অভিশাপ আছে। আর ওখানে নাকি ভুত-প্রেতাত্মা আছে।

– ওহ !! আম্মু, তুমিও ওসবে বিশ্বাস কর ?

– না, আসলে তা না। কিন্তু তুই আমাদের একমাত্র ছেলে তো তাই ভয় হয়।

– কিসের ভয় ? তুমিই তো বল যে আমি বড় হয়ে গেছি।

– তা ঠিক। রাতে তোর আব্বু আসলে বলিস। কারণ, এসব বিষয়ে তো আমি একা অনুমতি দিতে পারি না, তোর আব্বুকেও বলতে হবে।

– হুম, ঠিক আছে।

বলে নিজের ঘরে চলে গেল রকি।

রাতে খাবার টেবিলে বসে আছে রকি আর ওর আব্বু-আম্মু।

রকিঃ (নিচু স্বরে) আব্বু।

আব্বুঃ হ্যাঁ, আব্বু ? কিছু বলবে ?

রকি ওর আব্বুকে সব খুলে বলল।

আব্বুঃ যেতে চাও ভালো। কিন্তু ওখানেই কেন ?

রকি কারণ খুলে বলল।

আব্বুঃ তা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি তো জানোই যে তোমার দাদার সময় থেকে ওখানে কেউ থাকে না। শুধু দেখাশোনা করার জন্য একজন কেয়ারটেকার আর দুজন চাকর আছে। আর ওই বাংলো নিয়ে ওই এলাকার সকলে কি যেন বলাবলি করে। ওখানে নাকি ভুত-টুত আছে।

রকিঃ আব্বু, তুমিও !! ওরা গ্রামের মানুষ, অনেক কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। প্লিজ আব্বু, এখন আমাকে বলো না যে তুমি ওসবে বিশ্বাস কর।

আব্বুঃ ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। যাবে। তা কে কে যাবে ?

রকিঃ হিমেল, পলাশ আর আমি।

আব্বুঃ ঠিক আছে। আমি ওখানে ফোন করে জানিয়ে দেব। কবে যাবে তোমারা ?

রকিঃ কাল তো জিনিসপত্র গোছাতে হবে। পরশু যাব।

আব্বুঃ আচ্ছা।

রকি রাতে ফোন করে হিমেল আর পলাশকে সব বলল। পরেরদিন গেল সব গোছাতে আর প্ল্যান করতে। ওখানে গিয়ে কি কি করবে তা ভাবতে ভাবতে রাতে আর ঘুমানো হয়ে উঠল না রকির।

পরদিন সকালে আম্মু-আব্বুর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল ওরা। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল ওদের। বিকেলে বাংলোর পরিবেশ অপূর্ব লাগছিল ওদের। বাংলোর চারপাশ ঘিরে চায়ের বাগান। বাংলোর একটু সামনেই একটা পুকুর। পুকুরপাড়ে একটা বিশাল বটগাছ। অনেক পুরানো। সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগল ওদের। যদিও কেয়ারটেকার বলেছিল ওদের চলে যেতে বিশেষ করে রকিকে। কেননা, সে বলছিল যে ওদের বংশে নাকি কার অভিশাপ আছে। এই বাংলো ওদের বংশের কারো জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু ওরা সবাই তা গল্প বলে উড়িয়ে দেয়।

 

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার পর ওরা ঘুরতে বের হয়। কেয়ারটেকার প্রথমেই সাবধান করে দেয় পুকুরপাড়ের কাছে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু ওরা কিছু না মেনেই পুকুরপাড় পুরোটা ঘুরে দেখে আর সিদ্ধান্ত নেয় গোসল করার। এরপর ওরা চাবাগান দেখতে বের হয়। আধার নেমে এসেছে মাত্র। হাল্কা আলোয় আর ঘন কুয়াশার মধ্যেই ওরা ঘুরতে লাগল। বাগানের কিছুদূর পরপর লম্বা খুঁটির সাথে লাইট লাগানো। তাই খুব একটা অন্ধকার মনে হচ্ছিলনা ওদের। বাগানের ভেতর চাপা রাস্তা। তাই ওরা লাইন ধরে যাচ্ছিল আর গল্প করছিল। প্রথমে পলাশ তারপর হিমেল আর সবার পেছনে রকি। কিছুদূর যাবার পর রকি হঠাৎ তার পিঠে হাল্কা বাতাসের ঝাপটা পেল, যেন কেউ তার পেছন দিয়ে খুব জলদি চলে গেল। পেছন ফিরে তাকাল রকি। এদিক ওদিক দেখল। না কোথাও কিচ্ছু নেই। মাথাটা ঘুরিয়ে নেবে ঠিক এমন সময় সে দেখল বেশ কিছু দূরে সাদা পোশাক পড়া কাউকে। আবছা আলো আর ঘন কুয়াশার জন্য ঠিক বুঝতে পারছিলনা রকি। যেতে লাগল সেদিকে। বন্ধুদের কথা যেন ভুলেই গেছে ও। রকি হেটে চলেছে সেই অজানা কৌতুহলের দিকে। প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, এমন সময় তার মনে হল সে প্রায় সেই পুকুরটার কাছে চলে এসেছে। সে দেখল, পুকুরপাড়ের পাকা করা সিঁড়িপথ। আর তারই একটি সিঁড়িতে একটি মেয়েকে পেছন থেকে দেখতে পেল সে। সেখান থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছিল। রকি কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটির। হঠাৎ তার কাঁধে কারও হাত পড়ল। এক ঝটকায় পেছন ফিরে তাকাল রকি। সে দেখল তার পেছনে সেই কেয়ারটেকার দাঁড়িয়ে। সে বলল-

– এসময় এখানে একা কি করছ ?

