অপহরণ সিরিজ—প্রথম অংশ

প্রখ্যাত শিল্পপতি গজেন্দ্রনাথ শীল নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খবরটা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল।এই ঘটনায় শহরের লোক আর নতুন করে আঁতকে উঠল না, কিন্তু দম প্রায় বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল পরের খবরটার জন্যে। পরের খবরটাও জানা গেল যথাসময়ে, আর সেটা জানার পরেও লোকে নতুন করে উত্তেজিত হল না। যেন এটাই স্বাভাবিক। পাঁচজনের বিস্ময়ের কারণ শুধু টাকার অঙ্কটা। পঞ্চাশ লাখ টাকা। অপহরণ করা একটা লোককে ফিরিয়ে আনার জন্যে গুনে গুনে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিতে হল!

কিন্তু উত্তেজিত হলেন স্বয়ং গজেন্দ্রনাথ শীল। খবরের কাগজে তাঁর বিবৃতি বার হল। উদ্যোগী সাংবাদিকরা শীল পরিবারের প্রতিক্রিয়াও ফলাও করে ছাপল। গজেনবাবু জানিয়েছেন, তাঁর প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ছিনতাই পার্টির হাতে পঞ্চাশ লাখ টাকা তুলে দিয়ে তাঁর পরিবারের লোকরা চূড়ান্ত বোকামির পরিচয়ে দিয়েছে। না হয় তাঁর প্রাণ যেত, কিন্তু তাই বলে গুণ্ডা বদমাইশদের সঙ্গে আপোষ। প্রশাসন এবং পুলিশকেও গজেনবাবু একহাত নিয়েছেন। যা বলেছেন তা সরল করলে বোঝায়, পুলিশ এবং প্রশাসন অপদার্থ। কোনও একটা অপরাধের কিনারা করার ক্ষমতা নেই তাদের।

পুলিশদের গালাগালি দেওয়াটা শহরের লোকরা এক কথায় মেনে নিয়েছে, তবে তাদের মতে গজেনবাবুর পরিবারের লোকদের বোকা বলা যায় না কোনও মতেই। মুক্তিপণের টাকা না দিলে হয় তো পরদিনই গজেনবাবুর লাশ পড়ে থাকত শহরের মধ্যিখানে। যেমন হয়েছিল অরবিন্দ হালদারের বেলায়। মৃতদেহ পড়ে ছিল চৌরঙ্গীর মোড়ে। মাত্র পনেরো দিন আগেকার ঘটনা, এই ঘটনার পরে আর কোনও পরিবারের লোক ঝুঁকি নিতে পরে না। বিশেষ করে গজেন্দ্রনাথ শীল যখন কোটি কোটি টাকার মালিক। অরবিন্দ হালদারের আগে আরও তিনজন বড় ব্যবসায়ী অপহৃত হয়েছিল। কিডন্যাপারদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে খালাস পেয়েছে তারাও। কিন্তু চোরা খুন, অপহরণ এখন আর শুধু বড়লোকদের মধ্যেই আটকে নেই, এই তো ক’দিন আগেই গরিব ঘরের আস্ত একটা পরিবারকে কে বা কারা নৃশংসভাবে খুন করে রেখে গেছে। শহরের সর্বত্র এখন চাপা আতঙ্ক। সন্ধেরাত্তির হতে না হতেই ব্যস্ত রাস্তা ঘাটগুলো ফাঁকা হয়ে যায়।

গজেন্দ্রনাথ শীল পুলিশ এবং প্রশাসনকে গালাগালি দিয়েই থামলেন না, বেশ নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করলেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগ অপহরণকারীদের ধরবেনই। তার জন্যে যত টাকা খরচ হয় হোক, সব টাকা তিনিই দেবেন। এই নাটকীয় ঘোষণাটা খবরের কাগজওয়ালারা আরও নাটকীয়ভাবে ছাপল।

