প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি খায় অভিক। যেন দ্রুতগতির ১৩০ সিসির ছোট করোলার হঠাৎ ব্রেক কষল। না, তুলনাটা যুৎসই হল না। এই ধাক্কাটার মধ্যে আরও ভয়াবহতা আছে, আছে আতংক যা নেই যানবাহনের আচমকা ব্রেকে। কেন বাবা এমন কাণ্ডটা করলেন কিছুতেই ভেবে পায় না অভিক। সারা বাড়িতে যেন সংক্রামক ব্যাধির মতো শোকের আবহ ছড়িয়ে দিয়েছে। অথচ এটা তার স্বভাব-বিরুদ্ধ। সবাইকে হতাশার বিরুদ্ধে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সাহস জোগান যিনি, সেই বাবাই কিনা আজ হঠাৎ এমন একটা হতাশা ছড়ানো কাণ্ড করলেন। ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে, সেদিকে দৃষ্টি নেই কারও।
একটা প্রচণ্ড ঝড়ের পর সব শান্ত-সুনসান। মা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছেন। রুবী পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে এখনও কাঁদছে কিনা জানে না অভিক। কাজের মেয়েটা রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিত আজ রান্না-খাওয়া কিছুই হবে না এ বাড়িতে। পরিবেশ অন্তত তাই বলে। গ্রামের বাড়ি থেকে ছোট কাকা এসেছেন। তিনিও বুঁদ হয়ে বসে আছেন খাটের কিনারে।
অভিক অনেক ভেবে খুঁজে পায় না বাবা কেন অফিস থেকে ফিরে এমন করে আজ তার মৃত্যুর কথা বললেন। বিদায় চাইলেন সবার কাছে। সাধারণত এত তাড়াতাড়ি বাড়িও ফেরেন না কোনোদিন। এক প্রাইভেট অফিসের প্রধান হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব তার। ফিরতে ফিরতে রাত নটা-দশটা হয়েই যায়। কিন্তু আজ ফিরেছেন সন্ধ্যার আগেই। অভিক তখনও বাসায় ফেরেনি। অভিকের অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়। যানজট ঠেলে বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছটা-সাতটা হয়ে যায়। বাসায় ফিরতেই দেখে ড্রইংরুমে মা, ছোট বোন রুবী আর ছোট কাকা বসে আছেন। তাদের বিপরীত দিকে সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন বাবা। ড্রইংরুমের পরিবেশটা কেমন থমথমে। টিউবলাইটের শুভ্র আলোটাও আজ কেমন যেন হলদেটে, জন্ডিস রোগীর অবস্থা যেন। সেই গম্ভীর থমথমে পরিবেশে ঢুকে অভিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। বাবার এমন অপ্রত্যাশিত আচরণে হতভম্ব হয়ে পড়ল অভিক। হতভম্ব না বলে বিহ্বল বলাই বোধহয় যথার্থ। কেন বাবা কাঁদছেন, কী হয়েছে এমন প্রশ্ন করাই ছিল ওর জন্য স্বাভাবিক কিন্তু একটা শব্দও ঠোঁট ফুঁড়ে বেরুল না। অসহায় অভিক বাবাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। কয়েক সেকেন্ড এভাবে যাওয়ার পর মা উঠে এসে বাবাকে ভর্ৎসনা স্বরেই বললেন, এসব তুমি কী শুরু করেছ বলো তো? কী হয়েছে তোমার? কেন এমন করছ?
বাবা ছেলের দিক থেকে স্ত্রীর দিকে তাকালেন, বললেন, বত্রিশটা বছর সংসার করলে রানু, তার পরও তুমি আমাকে এই বুঝলে?
