অতিপ্রাকৃত ¬[৩য় অংশ]

আদিত্য কি বলতে যাবে- হাজেরা চা নিয়ে এল। এত শীঘ্র চা বানাল কীভাবে। আমি অবাক হলাম। দেখলাম আদিত্য অবাক হয়ে হাজেরার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
চা দিয়ে হাজেরা চলে যেতেই আদিত্য বলল, মামা আমি এই মেয়েটাকে এর আগে দেখেছি।
সে কী রে। কোথায় দেখেছিস?
তোমাকে বলেছিলাম না- গতবছর আমি সুতারখালী গিয়েছিলাম?
হ্যাঁ। মনে আছে।
মেয়েটাকে ওখানে দেখেছি।
বলিস কী। তুই বলছিলি ওখানকার জেলেরা নাকি কাঁচামাছ খায়?
হ্যাঁ, খায়। তবে আরও অনেক কিছুই তারা করে।
আমি দর্শনের অধ্যাপনা করেছি। কুসংস্কার প্রশ্রয় দিইনি। আমি বিশ্বাস করি সব কিছুর ব্যাখ্যা রয়েছে। আজহোক কাল হোক বোঝা যাবে …আমার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। বললাম, খুলে বল ।
আদিত্য বলল, গত বছর যখন সুতারখালীযাই- আমার সঙ্গে আমার বন্ধু আদনানছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম খুব কাছ থেকে আমরা জেলেদের জীবন দেখব এবং জেলেপাড়ায় আগে থেকে খোঁজ খবর করে যাব না। কোনও উপজেলায় নেমে লোকাল বাসে চেপে কোনও নদীর ধারে নেমে পড়ব। এভাবে দাকোপ উপজেলায় নেমে লোকাল বাসে চেপে নিশিকাটি বলে একটা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। গ্রামটা ভদ্র্রা নদীর পাড় ঘেঁষে । ছোট গ্রাম। আমি আর আদদান এক জেলে পরিবারে উঠেছিলাম। তো, পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙল। আদনান ঘুমিয়ে ছিল। আমি উঠে ভদ্রা নদীর পাড়ে গেলাম। নির্জন পাড়। বাতাসে কেমন আশটে গন্ধ। দেখি যে নদীর ধারে কয়েকজন লোক বসে আছে। গতকাল এদের জেলেপাড়ায় দেখেছি। তারা কাঁচা মাছ খাচ্ছে।
কাঁচা মাছ? কি মাছ?
এই ধর, খলিসা, মেনি, চাপিলা।
কাঁচাই খাচ্ছে?
হ্যাঁ, কাঁচা। চিবিয়ে।
কথাটা শুনে আমার মুখটা মনে হয় এখনসিরিয়াস দেখাল।
আদিত্য বলল, আমার বমি বমি লাগছিল।ফিরে এলাম। রোদ উঠতে দেখি আদনান- এর খুব জ্বর । দুপুরে ওর জ্বর সারল। ও আর ওখানে থাকতে চাইল না। অগত্যা ফিরে এলাম। এই ক’দিন আগে আবার গেলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, একা?
হ্যাঁ। একা। আদনান সিলেট। অন্যদেরও পেলাম না।
গেলি কি কাঁচামাছ খাওয়ার রহস্যভেদ করতে?
ঠিক তা না মামা। নিশিকাটি গ্রামটা কেমন টানছিল। গতবছর ভোরের ভদ্রা নদীর ছবি তুলেছিলাম।ভদ্রার ওইপাড়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। এতবড় মাঠ এর আগে দেখিনি। ঠিক যেন তেপান্তরের মাঠ। গাছপালা নেই। আকাশের রংও যেন কেমন। গভীর ফিরোজা। কোনও চেঞ্জ নেই। তাই ভাবলাম পূর্ণিমায় নদী-মাঠের ছবি তুলব। এবার পূর্ণিমা হিসেব করে রওনা হলাম। এবারও সেই জেলেপরিবারেই উঠেছি। রাতে ঘুমালাম না । মাঝরাতে ভদ্রার পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। চারিদিকে দিনের মত অলো। পাড়ে উলটানো নৌকা। একটা নৌকায় হেলান দিয়ে বসে রইলাম। হাতে তোমার দেওয়া ১৮ মেগার ক্যানন ইওএস এমটা । মাঝে মাঝে ছবি তুলছিলাম । ওপারে তেপান্তরের মাঠ চাঁদের আলোয় ভেসেযাচ্ছিল। এমন সময় বড় একটা মাছ ভেসে উঠেই আবার আবার ডুবে গেল। অনেক বড় মাছ, এই ধর একটা নৌকার সমান। মাছটা রুই মাছে মতন দেখতে। আমি তো অবাক। তবে ছবি তুলে নিলাম।তখনই অদ্ভূত এক আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখলাম জেলেপাড়ার সবাই অদ্ভূত আওয়াজ করতে করতে ছুটে আসছে। এই ধর দু-তিনশ জন হবে। দলটায় ছেলেবুড়ো সবাই আছে। তারা পানির কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু, পানিতে পড়ার আগে এক এক জন রুই মাছ রূপান্তরিত হল।
ক্বি! কি বলছিস তুই!
