অদ্ভূত

এত সকালে মোল্লা বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে যাবে, তা কে জানতো! গফুর মোল্লার অস্থিরতায় আরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে। পাড়ার কোনো বাড়িতে এখন মানুষ নেই, সব মানুষ যেনো জড়ো হয়েছে মোল্লা বাড়ির দক্ষিণ ঘরটার উঠানে। মাঝখানে চেয়ারে বসে আছে গফুর মোল্লার ছোট ছেলে। পাশে লেকবার কবিরাজ। লেকবার কবিরাজ অত্র এলাকার অতি পরিচিত একটি মুখ। চোয়াল ভাঙ্গা দীর্ঘকায় মানুষটিকে দেখে মনে হয় কতদিন যে ঠিকমতো খান না! কিন্তু কবিরাজ সাহেব তা মানতে নারাজ। তিনি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন! লেকবার কবিরাজের দৈনন্দিন রুটিন আজ মানা হয়নি। কর্মচঞ্চল দিনের একটা পরিকল্পনা কবিরাজ সাহেব মেনে চলেন সবসময়। সকাল দশটার আগে বাড়ি থেকে বের হন না। কারোর যদি বিশেষ কোনো প্রয়োজন হয়, তবে সে নিজে কবিরাজ সাহেবের বাড়িতে আসেন। পঞ্জিকার দিনক্ষণ মেনেই সবকিছু করে থাকেন তিনি। আজ সূর্য না উঠতেই হাজির মোল্লা বাড়িতে। মোল্লা বাড়ির বড়জন গফুর মোল্লার বড় ভাই রহিম মোল্লা যখন বাড়ির কাজের ছেলেটাকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন, তখন লেকবার কবিরাজ কি না এসে পারেন? তাই তো তার আসা।
লেকবার কবিরাজ তার পকেট থেকে ডায়েরীটা বের করলেন, তখনও গফুর মোল্লার ছোট ছেলের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। এ দিয়ে কয়েক বালতি পানি ছোট ছেলেটার মাথায় ঢালা হয়েছে। গফুর মোল্লার ছোট ছেলে আশিক ও স্থির চেয়ারে বসে আছে। ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আশিকের মা। নীরবে আশিকের মায়ের অশ্রু ফোটা গড়িয়ে গড়িয়ে আশিকের গায়ে পড়ছে। ওদিকে কাছেই অন্য একটি চেয়ারে বসে আছেন লেকবার কবিরাজ। ডায়েরীর পাতা ঘেটে ঘেটে কী যেনো বের করলেন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখলেন। তারপর বিড়বিড় করে কী যেনো বলে বার কয়েক আশিকের গায়ে ফুঁ দিলেন। ‘কি নাম বাবা তোমার?’ আশিকের দিকে চোখ টেনে কবিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। আশিক উত্তর না দিয়ে মাথা উঁচু করে মায়ের দিকে তাকালো। মা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘বলো বাবা তোমার নাম! তোমার কাকু জানতে চাইছেন।’
মায়ের দিকে তাকানোর অর্থটা বোধহয় আশিকের মা বুঝতে পারলেন না। আশিক বোঝাতে চাইলো তার লেকবার কাকু তো ভালো করেই তার নাম জানেন, তবে কেনো তিনি আবার জানতে চাইলেন। আশিকের নীরব থাকা দেখে পাশ থেকে আশিকের ছোটো ফুফুও বলে উঠলেন, ‘কিরে নাম বল্!’ কিছুটা বাধ্য হয়েই আশিক তার নামটা বললো। কবিরাজ সাহেব মাথা উঁচু-নিচু করে আবারও ডায়েরীর পাতা ঘাটতে লাগলেন।
বাড়ির কাজের ছেলেটাকে দিয়ে একটা সাদা কাগজ আনা হলো। লেকবার কবিরাজ সাদা কাগজে কি সব অপরিচিত অক্ষর দিয়ে ভরে ফেললেন। কাগজটা ভাঁজ করে আশিকের হাতে দিলেন। তার আগে জানতে চাইলেন, ছেলেকে লবণ-পানি খাওয়ানো হয়েছে কিনা। পাশ থেকে গফুর মোল্লা বললেন, ‘হ্যাঁ, এক গ্লাস খাওয়ানো হয়েছে।’ আরও এক গ্লাস লবণ-পানি খাওয়াতে বললেন, কবিরাজ সাহেব। যদিও লবণ-পানি খেতে আশিকের একটু কষ্ট হচ্ছে, তবু তার ভালোর জন্য না খেয়ে উপায় নেই।
সাদা কাগজ হাতে পেয়ে আশিককে কিছুটা ভীতু মনে হলো। তার শরীর কাঁপছে বোঝা গেলো। লেকবার কবিরাজের সাথে সাথে আশিকের মা-ও বলে উঠলেন, ‘ভয় নেই বাবা!’ ভালো করে কাগজের দিকে তাকাতে বললেন, আশিকের কবিরাজ কাকু। ‘বাবা দেখোতো কিছু দেখা যায় কি না!’ কবিরাজ কাকুর কথা মতো ভালো করে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকলো আশিক। কিছুতো দেখা যায় না!
