বাজার করে ফেরার সময়ই দৈনিক পত্রিকা কিনে আনি। এক সঙ্গে বেশ ক’টা পত্রিকাই কিনি। দৈনিক পত্রিকা পড়েই আমার অবসর সময়টুকু কেটে যায়। আমি পত্রিকায় চোখ বোলাতে থাকি। দুঃসংবাদই বেশি। জানালা দিয়ে হু হু করে রোদ ঢুকে পড়েছে জাজিমের ওপর, পত্রিকায়, আমার মুখের ওপর । নীচের গাছপালায় পাখিদের সরব কিচিরমিচির শুনতে পাচ্ছি।
পুরনো এই দোতলা বাড়িটি কালিকাপুরের বেশ নিরিবিলি এলাকায় । একতলায় পিএন ফার্মা নামে একটি অষুধ কোম্পানির গুদাম ঘর। বাড়িওয়ালার নাম হাজি সাদেকুররহমান। তিনি নাকি নরসিংদীর বিরাটব্যবসায়ী। অবশ্য তাকে আমি কখনও দেখিনি। বাড়ি ভাড়া দিই দারোয়ানেরহাতে। তার নাম দেলোয়ার হোসেন। মাঝবয়েসি লোকটাকে আমার তেমন পছন্দ না।
অফিস এই বাড়ি থেকে কাছেই। হেঁটেই যাই। রেললাইন ক্রশ করতে হয়। কালিকাপুর রেলওয়ে স্টেশনটিও কাছেই। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম না এলেস্টেশনে চা খেতে চলে যাই। মধ্যরাতের নিঝঝুম স্টেশন আমার ভালো লাগে।
মোবাইলটা বাজল। ঝুমুর। আমার ছোটবোন। ইডেনে পড়ছে। দিনে অন্তত দশবার ফোন করবে। বললাম, কী রে? কী হয়েছে বল।
ঝুমুর বলল, ভাইয়া, ভাইয়া। মা না চৈতী আপুকে পছন্দ করেছে। তোমার সঙ্গে বিয়ে দেবে। তুমি রাজি হয়ো না কিন্তু।
আমার মন বিষাদে ছেয়ে যায়। চৈতীকে আমার ভালো লাগে বলে। বললাম, কেন? আমি রাজি হব না কেন?
ঝুমুর বলল, ওই মেয়েটাকে আমার পছন্দ না।
পছন্দ না কেন?
উফঃ বললাম তো ওই মেয়েটাকে আমার পছন্দ না।
কেন পছন্দ না সেটাই তো আমি জানতে চাচ্ছি? আমার কন্ঠস্বর কি খানিকটা রূঢ় শোনালো?
ওকে একটা ছেলের সঙ্গে বসুন্ধরায় দেখা গেছে ।
আমার বুক ধক করে উঠল। কে বলল তোকে?
নাম বলা যাবে না।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমি ওকে বিয়ে করব না। এবার খুশি তো?
থ্যাঙ্কস ভাইয়া! তুমি কবে ঢাকায় আসছো?
দেখি। পসিবলি বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে রওনা হব।
রাখছি, কেমন?।
ফোন রেখে বিষন্ন বোধ করি। মা আমারজন্য চৈতীকে পছন্দ করেছে।চৈতী কেআমি চিনি। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের সালমা ভাবির কাজিন। চৈতী জাহাঙ্গীরনগরের পড়ছে। ইংরেজি অনার্স । শ্যামলা, লাবণ্যময়ী মেয়েটাকে আমি মনে মনে কল্পনায় নিয়ে আসি। এখন ঝুমুর বাগড়া দিচ্ছে। সমস্যা হল পাত্রী হিসেবে কোনও মেয়েকেই ঝুমুরের পছন্দ না। আজব সাইকোলজি ওর। ওর ওপর রাগও করতে পারি না। ও খুব ছোট থাকতে বাবা মারা গিয়েছে। ঝুমুর আমার অনেক আদরের … কিন্তু, আমার চৈতীকে ভালো লাগে। এই আমার বিষন্নতার কারণ। মফঃস্বলে একা একা থাকি। পাশে চৈতী থাকলে ভালোই হত। আবার ভাবি এই একাকী নিঃসঙ্গ জীবনও তো একেবারেই মন্দ না …
ভাত প্রায় হয়ে এসেছে। কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে দেখি টুম্পা। পরনে সাদা রঙের সালোয়ার-কামিজ । সবুজ ওড়না। লাক্স সাবানের গন্ধ পেলাম। গোছল সেরে এসেছে মনে হল। চুল খোলা। টুম্পার হাতে একটি ট্রে।
এসো । বললাম।
টুম্পা ঘরে ঢুকে চেয়ারের ওপর ট্রেটা রাখল। ট্রের ওপর ঢাকনা দেওয়া তিনটি বাটি। ঢাকনা সরিয়ে দেখাল … একটা বাটিতে মেথি কলিজা; অন্যটিতে ঘন ডাল; আরেকটিতে টমেটোর চাটনী
ধন্যবাদ। বললাম।
টুম্পা আদুরে গলায় বলল, ধন্যবাদ দিতে হবে না আঙ্কেল। আমি এখন যাই।বাটি থাক। পরে এসে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
টুম্পা দরজার কাছে এসে বলল, ওহো, আঙ্কেল। তোমাকে একটা কথা বলতেই তো ভুলে গেছি। এই দ্যাখো, আজকাল আমার যে কী হয়েছে।
কী কথা শুনি?
