অবয়ব —– হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

নিতাই নাকি একেবারে রাতারাতি ব’দলে গেছে। গোটা কুবেরপুর গ্রামজুড়ে ওকে নিয়ে এই তিনটে দিনেই একটা মাত্র আলোচনা ছড়িয়ে প’ড়েছে। সকালবেলা পঞ্চায়েত প্রধান সাহেবের সাথে দেখা পণ্ডিতমশাই মাধব ভট্টাচার্জের। প্রধান সাহেব জিজ্ঞেস ক’রলেন,
— কী ব্যাপার, পণ্ডিতমশাই! কি সব শুনছি!
পণ্ডিতমশাই-এর বয়স হয়েছে। ভ্রু-তে লোমগুলো বিরাট বিরাট আকৃতি নিয়েছে। তাও পাক ধ’রে গেছে আজকাল। এ অবস্থায় তা কোঁচকালে তাঁকে একটা অদ্ভুত জীবের মতো দেখতে লাগে। তিনি তাঁর সেই ভুরু-টুরু কুঁচকে জানতে চান— কী শুনছেন, বলুন তো?
— এই যে আমাদের নিতাই, সে নাকি হঠাৎ বেমালুম ব’দলে গেছে? এটা কি সত্যি?
— আমার সাথে তো তার দেখা হয়নি, প্রধান সাহেব। তবে আমিও তেমন একটা শুনলাম বটে।
এরপর পণ্ডিত মশাইয়ের সাথে হাটের পথে দেখা গ্রামের একমাত্র উচ্চশিক্ষিত ছেলে চৌধুরীদের অনুপ-এর। তাকে ধ’রলো পণ্ডিতমশাই— কী গো অনুপ, কী শুনছি! আমাদের নিতাই নাকি রাতারাতি কী একটা ব’দলে গেছে? তুমি কি জানো কিছু? অন্য কাউকে তো জিজ্ঞেস ক’রতে পারি না। চাষাদের গ্রাম। কী ব’লতে কী ব’লবে। তুমি বলো দেখি। তুমি তো শিক্ষিত মানুষ, গাঁ-এর গর্ব। তুমি কিছু জানো?
গ্রামের পণ্ডিত যেমন হয় হোক, বা তার পাণ্ডিত্যের দৌড় যতটুকু থাক, অনুপ সম্মান করে পণ্ডিতমশাইকে। শুধু তিনিই নন। বয়োজ্যেষ্ঠ সকলেই সম্মান পায় তার কাছ থেকে। তাই সে তার নিজের বিনয়েই পণ্ডিতমশাইকে প্রণাম ক’রে উঠে দাঁড়াতেই পণ্ডিত যেই ব’ললেন, ‘জয়োস্তু’ তখন অনুপ উত্তর দিলো,
— জানি মানে, পণ্ডিতমশাই, দেখেছি আজ নিতাইকে। দোকান খুলে ব’সেছে। সত্যি এ একেবারে অন্য নিতাই।
— কি রকম? কী রকম?
—- কারণটা যাই হোক, আমি খুব খুশী। তাই কথাটা আগে শুনেছিলাম ব’লে নিজেই ডেকে যাচাই ক’রলাম— কী গো নিতাই? কালীপুজো কেমন কাটলো? তা সে তো দিব্যি একেবারে শহরের কায়দায় ব’লল, ‘ভালো, অনুপ দাদা। এবারে বড়ো ভালো কেটেছে।’
— তোমাকে একেবারে ‘দাদা’ ব’লল! না, মানে….. তেমনটা বলাই উচিত। কিন্তু সেটা তো বলার মানুষ ও নয়। অনুপের থেকে সম্মতি পেয়ে আবার পণ্ডিত মশাই জানালেন— তাহলে তো সত্যিই গ্রামের মানুষ মিথ্যে কিছু ব’লছে না। আমাকে তো প্রধান সাহেব শুধোলেন। আমি তো ঠিক কিছু ব’লতে পারলাম না। তা কালীপূজো তো গেছে ধরো গত ছাব্বিশে। আজ একত্রিশ। কী ক’রে এমনটা হয় বলো তো?
— সে তো পণ্ডিতমশাই আপনারাই ব’লতে পারবেন। আপনাদের মতো অভিজ্ঞতা কি আমার আছে? বিনয় করে অনুপ।

গ্রামের অশ্বত্থ গাছতলাটায় বসা তিন বুড়ো। বিকেল তখন সাড়ে চারটে মতো বাজে। রোজই তারা বসে সেখানে। তাদের মধ্যেও একই আলোচনা। গাছের তলাটা বিড়ির ধোঁয়ায় ধূমায়িত ক’রে দিয়ে গ্রামের যোগেন খুড়ো ব’লল,
— কী গো, অপরেশ দা? আমাদের নিতাইকে কি কোন পরীতে পেয়েছে, না কেউ কোন বান-টান মেরেছে? এমনটা হোল কী ক’রে বলো তো?
— আমিও তো তাই ভাবছি। না, হ’য়েছে, ভালোই হ’য়েছে বটে। কিন্তু যা হোল, তা হোল কেমন ক’রে, তা না জেনে তো পারছি না। নিতাই তার বউকে নিয়ে একেবারে হাটে যাচ্ছে, দেখলাম আজ। এ তো দেখেছি, ধরো গিয়ে, আজ থেকে বছর সাতেক আগে। মানে সে বচ্ছর ও মেয়েটাকে বিয়ে ক’রে আনলো। কী, দামোদর? ঠিক ব’লছি তো নাকি?