সেই সকালেই গজেনবাবুর মেরুন রঙের বিলিতি গাড়িটা গিয়ে থামল বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর তিলক চৌধুরীর বাড়ির সামনে। ডোরবেল বাজতেই দরজা খুললেন তিলক চৌধুরী। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “সুন মিস্টার শীল, আমি আপনাকেই আশা করছিলাম।”
তাই শুনে একটু হকচকিয়ে গিয়ে গজেনবাবু বললেন, “মানে?”
“মানেটা তো আজ সকালের খবরের কাগজগুলোই বলে দিয়েছে। কিন্তু আমি বলব স্টেটমেন্টটা কাগজে ছাপতে দিয়ে আপনি মস্ত ভুল করেছেন।
সম্পূর্ণ অপরিচিত কারও বাড়িতে পা দেবর সঙ্গে সঙ্গেই কেউ যদি আসার উদ্দেশ্যটা ধরে ফেলে যে কেউই একটু চমকে যাবে। গজেনবাবুও চমকে গিয়েছিলেন, কিন্তু চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “যাক আমি তাহলে ঠিক লোকের কাছই এসেছি। আপনিই এ কাজটা করতে পারবেন। কিডন্যাপারদের এই দলটাকে ধরুন তো। টাকা পয়সার কথা ভাববেন না। আপনি যা চান তাই দেব।”
সামনের সোফায় গজেন বাবুকে বসে বলে আগের কথার জের টানলেন গোয়েন্দা। “আপনি কিন্তু সত্যিই ভুল করছেন। খবরের কাগজে আপনার ঐ বিবৃতিটা চাপতে দেওয়া উচিত হয় নি।”
“কেন?”
“কেন আপনি বুঝতে পারছেন না? আপনি বুদ্ধিমান লোক। কিডন্যাপাররা আপনার মতো একজন শত্রুকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে চাইবে না। আপনার সঙ্গে গার্ড আছে?”
গজেনবাবু মাথা কাত করলেন এক পাশে।
“আর্মড না আনঅর্মড? জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা।
“আর্মড। পিস্তল আছে।”
“ক’জন গার্ড?”
“একজন।”
গোয়েন্দা দ্রুতগতিতে দু দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “একজনে হবে না। দু’জন নেবেন। ওরা গাড়ির পেছনের সিতে বসে দুই জানলায় চোখ রাখবে। আর আপনি বসবেন শোফারের পাশে।”
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে বাধ্য ছেলের মতো একদিকে মাথা নাড়লেন গজেনবাবু। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “পুরো ঘটনাটা এবার আপনাকে বলি।”
“ঘটনা মনে আপনার কিডন্যাপিং-এর?”
“হ্যাঁ।”
“না, তার এখন দরকার হবে না। সবকটা অপহরণের রিপোর্টই আমার ফাইলে আছে।” কথাটা বলতে বলতে ওদিকের একটা ফাইলের দিকে আঙুল তুললেন গোয়েন্দা।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থাকার পরে গজেনবাবু হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে হাতের ছোট্ট অ্যাটাচিটা খুলে বললেন, “আপনাকে এখন তা হলে হাজার দশেক টাকা দিচ্ছি, কাজ শুরু করুন আপনি।”
তিলক চৌধুরী শক্ত মুখে দু দিকে মাথা নেড়ে বললেন, “না, এখন টাকা লাগবে না। আপনি বরং আমাকে কিছুদিনের জন্যে একটা ভালো জিপ দিন। ড্রাইভার লাগবে না।”
“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, এ আর কী এমন কথা। আজকেই আপনার বাড়িতে আমি জিপ পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আপনার ফী-জের অ্যাডভান্স -।”
গোয়েন্দা তিলক চৌধুরী গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, “কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি টাকা নিই না।”
“আচ্ছা, এখন তাহলে আমি চলি। কোনও প্রয়োজন হলেই আমাকে কন্ট্যাক্ট করবেন। নমস্কার।”
“নমস্কার” বাড়ির সামনের ছোট্ট লনের গেট পর্যন্ত মিস্টার শীলকে এগিয়ে দিলেন তিলক চৌধুরী।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নতুন একটা জিপ এসে দাঁড়াল গোয়েন্দার বাড়ির সামনে। পেছনে একটা সাদা অ্যামব্যাসাডর। অ্যামব্যাসাডর থেকে বেরিয়ে এলেন মিস্টার শীলের প্রাইভেট সেক্রেটারি রাকেশ গুপ্ত। গুপ্ত তিলক চৌধুরীর হাতে চাবি তুলে দিয়ে বললেন, “মিস্টার শীল, এই জিপটা আপনার ব্যবহারের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে একটা অনুরোধ, আপনি নিজের পয়সায় তেল কিনবেন না। আপনার বাড়ির সামনে ফিলিং স্টেশনে বলা আছে। যা তেল দরকার আপনি নেবেন, বিল যাবে আমাদের কোম্পানিতে। পেমেন্ট আমরা করব।”
একটু ইতস্তত করে তিলক চৌধুরী বললেন, “আচ্ছা, ধন্যবাদ।”

দিন পাঁচেক বাদে খবরের কাগজে আর একটি অপহরণ ও মুক্তির খবর বার হল একসঙ্গে। মুক্তি অবশ্য মুক্তিপণের বিনিময়ে।
এবার অপহৃত হয়েছিলেন বিখ্যাত মিল-মালিক মনোময় বেরা। অপহরণকারীরা তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করার পরে মনোময়বাবুকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!