একজন সাদাসিদে সরকারি কর্মকর্তা বলতে যা বুঝায় রফিক সাহেব ঠিক তাই। তার পকেটে সব সময় একটা কৃত্রিম সংকট লেগেই থাকে। বড় চাকুরে বলে তার কাছে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর আবদারও অনেক। কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তা, তার বেতনই বা কতো? সে কয়জনকে সাহায্য করবে? তাই অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হয়। মানুষকে এভাবে ফিরিয়ে দিতে তার অনেক কষ্ট লাগে। নিজে কষ্ট করে মানুষ হয়েছে তিনি ছাড়া অন্যর কষ্ট আর কে বুঝবে? তাই টাকা পয়সা কিংবা চাকরি বাকরি দিয়ে কারো উপকার করতে না পারলেও ভালোভাবে আপ্যায়ন করায় সব সময়। মানুষ বেঈমানি করলেও খাবার দাবার বেঈমানি করে না। তারা রোজ কেয়ামতের দিন ঠিকি সাক্ষ্য দিবে।
একটি জেলা শহরের কোনো একটা অধিদপ্তর কিংবা পরিদপ্তরের প্রধান কর্মকর্তা রফিক সাহেব। ঘন ঘন বদলীর কারণে পরিবার পরিজন ঢাকায় রেখে নিজে কর্মস্থলে থাকেন। ছেলে-মেয়ে দুজনই ঢাকার নামী-দামী দুই স্কুলের ছাত্র। তাদের পেছনে খরচ হয়ে যায় অনেক টাকা। ঢাকার রাস্তাঘাটে জ্যামের কারণে স্কুলে সন্তান আনা নেয়ার কাজে ভীষণ সমস্যা হচ্ছিল তার স্ত্রীর। একটা গাড়ি হলে সব কাজেই গতি আসবে, স্কুলে আসা যাওয়া, কোচিং, বাজার, বাপের বাড়ি সব জায়গায় সহজে যাওয়া যাবে। কিন্তু গাড়ি কিনতে গেলেইতো ইনকাম ট্যাক্সের লোকজন ঝামেলা করবে। অবশেষে শালার নামে একটা গাড়ি কিনলেন রফিক সাহেব।
গাড়িতে চড়ে বাসায় এসির বাতাসে ঘুমাতে না পারলে গাড়ি চড়ার স্বাদ পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায় না। তার বাচ্চার বন্ধুর মা প্রতিরাতে কত ডিগ্রী তাপমাত্রায় ঘুমিয়েছে তার গল্প করে রোজ। এই গল্প শুনতে রফিক সাহেবের স্ত্রীর কয়দিন ভালো লাগে! তার স্বামী এবার ঢাকায় আসলে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু স্বামী মাস খানেকের ভেতর ঢাকায় আসবে না। এদিকে গরমের পরিমাণ বাড়ছে। কয়েকদিন না যেতেই প্রতিটি শয়ন কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্র লেগে যায়। একজন সরকারি কর্মকর্তার সামর্থের একটি সীমা থাকে, খাবার কক্ষে ঠান্ডা যন্ত্র লাগাতে পারে নাই বলে স্ত্রীর কাছে ছোট হয়ে থাকতে হয়। গতবছর বউ মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিল কিন্তু তার গোনা বেতন তাই কোন রকমে নেপাল ঘুরে এসেছে। ঢাকার বাসায় গেলে ছেলেমেয়েরা পিতজা হার্ট কিংবা কেএফসির মুরগীর রান খেতে চায়। তাদের আবদারও রক্ষা করতে হয়।
নিজ গ্রামে এলাকার এ সৎ মানুষটি কারো জন্য তেমন কিছু করতে পারে না। এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মসজিদের টিনের চালটা ভেঙে ছাদ করে দিবে। কেয়ামত পর্যন্ত সদকায় জারিয়া হিসেবে এটা তার কবরে, তার বংশধরদের কবরে শান্তি বর্ষণ করবে। সততার জন্য আর বেশি কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। মসজিদের ছাদ পাকা হবে এতেই এলাকার মানুষ খুব খুশী। মসজিদের ইমাম মোনাজাত করে, আল্লায় যেন তাকে লক্ষ টাকার মালিক বানিয়ে দেয়। অংকে কাঁচা হুজুর প্রজাতি সব সময়ে মানুষকে বদদোয়া দেয়। যে রফিক সাহেব পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে মসজিদের ছাদ পাকা করে দিবে তাকে লাখ টাকার মালিক বাননোর জন্য দোয়া করা এক ধরনের অপমান। তার গাড়ির মুল্যইতো পচিশ লক্ষ টাকা। এদেশের ইমাম মুয়াজ্জিনরা কখন যে অংক শিখবে আল্লাই ভালো জানে। মসজিদ থেকে বেরুনোর মুহূর্তে ইমাম সাহেবকে পাঁচশত টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে তার মুরব্বিদের কবরে জিয়ারত করতে বলে রফিক সাহেব।