তুমি কি বুঝতে দিচ্ছ কিছু? কোনোদিনও তো তোমাকে এমন আচরণ করতে দেখিনি। আজকের তোমার সঙ্গে অতীতের তোমার কোনো মিল নেই। সেই কলেজে যখন পড়ো, তখন থেকেই চিনি-জানি। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ না হতে সংসার শুরু। কই কোনোদিন তো এত হতাশা তোমার মধ্যে দেখিনি? কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ এসে বলা শুরু করেছ আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।
এবার আহসান সাহেব একটু শক্ত হলেন যেন। অভিযোগের সুরেই স্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তুললেন, কেন, মিথ্যে বলছি? আমার সৎ অনুভূতি আমি তো লুকিয়ে রাখতে পারি না। গত রাতে মা এসে বললেন, বাবা চল আমার সঙ্গে। আমি বললাম কোথায় মা? মা বললেন, এমন সুন্দর জায়গায় তোকে বেড়াতে নিয়ে যাব, তুই যা কখনও দেখিসনি। এই কথা বলেই মা আশ্চর্য সুন্দর এক ট্রেনে উঠলেন, এত দেশ ঘুরেছি আমি, কোথাও এমন সুন্দর ট্রেন দেখিনি। আমি মাকে অনুসরণ করে সেই আশ্চর্য সুন্দর ট্রেনে উঠে গেলাম।
অভিক বলে, বাবা এটা তো সে ফ স্বপ্ন। দাদি তোমাকে স্বপ্নে কোথাও নিয়ে গেছে বলে তুমি মরে যাবে? এমন বিশ্বাস কী করে হল তোমার? তুমি না এত আশাবাদী মানুষ!
বাবা ম্লান হাসলেন কারণ মর্মবিদারী সেই হাসি আর তার ছলছলে দৃষ্টিতে যেন রাজ্যের অভিযোগ। অভিক, তুইও তোর মার মতো কথা বলছিস? আর তোর দাদির সঙ্গেই তো শুধু যাইনি, সেই কবে আমার শিশুবেলায় নানা মারা গেছেন, সেই নানার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি লঞ্চে। বর্ষার উত্তাল ঢেউয়ে উপচেপড়া মেঘনার কী ভয়াল সে াত। সেই সে াতে দুলছে দোতলা লঞ্চ। নানা আমাকে বলছেন, এবার সুন্দরবন দেখাবই তোমাকে। এত ভালো রেজাল্ট করেছ। এ আমার শ্রেষ্ঠ উপহার তোমার জন্য। অথচ ভয়ে আছি আমি। সেই ছোট্টবেলার এতটুকুন আমি। কী ভালো রেজাল্ট করলাম তুই-ই বল? আমি তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছি কিনা মনেও পড়ে না।
অভিক জানে, বাবার এসব যুক্তি আর আবেগময় প্রশ্নের কোনো উত্তর দিয়ে ফল হবে না। বাবা যা বুঝেছেন, তা-ই সত্য মেনেছেন। অন্য কোনো যুক্তি নেবেন না। উপরন্তু দাদাও নাকি তাকে গত কয়েক রাত ধরে স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন, সে কথাও মাকে বলেছেন। অর্থাৎ বদ্ধমূল ধারণা দু-চার দিনের মধ্যেই তিনি মরে যাচ্ছেন। এটা গত তিন-চার দিনের কথা। আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছেন ব্যাংক একাউন্টের যৌথ স্বাক্ষরের জন্য ফর্ম নিয়ে। মায়ের স্বাক্ষর নিয়েছেন প্রায় জোর করেই। এ নিয়ে এক দফা কান্নাকাটি যে হয়ে গেছে, সে কথাও ছোট কাকার কাছ থেকে শুনেছে। অভিকের গলা জড়িয়ে কান্নাকাটির পর একটা লিখিত স্ট্যাম্পে অভিকের স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। বলা যায় প্রায় জোর করেই। অর্থাৎ আহসান সাহেব ধরেই নিয়েছেন, তার দিন শেষ। তার মৃত্যুর পর সাকসেশন সার্টিফিকেট, বাড়ির অংশীদারিত্ব, ব্যাংক একাউন্টের টাকা-পয়সা এসব নিয়ে যাতে স্ত্রী-সন্তানরা কোনো ঝামেলায় না পড়ে, তার সবই তিনি সম্পন্ন করে রেখে যেতে চান।
