ধনগুপ্ত ছিল এক ব্যবসাদারের ছেলে। বাপের অনেক সম্পত্তি সে পেয়েছিল। তাঁর ঝোঁক ছিল ভোগবিলাসের দিকে। কিন্তু ব্যবসা এমন একটা জিনিস যা করতে হলে ভোগবিলাসে গা ভাসানোর সময় তেমন থাকে না। ফলে ধনগুপ্তের কিছুদিনের মধ্যেই বিরক্ত জা্গল। সে ভাবল, অত কষ্ট করে ব্যবসা না করে জুয়ো খেলে টাকা রোজগার করবে। ধনগুপ্ত আস্তে আস্তে ব্যবসা ছেড়ে চুটিয়ে জুয়ো খেলা শুরু করল। খেলতে খেলতে সে যেমন মোটা টাকা হারত আবার তেমনি জিততও। কিছুদিন এইভাবে চলার পর একদিন হঠাৎ সে সমস্ত ধনসম্পত্তি খুইয়ে রাস্তার ভিখারী হল। এই ঘটনার ফলে ধনগুপ্তের মনে জীবনের প্রতি বিরক্তি জাগল। তার আর ইচ্ছা করল না সমাজে বাস করতে। সে হিংস্র জন্তুর কথা ভেবেও, জীবনের মায় ছেড়ে অরণ্যের দিকে পা বাড়াল।
কিছুকাল পরে তার চুল দাড়ি বেড়ে গেল, চুলে জট ধরল। তাকে তখন ঠিক একটা পাগলের মতো দেখাচ্ছিল। একদিন ধনগুপ্ত কাউকে কিছু না বলে একবস্ত্রে বাড়ীঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল। সে ভাবলঃ যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাবে। এইভাবে অত সম্পদ হারিয়ে, ঘর বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তার যে খারাপ লাগছিল না তা নয়, তবে বন্ধনহীন মুক্ত জীবনও কত আকর্ষনীয় নয়। এবং সেই আকর্ষনেই ধনগুপ্ত এত সহজে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে পারল। এইভাবে বহুদূর গিয়ে সে বিরাট অরণ্যের প্রান্তে এসে দাঁড়াল। অদূরে বহু অরণ্যবাসী ছিল। সে বছর ফসল না হওয়ায় ওরা দূরে দূরে গিয়ে শিকারে লাগল।
হঠাৎ ওদের নজর পড়ল ধনগুপ্তের ওপর। তার বিরাট বিরাট দাড়ি গোঁফ দেখে তারা অবাক হল। তারা আরও অবাক হল এই দেখে যে ধনগুপ্তের কাছে কোন অস্ত্র নেই। যে বনে এত বাঘ ভালুক সেখানে নিরস্ত্র মানুষকে দেখে ওদের অবাক হওয়ারই কথা। ওরা ভাবল এ মানুষ নয়, দেবতা নিশ্চয়। ওরা তার পায়ে পড়ে প্রণাম করল। তখন ওদের দিকে তাকিয়ে ধনগুপ্ত হাসি হাসি মুখে বলল,“কি চাও তোমরা?” “আপনি আমাদের আস্তানায় এলে আমাদের ভাগ্য খুলে যাবে।” ওরা বলল। কথা না বাড়িয়ে ধনগুপ্ত ওদের ডেরায় চলে গেল। ধনগুপ্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদিন বাদে মুষলধারে বৃষ্টি হল। অরণ্যবাসীরা ভাবল, এটা ধনগুপ্তের মাহাত্মের ফলে হয়েছে। ভাল বৃষ্টি হওয়ায় সে বছর এলাকায় ভাল ফসল হয়েছিল। তার ফলে অরণ্যবাসীদের ঘরে ঘরে আনন্দ দেখা দিল। সে দেশের রাজার সঙ্গে অরণ্যবাসীদের বিবাদ ছিল। ওদের সবসময় রাজা দাবিয়ে রাখতেন। রাজার কানে গেল যে অরণ্যবাসীদের অবস্থা ভাল হচ্ছে। তিনি তাদের দাবিয়ে রাখার জন্যে বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালেন।
এদিকে অরণ্যবাসীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তারা যেহেতু একজন মহাপুরুষকে তাদের কাছে পেয়ে গেছে সেহেতু তারা হেরে যেতে পারে না। তাই আত্মবিশ্বাসের সাথে যুদ্ধ করে রাজার সেনাবাহিনীকে তারা হঠিয়ে দিল। রাজার সেনাবাহিনী হেরে যাওয়ায় রাজা খুব অবাক হলেন। তিনি কারণ জানতে গুপ্তচর পাঠালেন। গুপ্তচর ফিরে এসে মহাপুরুষের আগমনের কথা জানাল। শুনে রাজারও বিশ্বাস হল যে নিশ্চয় কোন মহাশক্তি অরণ্যবাসীকে সাহায্য করছে। তাই তিনি ভাবলেন, অরণ্যবাসীকে জব্দ করার আগে ঐ মহাপুুরুষকে লাভ করা তাঁর পক্ষে উচিত হবে। রাজা গোপনে ধনগুপ্তের সঙ্গে যোগযোগ করে তাকে তাঁর রাজ্যে আসার আহ্বান জানালেন। ধনগুপ্ত ভাল যে ঐ অরণ্যে থাকার চেয়ে রাজার অধীনে থাকলে তার অনেক উন্নতি হবে।