এই মুহূর্তে আশিকের একটি কথা খুব মনে পড়ছে। গত সপ্তায় আশিকদের পাড়ার ফরমানের বড় মেয়ের গায়ে ভূত লেগেছিলো। তাকে যখন এই কবিরাজ সাহেব এরকম একটি সাদা কাগজ দিয়েছিলেন, তখন ফরমানের মেয়ে জরিনা ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলো। বারবার বলতে ছিলো, ‘ওমা, মা গো, ওই দেখো কাগজের ভিতর দু’জন ছেলে বড় বড় হাত বের করে হাসছে আর ভেংচি কাটছে।’ এই বলতে বলতে জরিনা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।
আশিকের কবিরাজ কাকুই শেষ পর্যন্ত জরিনার ঘাড় থেকে ভূত তাড়িয়ে ছিলেন। সেদিন সবার উদ্দেশে লেকবার কবিরাজ বলেছিলেন, ‘কেউ যদি এ রকম কোনো কিছু দেখে থাকে বা কাউকে যদি আচর করে তবে আমার এই সাদা কাগজে সে সেই ভূত পেত্নীকে দেখতে পাবে।’
কথাটা মনে পড়াতে আশিক কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো। ওদিকে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আশিকের দিকে তাকিয়ে আছে। লেকবার কবিরাজ আবারও জোর দিয়ে বললেন, ‘কি বাবা আশিক কিছু দেখা যাচ্ছে? কেউ কি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে?’ লেকবার কবিরাজের কথা শুনে অনেকের গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠলো। আশিক চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাসের সাথে বললো, ‘নাহ্।’ সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। আশিকের মা আবারো বললেন, ‘ভালো করে দেখে বলো বাবা!’ ‘না, মা আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’ -মায়ের দিকে তাকিয়ে আশিক বললো। এবার পাড়ার অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো, কবিরাজ সাহেব তবে কি ঠিকমতো চিকিৎসা করতে পারলেন না। সাদা কাগজে যদি কিছু না-ই দেখা যায়, তবে গফুর মোল্লার ছোট ছেলে কাঁদতে কাঁদতে যা বল্লো…… সে কথার কি হবে?
আজ সকালে, তখন কেবল ভোর গড়িয়েছে। সূর্য ওঠেনি। রান্নার তেল নেই বাড়িতে। সকালে রান্নার অল্প পরিমাণ তেল কেনার জন্য আশিকের মা আশিকের হাতে একশ’ টাকা দিয়ে বললেন, ‘এই নাও টাকা, এক পোয়া তেল কিনে আনো। আর বাকী টাকা ফেরৎ নিয়ে আসবা।’ সাত বছর বয়সী আশিক তেলের বোতল আর টাকার নোটটা নিয়ে দোকানের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হলো। কিছুক্ষণ পর সে বাড়িতে হাজির। হাতে তেলের বোতল কিংবা টাকা কিছুই নেই। আশিকের মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি আশিক তেল কই?’ আশিক কিছু না বলে কেঁদে ফেললো। কান্না তার থামে না কিছুতেই। আশিকের বাবা ছুঁটে আসলেন ঘর থেকে। ছুটে আসলেন আশিকের বড় চাচাও। এক এক করে পাড়ার সব মানুষ জড়ো হয়ে গেলো আশিকদের বাড়িতে। উপস্থিত সবাই জানতে পারলো। আশিক যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে দোকানে যাচ্ছিলো, পথিমধ্যে বটগাছের নিচে থমকে দাঁড়ায়। কালিওলা নামক জায়গায় একটা বিরাট বড় বটগাছ আছে। বট গাছের পাশে একটা মন্দির। কালিপূঁজার মন্দির। খুব সকালে আর ঠিক দুপুরে গ্রামের রাস্তায় যখন কেউ না থাকে, তখন বটগাছের নিচ দিয়ে যাওয়া সত্যিই খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার। গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। বুকের মধ্যে ধপ করে ওঠে। মনে হয় সাথে সাথে পেছনে কে যেনো আসছে। পেছনে তাকালে কাউকে দেখা যায় না। ঐ বটগাছটা পেরুলেই বেশ কিছু দোকান। বটগাছের কাছে পৌঁছতেই আশিক দেখতে পায়, বটগাছ থেকে সাদা কাপড় পরা একজন নেমে আসছে। কাপড়পরা লোকটার নিচের অঙ্গগুলো নেই। শুধু মাথা আর সাদা কাপড় দেখা যাচ্ছে। এই দেখে আশিক ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। পরে সাদা কাপড় পরা লোকটা আশিককে বলে, ‘তোর কাছে একশ’ টাকা আছে, ওই টাকাটা দে।’ আশিক ভয়ে টাকাটা দিয়ে দেয়। তারপর আশিক দেখে লোকটা হঠাৎ তার সামনে থেকে হারিয়ে যায়। এরপর হাঁপাতে হাঁপাতে আশিক দৌড়ে বাড়ি চলে আসে। আশিকের মুখে এ কথাগুলো শুনে সবই থ হয়ে যায়। কেউ বা বলতে থাকে, আল্লাহ্র রহমত- ছেলেটা ভালোভাবে বেঁচে এসেছে। নইলে ওর যদি কিছু একটা হয়ে যেতো, তবে আশিকের মা কি করতেন? আশিকের কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কথাগুলো শুনেই আশিকের মায়ের মতো বাবাও খুব বেশি অস্থির হয়ে পড়েন। বড় ভাইকে ডাক দিতেই রহিম মোল্লা দ্রুত লেকবার কবিরাজকে ডেকে পাঠান। এরপর থেকে শুরু হয় কবিরাজ সাহেবের তদবির।
লেকবার কবিরাজের দেয়া সাদা কাগজে আশিক কিছু দেখতে না পেলেও আশিকের সুরক্ষার জন্য পরবর্তী ব্যবস্থাগুলো অতিযত্নে সম্পন্ন করলেন কবিরাজ সাহেব। নতুন মাদুলী কিনে তার মধ্যে সেই সাদা কাগজটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে দিলেন। একুশ টাকার বিনিময়ে পাওয়া তাবিজটা আশিকের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। কবিরাজ সাহেব সতর্কতার দৃষ্টিতে আশিকের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একুশ দিন তাবিজটা গলায় বাঁধা থাকবে।’ এই একুশ দিনের মধ্যে আশিকের জন্য কিছু বিধি-নিষেধও বেঁধে দেয়া হলো। গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, হাঁসের ডিম, অাঁইশ জাতীয় কোনো মাছ। যেমন- ইলিশ, সাথে গজার মাছ খেতে পারবে না। এবং বিশেষভাবে বলা হলো, এই একুশ দিনের মধ্যে কোনো মরা বাড়ি যাওয়া যাবে না। ছেলের ভালোর জন্য যেকোনো মা কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আশিকের মা’র ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না।
একুশ দিন পর। আশিক, আশিকের বড় ভাই আকাশ আর আশিকের মা সকালের নাশতা সেরে বসে গল্প করছে। হঠাৎ আশিক মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, ‘মা একটা কথা বলবো যদি রাগ না করো।’ আশিকের ভালো করেই জানা, তার মা রেগে যাওয়া মানেই তাদের পিঠে মার। সন্তানদের যেমন ভালোবাসেন, তেমনি শাসন করতেও কোনো ছাড় নেই আশিকের মা’র। মা অভয় দিলে আশিক যা বললো, তাতে রীতিমতো তার মা বিস্মিত হলেন। বল্লেন, ‘বলিস কি?’ ‘হ্যা মা, সেদিন তোমার কাছে মা’র খাওয়ার ভয়ে মিথ্যে বলেছিলাম। সেদিন কেউ আমার কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেয়নি। রাস্তার মাঝে টাকা হারিয়ে ফেলেছিলাম। টাকা হারানোর কথা বললে তুমি যদি…..।’
আশিকের মা কথাগুলো শুনে একদিকে যেমন বিস্মিত হলেন, তেমনি খুব বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে গেলেন। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বল্লেন, ‘পাগল ছেলে, তুই আমাকে এত ভয় করিস!’

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!