একজন তরতাজা জীবন্ত মানুষ যদি এমন মৃত্যুপ্রস্তুতি নেয় এমনকি ঢাকার সহায়-সম্পদ, গ্রামের জমিজমার কে কী হারে পাবেন তারও উইল দলিল শেষ করেন, ছোট ভাইকে টেলিফোনে জরুরি কাজ আছে বলে ডাকান, তখন কেমন অসহায় হয়ে যায় তার স্বজনরা। এরকম একটা পরিস্থিতির পর যখন ছেলেমেয়ে-স্ত্রী-স্বজনদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নেন তা হলে তা কে সহ্য করতে পারে? ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কান্নার রোল পড়েছে বাড়িতে।
সেই থমথমে পরিবেশেই বাড়ি ফিরেছে অভিক। তারপর প্রায় ঘণ্টা তিনেক পেরিয়ে গেছে। রুবীর ঘরের দরজায় দু-একবার টোকা দিয়ে ভেবেছিল দরজা খুলে দেবে। কিন্তু না খোলেনি। বেশ কয়েকবার জোরে আঘাত করার পর দরজা খুলে দেয় ছোট বোন। চোখ-মুখ ফুলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে। ভাইকে দেখে যেন প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় মিলল। হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। অনেক চেষ্টা করেও বোনটিকে শান্ত করতে পারছে না। নিজের বুকের ভেতর উথলে ওঠা কান্না চাপা দিতেই সে মুহূর্তে হিমশিম খেয়ে যান অভিক। অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করে রুবীকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে একসময় চলে আসে ডাইনিং স্পেসে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে, কাঁদুক রুবী। আরও কাঁদুক। কাঁদলে কষ্টটা হালকা হবে। মায়ের ঘরের দরজাটায় কিঞ্চিৎ ফাঁকা। বাতি জ্বলছে ভেতরে। দুবার ডাকল অভিক- মা, মা কোনো সাড়া শব্দ এলো না। দরজার ফাঁকা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে বাধ্য হল। দেখে বাবা জায়নামাজের ওপরই ফ্লোরে উঁবু হয়ে আছেন। দৃষ্টি ফেলে খাটের ওপর। মা খাটের এক কোণে বালিশে মুখ গুঁজে আছেন। কাঁদছেন মুখ চেপে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিছুই বোঝা গেল না। একটা হাহাকারের মতো ঝড়ো দীর্ঘশ্বাস ডুকরে উঠল অভিক নিজের ভেতরে নিজেই। চাপা স্বভাবের হলে যা হয় সেই অব্যক্ত কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে রইল ওর। কিন্তু জগতে কারও সঙ্গে যে এই মুহূর্তে শেয়ার করবে এই কষ্ট সে রকম একটি মুখ কোথাও খুঁজে পেল না। ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে ছোট কাকা ততক্ষণে সোফার ওপরই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
হতবিহ্বল অভিক আকাশ-কুসুম ভাবনায় তলিয়ে যেতে থাকে- বাবার জীবনে হঠাৎ কী এমন নতুন ঘটনা ঘটেছে। বাবার মতো ধৈর্য, এমন সহিষ্ণু দ্বিতীয় কারও সাক্ষাৎ এই বিশ বছরের জীবনে পায়নি অভিক। মায়ের সঙ্গে মধুর সম্পর্কে যাকে হবে- তার জন্মের পর যেমন কখনও দেখেনি অভিক। অমিলের বহু যৌক্তিক কারণ ছিল। অনেক বছর আগে কথাটা নানা বাড়িতেই শুনেছিল, তার এক ফুফাতো খালাকে দেখিয়ে তার মাকে বিয়ে দিয়েছিল বাবার সঙ্গে। বিয়ের পর চরম কষ্ট পেয়েছিলেন বাবা। দাদা-দাদি এ বিয়ে ভেঙে দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবা নাকি বলেছেন, মেয়েটির কী দোষ। অপরাধ করেছে যারা শাস্তি তো তাদের দিতে হবে। কোনোদিন নানাবাড়ি আর যাননি বিয়ের পর। তাছাড়া মায়ের সঙ্গে বাবার অনেক