অন্ধকার সিঁড়িতে প্রেত¬ [৩য় অংশ]

মোজাফফর ভাই বললেন, অর্থমন্ত্রী একটা স্রেফ গ … কথা শেষ হল না- টুম্পা এল । হাতে একটা গ্লাস। গ্লাসে সাদা ঘন তরল। বোরহানি মনে হল। জিনিসটা আমার ভারি পছন্দের। গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে টুম্পা বলল, খেয়ে দেখ তো আঙ্কেল, কেমন হয়েছে।
গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুক দিয়েছি। লাচ্ছি মনে হল। তবে পুদিনা পাতার গন্ধ বেশি।
এবার বল, কেমন হয়েছে? টুম্পা জিজ্ঞেস করল।
নাইস। হেসে বললাম।
সত্যি?
সত্যি।
টুম্পা বলল, এটা হল পুদিনা লাচ্ছি। আমি বানিয়েছি। ঝুমুর আন্টি রেসিপি দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ঝুমুর?
হ্যাঁ। বলে সাঁই করে ঘুরে চলে গেলটুম্পা। আমি খানিকটা হতভম্বই হয়েগেলাম।
মোজাফফর ভাই পোলাও-বিরিয়ানি খেতেপারেন না। ফরিদা ভাবি ভাতই রেঁধেছেন। ভাতের সঙ্গে বেগুন ভাজি, টমেটো দিয়ে রূপচাঁদা মাছের শুঁটকি, কাচকি মাছ ও কাঁঠালের বিচির চচ্চড়ি; মাংসের মধ্যে পেস্তাবাটা দিয়ে সাদা মুরগী, আর মেথি কলিজা; ঘন ডাল, টমেটোর চাটনী, চমচম, ঘরে তৈরি নারকেলের সন্দেশ আর টুম্পার পুদিনা লাচ্ছি ।
খেতে বসে মোজাফফর ভাইয়ের একটা কথায় ভীষণ অবাক হলাম। মোজাফফর ভাই ভাত মাখতে মাখতে বললেন, শোন, রায়হান? কথাটা তোমাকে বলি।
জ্বী, বলুন।
তোমার ভাবির এই বাড়িটা বেশ পছন্দ। আমাকে কিনে নিতে বলছে ।
আমি অবাক হয়ে ফরিদা ভবির দিকে তাকালাম। ফরিদা ভাবি মোজাফফর ভাইয়ের প্লেটে বেগুন ভাজি তুলে দিলেন। মুখ কেমন থমথমে মনে হল।
মোজাফফর ভাই ভাত মুখে ফেলে চিবুচ্ছেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, আর তোমার ভাবিরও কপাল। আজ বাড়িওলা হাজিসাহেব নরসিংদী থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছেন মেয়ের কাছে। এ বাড়ি অর্ধেক দামে ছেড়ে দেবেন যদি আমি কিনি। ভাবছি তোমার ভাবির যখন এতই শখ, তখন রাউজানের পৈত্রিক জমিজমা বিক্রি করে আর ব্যাঙ্ক থেকে লাখ তিরিশেক লোন নিয়ে বাড়িটা কিনেই নেব।
টুম্পা খেতে বসেনি। ও হাততালি দিয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা, হ্যাঁ। কিনোফ্যালো, প্লিজ। এই বাড়ি আমারও খুবপছন্দ।
আমার কপালে ভাঁজ পড়ল । আমার মনে হল, ফরিদা ভাবির সমস্যাটা নিয়ে খুব শিগগিরই একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দরকার হলে ফরিদা ভাবি কে ঢাকায় নিয়ে যাব। আমাদের বাড়িতে থাকবেন।সালমা ভাবির হাজব্যান্ড আবিদ ভাই। তার বড় বোন ড. রেহনুমা আহমেদ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। গ্রিনরোডে চেম্বার। কথাটা মোজাফফর ভাইকে কিবলব? উনি যদি আমাকে ভুল বোঝেন? তাহলে? আমি তো আর প্রমাণ করতে পারব না যে ফরিদা ভাবি বহু বছর আগে মরে যাওয়া এক মৃতের ভাবনায় আচ্ছন্ন। যাকে বলে অবসেসড।
মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা নিয়ে রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘরে ফিরে এলাম। জামা-কাপড় খুলে, দাঁত ব্রাশ করে, বাতি নিভিয়ে জাজিমের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। মাথার কাছে খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ফুটফুটে জ্যোস্না ঢুকছিল ঘরে। আর উথাল-পাথাল হাওয়ায় জানালায় পাল্লায় শব্দ হচ্ছিল। একটা সিগারেট ধরালাম। আমার মাথায় তখন থেকে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল। ফরিদাভাবি কেন কালিকাপুরে স্থায়ী ভাবেথেকে যেতে চাইছেন? টুম্পারই-বা এই জায়গা কেন এত পছন্দ ? আমাকেই- বা কেন ফরিদা ভাবি আজ সকালে ঘটনাটা বললেন? যতই ভাবছি তালগোল পাকিয়ে ফেলছি। কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না। মগজের গোড়ায় তামাকের ধোঁওয়া দিয়েও জট খুলছিল না। রাত কেবল বাড়ছিল …
আমার ঘুম আসছিল না। ভিতর ভিতর ভীষণ অস্থিরতা টের পাচ্ছিলাম। একএক করে বেশ ক’টা সিগারেট শেষ করলাম। নীচের রাস্তায় কুকুর ডাকছিল। দায়োয়ান দোলোয়ার হোসেন জড়ানো গলায় কুকুরদের ধমক দিল। দোলোয়ার হোসেন নেশা করে মনে হল। কথাটা একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে অস্বীকার করেছিল।
কুউউ ঝিকঝিক শব্দ করে একটি ট্রেন যাচ্ছিল।কবরস্থানের ওপাশ দিয়ে রেললাইন। শেষ সিগারেটটা এ্যাশট্রেতে গুঁজে রাখলাম। আমি রাতেও মোবাইল অফ করি না। কেবল মোবাইলের রিং টোন ডিজঅ্যাবল করে ভাইব্রেশন মোড সেট করে রাখি।
আমার কেমন ঘুম পাচ্ছিল। আধোঘুমে আধোজাগরণে দেখলাম আবছা আলোয় ঘন বাঁশঝাড়। মাঝখানে সরুপথ … চৈতী হাঁটছে। কোথায় যেন যাচ্ছে ও। চৈতী না টুম্পা? ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ চৈতী কিংবা টুম্পা দৌড়াতে লাগল। ঝাঁক ঝাঁক মৌমাছি ওদের তাড়া করেছে। বন বন বনবন শব্দ হচ্ছে। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছিল … আমার মনে হল মৌমাছি না, মোবাইলটা ভাইব্রেইট করছে। বালিশের পাশ থেকে আমি এলজিটা তুলে নিলাম। ঝুমুর ! এত রাতে? আমার বুক ধক করে উঠল।
ভাইয়া … মা না …
মা-র কি …আমার গলায় স্বর ফুটল না।
আমি আর মা টিভি দেখছিলাম … মা হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলেন । আমি চিৎকার করতেই আবিদ ভাইয়া আর সালমা ভাবি এলেন। ওরা মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। আমি … আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি ভাইয়া। বলে ফুঁপিয়ে উঠল ঝুমুর।
আমি আসছি। বলে ফোন অফ করে দিলাম। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে ছিলাম। দ্রুত প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে নিলাম। পকেটে মানিব্যাগ আর তালাচাবি ঢুকালাম। আর কিছু নেব না। কিন্তু, এখন কি ট্রেন বা বাস পাব? রেন্ট- এ- কার- এর দোকান কি খোলা পাব? আমার সারা শরীর কাঁপছিল। মায়ের কিছু হলে …আমি কিছু ভাবতে পারছি না।
দরজা খুলে বাইরে এলাম। সিঁড়ি ঘরে অন্ধকার। অসুবিধে নেই মোবাইলে টর্চ আছে। পকেট থেকে তালা বের করলাম। ঠিক তখনই ভীষণ পচা গন্ধ পেলাম। আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠল। সিঁড়িতে কোথাও ইঁদুর মরে পচে আছে। কই তখন তো ইঁদুরের গন্ধ পাইনি।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!