ফরিদা ভাবি বললেন, কলেজে পড়ার সময়আমাকে … আমাকে একজন ভালোবাসত। আমার … আমার বিয়ের কথা শুনে সে আত্মহত্যা করে। এখন …এখন … আবার সে এত বছর পর আমার কাছে ফিরে এসেছে।
আমি চমকে উঠলাম। ফরিদা ভাবি এসব কী যা তা বলছেন! মানুষ মরে গেলে আবার ফিরে আসে নাকি?
ফরিদা ভাবি বললেন, আবু জাফর স্যারদূর্গাপুর মহিলা কলেজে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। উনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেন। আমাকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। লিখেছেন, পরী, তোমায় আমি না- পেলে আমার জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। কিন্তু … কিন্তু বিশ্বাস কর রায়হান, আমার … আমার করার কিছুই ছিল না। আমার বাবা-মা নেই। বড় মামার কাছে মানুষ হয়েছি। বড় মামা ছিলেন দূর্গাপুর থানার দারোগা। ভীষণ কড়া মেজাজের মানুষ।এই বলে চুপ করে গেলেন ফরিদা ভাবি।হয়তো অতীতে ফিরে গেছেন। ফরিদা ভাবির কন্ঠস্বর কেমন কাঁপছিল। গোলপানা ভরাট ফরসা মুখে নীল রঙের গভীর ছাপ।মুখে ঘাম ফুটে আছে। চোখ দুটিতে কেমন যন্ত্রনার চিহ্ন।
কিছুক্ষণ আগে বাজার করে ফিরছি। দেখি যে সিঁড়িতে ফরিদা ভাবি দাঁড়িয়ে আছেন । আমাকে দেখে বললেন,তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে রায়হান। ভাবলাম টুম্পার ব্যাপারে কিছু বলবেন। সেদিন অফিসথেকে ফেরার সময় দেখলাম টুম্পা রূপমতী সিনেমাহলের সামনে একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। কথাটা হয়তো ফরিদা ভাবির কানে গিয়েছে; টুম্পার বাবাকে বলতে সাহস পাচ্ছেন না। আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান। বললাম, আসুন, ঘরে আসুন।
ভাবি ঘরে এসে বললেন, টুম্পা কোচিংয়ে। আর তোমার ভাই ফরিদগঞ্জ থেকে কিছুক্ষণ আগে রওনা হয়েছেন। আমার হাতে বেশি সময় নেই। যা বলার তাড়াতাড়ি বলতে হবে।
আচ্ছা, বলুন।
তখন আমি ভাবতেও পারছি না ফরিদা ভাবি এমন অবাস্তব ভৌতিক কাহিনি শোনাবেন । ফরিদা ভাবির বয়স প্রায় ত্রিশ-পয়ত্রিশের কাছাকাছি। এই বয়েসে মহিলারা কী এমন অযৌক্তিক ইমোশ্যনাল কথাবার্তা বলে? অবশ্য আমি সিওর নই।
ফরিদা ভাবি বললেন, আবু জাফর স্যারের বাড়ি ছিল কালিকাপুর।
আমি এবার অবাক হয়ে বললাম, কালিকাপুর মানে! এখানে?
হ্যাঁ। আত্মহত্যার পর এখানেই জাফর স্যারকে কবর দেওয়া হয়েছিল। কবর থেকেই উঠে এসে জাফর স্যার গতকাল গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন ।
কথাটা শুনে আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ফরিদা ভাবির সঙ্গেমৃত কারও দেখা হয়েছে … এমনটা আমি নটরডেম কলেজের সায়েন্স ক্লাবের একজন প্রাক্তন সদস্য বলেই মেনে নিতে পারছি না। আমি জানি ফরিদা ভাবির সমস্যাটি কোনওমতেই সুপারন্যাচারাল না। মনে হয় মানসিক।
ফরিদা ভাবির জন্য আমার ভীষণ খারাপই লাগছিল। আমি নতুন চাকরি পেয়ে মাসখানেক হল এই মফঃস্বল শহরে এসেছি। ফরিদা ভাবিরা থাকেন আমার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে । স্বামী-সন্তান নিয়ে কী সুখের সংসার । পরিবারটি ভারি মিশুক আর অমায়িক। আমার নিঃসঙ্গ মফঃস্বল জীবন আনন্দে ভরিয়ে রেখেছে। ফরিদাভাবি ভারি নরম মনের মানুষ। বড় বোনের মতো নিয়মিতই আমার খোঁজখবরনেন তিনি। প্রায়ই এটা-ওটা রান্না করে খাওয়ান। এমন একজন দরদি মানুষ মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছেন । আমার তো খারাপ লাগবেই।