কিছুতেই মেলে না। তবু এই দুটি সহিষ্ণু মানব-মানবী সংসারের মঞ্চে কী সুন্দর নাটক করে চলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ভেবে অবাক হয় অভিক। ছোটবেলায় বোঝেনি। যতই বড় হয়েছে, দিন দিন স্পষ্ট হয়েছে সব। মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয়েছে। বাবার জন্যও। এত কিছুর পরও তবু কী চমৎকার নৈপুণ্যে ঝঞ্ঝাটহীন পার করে এসেছেন দীর্ঘপথ। গোটা পরিবারের ভার বহন করেছেন মুখ বুজে সারাটা জীবন। নিুমধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিত স্বনির্ভর সন্তান। যাকে বলে সেলফডেম ম্যান। নিজের ভাইবোনদের শুধু নয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন রক্ত সম্পর্কের প্রায় এক ডজন মানুষকে, যাদের অনেকে বিত্ত-বৈভবে বাবাকে ছাড়িয়ে গেছেন। মুহূর্তে সংসারের হালচাল জরিপ করে নেয় সে। অভিকের চাকরি হওয়ার পর গত তিন বছরে সংসারে, একটু বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্যের হাওয়া লেগেছে। অফিসের গাড়ির জন্যও আর বাবাকে অপেক্ষা করতে হয় না। এখন বলতে গেলে দুটো ফুলটাইম গাড়ি। অভিক বিদেশী সংস্থায় চাকরি করে। ভালো বেতন। ওর ফুলটাইম হয়েছে বছর দেড়েক হল। তার আগেই একটা গাড়ি কিনে নিয়েছে সে। বাবাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে আসার পথে রুবীকে ভার্সিটিতে নিয়ে যায়। ওর নিজের দরকার হয় না। অফিসের গাড়িতেই তখনও আনা-নেয়া চলছে। রাতে বাবাকে আনতে যায় ড্রাইভার। তখন যেখানে খুশি বাবা বেড়াতে যেতে পারেন। রুবীও মাঝেমধ্যে ওর বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি যায়। রুবীর মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার চলছে। এরই মধ্যে একটি বিয়ের আলোচনাও প্রায় চূড়ান্ত। ছেলে কম্পিউটার সায়েন্স প্রথম শ্রেণী পাওয়া। উঁচু মাইনের চাকরি করছে একটি নামকরা ফোন কোম্পানিতে। রুবীরও পছন্দের।
একপলকে অভিক এসব জরিপ করে নেয় মনে মনে। সংসারে সচ্ছলতা প্রতিষ্ঠা সবই তো এসেছে। ইংরেজি সাহিত্যে ভালো রেজাল্ট করা অভিকের জীবনে বাহ্যিক প্রতিষ্ঠার সবই হয়েছে। শুধু এক অন্তহীন শূন্যতায় নিজের ভেতরটা যে হু হু করে, সেটাই কাউকে বলতে পারে না সে। বিয়ে করেও ব্যাচেলর জীবনের ট্রাজেডি বইতে হচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট কারও সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না সে। তবু একজন যে গভীরভাবে তা অনুভব করে, এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারে সে। কিন্তু বুঝেও তা বাবাকে বুঝতে দিতে চায় না অভিক। খুবই অন্তর্মুখিন ছেলে। প্রচণ্ড আবেগ ভেতরে ভেতরে। কিন্তু বাইরে তার সামান্য প্রকাশ নেই। এছাড়া অল্প বয়সেই অনেক কষ্টের ক্ষত জমা হয়েছে বুকের মধ্যে। সেসব ক্ষতে নিজেই প্রলেপ বুলায় জীবনানন্দ আর শেকসপিয়ারের কবিতার পঙ্ক্তি আউড়ে। আজ এ মুহূর্তে বাবার আকস্মিক মৃত্যুম্মুখ বিদায় ভাবনা ওকে দুঃস্বপ্নের এমন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে যে আর নতুন কোনো আলো দেখতে পায় না অভিক।
