অভিযোগ-কানন

 

আমাদের পাশের বাড়িতে লালমুদ্দিন এর পরিবার থাকে। তার বড় মেয়ে হাজেরা আমার সমবয়সী। প্রায় সময়ই ওর সাথে আমি খেলাধুলা করি। হাজেরা যে বাড়িতে থাকে সে বাড়িতে  অনেক ধরনের ফলের গাছ আছে – বরই, পেয়ারা, আম, জাম ইত্যাদি। আমি সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। ওদের বাড়ির পাশ দিয়েই স্কুলে যেতে হয়। প্রায় সময়ই হাজেরা আমাকে জাম, পেয়ারা, বরই দিত। আর আমি তা খুশি মনে গ্রহন করতাম। একটু  লোভও লাগতো, তাই আগে আগেই স্কুলে যেতাম। কারণ হাজেরার সাথে দেখা না হলে তো আর বরই, আম পাওয়া যাবে না। তাই স্কুলে যাবার তাড়াটা একটু বেশিই ছিল। সবাই ভাবত আহা আমার কী আগ্রহ স্কুলে যাবার। বরই পেয়ারার লোভ সে কি আর জানতো! আমি প্রতিদিন স্কুলে যাই, কিন্তু হাজেরা স্কুলে যায় না। তাই হঠাৎ একদিন হাজেরাকে আমার সাথে স্কুলে যাবার জন্য  অনুরোধ করলাম। সে সোজাসাপটা উত্তর দিল, আমি স্কুলে যাবো না। আমি জানতে চাইলাম কেন স্কুলে যাবি না। তার সোজা উত্তর, গরীব মানুষেরা স্কুলে পড়ে না। আমিও তাই বুঝলাম। হাজেরাদের মতো পরিবারের মেয়েরা বুঝি পড়ালেখা করে না বা করার দরকার হয় না, কারণ ওরা পরের বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজ করে, পড়ালেখা শিখে কি হবে! নদী থেকে কলস ভরে পানি আনতে তো আর লেখাপড়ার প্রয়োজন হয় না। হায়, তখন যদি বুঝতাম, আমি কিন্তু ওকে বর্ণমালা শিক্ষার জন্য তাগাদা দিতাম। আমি যখন ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে স্কুলে যেতাম, তখন দেখতাম ও মাটিতে দাগ কেটে এক্কা-দুক্কা খেলে আর আমি স্কুলে যাই। প্রতিদিনই আমি ওকে বলতাম, চল স্কুলে যাই। ও যেতো না, বলতো আমি স্কুলে যাবো না, তুমি যাও। হাজেরার তো বই-খাতা-পেনসিল ছিলনা তাই প্রতিদিন ওকে একটি করে বর্ণ মাটিতে লিখে দিয়ে যেতাম আর বলতাম শিখতে আর লিখতে, আগামীকাল পড়া ধরবো – বলতে হবে, লিখতে হবে। এমনি করে তাকে বর্ণমালার সাথে পরিচয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আমার। সেও চেষ্টা করছিল। কিন্তু বিধি বাম! আমি তাকে স্কুলগামী করতে পারিনি। তারপর আমার নিজের শিক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসার কারণে হাজেরার সাথে বিচ্ছেদ ঘটলো অ, আ, ই তেই।

অনেক বছর পরে হাজের সাথে আবার দেখা হলো। জানতে চাইলাম, কেমন আছো?
– ভালই আছি।
অনেকদিন পর সেও আমাকে দেখে উত্সাহে কাছে এলো, জানতে চাইলো আমি কেমন আছি।
ছেলেমেয়ের খবর নিলাম। স্বামীর কথা বলতেই একটু অন্যমনস্ক হলো
– স্বামীর জন্য গ্রামে আসতে পারিনা!
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
– কেন?
সে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জলের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে –
– আমার স্বামী চুরি করে! গ্রামের লোকজন বিচার করে বের করে দিয়েছে গাম থেকে।

ওর স্বামী্র নাম শরীফ। শরীফ গ্রামে আসলেই চুরির ঘটনা ঘটে। তাই হাজেরাও গ্রামে আসতে পারেনা, স্বামীর জন্য লজ্জ্বা হয়।

সেই শিশুকালের কথা মনে করে সে দু;খ করে
– সেদিন যদি তোমার কথা শুনে স্কুলে যেতাম, লেখাপড়া শিখতাম তাহলে আমার আর চোরের বউ হতে হত না। আজ সবাই আমাকে চোরের বউ বলে। আজ আমি চোরে বউ।
এ বলেই হনহন করে আমার সামনে থেকে ছলছল চোখে চলে গেল হাজেরা। আর আমার সামনে অভিযোগটি হিমালয়ের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!