— আপনি কি আর ভুল ব’লবেন, অপরেশ দা! আপনার স্মৃতি তো এতোটা নষ্ট হয় নি। আপনার তো বয়সও তো ততটা হয়নি, দাদা। দাদার পোঁ ধরে দামোদর মাঝি। তারও বয়স প্রায় পঁচাত্তর। একটু কেশে নিয়ে আর খ্যাঁক করে থুঃ মেরে শেষে ব’লল— মানুষের পরিবর্তন! কে-ই বা ব’লতে পারে!
— হ্যাঁ, এতদিন তো মেয়েটাকে….. কী যেন নাম ওর বউ-টার? নিতাই-এর বৌ-এর নাম মনে করার চেষ্টা ক’রে অবশেষে মনে প’ড়তে মন্তব্য ক’রলো যোগেন খুড়ো— হ্যাঁ, পতিমা। পতিমা। তা সেই পতিমাকে তো গোটা গেরামের মানুষ পতি রাতেই কান্না ক’রতেই শুনেছে। কোনো কোনদিন তো ঘর থেকেই বের ক’রে দিয়েছে মেয়েটাকে।
যোগেন খুড়োর কথাকে সমর্থন ক’রে দামোদর এও ব’লল— এর সঙ্গে গালিগালাজ তো ছিলোই। প্রধান সাহেব কতগুলো মিটিন ক’রেছেন, বলুন! কিছু ক’রতে পেরেছেন? নিতাইকে তো কেউ কেউ চড়টা-চাপড়টাও মেরেছে। হ’য়েছে তাতে কিছু?
— তাহলে হোল কী ক’রে! ভোজবাজিটা ক’রলো কে?
উত্তর মেলে না। বিড়ির ধোঁয়া আরও পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠে বেচারা অশ্বত্থ গাছটাকে বেষ্টন ক’রে। নিতাই ব’দলে যাওয়ায় বোধহয় এই বুড়ো অশত্থ গাছটার বিরাট অপরাধ হ’য়ে গেছে।

দুপুরে খেয়েদেয়ে উঠে যে বয়স নির্বিশেষে গ্রামের মহিলারা ঘোষবাড়ির দালানে ব’সে এ বাড়ির বউ-এর, আর সে বাড়ির ছেলের আদ্যশ্রাদ্ধ করে, শাপ-শাপান্ত করে, তাদের জটলাতেও নিতাই। প্রচলিত আলোচনা নয়। নিতাই-এর বৌ নাকি আবার কপালে বড়ো ক’রে সিঁদুরের টিপ প’রছে, পায়ে আলতা দিয়েছে, পাটভাঙা শাড়ি প’ড়েছে। এ দৃশ্য তো গ্রামের মানুষ গত বছর পাঁচ-সাত ধ’রে দেখছে না। কে ব’লবে, এটা ওর শ্বশুরের ভিটে! একটা কালো ঝুল কাপড় প’রে থাকতো বেচারা। ঘর থেকেই তো বেরোতো না। মুখে, পিঠে, ঘাড়ের পাশে, এমনকি শরীরের নানা জায়গায় কালশিটে প’ড়ে গিয়েছিলো। নিতাই মদ খেয়ে ফিরতো বাড়িতে। প্রায় প্রতি রাতে এক নাটক। গ্রামের নিতাই-এর বাড়ির একেবারে লাগোয়া পড়শিরা অমন কচি বউ-টাকে মারছে শুনে প্রথম প্রথম কানে আঙ্গুল চাপা দিয়ে থাকতো। কী ক’রবে! কাঁহাতক এই একটা ব্যাপারে রোজ রোজ ও বাড়ি গিয়ে শাসানো যায়! পরিবর্তন তো কিছু নেই। পরে ধীরে ধীরে এমনটা শোনা যেন একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো ওদের সকলের।
ঘোষগিন্নী ব’লল— আরে তুই তো সম্বন্ধ দেখে বে ক’রেছিস। না হয় তোর বৌ কালো। কিন্তু ঐ চুল? গোটা গেরামে কার আছে, বলো?
— তা কেন? পতিমেকে কি দেখতে মন্দ? গেরামে তো অমন সুন্দরী বৌ একটাও নেই। জনার্দন গিন্নী মন্তব্য করে।
গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের গিন্নী জানায়— আহা, গায়-গতরেও তো পতিমে বেশ। এত ঝে মার খেয়েছে এতকাল ধ’রে, চেহারাটা দেখেছো? একটু টস্কেছে কি? তাহলে নিতাই-এর সমস্যাটা কী ছিল, বলোদিনি?