কত কী যে মনে পড়ছে এখন। এই তো গত বছর হঠাৎ অফিসে কাজের ফাঁকে একটি দৈনিকে বাবা দিবসের বিশেষ আয়োজন দেখে হঠাৎ মনে হল, বাবাকে কত ভালোবাসে, অথচ কোনোদিনই বলা হয় না। একটা মেসেজ পাঠালে কেমন হয়। অভিক খুব ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠাল বাবার সুস্থ দীর্ঘায়ু কামনা করে। তার জবাবে বাবা যে কী দীর্ঘ একটা জবাব দিলেন, ওহ্ মাই গ্রেট বিলাভেড সান, গড ব্লেস ইউ…. আরও কত আবেগময় কথা।
অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় একটা দুর্ঘটনার মতো সম্পর্ক হয়েছিল সোমার সঙ্গে। অভিক কল্পনাও করেনি ভালোবাসা যে খেলার ছলে এমন নির্মম রসিকতা হতে পারে। সেই হৃদয়হীনতা আর অবিশ্বাস্য প্রতারণা সইতে পারেনি অভিক। সোমা চোখের সামনে এই নিষ্ঠুর ভালোবাসা নাটকের শেষ পর্দা টেনে নিলে অভিকের কাছে জীবনটাকে অর্থহীন মনে হয়েছিল। অনিদ্রায়-অনাহারে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। সেই চরম দুঃসময়ে দু-একজন সহপাঠী ছাড়া আর কেউ জানত না এই বিপর্যয়ের কথা। দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল অভিক। মা শুধু জিজ্ঞেস করতেন, কী হয়েছে। কী আশ্চর্য বাবা ঠিকই বুঝেছিলেন। যথাসময়ে যথাস্থানে তিনি পরিচর্যা দিয়েছিলেন বলেই আবার ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে অভিক। জীবন যে কারও জন্য কোথাও থেমে থাকে না, এই দৃঢ় প্রত্যয় বাবাই জাগিয়েছিলেন ওর মনে।
এ রকম কত যে খণ্ড খণ্ড ভাবনার মেঘ অভিকের স্নায়ুকোষে স্মৃতির মতো ভেসে উঠছে। এমনই ভাবতে ভাবতে কখন যে আধো ঘুম আধো জাগরণে এক আশ্চর্য হেলুসিনেশন, নাকি স্বপ্নের ভেতরে ডুবে যার অতীত কে জানে। সেই পরাবাস্তব স্বপ্ন বাস্তব থেকে বহু দূরের, কল্পনার মতো সুন্দর, কিন্তু বাস্তবের মতো বিপন্নতার, সীমাহীন কষ্টের।
প্রেম, বিয়ে স্বপ্ন, বাস্তবতা, জীবন, মৃত্যু এ রকম গভীর বোধের ভেতর দিয়ে এক আশ্চর্য গল্প বয়ন করে চলেছেন রূপকথার এক চরকাবুড়ি। আর সেই গল্পের মেঘে ভাসতে ভাসতে অভিক দেখে চরকাবুড়ি যেন তার দাদা অথবা পরদাদার কাল থেকে উঠে এসেছে। দাদির ওরাল গল্প থেকে জানা যায় আহসান নামের এক কিশোরের স্বপ্নডানায় ভর করে উড়ে চলার আশ্চর্য কাহিনী। আশ্চর্য রূপকথার পরী ছেলেটিকে উড়িয়ে নিয়ে যেত কোনো কোনো জ্যোৎস্না রাতে। তারপর নিখোঁজ সেই ছেলেটির খোঁজে গোটা পরিবারে হাহাকার পড়ত। তারপর একদিন আবার ফিরে আসত। সে ছেলেটি ধীরে ধীরে এমন স্বপ্নবাজ হয়ে ওঠে যে যৌবনে তাকে নাকি সত্যি এক লালপরী এক ভরদুপুরে সংসার থেকে বহু দূরে কোনো বিধ্বস্ত নগরীর নির্জনতায় নিয়ে স্বপ্নের অঞ্জন মাখিয়ে দিয়েছে চোখে। তারপর থেকে অভিক এমন এক অহংকারী সন্তান হয়ে ওঠে, রুবী এমন এক সফল কন্যা হয়ে ওঠে, যাদের পিতা জীবনে এক লাইন কবিতা না লিখেও কবির মতো গভীর গভীরতম রোমান্টিক আর স্বপ্নবান। সঙ্গীত তার অসম্ভব প্রিয়। দুুঃখ তার শৈল্পিক তৃষ্ণা ছড়ায় প্রৌঢ় মানুষটির অবয়বে, হৃদয়ে। অভিক আর রুবী দেখে তার বাবা আগুন হাতে বসে আছেন। গনগনে লাল তিনটি জ্বলন্ত কয়লা ফুলের মতো ফুটে আছে তার হাতে। অথচ সামান্য আহ্ উহ্ শব্দটিও নেই ঠোঁটে। শুধু কুঁকড়ে আছে তার চোখের গভীরে দুটি উজ্জ্বল কালো তারা। রাতের গভীরতায় আধো ঘুমে ক্লান্তির ঘোরে নেতিয়ে পড়া অভিক আস্তে আস্তে অন্য এক জগতে তলিয়ে যায়। যেখানে বাবার মৃত্যুর চেয়ে করুণ দুঃসংবাদ- মা নেই। আশ্চর্য বাবা তা জানেন না। জীবনকে অর্থহীন ভেবে মৃত্যুর প্রস্তুতির অনুসন্ধান চলতে থাকে অবচেতন মনে। অভিক দেখে বাবা নয় মা-ই মারা গেছেন।
