
সে বহুকাল আগের কথা। এই পৃথিবী থেকে বহু দূরে ছিল একটা দেশ, যেখানে পরীরা এসে মানুষের সাথে গল্প করত। পাখিরা, মাছেরা সবাই কথা বলত। সেখানে ছিল এক বৃষ্টি গাছ—যার নিচে দাঁড়ালেই বৃষ্টি ঝরত আর সাথে আসত মিষ্টি সুবাস। ছিল একটি সুখ নদী, যেখানে কেউ দুঃখের কথা বললে, নদী তার দুঃখ দূর করে দিত।
সেই নদীর পাশেই ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম। সেখানে থাকত অপরাজিতা নামের এক মিষ্টি মেয়ে। সবাই তাকে অপামনি বলে ডাকত। গ্রামের লোকেরা তাকে খুব ভালোবাসত, নিজের ঘরে ডেকে খাওয়াত, কারণ সে যে ভারী লক্ষ্মী মেয়ে! বয়সই বা কত! সবে মাত্র তিনটা দাঁত পড়েছে। অপামনি সারাদিন ঘুরে বেড়াত, প্রজাপতিদের সাথে নাচত, বনের পাখিদের সাথে গান গাইত। কী মধুর তার কণ্ঠ! তার গান শুনে বনের গাছের পাতা নাচত, জলের মাছ ডাঙায় উঠে সেই গান শুনত। সন্ধ্যেবেলায় পরীরা এসে গল্প করত তার সাথে আর নিয়ে আসত কত আজব আজব জিনিস! সেসব পেয়ে অপামনি খিলখিলিয়ে হাসত।
একদিন সুখ নদীর পাশে বসে একমনে কাঁদতে লাগল অপরাজিতা। গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা জল পড়ল সুখ নদীতে। সুখ নদী বলে উঠল, “ওমা! এ কী গো অপামনি, তোমার চোখে জল! কী দুঃখ তোমার? বল আমায়, সব দূর করে দেব আমি।”
অপামনি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার মা যে বড্ড অসুস্থ গো সুখ নদী! কেউ কইতে পারে না কী হয়েছে তার। ওপাড়ার দিদিমা বলেছে, মা নাকি বেশিদিন আর বাঁচবে না। মা না থাকলে আমার কী সুখ থাকবে বল?”
অপরাজিতার কান্না দেখে পুরো নদীর জল কেঁপে উঠল। নদীর মাছেরা সুখ নদীকে মিনতি করে বলল, “ওগো সুখ নদী, তুমি তো সবাইকে সুখী কর। অপামনির মাকে তুমি ভালো করে দাও। নাহলে আমরা আর কোনো মানুষের জালে ধরা দেব না।”
বনের গাছেরা মাটিকে বলল, “মাটি, তুমি আমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছো। অপামনির মাকে তুমি বাঁচিয়ে দাও। নাহলে আমরা আর কোনো ফুল, ফল দেব না।”
রাতে আলোচনা সভায় বসল সুখ নদী, বনের মাটি, বাতাস আর পরীরা। অনেক ভেবে তারা অপরাজিতার মাকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে পেল। তারা অপামনিকে ডেকে বলল, “অপামনি, তোমার মাকে বাঁচানোর একটা উপায় আমরা পেয়েছি। কিন্তু সে যে বড় কঠিন উপায়!”
অপামনি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বল তোমরা, আমায় কী সে উপায়! মা কে বাঁচাতে আমি সব করতে পারব।”
“বেশ, তবে কাল ভোরে যখন সূর্য মামা পূব আকাশে উঁকি দেবে, তখন একটা ফানুসে করে তোমায় সবাই উড়িয়ে দেবে। সে ফানুস গিয়ে যেখানে পড়বে, সেখানেই মিলবে তোমার মাকে বাঁচানোর উপায়,” বলল কাজলিপরী।
ভোরবেলায় একটা বড় ফানুসে বসিয়ে অপরাজিতাকে আকাশে উড়িয়ে দিল সবাই। কাঁদল অপরাজিতা, গ্রামের মানুষ, নদী, গাছ, মাছ সবাই… উড়তে উড়তে বহুদূর চলে গেল সে ফানুস। গিয়ে পড়ল এক অচেনা রাজ্যে।
সেখানে ঘাসগুলো সব ফ্যাকাসে, গাছে নেই কোনো পাতা, নদীতে নেই কোনো জল। হাঁটতে হাঁটতে এক বিরাট রাজপ্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল অপরাজিতা। অন্দর মহলে ঢুকে দেখল, রাজা বসে কাঁদছেন।
তার কাছে গিয়ে বলল, “আপনি কাঁদছেন কেন?”
রাজা মাথা তুলে দেখল, লাল পাড়ের ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। বলল, “কে তুমি মা? কোথা থেকে এসেছো? আমার এই রাজ্যে যে সন্ন্যাসীর অভিশাপ পড়েছে! তাই কোনো গাছে ফল নেই, নদীতে জল নেই। না খেতে পেয়ে আমার সব প্রজারা মরে যাচ্ছে। আমার একমাত্র নয়নের মণি রাজপুত্র সমরও পানির অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।”
“আমি পারব আপনার রাজ্যকে বাঁচাতে,” বলল অপরাজিতা।
“কি বললে মা তুমি! তুমি পারবে? কী করে! কথা দিচ্ছি, যদি তুমি সত্যি আমার রাজ্য আর আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারো, যা চাও তাই পাবে,” বলল রাজা।
অপরাজিতা বাইরে বেরিয়ে এল। এসে গান গাওয়া শুরু করল। তার সেই গান শুনে ঘাসগুলো সব সতেজ হয়ে গেল, গাছগুলো সব পাতায় পাতায় ভরে উঠল, নদী জলে ভরে গেল, সাথে কত মাছ! জল খেয়ে প্রাণ ফিরে পেল রাজপুত্র সমর।
সমরের সাথে বসে গল্প করতে করতে নিজের দুঃখের কথা বলল অপরাজিতা।
সমর বলল, “আমি জানি কী করে তোমার মা কে বাঁচাবে।”
অপরাজিতা চমকে উঠে বলল, “কী করে!!! বল আমায় সে উপায়?”
সমর বলল, “এই রাজ্যের পূর্ব কোণে আছে এক বৃষ্টি গাছ। সে গাছের নিচে দাঁড়ালেই বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টির জল যদি খাওয়াতে পারো তোমার মাকে, তিনি বেঁচে যাবেন।”
তারপর দুজনে মিলে চলে গেল সে বৃষ্টি গাছের কাছে। দুজনেই ভিজল আর শিশি ভরে নিল সেই বৃষ্টির জল।
তারপর রাজকুমার তার ঘোড়ায় চড়িয়ে অপামনিকে নিয়ে গেল তার মায়ের কাছে। বৃষ্টির জল খেয়ে সুস্থ হয়ে গেল অপরাজিতার মা।
কয়েক বছর পর, খবর পাঠিয়ে অপামনিকে রাজপুত্রবধূ করে নিয়ে গেল রাজকুমার সমর।