
বিশ্ব দৃষ্টি দিবস উপলক্ষে আমরা দু’পর্বের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। এ পর্বে আমরা বিশ্বের কয়েকজন সফল দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে আলোচনা করেছি।
অন্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন ইংরেজ কবি জন মিল্টন, গ্রীক কবি হোমার, ফার্সী কবি রুদাকী এবং লেখিকা হেলেন কিলার। এরা ছাড়াও আরবী সাহিত্যের খ্যাতনামা কবি বাশ্শার বিন বোরদ, সিরিয়ার আবুল আলা আল-মা’আররী এবং মিশরের বিশিষ্ট লেখক তাহা হোসাইনের নাম উল্লেখ্যযোগ্য। তারা কাব্য-সাহিত্যে এমন অবদান রেখেছেন যে, যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন তাদের নাম বিশ্ব ইতিহাসে লিপিবন্ধ থাকবে। তারা যেন অন্ধ হয়েও অন্ধ নন।
পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই প্যারাডাইজ লস্ট কাব্যগ্রন্থের নাম শুনেছেন! বাইবেল-এর কাহিনীকে ভিত্তি করে রচিত এই মহাকাব্যটি ১৬৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বিখ্যাত এ গ্রন্থটির লেখক ছিলেন অন্ধ কবি জন মিল্টন। তিনি ১৬০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা ছাড়াও তিনি গদ্য লিখতেন। ১৬৭৪ সালের নভেম্বর মাসে তার মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত মিল্টনের জীবন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। মিল্টনের পর গ্রীক কবি হোমারের নাম সবচেয়ে বেশী আলোচনা করা হয়ে থাকে। ইলিয়াড ও ওডিসি তাঁর বিখ্যাত রচনা। হোমার নামে আদৌ কোন কবি ছিলেন কি না তা নিয়ে ১৯শ শতাব্দীতে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০শ শতাব্দীতে এই বিতর্কের অবসান ঘটে এবং তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়।
অন্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে একটি পরিচিত ও সফল নাম হচ্ছে হেলেন কিলার। একজন অন্ধ, বোবা আর বধির মেয়ে কেবল সাধনা কারণে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সর্বোচ্চ মার্ক নিয়ে বি.এ পাস করেন এবং পরবর্তীতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুনে হেলেন কিলার জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতই হেলেন কিলারের জন্ম হয়েছিলো। কিন্তু ১৯ মাস বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি বধির ও দৃষ্টিহীন হয়ে যান। ছয় বছর বয়সে হেলেন কিলার টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহামবেলের সহায়তায় বধিরদের জন্য বিশেষ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এখানেই শিক্ষক অ্যান সুলিভানের সহযোগিতায় তার পাঠ গ্রহণের কঠিন অধ্যবসায়ের সূচনা হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত রেডক্লিফ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে ডিগ্রি অর্জনের আগেই নিজ আত্মজীবনী দ্যা স্টোরি অব মাই লাইফ প্রকাশিত হয়। দ্যা ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন, আউট অব ডার্ক, মাই রিলিজিয়ন তার বিখ্যাত বই গুলোর অন্যতম। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে অন্ধ ও বধির এবং বিশ্বখ্যাত লেখিকা হেলেন কিলার ৮৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
পাঠক! ইংরেজী ও গ্রীক ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের পর এবার আমরা ফার্সী সাহিত্যেক জনক বা বা’বা’-ই-ফার্সী নামে পরিচিত অন্ধ কবি রুদাকীর সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। জন্মান্ধ এই কবি নবম শতাব্দীর শেষের দিকে সমরখন্দের রুদাক জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। রুদাকী ছিলেন ফার্সী সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ফার্সী সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে, “সাতজন কবির সাহিত্য কর্ম রেখে যদি বাকী সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফার্সী সাহিত্য টিকে থাকবে।” এই সাতজন কবির একজন হচ্ছেন রুদাকী। অপর ছয়জন কবি হলেন ফেরদৌসী, হাফিজ, নিজামী, মাওলানা রুমী, শেখ সাদী এবং কবি জামী।