— কে ঝানে, বলো? কে উত্তর দিতে পারবে! যাক, মেয়েটা অন্তত বেঁচেছে এবারে।
— আরে দ্যাখো, কতদিন এমনটা থাকে। বউ-টা তো বাঁজা। আজ এত বচ্ছর গেলো। একটাও তো কোল আলো ক’রে এলো না।

নিতাই এ গ্রামের ছেলে। বয়স তার তিরিশ, কি বত্রিশ। মা নেই তার ছোটবেলা থেকে। বাবা মৃত্যুকালে তার ছোট্ট মুদিখানাটা দিয়ে যায় ছেলেকে আর তার বিয়েও দিয়ে যায়। মেয়ে সে নিজেই পছন্দ ক’রে দিয়ে গেছে। নাম প্রতিমা। বাপের বাড়ি মেয়েটার এতোটাই দূর যে, তাদের পক্ষে নিয়মিত মেয়ের খবর নেওয়া হয় না। তাছাড়া তারা গরিব। গরিবের বেশি খবরা-খবর করা তো ধৃষ্টতা। তবে প্রতিমা সুন্দরী। সুন্দরী ব’লতে যথেষ্ট সুন্দরী। কিন্তু তার রঙটা ভালো ভাষায় বলতে গেলে ‘চাপা’। কিন্তু নিন্দুকেরা ব’লবে ‘কালো’। মাথায় তার এক ঢাল কালো চুল। গ্রামের প্রায় কোন নারীই শহরের নারীদের মতো না মাখে দামী দামী শ্যাম্পু, না মাখে আরো নানা নাম-না-জানা অত্যাধুনিক প্রসাধনী। কিন্তু তাদের চুল আর ত্বক যেন প্রকৃতি এই দূষণেও রক্ষা ক’রে রেখেছে। প্রতিমা তাদের মধ্যেও ব্যতিক্রম। যেদিন সে মাথায় মেটে সাবান মাখে, সেদিন দেখার মতো। একটা দূর পর্জন্ত চুল আর বড়ো হ’তে দিতে নেই— এমন প্রাচীন সংস্কার আছে ব’লে সে চুল কেটে কেটে একটু খাটো ক’রেই রাখে। তা সত্বেও সেই চুলের দুরন্তপনা সহ্য ক’রতে হয় প্রতিমাকে। বিয়ের এতগুলো বছর কেটে গেছে কিন্তু কোন সন্তান হয় নি ওদের। গ্রামের মানুষ মনে করে, এটাই হয়তো নিতাই-এর হিংস্র হ’য়ে ওঠার কারণ। কিন্তু স্বয়ং নিতাইও জানে না, খুঁতটা কার শরীরে। প্রতিমা, না সে নিজে? এদেশে, সন্তান না হলে, বিশেষ ক’রে গ্রামাঞ্চলে, চোখকান বুজে বউ-এর দোষ দেওয়ার চল আছে। বউ বাঁজা। ওদের পরিবারে তেমনটাই হয় কিনা, জানে না কেউ। তবে বিয়ের বছর দুয়েক যেতে না যেতেই ধীরে ধীরে সকলে টের পেয়েছে যে, নিতাই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরছে আর বৌ-কে মারধোর ক’রছে। প্রথম প্রথম প্রতিমা গলা চেপে ধ’রে যন্ত্রণা সইতো যাতে বাইরের মানুষ টের না পায়। লজ্জা পেতো প্রতিমা। কিন্তু কালে কালে তা গেছে। আর্তনাদ মুখ দিয়ে বেরিয়েই আসে। মানুষ জানতে শুরু করে।
কিন্তু সেই নিতাই আজ দিন তিনেক কেমন যেন চুপচাপ। মাথা নিচু ক’রে বাড়ি ফেরে, মাথা নিচু ক’রেই বাড়ি থেকে বেরোয়। ওকে যেন চেনাই যায় না, যেমনটা চেনা যেতো না ওর প্রথম দিকে মদ্যপ চেহারাটা। এমনকি গতকাল তো বৌকে নিয়ে হাটে গিয়েছিল পর্জনত। অনেকে দেখেছে। কিন্তু এ পরিবর্তন সাধন হোল কী ক’রে, কেউ জানে না। জানে শুধু প্রতিমা আর দুর্গা মন্দিরের গুনিন বুড়ি। তারা যে জানে, তাও কেউ জানে না। এটা তো জিজ্ঞেস করা যায় না, ‘হ্যাঁগো বৌ, তোমার সোয়ামী এমনটা ব’দলে গেলো কী ক’রে?’
দুর্গা মন্দিরের গুনিন বুড়ি সারা বছর এই নিস্তরঙ্গ অশিক্ষিত গ্রামকে প্রতারণা ক’রে খায়। জল পড়া, তেল পড়া, বাটি চালান, ঘট চালান এসব ক’রে নিজের একার ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। কোনদিন তার মনে গ্রামের কারোর জন্যে মঙ্গল চিন্তা এসেছে কিনা, জানে না কেউ। তবে তাকে ঠগ ব’লবে কার সাধ্য! সে গোটা গ্রামের রক্ষাকর্ত্রী। মন্ত্র-তন্ত্র, ঝার-ফুঁক যে কী মারাত্মক কাজ করে, তা জানে গ্রামের মানুষ, বিশেষত মহিলা সমাজ।
সেই গুনিন বুড়ি দিয়েছে এই মোক্ষম দাওয়াই। প্রথমটা তো দাওয়াইটা শুনে মাত্র কেঁপে উঠেছে প্রতিমা। এমা! লজ্জা করে না! এটা কি করা যায় নাকি? ও কি কখনও এসব ক’রেছে! তাছাড়া যারা যাত্রাপালাতে একটু-আধটু পার্ট করেছে, তারা পারলেও প্রতিমা পারবে কী ক’রে! ও ব’লেওছিলো,
— না না। এ আমি পারবো না। এসব করা যায় নাকি? আমার কল্যাণ-অকল্যান-এর ভয় আছে না!
