প্রাণের মহেশ
তুমি আর এখন আসিতেছ না কেন? বিধুবাবুর সহিত ঝগড়া করিয়া আমায় পরিত্যাগ করা কি তোমার উচিত? আজ যা হয়, একটা হইয়া যাইবে। বিধুবাবু বাড়াবাড়ি করিলে, তাহলে আমার কাছে আসিতে বারণ করিব। আমার কুন্তলীন একেবারে ফুরাইয়া গিয়াছে। দেলখোস নামে নাকি এক প্রকার নূতন এসেন্স বাহির হইয়াছে, দেখিতে পাই কি? ঝিকে পাঠাইলাম, তুমি আজ অবশ্য আসিবে, অন্যথা না হয়। ইতি
তোমারই ভালোবাসার নলি—|
পত্রখানা দুইবার পড়িয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। পত্রের তারিখ দেখিয়া অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পাইল। এ পত্রে ঝির সন্ধান পাইলাম। বিধুবাবু নামে এক ব্যক্তির সহিত মহেশের মনোমালিন্য ছিল, পত্র পড়িয়া বুঝিতে পরিলাম। এক্ষণে যেন অনুসন্ধানের কিছু সূত্র বাহির হইল, মনে করিলাম। আমি আর বিলম্ব না করিয়া ধড়াচূড়া ছাড়িয়া একটি ফিট্ বাঙালীবাবু সাজিলাম। তাহার পর চিঠিখানা পকেটে পুরিয়া, আমার প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত গাড়োয়ানকে সেখানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া পদব্রজে রাস্তায় বাহির হইলাম।
হাড়কাটা গলির সেই বাড়িটা খুঁজিয়া বাহির করিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না। আমি একেবারে সপাসপ উপরে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। তখন অপরাহ্ন পাঁচটা – সন্ধ্যার প্রাক্কাল। গৃহকর্ত্রী বেশভূষা পরিপাটী করিতেছে। আমি চিরপরিচিতের ন্যায় একখানা কেদারা টানিয়া বসিয়া পড়িলাম। যুবতী তখন আমার অভ্যনার্থে তাড়াতাড়ি আপন কার্য সমাধা করিয়া ঝিকে তামাক আনিবার নিমিত্ত আদেশ করিল।
আমি ইত্যব্সরে আপন মনে অনুচ্চস্বরে বলিতে লাগিলাম, ‘বিধুবাবুর এখানে আসিবার কথা ছিল। কই তিনি যে আসিলেন না।’
যুবতী উত্তরচ্ছলে বলিল, ‘কই সে ত আজ কয়দিন আসিতেছে না। সেই যে সে দিন মহেশের সঙ্গে মারা মা—‘ এ পর্যন্ত বলিয়া যুবতী আমার মুখের দিতে চাহিল। আমি যেন নিতান্ত অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর করিলাম, ‘তা কাজটা কি ভালো হয়েছিল? আমি সমস্তই শুনিতে পাইয়াছি। বিধু আমার পরম বন্ধু।’
যুবতী: কৈ আপনাকে ত একদিনও এখানে দেখি নাই।
আমি: এতদিন আসিবার প্রয়োজন পড়ে নাই, তাই আসি নাই। কিন্তু সেদিনকার ঘটনার পর বিধু প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, সে কখনও এখানে একাকী আসিবে না।
যুবতী: তা মহাশয়, আমার দোষ কি বলুন? বাস্তবিক, সেদিন মহেশের কাজটা ভারি অন্যায় রকমের হয়েছিল। ভ্দ্রলোকের গায়ে হাত তোলা, জুতো মারা, এগুলি নেহাত ছোট লোকের কর্ম।
এই বলিয়া যুবতী স্বহস্তে প্রস্তুত পানের খিলি দুটি আমায় প্রদান করিল। আমি সমস্ত ব্যাপার ইতিমধ্যে বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। এক্ষণে আমার মনে হইতে লাগিল, এ জুতোমারা কাণ্ডের প্রতিশোধ লইতে বিধুবাবু নামক ব্যক্তির পক্ষে মানসিক উত্তেজনা-প্রাবল্যে মহেশের জীবনলীলা সাঙ্গ করা একেবারে অসম্ভব নহে। ইহা ২৬শে আশ্বিনেরই ঘটনা। যাহা হউক, অধুনা আমার পক্ষে এই বিধুবাবুর অনুসন্ধান লওয়া বিশেষ প্রয়োজনীয় হইয়া পড়িল; কিন্তু এখানে আমি বিধুবাবুর বন্ধু বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছি, সুতরাং সোজাসোজি ইহাকে সে কথা জিজ্ঞাসা না করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিলাম। ইতি,মধ্যে, ঝি-মূর্তি, একটি রূপার হুকা হাতে করিয়া সেই কক্ষে প্রবিষ্ট হইল। এবং আমাকে দেখিয়া বলিল, –
‘এটি যে নূতন বাবু!’
যুবতী তদুত্তরে বলিল, ‘ইনি বিধুবাবুর বন্ধু।’
ঝি: কোন বিধুভূষণ?
যুবতী: অঁযা – নেকি? মুখুয্যে – সেই ২১ নম্বর কলুটোলার।
এতক্ষণে সহজেই আমার কার্য সিদ্ধি হইয়াছে; – আমি ঘটনাক্রমে বিধুর ঠিকানা অবগত হইলাম। সুতরাং আর সেখানে অপেক্ষা করার দরকার নাই ভাবিয়া, ঝির কথার উত্তরচ্ছলে অন্যমনস্ক ভাবে বলিলাম, ‘ বিধুবাবুর ত এখনই এখানে আসিবার কথা ছিল, দেরি হইতেছে কেন, বুঝিতে পারিতেছি না। তা, আমি একটু দেখিয়া আসিতেছি।’
এই বলিয়া আমি ‘২১ নং কলুটোলা ‘ ঠিকানাটি মনে রাখিয়া সে বাড়ি হইতে বহিষ্কৃত হইলাম। এবং অবিলম্বে মুচিপাড়া থানায় আসিয়া পঁহুছিলাম।
তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। আমি আসিয়া দেখি সুশীলবাবু আমার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছেন। আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে তাঁহাকে সমস্ত ঘটনা বুঝাইয়া বলিলে, তখনই বিধুর সম্বন্ধে তদন্ত করা উচিত বলিয়া পরামর্শে স্থির হইল। দুই জন পুলিশ কনেস্টবল, পুলিশ পোষাক পরিহিত সুশীলবাবু এবং বাঙালীবাবু আমি – শকটারোহনে অগৌণে কলুটোলায় যাইয়া উপস্থিত হইলাম । বলিয়া রাখা ভাল, হত্যাগৃহে প্রাপ্ত কাটারি এবং নাগরা জুতা আমাদিগের সঙ্গে লইয়াছিলাম।
তাহাদিগকে গাড়িতে পথের উপরে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমি একাকী সেই ২১ নং বাড়িতে প্রবেশ করিলাম। এটি একট ছোটখাটো ডিস্পেন্সারী। অনুসন্ধানে জানিলাম সুধীরবাবু নামক জনৈক ভদ্রলোক ডিস্পেন্সারীর স্বত্বাধিকারী। তিনি সপরিবারে ইহারই উপরতলে বাস করেন, নীচের ঘরে ডাক্তারখানা। আরো জানিলাম, সত্য সত্যই বিধুভূষণ নামে উক্ত সুধীরবাবুর এক ভাইপো এ বাড়িতে বাস করেন। তিনি এক্ষণে বেকার অবস্থায়ই আছেন।
আমি যে সময় সেখানে উপস্থিত হইয়াছিলাম, সে সময় ডাক্তারবাবু বাসায় ছিলেন না। সুতরাং ডাক্তারখানার কম্পাউণ্ডারকে বিধুবাবুকে সংবাদ দিতে বলিযা নীরবে সেখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
কম্পাউণ্ডার উপরে চলিয়া গেল, এবং অল্প সময়ের মধ্যে আরক্ত-নয়ন, বিষাদ-বদন, রুক্ষ কেশ এক যুবক সম্ভিব্যাহারে সে কক্ষে প্রবিষ্ট হইল। যুবকের মুখাকৃতি ও ভাবগতি সন্দর্শনে আমার দারুণ সন্দেহ একেবারে বিশ্বাসে পরিণত হইল।
আমি একটু ত্রস্ততার সহিত অথচ মৃদুস্বরে যুবককে বলিলাম, ‘আমি হাড়কাটা গলি হইতে আসিয়াছি। পথে গাড়িতে ‘নলি ‘ অপেক্ষা করিতেছে, আপনি একটু বাহির হইতে পারেন?’
যুবক সংক্ষেপে উত্তর করিল, ‘আমি আজ বড় অসুস্থ।’
আমি তখন ব্য্গ্রভাবে বলিলাম, তবে আপনি একটু এখানেই অপ্ক্ষা করুন, আমি তাহার নিকট হইতে আসিতেছি।’ এই বলিয়া ত্বরিতপদে রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম, এবং কয়েক মুহূর্তের পর দলবল সহ সুশীলকে সে বাড়িতে উপস্থিত হইতে উপদেশ দিয়া , পুনরায় ডাক্তারখানায় প্রবেশ করিলাম। এবারে তাড়াতাড়ি আসিয়াই আমি দৃঢ় মুষ্টিতে বিধুর দক্ষিণ হস্ত ধারণ করিয়া, বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে সেই নাগরা জুতাখানি বাহির করিয়া বলিলাম, ‘দেখ দেখি বিধু, তুমি এ জুতা সেদিন রাত্রিকালে মহেশের হত্যাগৃহে ফেলিয়া আসিয়াছিলে কিনা।’
আমার কথা শুনিয়া ও ভাবভঙ্গি দেখিয়া বিধু ফ্যাল্ফ্যাল্ করিয়া আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল এবং স্বীয় হস্ত ছাড়াইবার চেষ্টা পাইল। তখন আমি আমার মুষ্টি দৃঢ়তর করিয়া বলিলাম, ‘সে চেষ্টা বৃথা; তুমি মহেশের হত্যাকারী, তোমাকে আমি গ্রেপ্তার করিলাম।’
ইত্যবসরে কনেস্টবল সহ সুশীলবাবু সে গৃহে প্রবেশ করিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, আসামী গ্রেপ্তার হইয়াছে, এক্ষণে থানায় চলুন।’
বিধু এ সকল দেখিয় শুনিয়া একেবারে দমিয়া গেল। আমি তাহাকে লক্ষ্য করিয়া পুনর্বার বলিতে লাগিলাম, দেখ বিধু, আমি সমস্তই জানিতে পারিয়াছি, তুমি হাড়কাটা গলিতে ‘নলি’র বাড়িতে মহেশ কর্তৃক প্রহৃত ও অবমানিত হইয়া প্রতিশোধ লইবার মানসে, উত্তেজনাবশে, সেদিনই মহেশকে খুন করিযাছ। এ বিষয়ের সমস্ত প্রমাণাদি আমি সংগ্রহ করিযাছি, এক্ষণে চল, তোমাকে হাজতে লইয়া যাইব।’
আমি এতটুকু বলিয়া দেখিলাম, বিধু আমার সমস্ত কথা শুনিতেছে কিনা সন্দেহ। কারণ, ক্রমে ক্রমে তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইতে আরম্ভ করিল।
তদনন্তর আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, বিধু, তুমি এক্ষণে কি বলিতে বা করিতে চাও?’
সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে উত্তর করিল, ‘মহাশয়, আমার কিছু বলিবার বা করিবার নাই। পাপ গোপনে থাকে না। পাপের ফল অবশ্যই ভুগিতে হইবে; চলুন, আমি কোথায় যাইব।’
আমি বলিলাম, ‘তুমি হত্যাপরাধ স্বীকার করিতেছ?’
সে উত্তর করিল, ‘আর মিথ্যে বলিব না; আমি হত্যা করিয়াছি।’
আমরা সেখানে বসিয়াই কতিপয় ভদ্রলোকের সমক্ষে বিধুর স্বীকারোক্তি এবং তত্কর্তৃক বর্ণিত হত্যার আমূল বিবরণ লিপিবদ্ধ করিলাম।
অবমানিত হইয়া, উত্তেজনাবশে সে এই ভীষণ কার্যে ব্রতী হইয়াছিল; মহেশ যাহাতে চিত্কার করিতে না পারে, ত্জ্জন্যে যে পূর্বাহ্নেই ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করিয়াছিল; অনুসন্ধানকারীদের বিপথে চালিত করিবার জন্য স্বেচ্ছাপূর্বক নাগরা জুতা রখিয়া আসিয়াছিল, একে একে এ সমস্তই বিধু স্বীকার করিল। এইরূপে বিধুর জবানবন্দী সমাপ্ত হইলে আমরা তাহাকে থানায় লইয়া চলিলাম।
বল বাহুল্য, এই অদ্ভুত-হত্যার মোকোদ্দমা দায়রা সোপার্দ হইল, এবং দায়রায়, জজ সাহেব ও জুরির বিচারে, বিধুভূষণের চিরনির্বাসন দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত হইল।