অতিথি সেবা বা মেহমানদারি

আমাদের সমাজে কেউ কেউ আছেন যারা বাড়ীতে মেহমান এলে অসন্তুষ্ট হন। তারা মনে করেন, মেহমান এলে অযথা কাড়ি কাড়ি টাকা-পয়সা খরচ হয়। কিন্তু তারা হয়তো চিন্তা করে না যে, ইসলামসহ প্রায় সব ধর্মেই মেহমানদারির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, মেহমান এলেই যে সামর্থের বাইরে খরচ করতে হবে এমন কোন কথা নেই। নিজেদের সামর্থ অনুয়ায়ী আন্তরিকতার সাথে অতিথিদের সেবা করতে পারলেই তারা খুশী হন এবং এতে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।
রংধনু আসরে আমরা ‘অতিথি সেবা’ বা ‘মেহমানদারি’ সম্পর্কে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি।

 

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মেহমানদারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক সময় অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে অনাহারে থাকতে হতো। নিজ ঘরে মেহমানদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে তিনি মেহমানদেরকে অন্য কোন সাহাবির বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। মোটকথা, মেহমানের কোনো অযত্ন যেন না হয় সেদিকে তিনি খেয়াল রাখতেন। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা শোনা যাক।
একবার বনু গিফার গোত্রের এক লোক রাসূল (সা.)-এর মেহমান হয়ে এলেন। নবীজী তার আগের দিন থেকেই অভূক্ত ছিলেন। যেদিন মেহমান এলেন সেদিন রাসূলের ঘরে বকরির দুধ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দুই দিনের অনাহারী হওয়া সত্ত্বেও অতিথিপরায়ণ নবীজী সবটুকু দুধ মেহমানকে খাওয়ালেন এবং নিজে ক্ষুধার্তই রয়ে গেলেন। আবার মেহমানকে বুঝতেও দিলেন না তিনি ক্ষুধার্ত। রাসূল (সা.) মেহমানদারির এমন বিরল দৃষ্টান্ত সাহাবীরাও অনুসরণ করেছেন।

মহানবী (সা.) এর এক সাহাবী খুবই গরীব ছিলেন। তিনি প্রায়ই রোজা রাখতেন। ইফতার করার জন্যও অনেক সময় তার কোন খাবার জুটত না। তাই অন্য সাহাবীরা প্রায়ই তাকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন।
একদিন হয়রত সাবেত (রা.) নামের এক আনসার সাহাবী ওই গরীব সাহাবীকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত করলেন। সাবেত আনসারী বাড়ি এসে তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘আজ কি রেঁধেছো?’ স্ত্রী বললেন, ‘আজ তো তেমন কিছু রাখিনি। যে খাবার আছে তাতে আমাদের দু’জনেরও হবে না।’
সাবেত আনসারী বললেন, ‘বলো কি! আজ যে আমার বাড়িতে একজন মেহমান আসবে। আমি তাকে দাওয়াত দিয়েছি।’
স্বামী-স্ত্রী যখন এসব আলাপ করছিলেন, তখন বাইরে মেহমানের গলার আওয়াজ শোনা গেল। সাবেত তাড়াতাড়ি তার স্ত্রীকে বললেন, ‘এক কাজ করো, সব খাবার মেহমানের সামনে রাখো। তারপর চেরাগটা ঠিক করার অজুহাতে নিভিয়ে ফেলবো। অন্ধকারের মধ্যেই মেহমানকে খেতে দিয়ে আমরা পাশেই বসে থাকবো। নিজেরা কোন খাবার খাবো না। তবে অন্ধকারে আমার সাথে তুমিও প্লেট থেকে খাবার তুলে নেবার ভান করবে। যাতে মেহমান মনে করেন যে, আমরাও তার সাথে আহার করছি।
পরিকল্পনা মতো মেহমানের সামনে খাবার নিয়ে আসা হলো। সাবেতের স্ত্রী চেরাগটা ঠিক করার অজুহাতে নিভিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পরও সলতে ঠিক করতে পারলেন না। অগত্যা অন্ধকারের মধ্যেই মেহমান খাওয়া শুরু করলেন। মেহমানের সাথে তারাও খাওয়ার ভান করতে লাগলেন। এক সময় খাওয়া শেষ হলো। হযরত সাবেত অভিনব কৌশলে মেহমানকে পেট ভরে খাওয়াতে পেরে মনে মনে খুব খুশী হলেন।
এক সময় খাওয়া শেষ হলো। মেহমান ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। পরদিন ভোরে ফজরের নামায পড়ার জন্য হযরত সাবেত মসজিদে নববীতে হাজির হলেন। নামায শেষে মহানবী তাকে বললেন, ‘তুমি গতরাতে মেহমানের সাথে যে ব্যবহার করেছো তা মহান আল্লাহ খুবই পছন্দ করেছেন।’
এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা সূরা হাশরের ৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘তারা নিজের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যদিও বা নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকে। আর যারা স্বভাবজাত লোভ-লালসা এবং কামনা থেকে রক্ষা পেয়েছে, তারাই সফলকাম।’

এবার আমরা আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) এর জীবন থেকে নেয়া একটি ঘটনা শোনাবো।
একবার হযরত আলী (আ.) খেতে বসলেন। এ সময় একজন মিসকিন এসে খাবার চাইল। তিনি মিসকিনকে তার খাবার দান করেন। পরদিন একইভাবে খাবার তৈরি করে যখন খেতে বসলেন তখন একজন এতিম এসে খাবার চাইল। তিনি তাকেও খাবার দান করেন। এরপর তৃতীয় দিন একজন মুশরিক বন্দি এসে খাবার চাইল, তিনি তাকে পুরো খাবার দিয়ে দিলেন এবং নিজে অভূক্ত থাকলেন। পবিত্র কুরআনের সূরা দাহরে আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘খাবারের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে খাবার দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদের খাবার দান করি, আমরা তোমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।’

কেবল ইমাম আলীই নন, তার বড় ছেলে ইমাম হাসানও মেহমানদারির ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ছিলেন। একদিন ইমাম হাসান (আ.) কোথাও যাওয়ার পথে দেখতে পেলেন, কিছু ফকীর রুটি খাচ্ছে। তারা ইমামকে দেখে বললোঃ হে রাসূলের সন্তান! আসুন ! আমাদের সাথে আহার করুন! ইমাম দ্বিধাহীন চিত্তে পরিপূর্ণ আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসে তাদের সাথে বসে পড়লেন। বসেই তিনি বললেন,আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না-এই বলে তিনি ফকিরদের সাথে আহার করতে শুরু করলেন। না,কেবল খেলেনই না,বরং তাদেরকে নিজের বাসায় দাওয়াতও করলেন। অতিথি ফকিরগণ যখন ইমামের বাসায় এলেন, ইমাম হাসান তাদেরকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করলেন এবং তাদের মেহমানদারি করলেন। সেইসাথে তাদের সবাইকে নতুন জামা-কাপড়ও উপহার দিলেন।

এই যে ছোট্ট ঘটনাটি,এতে আমাদের জন্যে বেশ কয়েকটি শিক্ষা রয়েছে। প্রথম শিক্ষাটি হলো মানুষকে মানুষ হিসেবেই যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি। ফলে আল্লাহর সৃষ্টিকে সমানভাবে ভালোবাসতে হবে। গরীবদেরকে গরীব হবার কারণে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়।

মেহমানদারির ব্যাপারে রাসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবীরা যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আমাদের সবার উচিত তা অনুসরণ করা। রাসূলের খোদার নির্দেশ কিন্তু তাই। তিনি বলেছেন, ‘যে আল্লাহ এবং পরকালের ওপর ঈমান আনে সে যেন মেহমানের সেবা করে।’ #

দুঃখিত!