— কীসের অকল্যাণ! তোর সোয়ামীর কল্যাণ থেকে বড়ো কী আছে রে, বেটি! এই ঝে সে পত্যেক রাতে ধেনো খেয়ে বাড়ি ফেরে, এতে তুই তার কোন কল্যাণ ক’রছিস?
— সবাই কি সব পারে, মা?
— সোয়ামীর জন্যে প্রাণ দিলো সতী, যমের সাথে যুদ্ধ করলো সাবিত্রী আর মরা সোয়ামীকে ফিরিয়ে আনলো। আর তুই এটুকু পারবি না? এরপর তো ওর লিভারটা পচে যাবে রে। তখন কার আশ্রয় পাবি? আর তুই কি সারাজীবন শুধু প’ড়ে প’ড়ে মারই খাবি! সারা গায়ে তো তোর কালশিটে প’ড়ে গেছে রে। তুই কী ইস্তিরি রে? মনটাকে শক্ত কর।
— মা, সোয়ামী হ’লেও তো সে পুরুষ মানুষ। তার সামনে এমন ধারা কি পারা যায়!
গুনিন বুড়ি চাপা ধমক দ্যায় প্রতিমাকে— তোর বিয়ের পর সেই পত্থম রাত্তিরের কথা মনে কর। তুই কি জীবনে এভাবে কোন পুরুষ মানুষের পাশে শুয়েছিলি! পেরেছিস তো। কী ক’রছিস, ভাবিস না। কেন ক’রছিস, সেটা ভাব। তাহলেই পারবি। তোর এ ছাড়া মুক্তি নেই।
সেদিন ভূতের মতো বাড়ি ফিরে এসেছিলো প্রতিমা। মনের মধ্যে একটা দোদুল্যমানতা। আমি পারবো তো! এত সোজা কথা নয়। কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে তাকে গুনিন বুড়ি। প্রতিমাকে সঙ্কোচ ক’রতে দেখে গুনিন বুড়ি অভিযোগ ক’রে বলেছে,
— তুই কি মনে করিস, একজন পুরুষ তোকে মন্ত্র প’ড়ে বিয়ে ক’রে এনেছে ব’লে তুই অমনি তার বৌ হ’য়ে গেলি? অতো সোজা নয়। ‘স্ত্রী ধর্ম’ পালন ক’রতে হয়। তবেই তো তোর অধিকার জন্মাবে স্বামীর ওপর। তা নয়তো তো তুই শুধুই তার বেবুশ্যে হ’য়ে থাকবি, সে তোর ভাতার হ’য়ে থাকবে। সেটাই কি তুই চাস? তাতে তো শুধু তোর স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ক’রলে হবে না। মহাকাল প্রশ্ন ক’রবে, ‘তুই কী ক’রেছিস তোর স্বামীর জন্যে? কতটুকু করেছিস?’ ‘স্ত্রী ধর্ম’ তো সোজা কথা নয় রে, পতিমে।
প্রতিমা খুবই ঈশ্বর ভক্ত মেয়ে। বাংলার একটি হিন্দু পরিবারে শিক্ষিতা-অশিক্ষিতা নির্বিশেষে নারীরা যেমন হ’য়ে থাকে, তেমনই প্রতিমা। প্রতিমার সারাদিন নানা দেবতার পুজোতেই আর উপবাসেই কাটে। তার প্রতিটা সপ্তাহের তিথি, লগ্ন, গ্রহ, নক্ষত্র একেবারে কণ্ঠস্থ। সারাদিনই একটা পঞ্জিকা হাতে নিয়ে সে ঘোরে। পঞ্জিকার যাবতীয় বিধিনিষেধ তার নখদর্পণে। ঐ পঞ্জিকাটিই যেন প্রতিমার ‘রবীন্দ্র সাহিত্য’ বা কোনো অমূল্য গ্রন্থ। সর্বক্ষণ তাই প’ড়ছে আর মেনে চ’লছে বিধান। আসলে মানুষ যত সঙ্কটের মধ্যে পড়ে, ততই সে দেবতার প্রতি ঝুঁকে পড়ে, পূজার্চনা করে, উপবাস করে আর নিজেকে আরো আরো দুর্বল করে। প্রতি রাতে নিতাই-এর হাতে মার খেতে শুরু ক’রলে প্রতিমা আরো দেবতায় আসক্তা হয়। এবার ও যখন দুর্গাপুজোয় অষ্টমীতে দুর্গা মন্দিরে অঞ্জলি দিতে এসেছিলো, তখন এই গুনিন বুড়ি ধরে ওকে। ওকে চেনে এই গুনিন বুড়ি কিন্তু কখনই এমনতর কোনো কথা বলেনি। অথচ আজ ওকে ধ’রে ডেকে নিয়ে যায় তার নিজের ঘরে। এই দুর্গা মন্দিরেই থাকে গুনিন বুড়ি। মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তার জন্যে একটা কুঠুরি দেওয়া আছে।
অন্ধকার সেই কুঠুরির মধ্যে প্রতিমাকে ব’সিয়ে লাল লাল চোখ পাকিয়ে গুনিন বুড়ি ব’সেছে ওর সামনে। প্রতিমার প্রানপাখি ভয়ে এই ওড়ে তো সেই ওড়ে। জায়গাটাই কেমন যেন অন্ধকার, রহস্যময়। রহস্যময় গুনিন বুড়ির কণ্ঠ,
— তুই পতি বচ্ছর দেবী মা-র কাছে অঞ্জলি দিতে আসিস। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী……. সব তিথিতেই আসিস। কী বলিস দেবী মা-কে? কী চাস? মা কালিকার কাছেও তুই অঞ্জলি দিস। কেন রে, মেয়ে? অঞ্জলি যদি দিবি তবে সোয়ামীর কাছে মার খাস কেন? মা কি তোকে মার খেতে ব’লেছে প’ড়ে প’ড়ে? আমি তো আগে জানতাম না। তোর সাথে যারা আসে, আমাকে তারাই ব’লেছে তোর দুঃখের কথা। তুই দুর্বল কিন্তু তুই মা কালিকা, দেবী চণ্ডিকা সকলের কাছে পুজো দিস। কেন? দেবী মাকে অপমান ক’রতে তোর বাঁধে না?