হ্যাঁ। যা দেখেছি তাই বলছি।ভৌতিকদৃশ্যটা দেখে আমার শরীর জমে গেল। মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব। নদী শান্ত। মৃদু রূপালি ঢেউ। একটু পর ঝাঁক ঝাঁক রুইমাছ ডলফিনের মতন লাফালাফি করতে লাগল। ছবি তুলে নিলাম। অনেক মাছ। এই ধর কয়েক হাজার । আবার সেই বড় রুই মাছটা ছোট তিমির মতন ভেসে উঠল। ছবি তুলেনিলাম। আমার হাত কাঁপছিল। হঠাৎ দেখলাম রুইয়ের ঝাঁক দ্রুত তীরের দিকে আসতে লাগল। তীরে উঠেই সব কটামাছ ভয়ঙ্কর রূপ ধরল। ভীষণ বিভৎস-কী বলব।হলুদ লম্বা কান, মাথায় ছোট্ট লাল রঙের শিং। সারা শরীরে সোনালি রোম। তারা উলু ধ্বণির মতন শব্দ করে আমার দিকে তেড়ে আসতে ।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তারপর?
আমি উঠে দৌড় দিলাম। উচুঁ পাড়ে উঠেএকবারও পিছনে না তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকি। এড়বোখেবড়ো রাস্তা। ওপাশে একটা খাল। খালটা আড়াআড়ি পেরোতেই ক্যামেরা ছিটকে পানিতে পড়ে যায়। পিছনের ওরাও খালের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুখ দিয়ে সেই অদ্ভূত স্বর করছে …তারপর আমি কীভাবে খাল পেরিয়ে করলা আর কলমি শাকের ক্ষেত আর শিরীষের জঙ্গল পেরিয়ে পিচ রাস্তায় উঠে এলাম বলতে পারব না। দৌড়াতে দৌড়াতে টের পেলাম শেষ রাত। তখনও দৌড়াচ্ছি। আন্দাজে। আধা কিলোর মতন দৌড়ানোর পর আজান শুনতে পেলাম।তখন পিছনে ওদের আওয়াজ কমে এল। একটা মসজিদ চোখে পড়ল। মসজিদের সামনে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। তারপর মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি মাথার কাছে মুয়াজ্জ্বিন সাহেব বসে।দোওয়া দরুদ পড়ছে। সব শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, নিশিকাটি গ্রামের নাম বাপ-দাদার আমলে শুনছি। অনেক বছর আগে ছিল। এখন আর নাই। বন্যায় নাকি ভেইসে গেছে। তিনিই টাকা-পয়সা দিয়ে আমাকে খুলনার বাসে তুলে দিলেন।
ওহ্। আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।
ঠিক তখনই ফোন বাজল। শবনম।
হ্যাঁ। বল।
শবনম থমথমে গলায় বলল, ভাইজান আদিত্যকে এখুনি বাড়ি আসতে বল, ও যদি এখন না আসে, তাহলে যেন সারাজীবনে না আসে।
ঠিক আছে। পাঠাচ্ছি। বলে ফোন অফ করে দিলাম। বললাম, শোন, আদিত্য। তুই এবার বাড়ি যা। তোর মা ক্ষেপেছে । আবার আসিস। তখন ঘটনাটার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাব।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!