টুম্পা বলল, আজ সকালে বাবা এসেছে।মা রাতে তোমাকে আমাদের সঙ্গে খেতে বলেছে।
আচ্ছা, আমি যাব।
যাবে কিন্তু, নইলে অনেকক্ষণ ধরে মিস কল দেব।
না, না। মিস কল দিতে হবে না। আমি সময়মতো চলে যাব।
টুম্পার মুখটা ওর মায়ের মতন। ফরিদা ভাবির জন্য উদ্বেগ টের পেলাম। সুখের সংসার । এখন কী মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন তিনি। সতেরো-আঠারো বছর বয়েসে আবু জাফর নামে একজন শিক্ষক ফরিদা ভাবির প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। সেই অপরাধ বোধে ভুগছেন কালিকাপুরে এসে। আবার এমনও তো হতে পারে … হয়তো জাফর স্যারের সঙ্গে গভীর সর্ম্পক ছিল ফরিদা ভাবির। যে জন্য টুম্পার বাবার কাছে নিজেকে অপরাধী ভাবছেন।
দুপুর কাটল চৈতীর স্বপ্নে। আমার চৈতীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। গতবার যখন ফোন-টোন না করে হুট করে ঢাকা গেলাম। দেখি দরজায় তালা। ঝুমুর কলেজে। কিন্তু মা কোথায়? সালমা ভাবিদের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজালাম। সালমা ভাবি দরজা খুলে আমাকে দেখে অবাক। সালমা ভাবি বললেন, আরে তুমি? মাকে না দেখে অবাক, না? আমি মাথা নাড়লাম। সালমা ভাবি বললেন, খালাম্মা আমার শাশুড়ির সঙ্গে মিরপুর মাজারে গিয়েছেন । এসো ভিতরে এসো। আমি ভিতরে ঢুকে অবাক। চৈতী সোফার ওপর বসে আছে। আমাকে দেখে খুশি হল মনে হল। বেগুনি রঙেরআটপৌড়ে সুতির শাড়ি পড়েছিল চৈতী । সোফায় বসে শাদাবকে খাইয়ে দিচ্ছিল। শাদাব সালমা ভাবির ছেলে।ভীষণ দুষ্ঠু।
আমি হাতমুখ ধুয়ে এলাম। খিদে পেয়েছে। খেতে বসলাম। চৈতীও এল। আমার আর চৈতীর ব্যাপারে সালমা ভাবির প্রশ্রয় আছে। চৈতী বলল, আমার না মফঃস্বল শহর খুব ভালো লাগে …কথাটা শুনে আমি বুকের মধ্যে আনন্দ টের পেলাম …
তো এখন ঝুমুর কেন যেন বেঁকে বসেছে…
রাত ন’টার দিকে গেলাম ফরিদা ভাবিরবাসায়।
মোজাফফর ভাই লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে ড্রইংরুমে বসে ছিলেন। টিউব লাইট জ্বলে ছিল। মোজাফফর ভাইয়ের মাথায় মস্ত টাক। কপালের বাঁ পাশে বড় আঁচিল। তবে বিদঘুটে দেখায় না। মোজাফফর ভাইয়ের স্বাস্থ বেশ ভালো।
ব্যাঙ্কাররা ঘরে বসেও নাকি ব্যাঙ্কেরই আলাপ করে। আর আমিও ওইদিকেই পড়াশোনা করেছি। কাজেই অনিবার্যভাবেই, বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের রিজার্ভের পরিমান, সুদের হার, গ্রামীণব্যাঙ্ক, শেয়ারবাজার, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি এবং সরকারি ব্যাঙ্কের কেলেঙ্কারি- এসব প্রসঙ্গ উঠে এল।
মোজাফফর ভাই একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন। ড্রইংরুমের বাতাসে মশলার ঝাঁঝ। আমি পরদার ফাঁক দিয়ে ফরিদা ভাবি আর টুম্পাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে মা ও মেয়ে। ফরিদা ভাবির পরনে হলুদ রঙের শাড়ি, লাল ব্লাউজ।মুখটা কেমন গম্ভীর। গাঢ় নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ আর সাদা ওড়না পরে পরীর মতন উড়ছিল টুম্পা ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।