কাল-পরশু দুদিন ছুটি। প্ল্যাটফর্ম গিজগিজ করছে। কোলাহলের ফাঁকে ফাঁকে উড়ে আসছে ভাঙাচোরা কথা। যেমন : করলেই তো পারত। ট্রেন পাই না পাই, টিকিট তো পেয়েছি। এর চেয়ে বাস ভালো ছিল। আর কত অপেক্ষা করা যায়। আমি কিন্তু বলেছিলাম। টুকরো টুকরো এরকম আরও কথা। একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথা জোড়া দিয়ে মনে মনে মজা পাচ্ছিল সুমন। সময়ও কাটছিল।
হঠাৎ রিংটোন। পকেটে হাত দিতে গিয়েও থেমে যায় সুমন। একই সাউন্ড, তবে অন্য কারও। বছর দশেক আগেও এত লোকের হাতে মোবাইল ছিল না। লোকজন বেড়েছে। দোকানপাট বাড়িঘর বেড়েছে। কিন্তু এ মফস্বল শহরটার তেমন কোনো পরিবর্তন হল না। আগের মতোই রয়ে গেছে অনেক কিছু। উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে বুড়ি একটা পাগলি গান করত। শুধু ওই জায়গাটাই ফাঁকা।
প্রমোশন পেয়ে সুমন আগের কলেজটাতেই ফিরে এসেছে। বৃহস্পতিবার চিটাগাং চলে যায়, শনিবার ফেরে।
আবার রিংটোন। এবার তারটাই বাজল। হৈ চৈ বেড়ে চলে চলেছে। এক কান চেপে অন্য প্রান্তের কথা শোনার চেষ্টা করছে সুমন।
-আমি প্ল্যাটফর্মে; কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
-তিন্নি কথা বলতে চায়।… নাও, বাপির সাথে কথা বল।…
হঠাৎ হুড়োহুড়ি শুরু হল। ধাক্কা লেগে মোবাইলটা ছিটকে পড়ল। কাকে যেন থামাতে গিয়ে ছুটে যাচ্ছে একজন যুবক। মোবাইল-স্ক্রিন থেকে নিভে যাচ্ছে তিন্নির ছবি, ওর মায়ের ছবি।
সুমন নিচু হওয়ার আগেই এক ভদ্রমহিলা ওটা তুলে দিল।- নিন স্যার,…
আপনার সংসার।
-আরে! কবিতা না?
-ওটা আমার ডাকনাম, ভালো নাম সুপ্রিয়া সেন।
-জানি, জানি। তা কী করছ এখন?
-আপনি ভালো আছেন স্যার?
সবার প্রিয় ছাত্রী ছিল সুপ্রিয়া; সুমনের একটু বেশি। ফশ করে তাই বলেই ফেলল- তা কোথায় বিয়ে হল?
-আপনাকে একটা কথা বলব স্যার? সুপ্রিয়ার চোখ দুটো আগের মতোই তীক্ষ্ণ। মাথাটা একটু কাত করে সে বলল- “আপনি কি এখনও কবিতা পড়ান?… আমার অনুরোধ- পড়াবেন না। বনলতা সেন পড়াবেন না, রবীন্দ্রনাথের বাঁশিতো নয়ই।”
আরেকটা ট্রেন এসে গেছে। আবার হুড়োহুড়ি। সুমন কাঁধের ব্যাগটা তুলে নিয়ে দেখল কবিতা নেই। মিলিয়ে গেছে। সুমন খেয়াল করেনি- ওর কপালে সিঁদুর ছিল না। হাতে শাঁখা ছিল না। ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে ট্রেনে উঠে গেল সে। তবুও প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থাকল- যতক্ষণ দেখা যায়। ট্রেন বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর সুমন টের পেল, বেখেয়ালে সে অন্য ট্রেনে উঠে পড়েছে।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়