ফরিদা ভাবি বললেন, তোমার ভাই কালিকাপুর বদলি হয়ে আসার পর থেকেই আমি জাফর স্যারকে স্বপ্ন দেখতে থাকি। জাফর স্যার বলেন… পরী তুমি এখন আমার কাছে ফিরে এসেছ। তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে না পরী? আমি বললাম …আপনাকে কেমন করে করব? আপনি তো বেঁচে নেই। তখন জাফর স্যার বলেন, আমি তোমাকে দেখববলে আজও বেঁচে আছি পরী। আমি তোমারজন্য তোমাদের বাড়ির সিঁড়িতে অপেক্ষা করে থাকব। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে তখন তুমি না হয় এসো কেমন। একই স্বপ্ন পরপর কয়েক রাত দেখলাম। মাঝখানে অবশ্য দেখিনি। গতকালও অনেক রাতে ওই একই স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে জাফর স্যার বললেন আমি তোমার জন্য সিঁড়িতে অপেক্ষা করে আছি। সবাই ঘুমিয়ে আছে। এখন তুমি আমার কাছে আস। আমার ভীষণ কৌতূহল হল। আমি সিঁড়িতে যাই। দেখি জাফর স্যার বসে আছেন।
আমি চমকে উঠলাম। এসব কী আজেবাজে কথা বলছেন ফরিদা ভাবী। মৃতের সঙ্গে অভিসার! ফরিদা ভাবির কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ফরিদা ভাবিকে অবিলম্বে মনোরোগ চিকিৎসক দেখানো দরকার। দরকার হলে ফরিদা ভাবি কে ঢাকায় নিয়ে যাব। মোজাফফর ভাইয়ের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলা দরকার।
আমি কী বলতে যাব- ফরিদা ভাবির মোবাইল বাজল। মোবাইলে কার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেন। তারপর ফোন অফ করে বললেন, আমি এখন যাই। তোমার ভাইয়ের ফোন। তোমার ভাই রওনা দিয়েছেন। বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন।
ফরিদা ভাবির স্বামী মোজাফফর ভাই ব্যাঙ্কার। চট্টগ্রামের মানুষ। ভীষণ আন্তরিক । মাস দুয়েক হল তিনিও কালিকাপুর বদলি হয়ে এসেছেন; মোজাফফর ভাইয়ের পোস্টিং যদিও ফরিদগঞ্জ ব্রাঞ্চে। জায়গাটা কালিকাপুর থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ কিলোমিটারের মতন। নিয়মিতই যাতায়াত করেন বাসে কিংবাট্রেনে। আবার মাঝে মাঝে ফরিদগঞ্জেই থাকেন।
বাজারের থলে নিয়ে রান্নাঘরে এলাম। বাজার প্রতিদিনই করি। আমারফ্রিজ নেই । আসলে এ বাড়িতে আসবাবপত্র তেমন কিছুই নেই। শোওয়ার ঘরের মেঝেতে একটা জাজিম; দুটি কমলা রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। আর একটি আলনা। ব্যস। আসবাব বলতে এই।
হিটারে চায়ের পানি চড়িয়ে দিলাম। আমি একা মানুষ। রান্নাবান্না নিয়ে বেশি ঝামেলা করি না। ফরিদা ভাবি অবশ্যি দু’বেলাই খেতে বলেন। মাঝে-মাঝে খাইও; তবে টুম্পাকেও পড়াই। টুম্পা ক্লাস টেন-এ পড়ে। মেয়েটির মুখচোখ শার্প হলেও ওর গায়ের রং ওর বাবার মতন; শ্যামলা। বেশ উচ্ছ্বল আর প্রাণবন্ত মেয়েটি। তার তুলনায় ফরিদা ভাবি কেমন যেন শীতল।
রান্নাঘরটি ছোটই। পশ্চিমের দিকের জানালায় রোদ। ঘন বাঁশঝাড়েরফাঁকে আস্তরহীন প্রাচীর চোখে পড়ে। ওটাই স্থানীয় কবরস্থান। বেশপুরনো । হিটার থেকে সসপ্যান নামাতে-নামাতে ওদিকে চোখ যেতেই চকিতে ভাবলাম … ওই কবরখানায় আবু জাফর- এর কবর হয়নি তো? বুঝতে পারছি না।
চা নিয়ে শোওয়ার ঘরে ফিরে এলাম।ভাবছি, ফরিদা ভাবি আসলে বিয়ের পর ওই ট্র্যাজিক ঘটনাটি ভুলেই ছিলেন। টুম্পার বাবা কালিকাপুর বদলি হয়ে আসার পরই পুরাতন স্মৃতির মনে পড়ে যাওয়ায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছেন।
মেঝের ওপর চায়ের কাপ রেখে জাজিমের ওপর শুয়ে পড়লাম।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।