তাই সে অরণ্যবাসীদের না জানিয়ে সোজা রাজার কাছে গেল। রাজা সাদরে তাকে গুহণ করে তার নাম জানতে চাইলেন। জবাবে ধনগুপ্ত বলল, “আমার নাম অনুভবানন্দস্বামী।” ধনগুপ্তের এই রাজার কাছে আসার দু-একদিনের মধ্যেই তাঁর একটি কঠিন রোগ সেরে গেল। রাজা যথারীতি রোগ মুক্তির জন্য বৈদ্যদের প্রশংসা করলেও মনে মনে তিনি বুঝিয়েছেন যে এ নিশ্চয় এই মহাপুরুষ অনুভবানন্দের মহিমা। রাজা তাঁর অনুভবানন্দের জন্য একটি বাড়ি তৈরী করলেন। দেখতে দেখতে রাজার কাছাকাছি যারা থাকে তারাও অনুভবানন্দের ভক্ত হয়ে গেল। ধনগুপ্ত অবস্থা বুঝে দুচারটি করে কথা বলত। রাজধানীর মত ধনবহুল স্থানে অনুভবানন্দ হয়ে থাকা যে কত কষ্টকর তা সে কিছুদিনের মধ্যেই হাড়ে হাড়ে টের পেল। কিছুদিন পরে ঐ রাজার সঙ্গে ধনগুপ্তের দেশের রাজার বিরোধ বাধল। রাজা যুদ্ধে যাওয়ার আগে ধনগুপ্তের কাছে এসে আশীর্বাদ প্রার্থনা করল।
ধনগুপ্ত বাধ্য হয়ে বলল, “বিজয়োস্তু।” এইভাবে নিজের দেশের পরাজয় কামনা করে মনে মনে দগ্ধ হল। কিন্তু তখন এ ছাড়া আর তার করার কিছু ছিল না। রাজা যুদ্ধে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলেন। ফেরার পথেই রাজা ঠিক করলেনঃ এবার অনুভবানন্দস্বামীর আশ্রম বড় করব। আরও ঘটা করে তার পূজো দেব। কিন্তু ফিরে এসে রাজা আর অনুভবানন্দস্বামীর দর্শন পেলেন না। তারপর আর কেউ কোনদিন এই অনুভবানন্দকে দেখেনি। বেতাল এই কাহিনী শুনিয়ে বলল, “রাজা, অরণ্যবাসীর নজরে পড়ার পর ধনগুপ্তের মনে পরিবর্তন নজরে পড়ার পর ধনগুপ্তের পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল।
জীবনের প্রতি তার যে বিরক্ত জেগেছিল সেটাও লোপ পেয়েছিল। কিন্তু আবার সে সংসারে ঝামেলায় কেন গেল? নিজের দেশকে যে রাজা পরাজিত করেছে তার কাছেও থেকে সে কি প্রশংসা চায়নি? আমার এই প্রশ্নের জবাব জানা সত্ত্বেও যদি তুমি না দাও তাহলে জেনে রাখ তোমার মাথা এক্ষুণি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।” রাজা বিক্রমাদিত্য জবাবে বললেন, “ধনগুপ্ত জানত নিজের দেশ ও নিজের দেশের রাজাকে। সে বুঝেছিল যে তার দেশ হেরে যাবে। তার নিজের যে তেমন কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই, তাও সে জানত। অত ক্ষমতা তার থাকলে সে জুয়ো খেলায় ধনসম্পত্তি হারাত না।
তবু তার নিজের দেশের পরাজয়ের জন্য রাজাকে সে আশীর্বাদ করল। এতে সে মনে মনে খুবই দুঃখ পেল। আর তাছাড়া একটি ভয় ছিল তার সবসময়। তা হল তার যে তেমন কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই তা যে কোন মুহূর্তে লোকের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। এই ভয়ে এবং ঐ দুঃখে সে রাজধানীর সুথ ছেড়ে একদিন বনপথে হারিয়ে গেল। রাজা বিক্রমাদিত্য এইভাবে মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেতাল শব নিয়ে ফিরে গেল সেই গাছে।