— আমি অপমান ক’রি না। আমি পবিত্র মনে, শুদ্ধ বস্ত্রে পুজো দিই মা-র।
— ওটুকুতেই কি হবে? তুই দেবী কালী মায়ের পুজো ক’রিস আর নিজে তোর জানোয়ারের মতো সোয়ামীকে ভয় করিস। এতে মায়ের অসম্মান হবে না? তুই পুজো দিস কেন? মা তোর পুজো নেয় না রে, পাগলী। তোর পুজো মাটিতেই গড়াগড়ি খায়।
মহা সমস্যায় পড়ে প্রতিমা। মনে মনে ভাবে, তাহলে এতদিন ধ’রে যে পুজো সে দিয়ে এসেছে, তা মাটিতে গড়াগড়ি গিয়েছে! তাই এর একটা উপায় চাই ব’লেই গুনিন বুড়িকে বলে— আমাকে মা তুমি কী ক’রতে বলো?
— আমি কি বোলব রে বেটি? মার মূর্তি দেখিস না, তার করাল দৃষ্টি দেখিস না, তার লোল জিভ দেখতে পাস না? তাকিয়ে দেখিস, মা-কে কি এমন দুর্বল মনে হয়? মা কি অসুরের অন্যায়কে মেনে নিয়েছিলো? তুই কালীপুজোর ঘোর অমাবস্যার দিন সকালে আমার কাছে আসবি। আমি তোকে মন্ত্রগুপ্তি দেবো। তাতেই তোর মুক্তি। খবর্দার, এ মন্ত্র কিন্তু অন্য কাউকে বলা মানা।
কালীপূজোর দিন সকালে তাকে মন্ত্র দিয়েছে গুনিন বুড়ি। ফেরার পথে প্রতিমা রাস্তা থেকে পুড়িয়ে ফেলা গোটা কুড়ি তুবড়ির খোল প’ড়ে থাকতে দেখে যত্নে তুলে নিচ্ছিল। গ্রামের কামার বৌ দেখে ফেলেছে। অমনি ধ’রেছে,
— কী গো বৌ? ওতে কি হবে?
উত্তর না দিয়ে চুপচাপ স’রে পড়েছে প্রতিমা। এগুলো তো তার ব্রহ্মাস্ত্র, বরুনাস্ত্র আর আরো নানা অস্ত্র। আজকে তো এইসব তার চাই।

কালীপুজোর দিন রাত এগারোটা। সেদিন অন্ধকার আরো অন্ধকার হ’য়ে আসছিলো। কালীপূজোর অমাবস্যা সাধারণ নৈশ অমাবস্যার মতো নয়। একটা কালো ভারী চাদর যেন গায়ে জড়িয়ে এই রাতটা দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রামগুলোর মাঠে, ঘাটে, হাটে, বাজারে, মন্দিরে….. কোথায় নয়। সর্বত্র চাপ চাপ অন্ধকার। লোকে বলে, এ সময় বেশি রাতে পথে এসে নামে ডাকিনী যোগিনী। নিতাইদের বাড়িটাও একটা অন্ধকারের চাদর গায়ে দিয়ে কোনো আজ এক অজানা ঘটনার আশঙ্কায় চুপ ক’রে দাঁড়িয়েছিলো।
নিতাই তার মুদিখানা-কাম-মনোহারি দোকান চালাতো বটে, কিন্তু সে ছিলো কালীভক্ত। আজ সে বিশেষ কারণ বারির পাত্রে চুমুক মেরে যায় পুজো দিতে। এমনটাই ক’রে থাকে প্রতি কালীপূজোয়। আজকের দিনে দোকানে একটু আতশবাজি-টাজি বিক্রি হয়। তাতে দুটো পয়সা বেশি আসে। তাই একটু দেরী ক’রেই ফেরে বাড়িতে। কিন্তু ঘরের সামনে এসে দ্যাখে, ঘরের দরজা বন্ধ। সারা বাড়িতে প্রতিমা আলো জ্বালেনি। নিতাই গলায় মদ ঢেলে এসেছে আগে থেকেই। এটা আজ রাতের পানভূমিকা। এরপর সারা রাত পুজো দেখবে আর মদ খাবে। মাঝে মাঝে চেঁচাবে ‘জয় কালী’ বলে। তাই নেশার ঘোরে এমনটা দেখে মাথাটায় তার আগুন লেগে যায়। আজকে পুজোর দিন। আর প্রতিমা বাড়িতে নেই নাকি? আছে তো আলো জ্বালেনি কেন? আজ ওর কপালে আছে।
আসলে প্রতিমাকে মারধোর করতে চায় না নিতাই। মন থেকে চায় না। কিন্তু পেটে একবার মদ প’ড়লে যে মেজাজ ঠিক থাকে না। এই সময় যদি এই নিয়ে বা ঘরের এটা ওটা নানা সমস্যা নিয়ে বৌ কিছু বলে, তবে তো মাথায় আগুন জ্বলে। ব্যাস্। মারধোর শুরু হ’য়ে যায়। কতবার ভেবেছে, আর মদ নয়। কিন্তু রাত ন-টা বাজলেই শরীরের মধ্যে কেমন যেন ক’রতে থাকে! আর একটা পশু হ’য়ে ওঠে নিতাই। এসব ও নিজেই জানে।