এদেশটা টিকে আছে রফিক সাহেবের মতো দুয়েকজন সত লোকের কারণে, এ কথা কতবার বলেছে নিযামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেব। নিযামিয়া মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং এ প্রায় তিন শত এতিম ছেলে খাওয়া দাওয়া করে। প্রতিদিন দুই মন চালের ভাত রান্না হয়। রফিক সাহেবের মতো লোক গোপনে দান খয়রাত করে এসব বাচ্চাদের জীবন রক্ষা করে। এর জন্য প্রচুর নেকি এবং দোয়া পান সবার। তিনি যে এখানে দান খয়রাত করেন এলাকার কাকপক্ষীও জানে না। এতিমের জন্য খরচ করলে আল্লাহ দেখবে কিন্তু কাকপক্ষীর জন্য খরচ করে সে তার সততা বজায় রাখতে পারবে না। তাকেও অনেকের মতো অসত হয়ে যেতে হবে। দ্বীনের সেবা করা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এবাদত। রফিক সাহেব দীন দুখী এতিম ছেলেদের দ্বীনি এলমে শিক্ষিত করছেন। এই কাজের নেক মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেব বলেছেন পুরো দশটা ওহোদ পাহাড়কে সোনা দিয়ে ঢেকে ওজন করলে যে রকম ভারী হবে তার সমান। রফিক সাহেব আগামীবার মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবকে নিয়ে ওহোদ পাহাড় দেখতে এবং হজ করতে মক্কা মনোয়ারায় যাবার খাস নিয়ত করেছেন। মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ ইতোমধ্যে তিনবার পরের টাকায় হজ করে চতুর্থ হজের নিয়ত করেছেন রফিক সাহেবের অনুরোধে। দ্বীনের কাজে সহায়তা করার ফযিলত অনেক এটা মাওলানা সাহেব জানেন। হজের টাকা পয়সা সব জমা দেওয়া হয়েছে একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে।
হঠাৎ রাষ্ট্রে কি এক গণ্ডগোল লাগলো। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়ন্ত্রন করেছে সেনাবাহিনী। সরকারি চাকুরেদের দফারফা অবস্থা। অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। সেনা সমর্থিত সরকার গঠন করা হয়েছে। তারা ঘোষণা করেছে সকল দুর্নীতিবাজদের শিক্ষা দেয়া হবে। ইতোমধ্যে অনেকে ত্রাণের টিনসন পুকুরে ডুব দিয়েও রক্ষা পায় নি। সেনাবাহিনীর লোকজন ভীমরুলের মতো দশ হাত পানির নীচ থেকে কামড়ে তুলে এনেছে। রাস্তাঘাটে বেওয়ারিশ কুকুরের মতো পড়ে থাকে ল্যান্ডক্রুজার, লেক্সাস, হামার গাড়ি। সেনাবাহিনী যাকে ধরছে তার হাড্ডি মাংস এক করে দিচ্ছে। সারা জীবন সততার সাথে চাকরি করে রফিক সাহেব শেষ পর্যন্ত আর্মির হাতে হাড্ডি মাংস হারাবেন এটা হতে পারে না।
মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবের সাথে কয়েকটা জ্বিন থাকে। তার এলমের গুণে রোকাম শহরের অনেক জ্বিন তার বয়াত হয়েছে। কয়েকদিন আগে আর্মির এক মেজর এসে মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবের খোঁজ খবর নিয়েছে। মেজর সাহেবের স্ত্রীর সন্তান-সন্ততি হয় না এই সমস্যা সমাধানের ভার পড়েছে মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবের উপর। ১৯৭১ সালের খান সেনাদের অনেক যত্ন-আত্তি করে, আবার আর্মির সেবা করার সুযোগ তার জন্য বিশাল আশীর্বাদ। রোকাম শহরের আঙ্গুরের রস আর জমজম কূপের পানি দিয়ে তিনি মেজর সাহবেবের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হওয়ার অব্যর্থ দাওয়াই দিলেন। মাওলানা সাহেবের রূহানী ক্ষমতায় মেজর সাহবের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হয়। তার মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। এ খবর জানাজানি হওয়ার পর এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তার এক আত্মিয়র জন্য দাওয়াই নিয়ে যান।