– না মানে ওখানে একটা মেয়ে কাঁদছে।

বলতে বলতে সেই জায়গাটা দেখাল রকি। কিন্তু যা দেখল সে তাতে প্রচন্ড শীতেও তার গা ঘামতে শুরু করল। কেউ নেই সেখানে।

– একি ! আরে কোথায় গেল মেয়েটা ? ওখানেই তো ছিল।

– ওখানে কেউ ছিল না। আর কেউ কাঁদছিলও না। বাংলোয় ফিরে চল। তোমার বন্ধুরা তোমায় খুঁজছে। ওদের রেখে একা এখানে এসেছ কেন ?

– ওরা কোথায় ?

– ওরা তোমাকে খুঁজে না পেয়ে বাংলোয় গিয়ে আমায় খবর দেয়। আমি তোমাকে খুঁজতে এখানে এসেছি। আমি  এখানেই থাকবে।

– কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন যে আমি এখানে আছি ?

– বাংলোয় ফিরে চল। তোমার বন্ধুরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

– কিন্তু আপনি কিভাবে……….

– বললাম না তাড়াতাড়ি বাংলোয় চল।

রকি আর কথা না বাড়িয়ে তার সাথে বাংলোয় ফিরে এল। ঘটনার কথা রকি ওর বন্ধুদের বলল না। রাতে খেতে বসে রকি বারবার সেই মেয়েটির কথা ভাবছিল। তার কান্নার সেই মায়াবী সুর যেন বার বার ফিরে আসছিল রকির। সে বার বার সেই মেয়েটার কথা ভাবছিল।

রাতে খাওয়া শেষ করে ঘরে শুয়ে শুয়ে গল্প করছিল ওরা। গল্প করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ল ওরা সবাই।

মাঝরাতে হঠাৎ কোন কিছুর চিতকারে ঘুম ভেঙে যায় রকির। মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে দেখে তিনটা পঁচিশ বাজে। চোখটা বন্ধ করতেই বাইরে থেকে সেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। রকি মোবাইলে টর্চ জ্বালিয়ে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সে দেখল সাদা পোশাকে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ” আরে এ তো সেই পুকুরপাড়ের মেয়েটা ” – মনে মনে ভাবতে লাগল রকি। হঠাৎ করেই রকি বলে উঠল-

– এই, এই মেয়ে, কি হয়েছে তোমার ? কে তুমি ? কাঁদছ কেন ?

মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে সোজা বাংলোর প্রধান দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। রকিও গেল পিছু পিছু। কিছুদূর যাবার পর রকি আবার বলল –

– এই মেয়ে, কোথায় যাচ্ছ ? দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি।

এবার মেয়েটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকাল সে। মেয়েটিকে দেখে রকি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এমন মায়াবী মুখ সে আগে কোনদিন দেখে নি। চোখদুটি আরো বেশি মায়াবী। রকি কি কিছু না বলে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। একটু পর রকি দেখল মেয়েটির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই রকি খেয়াল করল মেয়েটির চোখদুটি ঘন কালো থেকে রক্তজবার মত লাল হয়ে গেল। তার চোখ বেয়ে পানির পরিবর্তে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। রকি ভয় পেয়ে চিতকার দিতে চেষ্টা করল কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না। ভয়ে ঘামতে লাগল রকি। এমন সময় মেয়েটি বলে উঠল –

– আমার সাথে এস।

তার মায়াবী কন্ঠের এক কথায় রকি যেন জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই সে চলতে লাগল মেয়েটির পিছু পিছু। মেয়েটি তাকে নিয়ে গেল সেই পুকুরপাড়ে। মেয়েটি নামছে পাড়ের সিঁড়ি বেয়ে। রকিও নামতে লাগল। মেয়েটি যেতে যেতে পুকুরের মাঝখানে চলে গেল। রকি শেষ সিঁড়িতে পা দিয়েছে। পুকুরে পা দিতে যাবে ঠিক এমন সময় হঠাৎ তার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। চেতনার জগতে ফিরে আসে রকি। কোথায় সে ? চারিদিকে তাকিয়ে দেখে সে। কোথাও কেউ নেই। আর সে এই পুকুরপাড়ে এত রাতে একা কি করছে ? ভাবতে ভাবতে সব ওলটপালট হয়ে গেল ওর। এমন সময় রকি তার বন্ধুদের ডাক শুনতে পায়। ওরা রকিকে খুঁজতে বের হয়েছে। রকি এক দৌড়ে ওদের কাছে যায়। গিয়ে সব খুলে বলে। সন্ধ্যার ঘটনাও বলে। এমন সময় কেয়ারটেকার চলে আসে। সে বলল-

– বলেছিলাম এখান থেকে চলে যেতে। তোমাদের বংশের উপর এ বাংলোর অভিশাপ আছে। কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই তোমারা সকালে এখান থেকে চলে যাও।

ওদের তিনজনের কেউই কিছু বলল না। সবাই আতংকিত। ওরা সিদ্ধান্ত নেয় সকালেই চলে যাবে। বাংলোয় ফিরে যায় সবাই। বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারে না ওরা।

সকাল হয়েছে। ওরা তিনজন নাস্তা করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হল। গাড়িতে বসে তিন বন্ধু। রকি ভাবছে যে, এক দিনের মধ্যে তার সংগ্রহ অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতা।

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!