অন্ধ কবি রুদাকীকে স্বভাব কবিও বলা যায়। তিনি গ্রীক কবি হোমারের মতো যে কোন মজলিসে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনর্গল কবিতা আওড়াতে পারতেন। তার স্মরণশক্তি এত বেশী ছিল যে, একবার যা আওড়াতেন পরে তা হুবহু বলে দিতে পারতেন। তিনি যখন কবিতা আবৃত্তি করতেন তখন তার ভক্তরা তা লিখে রাখতেন। বন্ধুরা, তোমরা জেনে অবাক হবে যে, খণ্ড কবিতা, দীর্ঘ কবিতা ও গজল বা গীতি কবিতা মিলিয়ে তিনি প্রায় তের লক্ষ কবিতা লিখেছেন! পৃথিবীতে এতো বেশী কবিতা খুব কম কবিরই আছে। রুদাকীর অধিকাংশ কবিতা সহজ-সরল ভাষায় রচিত এবং নানা উপদেশে পরিপূর্ণ। তাঁর একটি কবিতা এ রকম-
জীবন আমাকে দিয়েছে ঢের শিক্ষা
শিক্ষার কাছে জীবন নেয় যে দীক্ষা
অপরের সুখে হয়ো না তুমি দুখী
তোমার সুখেও হবে না কেউ সুখী।
রুদাকী কেবল কবি ছিলেন না। তিনি একজন ভালমানের গায়কও ছিলেন। বেহালায় সুর তুলে নিজের গজল এমন সুন্দর করে গাইতেন যে, সবাই সে গজল শুনে তন্ময় হয়ে যেতেন। তাঁর গজলগুলো কেবল মিষ্টি সুরের স্বাদেই ভরপুর নয়, এক একটি গজল যেন মূল্যবান মুক্তাখণ্ডের মতোই দামী।
রুদাকীকে ফার্সী সাহিত্যের জনক বলা হলেও তিনি আরবী ভাষায়ও পণ্ডিত ছিলেন। তিনিই প্রথম বিখ্যাত শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ কালিমা ওয়া দিমনা আরবী সাহিত্যের অমর গ্রন্থ আলিফ লায়লা ফার্সীতে অনুবাদ করেন।
পাঠক! আপনারা হয়তো ভাবছেন, একজন অন্ধ কবির পক্ষে এতো কিছু করা কিভাবে সম্ভব হলো? এ প্রশ্নটি রুদাকীকেও করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “জীবনযুদ্ধে জয়লাভের জন্য যে সব হাতিয়ারের প্রয়োজন, অন্ধত্ব হচ্ছে সে সবের একটি। অন্য সব হাতিয়ার ধারালো থাকলে একটির অভাব আসলে কোনো অভাব নয়।” একথার মাধ্যমে রুদাকী বলতে চেয়েছেন অন্ধত্ব আসলে সাফল্যলাভের ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। তাই তো তিনি প্রমাণ করে গেছেন, অন্ধরাও অসাধ্য সাধন করতে ও জীবন-যুদ্ধে জয়ী হতে পারে।
ফার্সী কবি রুদাকীর পর এবার আমরা আরবী ভাষার খ্যাতিমান কবি বাশ্শার বিন বোরদের জীবন ও কর্ম নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো। কবি বাশ্শার সপ্তম শতাব্দীর শেষ দশকে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ক্রীতদাস। কবি বাশ্শাদ ছিলেন জন্মান্ধ। কিন্তু অন্ধ হলে কি হবে? আল্লাহ তাঁকে চোখের জ্যোতি দেননি বটে কিন্তু দিয়েছিলেন অসাধারণ স্মরণশক্তি এবং প্রখর বুদ্ধি। তিনি বসরার স্কুলে ভর্তি হবার পর শিক্ষকরা একবার যা বলতেন জীবনে তা কখনো ভুলতেন না। কেবল শোনা এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করেন। বাশ্শার বিন বোরদ একজন বড়মাপের কবি ছিলেন। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই ছিল অন্যায়-অবিচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে। অন্যায় করলে তিনি খলিফাকেও খাতির করতেন না। একবার খলিফার বিরুদ্ধে কবিতা লেখার অপরাধে আব্বাসীয় খলিফা আল মাহদী তাকে রাজদরবারে ডেকে পাঠালেন। খলিফা কবিকে বললেন, “আমার বিরুদ্ধে কবিতা লেখার পরিণতি কী হতে পারে আপনি তা জানেন?” খলিফার কথা শুনে কবি বাশ্শার বললেন, “জানি। তবে মনে রাখবেন বাদশাহ নামদার! আল্লাহ আমাকে চোখের জ্যোতি দেননি বটে কিন্তু তিনি আমাকে অন্যায় ও অবিচার ঘৃণা করার ক্ষমতা দিয়েছেন প্রচুর।” কবির এ কথা শুনে খলিফা তাকে বন্দী করার আদেশ দেন। কবির বয়স তখন ৯০ বছর। এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি অন্যায়ের কাছে মাথানত করলেন না। বন্দী অবস্থায় ৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি যেন মরেও অমর, অন্ধ হয়েও তিনি যেন অন্ধ ছিলেন না।
পাঠক! এবার আমরা এমন একজন অন্ধ পণ্ডিতের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেবো যিনি দুই বিষয়ে ডক্টরের ডিগ্রির অধিকারী ছিলেন। নিজের প্রতিভার জন্য তিনি বিশ্বখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হতে পেরেছিলেন। শুধু কি তাই, তিনি দুইবার মিশরের শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। খ্যাতিমান এই মানুষটির নাম তাহা হোসাইন। তিনি ১৮৮৯ সালে মিশরের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ডক্টর তাহা হোসাইন একাধারে গবেষক, সমালোচক, ছোট গল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক ছিলেন। তোমরা শুনে অবাক হবে যে, তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১০৪টি! আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তাহা হোসাইন মাত্র এগার বছর বয়সে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আধুনিক আরবী সাহিত্যের এই পণ্ডিত ১৯৭৩ সালে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।