রফিক সাহেবের ব্যাংক হিসাব, তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব সবই অস্বাভাবিক। বাসায় নগদ টাকাও জমেছে বেশ। সততার পুরস্কার হিসেবে এই বয়সে আর্মির প্যাদানি খাওয়ার ভয়ে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গিয়েছে। মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবকে ফোন দেয় এই বিপদের দিনে। মাওলানা সাহেবকে জানায় অনেক লোকের উপর আর্মি জুলুম করছে তিনি ভয় পাচ্ছেন তার উপর কখন জুলুম নেমে আসে। ইতোমধ্যে বাসার শীতাতপ নিয়ন্ত্রন খুলে ফেলা হয়েছে, গাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে শালার বাড়িতে। তার স্ত্রী অনেক কষ্টে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়। মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেব তাকে আস্বস্ত করেন, আল্লার দুনিয়ায় যত মুশকিল তত আসান। আপনি কোন চিন্তা করবেন না আপনি আমার এতিম বাচ্চাদের জন্য এবার বেশি করে দান করুন আল্লাহ আপনাকে দেখবেন।
মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবের আশ্বাসে কিছুটা স্বস্তি আসে রফিক সাহেবের মনে। রফিক সাহেবের স্ত্রী স্বামীর এহেন বিপদে নফল নামাজ আদায় করছে এবং টানা রোজা রাখছে। রফিক সাহেব গাড়ির পেছনে একটা বস্তা উঠাতে বলে তার ড্রাইভারকে। তারপর নিজে ড্রাইভ করে চলে আসে নিযামিয়া মাদ্রাসায়। মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেব আগে থেকেই জানতেন। তিনি তার কয়েকজন খাদেমকে বস্তাটা উঠিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়। মাওলানা সাহেব, গুণে নিলে ভালো হতো না! মাওলানা সাহেব বলে দানের টাকা গুণতে নেই। আপনার উপর আমার আস্থা আছে।
মেজর সাহেবের গাড়ি আসে মাদ্রাসার সামনে। রফিক সাহেবের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। কখন যে মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবের পায়ের উপর পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন রফিক সাহেব নিজের অজান্তে টেরই পেলেন না। আরে সাহেব বুকে সাহস রাখুন। মেজর সাহেব আমার পরিচিত আপনার কোনো ভয় নেই, কেউ আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। রফিক সাহেবকে পরিচয় করে দেয়া হল মেজর সাহেবের সঙ্গে মাওলানা সাহেবের বহুত পেয়ারের লোক বলে। মাওলানা সাহেবের পেয়ারের লোক মানে মেজর সাহেবের পেয়ারের না। রফিক সাহেবের কুস্টি-ঠিকুজি সবই আছে মেজর সাহেবের কাছে। কিন্তু যেহেতু পরিচয় হয়ে গেছে এখন নিশ্চয়ই একটা সমাধানের পথ বেরুবে।
একজন সত লোক হিসেবে রফিক সাহেবের কর্ম জীবন শেষ হয়েছে। তার বাসায় আবার এসি ফেরত এসেছে। তার গাড়িও ফেরত এসেছে। আর্মিরা ব্যারাকে ফিরে গেছে। রফিক সাহেব অনেকদিন আর নিযামিয়া মাদ্রাসায় যায় না। মাওলানা আনোয়ার উল্লাহ সাহেবের ফোন আসলে কেটে দেয়। শেষ পর্যন্ত তার ওহোদ পাহাড় দেখা হয়েছে তবে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে নয় তার স্ত্রীর সঙ্গে। রফিক সাহেব এখন লম্বা জোব্বা পড়েন, মুখে দাড়িও রেখেছেন। তার স্ত্রীও হিজাব পড়ে চলাফেরা করেন। মাওলানা সাহেবের রূহানী ক্ষমতার উপকার নেয় এখন নতুন রফিক সাহেব।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।