বাবা এয়ারপোর্টের দিকে দ্রুত ছুটছেন অভিকের দেয়া সেই ঝকঝকে নতুন গাড়িতে। আর চোখে-মুখে থমথমে বিষণ্ণতা। তার প্রবীণ পিতা সেই স্বপ্নে আশ্চর্য তারুণ্যে উদ্ভাসিত এক যুবক। বাবার মতো অবিকল চেহারার মানুষটিকে দেখে স্বপ্নের ভেতরে কিংবা ঘোরের ভেতরে অভিক আনন্দে আর্তনাদ করে ওঠে- বাবা। কিন্তু সেই মর্মভেদী আকুল ডাক কিছুতেই স্পর্শ করে না তাকে। তিনি সামনের গাড়িটিকে অনুসরণ করছেন। গাড়ির ভেতরে নিলু নামের এক তরুণী আর তার প্রবাসী স্বামী গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তারা আজ বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে স্বপ্নের সোনার হরিণের দেশে। আর কখনও দেখা হবে কিনা জানেন না টগবগে তরুণ রূপকথার গল্পের মতো পরীর আসরে পড়া আহসান সাহেব। পেছনে পেছনে ছুটছে অভিকের গাড়ি।
অবিকল আরও একখণ্ড গল্প, স্বপ্ন নয়, শোকের মতো থমথমে এক টুকরো নির্মম বাস্তবতার গল্প দগ্ধ করে ফেলে মুহূর্তেই অভিক নামের তরুণকে বিয়ের পরপরই তৃণাও এভাবেই উড়ে গিয়েছিল আর এক বরফ ঢাকা স্বপ্নের দেশে, পিএইচডি করবে, বড় হবে। কিন্তু যাওয়ার দুবছরের মধ্যে বদলে গেছে তৃণা। আবার ফিরে আসবে কি? ভালোবাসার চেয়ে, সংসারের বন্ধনের চেয়ে যেখানে ইউরোর উত্তাপ কিংবা উষ্ণতা অনেক বেশি। তৃণার কথা মনে হতেই চোখ ফেটে এক ফোঁটা জল নিঃশব্দে গড়িয়ে যায় চিবুক ছুঁয়ে। তৃণা যেন এক রূপকথার নায়িকা। এ পৃথিবী যেন কখনও পায় না তাকে। বাবা দাঁড়ানোর প্রেরণা দিয়েছেন। এ রকম দ্বৈত কষ্টের দ্বান্দ্বিক পরাস্বপ্নের মধ্যে অভিক দেখে তার বাবা উড়ন্ত এক বিমানের পেছনে পেছনে উড়তে উড়তে একখণ্ড মেঘ হয়ে ভেসে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে অসংখ্য মেঘের ভিড়ে একটা শূন্যতায় মিশে যাচ্ছেন। স্বপ্নের মধ্যেই তিরোহিত বাবার জন্য আর্তনাদ করে ওঠে অভিক। কিন্তু সেই ডাক কোথাও পৌঁছায় না। আগরবাতি আর লোবানের গন্ধে একটা পবিত্র অথচ শোকবিহ্বল। আবহ ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা বাড়িতে। অভিক চিৎকার করে মাকে ডাকে। উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিক রোগী প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা গত ১২টা বছর শয্যাশায়ী মাঝে মাঝে অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটেন। সন্ধ্যায়ও ড্রইংরুমে সোফায় দেখেছিল অভিক।
কী আশ্চর্য ওর ডাক শুনে সে-ই মা কি না কারও সাহায্য ছাড়াই দৌড়ে প্রায় ছুটে এলেন। কীরে কী হয়েছে বাবা! ভাইয়া কী হয়েছে বলতে বলতে যে আর্তনাদ করতে করতে ছুটে এসেছে রুবী, কাজের বুয়া। কিন্তু বাবা আসেন না। দুঃস্বপ্ন থেকেই জেগে ওঠে স্তব্ধ বিহ্বল তাকিয়ে থাকে অভিক। বেডরুমের ঘড়িটা স্তব্ধ কেন? নিজের মধ্যেই এই উত্তরহীন প্রশ্নটা প্রতিধ্বনি তুলতে থাকলে অসহায় মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে অভিক।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক