ইউরোপের একটা মসলিম দেশ তুরস্ক।তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের।বখতিয়ার খলজি ১২০৪ সনে বাংলাদেশে এসে রাজত্ব করে গিয়েছেন।সেই তুরস্কের লোককাহিনীর চরিত্রগুলো এখনো ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে বিশ্বে পরিচিত হয়ে আছে।এখানকার গল্পটি খলিফা হারুঅর রশিদের আমলের ঘটনা।খলিফা হারু অর রশিদ ইতিহাসে খুব বিখ্যাত ছিলেন।সে সময় রাজা বাদশাদের বলা হত খলিফা ।
হারুন অর রশিদের এক চমৎকার খেয়াল ছিল।তিনি মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতেন তার নিজের রাজ্যে।কেউ তাকে চিনতে পারত না।অথচ তিনি প্রজাদের অবস্থা নিজের চোখে দেখতেন।বুঝতে পারতেন কি অহাব, কি অভিযোগ,কে কষ্ট পাছে আর কে অত্যচার করছে।এই সব ঘুরে ঘুরে দেখে তিনি দরবারে বিচার করতেন।ফলে রাজ্যের লোকেরা পেত ন্যায় বিচার।একদিন খলিফা হারু অর রসীদ বেরিয়েছেন ছদ্দবেশে।ঘুরছেন বাগদাত শহরের পথে পথে।সঙ্গে আছেন উজির।কিন্তু তাকে দেখে এখন উজির চেনার উপায় নেই।খানিক্ষণ বেড়ানোর পর তাইগ্রিস নদীর পাথরের সাকো পার হলেন তারা। তারপর দেখলেন,পথের পাশে বসে এক লোক ভিক্ষা করছেন।খলিফা তার কাছে গেলেন আর বুঝতে পারলেন যে সে অন্ধ।দেখে খলিফার মনে খুব দয়া হল।তিনি তার হাতে দিলেন একটি মোহর।
অমনি অন্ধ লোকটি তার হাত ধরে বললেন,আপনার অশেষ করুণা!আল্লাহ আপনাকে খুসি করুক।কিন্তু দয়া করে আমায় যখন দান করলেন,তাহলে আর একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে।
খলিফা ভাবলেন,বুড়ো বেচারি বোধহয় বুঝতে পারি নি তাকে মোহর দেয়া হয়েছ।অন্ধ মানুষ তো!কিন্তু তিনি মোহর দেবার কথা না জানিয়ে বললেন,তা,বেশ কি তোমার অনুরোধ,বলো।তখন বুড়ো বলল,আমার গালে একটি চড় মারতে হবে।আমার গালে চড় মারলে আমি দান নেইনা।যিনি আমাকে মারেন না আমি তার কাছথেকে কিছু নিই না।তাই বলছি দান যখন করেছেন,তখন অন্তত একবার আমার গালে চড় কষিয়ে যান।
খলিফা তার কথাশুনে যেমন অবাক হলেন।তেমনি কৌতূহলী হলেন।এত ভারি মজর ব্যাপার।লোকটা নিজেকে মার খাওয়াতে চান কেন?
এমন অদ্ভুত কথা কখনো শোনা যায়?কেউ তাকে চড়ালে তার দান নিবে।অনুরোধ রক্ষা করতে প্রথমে হারুন অর রসীদ রাজি হলেন না।
বললেন না হে, তোমাকে আমি শুধু মারতে পারব না।বিনা দোশে তোমাকে চড় মারলে আমার অন্যায় হবে।তোমাকে দান করে যে পূর্ণ করব তা অকারণে নষ্ট হবে।
শুনে অন্ধ ভিকারি বলল,আমাকে মারলে ঠিক কাজই করা হবে।কারণ আমি জিবনে অনেক পাপ করেছি।আর সেই সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি।সকলের হাতে চড় খেয়ে।আল্লাহর কাছে শপথ করেছিলাম কারোর কাছে চড় না খেয়ে ভিক্ষা নেব না।এখন আপনার যা খুশি তাই করুন।জদি আমার চড় না মারেন,আপনার এই দান ফিরিয়ে নিন।কারণ আল্লাহর নামে যে শপথ করেছি তা প্রান থাকতে তা অন্যথ করব না।
খলিফা তখন আর কি করেন!মোহর দান করে তো ফিরিয়ে নিতে পারে না।তাহলে গরিব বেচারার ক্ষতি করাই হয়।তাই নিতান্ত্য ইচ্ছা না থাকলেও গরিব বুড়োর গালে একটা আস্তে করে একটা চড় মারলেন।তখন বুড়ো মোহর টি ঝোলার মধ্যে পুরল।খলিফা তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন।যেতে যেতে রাস্তায় উজির কে বললেন,দেখ জাফর,লোকটির এই অদ্ভুত ব্যাবহার দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।অন্ধের এরকম করায় নিশ্চয় কোন অন্য কারন আছে।আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে কারন জানতে।কাল তুমি লোকটির দরবারে এনে হাজির করবেন।আমি ওর সব কথা শুনতে চাই ওর নিজের মুখ থেকে।উজির বললেন,জাঁহাপানা কাল প্রথমে একে আপনার দরবারে হাজির করা হবে।
সে দিনকার মতো ছদ্মবেশে ভ্রমন শেষকরে হারুন অর রশিদ তার প্রাসাদে গিরে গেলেন।পরের দিন দরবার বসেছে।খলিফা বসে আছেন তার রত্ন সিংহসনে।এমন সময় উজির হাজির করলেন সেই অন্ধ লোকটিকে তার সামনে।
হারুন অর রশিদ তাকে দেখে বললেন,তোমার সব কথা শুনব বলে তোমাকে এখানে আনিয়াছি।তুমি কি এমন পাপ করেছ যার কারণে আল্লাহার কাছে এমন অদ্ভুত শপথ করেছ।নিজের ইচ্ছায় নিজে এমন করে চড় খাচ্ছ?
তখন সেই বুড়ো হারুন অর রশিদ কে সালাম দিয়ে তার সব কথা বলতে শুরু করল।ধর্মাবতার এই গুলামের নাম আবদালা,এখন আমার এই হাল হয়েছে বটে কিন্তু এক সময় আমার অবস্থা ছিল অন্য রকম।আমার বাবা খুব বড় সওদাগার ছিলেন।আর সে খুব সম্ভ্রান্ত লোকবলে তার সুনাম ছিল খুব।তার মৃত্যর পর আমি ঠিক করলাম যে অলসের মতো বসে দিন কাটাবো না।আমিও সওদাগারি করব,যেমন করতেন আমার বাবা।এই ভেবে হাতের সব টাকা খরচ করে চল্লিশটা উট কিনে ফেললাম।কিছুদিন পর আমি গেলাম বসরায়।আমার উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে শস্য কেনা।
বসরায় জাবার পথে একদিন সরাইখানাই গেছি।সেখানে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিশ্রাম করছি,এমন সময় এক ফকির সেখানে এলেন।তার ব্যাবহার খুব সুন্দর।
ফকিরের সঙ্গে সেখানে আমার আলাপ পরিচয় হল।আমরা দু,যনে বেশ কিছুখনের মধ্যে ঘনিষ্ট হয়ে উঠলাম।যেন কত কালের চেনা।কত আপন লোক!সত্যি ফকির যেমন সরল তেমন তার দয়া।খানিকক্ষন কথা বলার পর তিনি আমাকে বললেন,ভাই তোমাকে একটা গোপম কথা বলি।শোণ আমি যতিশ বিদ্যা যানি।এখানে আসার পর আমি আশ্চর্য জিনিস দেখেছি,এখানে কাছে একটা যায়গায় একটা গুপ্ত ধন আছে।সোনা ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই।আমি সেখানে জাব ঠিক করেছি।
কাউকে একথা বলেনি,কারণ কে কি রকম লোক বলা তো যায় না। তোমাকে বড় ভাল মনে হল। তাই বললাম।আমি সেখানে গুপ্ত ধন আনতে এখনি যাব।কিন্তু আমি তো বেশী বয়ে আনতে পারব না তাই তোমার সঙ্গে নিতে চাই।আমার বড় ইচ্ছা হচ্ছে তুমি সেই গুপ্ত ধনের ভাগ নাও।তোমার তো চল্লিশ টা উট আছে।তুমি আমার সঙ্গে চল চল্লিশটা উট নিয়ে।
আমি তোমাকে সেই গুপ্ত ধনের যায়গা দেখিয়ে দেব। আর যা যা করলে সেই গুপ্ত ধন পাবে তাও বলে দেব।তার পর তোমার উঠের পিঠে মোহর গুলো বোঝাই করে নিয়ে আসবে শহরে।তখন আমি কুড়িটা বোঝাই করা উট তোমার কাছথেকে নেব। বাকি অর্ধেক তোমার থাকবে।কেমন,এতে রাজি তো?
আমি আন্দে ফকির কে জড়িয়ে ধরে বললাম আমি রাজি।তখন আমি আর ফকির সে সরাই খানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে থাকল চল্লিশ খানা উট।চলতে চলতে আমরা এক বিশাল প্রান্তর পার হলাম।তার পর এসে পড়লাম এক পাহাড়ি যায়গায়।খানিক পরে আমি আর ফকির একটা পাহাড়ের নিচে দাঁড়ালাম।সেই ফকির তখন হাত নেড়ে গোটা কথক মন্ত্র উচ্চারণ করে কি সব বললেন।
অমনি দেখি সেখান কার মাটি আমাদের সামনে ফাঁক হয়ে গেল।আর আমাদের পায়ের নিচে বেরিয়ে পড়ল একটি সুড়ঙ্গ।
ফকির আর আমি সেই সুড়ঙ্গের নিচে নেমে গেলাম।গিয়ে দেখি চার দিকে শুধু মোহর আর মোহর।যত পারলাম সেই পরিমাণ মোহর উপরে আনলাম।অমনি করে চল্লিশটা উট বোঝাই করে নিলাম।একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম আমি,আমি যখন সুড়ঙ্গের মধ্যে মোহর তুলতে ব্যস্ত,সেই সময় হঠাৎ দেখি ফকির সুড়ঙ্গ থেকে একটা কৌটা নিজের আলখাল্লার মধ্যে রেখে দিলেন বেশ যত্ন করে।মনে হল সে টা কোন গুপ্ত ধন,ফকির যখন আমেকে দেখাল না,তখন আমার কিছুই জিজ্ঞাস করা উচিৎ নয়।
যাই হোক উটগুলো মোহর বোঝাই করে আমি ফকিরের উপদেশ মতো সেই দুর্গম পথ পার হয়ে এবার শহরে ফিরে এলাম। এক সঙ্গে এত সোনা নিয়ে আসার সময় আমার মনটা অনেক বদলে গেল।আমি ভাবলাম কুড়িটা উট ফকির কে না দিয়ে দশটা দিই।তাহলে এই ত্রিশটা উট বোঝায় মোহর নিয়ে আমি একজন বাদশা হয়ে যাব।তাই লোভে পড়ে বললাম,দেখুন ফকির ভাই,কুড়িটা উট আপনাকে দেব বলে কথা দিয়েছিলাম।এখন তা দিতে অস্বীকার করছি না।কুন্তু আপনি একা মানুষ।এত সোনা নিয়ে গেলে আপনার বিপদ হতে পারে।তাছাড়া আপনি ফকির মানুষ এত সোনার দরকার বা কি?ফকির সাহেব আমার কথা শুনে বোধায় আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছে।বেশ তাই হবে আমি দশটা উটই নেব।এই বলে তিনি দশটা বোঝায় করা উট নিয়ে চললেন।এখন আমার আরও লোভ হল।ভাবলাম দশটা উট-বা কেন দেব?সবটা আমি পেয়েগেলে,আরও তো ভাল হয়।ফকির জদি ভাল কোথায় না দেয় জর করে নেব।
তখন আমি যোর করে ফকির কে
ডাকতে লাগলাম।তিনি আমার ডাক শুনে দাঁড়ালেন,আমি তার সামনে গিয়ে বললাম,দেখুন আপনি অন্য সময় এসে আবার যত বেশী মোহর নিতে পারেন।এখানকার মন্ত্র তো আপনার জানা।এবার মোহর বোঝায় উট গুলো আমার দিয়ে দেন।
ফকির এবারও আমার কথাশুনে হেসে বাকি দশটা উট আমার দিয়ে দিলেন।কেমন ভাই এবার তো তুমি খুশি?
কিন্তু তখন আমার ঘাড়ে শয়তান ভর করেছিল।আমার লোভ এতে মিটল না। সেই কৌটার কথা মনে পড়ে গেল আমার।
আমি নির্লজ্জের মতো তাকে বললাম,আপনি সুড়ঙ্গথেকে যে কৌটাটা নিয়েছেন সেটা আমাকে দিতে হবে।সেই কৌটার মধ্যে নিশ্চয় দামি কিছু আছে।না হলে আপনি তো অমন যত্নকরে আলখেল্লার মধ্যে রাখতে না।
আমার কথা শুনে ফকির বাবা একটু হেসে কৌটাটা আমার দিয়ে দিলেন।আমি তার খানিক টা খুলে দেখলাম তার ভিতরে তেলের মতোন কি রয়েছে। মনি মুক্তা কিছু নেই।ফকির তখন জিজ্ঞেস করল এটা সাধারন তেল নয়।এর কোন গুন আছে।
তিনি বললেন এই তেল যদি তোমার বাচোখে লাগাও তাহলে জগতের যা ধনসম্পদ আছে তুমি দেখতে পাবে।কিন্তু এই তেল ডান চোখে লাগালে তুমি অন্ধ হয়ে যাবে।ফকিরের কথা শুনে আমার কৌতুহল হল,আমি তখন তাকে অনুরোধ করলাম সেই তেল তার চোখে লাগাতে।তিনি আমার চোখ বুঝতে বললেন,তার পর আমার বা চোখে দিয়ে দিলেন সেই তেল।সঙ্গে সঙ্গে আমি দেখতে পেলাম সেই গুপ্ত ধন।তখন দুষ্ট বুদ্ধি মনের ভিতরে একেবারে চেপে বসেছে।
আমি মনে করলাম ফকির মনে হয়
এবার আমার সাথে প্রবঞ্চনা করছে।বা চোখে তেল দিলে যখন সব গুপ্তধন দেখা যায়,তখন ডান চোখে দিলে নিশ্চয় সেসব গুপ্ত ধন মনে হয় হাতের মুঠোয় এসে যাবে।অন্ধ হবার কথাটা আমার ভয় দেখানোর জন্য বলেছে।এই ভেবে আমি ফকির কে বললাম,আমি এমন বোকা নই যে তোমার ঐ বাজে কথায় কান দেব।তুমি আমার অন্ধ হবার ভয় দেখিয়েছ,জগতের সব গুপ্ত ধন আমার নিতে দেবে না মনে করেছ।দাও আমার ডান চোখে তেল।তাতে আমার যা হয় হোক।
আমার এই কথা শুনে ফকিরের বেশ রাগ হল,বুঝতে পারলাম।তিনি আর কোন কথা না বলে সেই ভয়ানক তেল দিয়ে দিলেন আমার ডান চোখে।টৎক্ষনাৎ আমি অন্ধ হয়ে গেলাম।
ফকির সাহেব তখন আমার বললেন,হতভাগা তোমার মতো লুভি এজগতে আছে কি না আমি জানি না।তাই এত ধনসম্পদ হাতে পেয়ে ধরে রাখতে পারলে না। এখন তোমাকে দিন কাটাটে হবে ভিক্ষা করে।এই তোমার অটি লোভের ফল।এই বলে ফকির সেই চল্লিশটা মহর বোঝাই করা উট আর সেই কৌটা নিয়ে চলে গেলেন।
আর আমি সেখানে একলা বসে বসে কাদতে লাগলাম।অন্ধ হয়ে গেছি,তখন তাই আর এক পাও আর একা চলতে পারলাম না। কোথায় যাব আর কি করব কিছুই বুঝে উঠটে পারলাম না।অবশেষে প্রায়শ্চিত করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছি যে যদি কেউ আমার মারে তবেই তার দান আমি নেব।নইলে না।জাঁহাপানা!এখন আমার ইতিহাস তো সব শুনলেন।আমি দারুন লোভের বেশে এমনি করে নিজের সর্বনাশ করেছি।
বুড়ো ভিক্ষকের সব কথা শুনে খলিফা বললেন,তোমার লোভের সাজা যথেষ্ট পেয়েছ।আর প্রায়শ্চিত্তের দরকার নেই।জানবে আজ থেকে তোমার কষ্টের অবসান হোল।আমি তোমার থাকা খাবার ব্যবস্থা করে দেব দরবার থেকে।আর তোমাকে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করতে হবে না।