এইসব ভাবতে ভাবতে এবার দরজায় ঘা মারে নিতাই। একবার, দুবার, তিনবার। না, খুলছে না তো? দরজা খোলা, না বন্ধ— অন্ধকারে ঠিকঠাক ঠাহর করাও যাচ্ছে না। হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো, না। দরজায় তো বাইরে থেকে তালা-টালা কিছু মারা নেই। তাহলে ভেতরেই আছে শালী। এত ঘুম কীসের মাগীর! সন্ধেবাতি দেওয়া নেই, মঙ্গলামঙ্গল ব’লে কিছু নেই! আজ তুই ম’রেছিস। এবারে বেশ জোরে জোরে আঘাত করে দরজায়। হঠাৎ আস্তে দরজাটা খুলে যায়। কিন্তু তাও ঘরে আলো জ্বলেনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অবাক হয় নিতাই। কিন্তু কেন জানি মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ ক’রতে শুরু করে নিতাই-এর। এমনটা তো এই প্রথম। কালীপুজোর এমন আঁধারে এমনতর ভয় হয়, শুনেছে নিতাই। তার ওপরে গোটা বাড়িটা অন্ধকার। ব্যাপারখানা কী? দরজা খুললেও কাউকে দেখা গেলো না। অন্ধকারে দৃষ্টি মোটামুটি স’য়ে গেলে নেশাগ্রস্ত চোখে একটা নারী মূর্তির অবয়ব দেখতে পায় নিতাই। কিন্তু এটা তো প্রতিমা নয়। মনের ভয় তাড়াতে আর প্রতিমাকে ভয় দেখিয়ে দিতে একবার বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে ব’লে ওঠে,
— ঘর অন্ধকার ক’রে কোন রাজকার্য করছিস রে? আলো জ্বাল্।
— ভেতরে আয়।
একটা নারীকণ্ঠ শুনলো নিতাই। বুঝতে পারলো না, এটা কার গলা! কঠোর, কঠিন, গমগমে। দৈব বানীর মতো। না, এ তো তার বউ-এর গলা নয়। কেমন যেন ভারী ভারী। আদেশ ক’রছে। এটা ওর বৌ প্রতিমা তো? কিন্তু সে ‘ভেতরে আয়’ বলার সাহস পাবে কোথা থেকে? এইসব ভাবনা গেড়ে ব’সলো নিতাইয়ের মাথায়। কেন জানি, সারা গায়ে একটা শিরশিরে ভাব অনুভাব করলো ও। তারপর যন্ত্রের মতো ভেতরে ঢুকল। হঠাৎ ফশ্ করে দেশলাই জ্ব’লে উঠলো। জ্ব’লে উঠলো একটা বড়ো প্রদীপ। সরষের তেলে টাপুটুপু। আর সেই আলোয় যা দেখলো নিতাই, তাতে তার মদের নেশা তো ছুটে যাওয়ার কথা বটেই, প্রায় অজ্ঞান হ’য়ে পড়ার মতো অবস্থা হলো ওর। প্রদীপ জ্বেলেছে স্বয়ং দেবী কালিকা। সেই লোল জিভ, সেই জিভ চেপে রাখা সাদা ঝকঝকে গোটা ছয়েক দাঁতের সারি, সেই একমাথা মেঘের মতো ফুলে ওঠা, ফুসে ওঠা চুল, চোখের কোল জুড়ে একটা যেন লাল রেখা আর একটা সাদা রেখা চোখদুটোকে আরো ভয়ঙ্কর ক’রেছে। এ তো প্রতিমা! কিন্তু এমন কেন! কোথায় ওর সেই ভীতু ভীতু, নরম নরম দৃষ্টি! প্রতিমার চোখদুটো জ্বলছে আগুনের ভাটার মতো। কিন্তু পরিষ্কার দেখলো নিতাই যে, এই কালী প্রতিমার হাত আছে দুটোই। চারটে হাত নয়। হ্যাঁ, এ তো প্রতিমাই। কিন্তু এমন ভয়ংকর সেজেছে কেন? এক ঢাল কালো চুলের কিছু অংশ এসে প’ড়েছে প্রতিমার বুকে। তাতে ওর বুকের একটা অংশ অল্প ঢেকেওছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওর সুগঠিত স্তনের কোন কোন অংশ। ওর গায়ে কোনো ব্লাউজ-ফ্লাউজ নেই। সেখানে ঝুলছে মুণ্ডমালা। কোথা থেকে এলো এই মুণ্ডমালা! এটা কী হলো! কিন্তু যেটা নিতাইকে একেবারে কাৎ ক’রে দিলো, সেটা হলো প্রতিমার শরীরটা। প্রতিমা জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে ঘরের দিকে ফিরে চ’লেছে নীরবে। আর পরিষ্কার দেখল নিতাই যে, প্রতিমা একেবারে দিগম্বরী। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। সন্তান না হওয়ার জন্যে বিয়ের সাত বছর পরেও ওর শরীরটা একটুও ভাঙ্গেনি। এমন শরীর দেখতে সুন্দর হয়। কিন্তু এ তো ভয়ঙ্কর লাগছে। এ যে একেবারে সাক্ষাৎ দেবী কালিকা। ঘরের মধ্যে মুণ্ডমালিনী! সর্বনাশ! এমনিতেই প্রতিমা কালো। কিন্তু আজ যেন ওর গায়ের রং আরো কালো লাগছে। বাইরের অমাবস্যার মতো ঘোর কালো। প্রতিমার চোখ-মুখ বেশ সুন্দর বটে। কিন্তু আজ তা যেন হিংস্র, ক্ষুধার্ত আর রক্ত লোলুপ লাগছে। যেন নিতাই-এর রক্ত খাবে ব’লে তৃষ্ণার্ত। কিন্তু ওর গায়ের কালো রং যেন এই স্বল্প আলোয় আরও কালো হ’য়ে নিতাইয়ের ঘরটাকে রহস্যময় তুলেছে।
মনে মনে ভাবে নিতাই, তাহলে কি প্রতিমার ওপর ওর আরাধ্যা দেবী কালিকা স্বয়ং ভড় ক’রেছে? সর্বনাশ। একটাই তো ঘর নিতাইয়ের। আর একটা আছে। তা সেটা তো একেবারে ছোট্ট। তাই সেটা প্রতিমার ঠাকুর ঘর। তার মানে রাত্রিবাসের এই একটাই তো ঘর। এখানে একজন ভড়ে-পড়া মহিলার সাথে রাত কাটানো যে মহা সমস্যার বিষয়! যদিও ও তো বেরিয়ে যাবে একটু পরেই। এটা ভেবে একটু শান্তি পায় নিতাই। না, প্রতিমা কোনো অস্বাভাবিক আচরণ তো ক’রছে না। শুধু নিতাইকে যখন কোনো কারণে আদেশ ক’রছে, সোজা ‘তুই তোকারি’ ক’রছে। কিন্তু নিতাই যে কালীপূজোতে মন্দিরে যায়, তাও আজ যেতে দিলো না প্রতিমা। নিতাই চুপচাপ বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ ক’রতেই গায়ের রক্ত হিম করা শব্দে ব’লল,
— কোথায় যাচ্ছিস? মন্দিরে? আমি তো ঘরেই আছি রে। তোর মন্দিরে কী কাজ? একদম বাইরে বেরোবি না। তোর সর্বনাশ হবে।
শেষের কথাটা এতো জোরে ব’লল যে, নিতাই-এর সাধ্য হলো না সে আদেশ অগ্রাহ্য করা। এ তো অন্য প্রতিমা! একটা জিনিস অবাক হ’য়ে দেখলো নিতাই, প্রতিমা যে ঘরে এভাবে কোনো কাপড় না প’রে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাতে যেন ওর কোন ভ্রূক্ষেপটুকু নেই। অবশ্য থাকবেই বা কী করে! ও তো এখন প্রতিমা নেই। দেবী। দেবী নিতাইকে আদেশ করা ছাড়া আর কোন কথা ব’লছে না। তাই বাধ্য হ’য়ে প্রতিমা ঠাকুর ঘরে গেলে ঘরের জানলাগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো নিতাই নিজে। যদি কেউ ডাকতে-ফাকতে আসে? ঘরে ঘুরছে ওর উলঙ্গ বৌ। মহা মুশকিল হবে। আলো তো জ্বালেই নি প্রতিমা। শুধু একটা প্রদীপ। তবু র’ক্ষে। ঘরের ইলেকট্রিক আলো গেলো কোথায়— তা দেখবার মতো সাহসটুকুও ওর হ’লো না। বাইরে থেকে ঝপ্ ক’রে চোখে প’ড়বে না। তারপর ঘরের মধ্যে একা ভূতের মতো ব’সে রইলো অগত্যা। কথা নেই, বার্তা নেই। ঠাকুর ঘরে গেছে প্রতিমা। এই ফাঁকে একবার টিভি-টা চালাতে ইচ্ছে হ’লো। একা একা ভয় লাগলে একটু গান-টান শুনলে একটু ভালো লাগে। যেন কিছুই হয়নি— এমন একটা ভাব করা যায়। কিন্তু সেটা চালাতে গিয়ে একবার দেখে নিতে চাইলো, প্রতিমা কোথায়। হয়তো টিভি চালালে ক্ষেপে-টেপে উঠবে। যে ভয়ঙ্কর রূপ আজ ওর! দেবতা ভড় ক’রলে এমনটা হয়, দেখেছে ও। দুর্গা মন্দিরের গুনিন বুড়ির ওপর ভড় হয়। একবার ও গিয়েওছে সেখানে। তখন চেনা মানুষ আর মানুষ থাকে না। এটা সবাই জানে। প্রতিমাও আজ আর প্রতিমা নেই। তাই আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ঠাকুর ঘরে গিয়ে যা দেখলো, তাতে ওর ভয়টা আরো বেড়ে গেলো। প্রতিমা ওর ঠাকুরের সিংহাসনের সামনেটায় একেবারে মা কালীর মতো দাঁড়িয়ে। হাতে একটা ঝকঝকে খাড়া। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই প্রতিমার। নিতাই যে ঘরে ঢুকেছে, তা যেন ও দেখেও দেখলো না। এ যেন মানুষ নয়। সাক্ষাৎ মৃন্ময়ী দেবি প্রতিমা। নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দ। অথচ পরেই দেবিমূর্তি-ই রাতে নিতাইকে রেঁধে-বেড়ে খাওয়ালো প্রর্জন্ত। রোজকার মতো সবই ক’রলো প্রতিমা কিন্তু একেবারে নিঃশব্দে, নীরবে। সম্পূর্ণ নির্বাক। আজ নিতান্ত বাধ্য ছেলের মতো নিতাই চুপ ক’রে খেয়ে নিলো যা দিয়েছে প্রতিমা। এই খাওয়া নিয়েই প্রতি রাতে গণ্ডগোল বাঁধাতো নিতাই। আর আজ? নো শব্দ। বিমর্ষ আতঙ্কিত নিতাই শেষে বিছানা নিলো। চুপ ক’রে মট্কা মেরে প’ড়ে থাকলে অন্তত একটা নিষ্কৃতি। ভয়টা পেতে হয় না। যা থাকে কপালে। কী কুলক্ষণে যে আজ বাড়ি ফিরেছিলো! নিজে নিজেই মনে মনে আক্ষেপ করে নিতাই।
কখন যেন নিতাই বুঝতে পেরে গেলো যে, প্রতিমা ওর কোন ক্ষতি ক’রবে না। ক্ষতি ক’রলে এতক্ষণ ক’রেই ব’সতো। এই বিশ্বাস থেকে নেশায় চোখ জুড়িয়ে আসা ঘুমের দেশে চ’লে গেলো নিতাই। কিন্তু ভয়ে ও আরো শুকিয়ে গেলো যখন দেখলো, উলঙ্গ প্রতিমা ওর পাশটাতেই এসে শুয়েছে। এভাবে কি ঘুমোনো যায়! পাশে স্বয়ং দেবী কালিকা। কী জ্বালাতন! এর মধ্যে একবার এসে ওর মদের সঙ্গীরা ওকে ডেকেও গেছে। কিন্তু কোনো সাড়া না দিয়ে অন্ধকারে মট্কা মেরে প’ড়ে থেকেছে নিতাই। ওঠার বা সাড়া দেবার সাহসটুকু হয় নি। তারপর আর মনে নেই। ঘুম ওকে অন্তত এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি দিলো।
রাত তখন ক-টা হবে, জানে না নিতাই। হঠাৎ ওর ঘুমটা ঝট্কা মেরে ভেঙ্গে গেলো। ওর মনে হোল, যেন ওর বুকের ওপরে একটা বিরাট ভারী পাথর-টাথর কেউ রেখেছে। চোখটা কোনরকমে মেলে দেখল ও। কিন্তু আধো আলো আধো অন্ধকারে যা দেখল, তাতে ফের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো ওর। বুকের ওপরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিমা। ওর দৃষ্টি নিতাই-এর দিকেও নয়। সোজা সামনে। একেবারে মন্দিরের কালীমূর্তি। হাতে তার ঝল্সে উঠছে মায়ের খাড়া। জমিদারদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা থামগুলোর মতো ওর হৃষ্টপুষ্ট একটা পা ওর বুকের ওপর চাপানো। প্রমাদ গ’নলো নিতাই। অমন যৌবনবতী উলঙ্গ দেহ দেখে যৌন চেতনা তো দূর, তাকিয়ে দেখার কোন আকাঙ্ক্ষাটুকু পর্যন্ত দেখা দিলো না নিতাইয়ের মনে। শুধু দম বন্ধ করা আতঙ্ক চেপে ব’সলো ওর মনে। একটা মৃত্যুভয় ওকে যেন গুটিয়ে দিলো। ওর হাত-পা যেন কোন কাজ ক’রছে না। সাড়া অঙ্গ অবশ, অনড়। ঝট্কা মেরে সরে যাবার ক্ষমতাটুকুও নেই ওর। নিতাই একবার ভাবলো, ওকে এবারে মেরেই ফেলবে নাকি প্রতিমা! মা কালী প্রতিমার রূপে কি তাঁর সন্তানের ওপর অত্যাচারের শাস্তি দেবে ওকে? ততক্ষণে প্রতিমার সুগঠিত শরীরের যে প্রবল ভার প’ড়তে শুরু ক’রেছে ওর বুকে, তাতে ওর দম প্রায় বন্ধ হবার যোগার। এবারে আর সময় নিলো না ও। আর কোনো ভুল নয়। সোজা দু-হাত জোর ক’রে কেঁদে উঠলো,
— মা, আমি দিব্যি ক’রছি, আমি আর প্রতিমার গায়ে হাত দেব না। ওকে কোন কষ্ট দেবো না। আমাকে একটা সুযোগ দাও, মা। আমাদের সন্তান না-ই বা হলো। তুমি যেমন আমাদের সাথে আছো, মা, তখন ওকে এবার থেকে আমি সুখে রাখবো। কোন দুঃখ দেব না। আমি প্রতিজ্ঞা ক’রছি, মা। আমি আর কোনোদিন মদ ছোঁব না। সন্তানকে রক্ষা করো, মা।
আর কিছু ওর মনে নেই, কেননা এর পরেই ও জ্ঞান হারায়।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!