হতে পারে এটা নিজেকে চেনা দ্বীপ বলে স্বীকার করবে না।
তাহলে আমি তোমাকে কোনও জাহাজ দেবো না।
হ্যাঁ, আপনি দেবেন।
ভিড় করা প্রজারা যখন লোকটার এরকম বলিষ্ঠ বক্তব্য শান্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনল, উজ্জীবিত এবং অনুপ্রাণিত বোধ করল তারা, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ওই লোকের সমর্থনে নাক গলাবে, যতটা না একাত্ম অনুভব করায়, তারচেয়ে বেশি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠায়-দরজা থেকে তাকে সরাতে পারলে তারা নিজেরা রাজার সামনে দাঁড়াতে পারবে, পেশ করতে পারবে যার যার আর্জি। তারা সবাই একযোগে চেঁচাতে লাগল: ওকে জাহাজ দিন! ওকে জাহাজ দিন!
রাজা মুখ খুলে পরিচ্ছন্ন নারীকে বললেন, প্রাসাদ প্রহরীদের ডাকো, তারা শৃংখলা আর শান্তি ফিরিয়ে আনুক।
কিন্তু আশপাশের বাড়ি থেকে পিল পিল করে বেরিয়ে এলো লোকজন, যোগ দিলো কোরাসে: ওকে জাহাজ দিন! ওকে জাহাজ দিন!
রাজা ভাবলেন এখানে যত বেশিক্ষণ থাকবেন তিনি, ততই ক্ষতি, কারণ তাঁর অনুপস্থিতিতে ওদিকে খাজনা আর উপহারের স্রোত বন্ধ হয়ে আছে।
হাত তুলে সবাইকে চুপ করার নির্দেশ দিলেন তিনি, তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমি তোমাকে একটা জাহাজ দেবো, কিন্তু মাঝি-মাল্লা দিতে পারব না, কারণ চেনা দ্বীপের জন্যে ওদের সবাইকে আমার দরকার হবে।
রাজাকে ধন্যবাদ জানাল লোকটা, যদিও উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের উল্লসিত চিৎকার-চেঁচামেচিতে সেটা চাপা পড়ে গেল। তবে এরপর রাজা যা বললেন সবাই সেটা শুনতে পেলো: জেটিতে চলে যাও, কথা বলো বন্দর প্রধানের সঙ্গে। বলবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি, তোমাকে একটা জাহাজ দিতে বলেছি-এই নাও আমার চিরকুট।
যে ব্যক্তিকে জাহাজ দেয়া হবে চিরকুটটা পড়ল সে। পরিচ্ছন্ন নারীর কাঁধে কাগজ রেখে দু’তিনটে লাইন লিখে তার নীচে সই করেছেন রাজা: এই চিরকুটের বাহককে একটা জাহাজ দেবে। তবে সেটা খুব বড় জাহাজ না হলেও চলবে। দেখবে সেটা যেন নিরাপদ হয়, এবং সাগরে অভিযান চালানোর উপযোগীও হওয়া চাই। আমি চাই না তার কপালে খারাপ কিছু ঘটলে আমার বিবেকে হানা দিক সে।
উপহার পাওয়ার বিনিময়ে দ্বিতীয়বার ধন্যবাদ দেয়ার জন্য লোকটা যখন মুখ তুলল, রাজা তখন তার কথা শোনার জন্য সেখানে অপেক্ষায় নেই। সে দেখল একা শুধু পরিচ্ছন্ন নারী দাঁড়িয়ে আছে ওখানে-কেন কে জানে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
দোরগোড়া থেকে সরে দাঁড়াল লোকটা, বাকি লোকজন যাতে সেখানে পৌঁছুতে পারে। সে সরে যেতে লোকজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল, কে কার আগে যাবে। কিন্তু হায়, ইতিমধ্যে আবার রাজপ্রাসাদের ওই দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ব্রোঞ্জের কড়া ধরে ঝাঁকাতে লাগল ওরা, ভাবছে পরিচ্ছন্ন নারী দরজা খুলে দেবে। কিন্তু ওখানে নেই সেই তরুণী, নিজের বালতি আর ঝাড়ু নিয়ে চলে গেছে আরেক দিকে।
পরিচ্ছন্ন নারী আরেক দরজা দিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়েছে, যেটার নাম সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত নামের এই দরজা খোলা একটা বিরল ঘটনাই বলতে হবে। সহজে খোলে না, কিন্তু যখন খোলে তখন ধরে নিতে হবে কেউ একজন খুব কর্ঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পরিচ্ছন্ন নারীর চেহারায় চিন্তিত ভাব ছিলো, এখন সেটার কারণ পরিষ্কার হচ্ছে। ওই মুহূর্তে প্রাসাদের চাকরি ছেড়ে ওই রহস্যময় লোকের সঙ্গে সাগরে যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল সে। লোকটা যাচ্ছে জেটিতে, রাজার দেয়া উপহার বুঝে নিতে, তার সঙ্গে সেও যাচ্ছে। সেলাই করে আর কাপড় ধুয়ে, ঘর মুছে আর ঝুল ঝেড়ে জীবনের অনেকটাই দেখা হয়ে গেছে তার। এবার একবার নাহয় কাজ বদল করে দেখুক না। পরিষ্কারের কাজই করবে, তবে এবার কাপড়চোপড় বা ঘরদোর নয়-জাহাজ। আর যাই হোক, সাগরে তাকে অন্তত পানির অভাবে ভুগতে হবে না।
লোকটার কিন্তু কোনও ধারণা নেই ইতিমধ্যে তার কাজ করে দেয়ার অন্তত একজন মানুষ যোগাড় হয়ে গেছে, তার পিছু নিয়ে আসছে সে, জাহাজের ডেক ধোবে, অন্যান্য সমস্ত ধোয়াধুয়ির কাজও করবে, অথচ এখনও সে কাউকে চাকরি দিতে শুরু করেনি। আসলে এভাবেই সাধারণত ভাগ্য আমাদের সঙ্গে খেলে, আমাদের ঠিক পেছনেই থাকে আনন্দ বা সহায়তা, দেখা যাবে আগেই কাঁধ ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, নিজেরা তখনও বিড়বিড় করে খেদ প্রকাশ করছি।
খানিক দূর হেঁটে বন্দরে পৌঁছুল লোকটা, প্রশ্ন করে জেনে নিলো কোথায় পাওয়া যাবে বন্দর ও জেটি প্রধানকে। অপেক্ষার সময় জেটিতে নোঙর ফেলা ছোটবড় অসংখ্য জাহাজের ওপর চোখ বুলাচ্ছে সে, ভাবছে কে জানে তার কপালে কি রকম জাহাজ জুটবে। রাজা বলে দিয়েছেন জাহাজটা হতে হবে নিরাপদ, এবং সাগরে অভিযান চালানোর উপযোগী।
অল্প একটু দূরে, কিছু ড্রামের আড়াল থেকে পরিচ্ছন্ন নারীও জাহাজগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছে। আমার ওই বোটটা পছন্দ, একটাকে পছন্দ করল সে, যদিও জানে তার পছন্দ বা অপছন্দে কিছু আসে যায় না। তাকে তো এমনকি কাজ করানোর জন্য রাখাও হয়নি। তবে, সে ভাবল, প্রথমে বন্দর প্রধান কি বলেন শোনা দরকার।
খবর পেয়ে বন্দরপ্রধান পৌঁছালেন, রাজার পাঠানো চিরকুট পড়লেন, লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলালেন, তারপর এমন একটা প্রশ্ন করলেন যেটা তাকে গাফলতি করে রাজা জিজ্ঞেস করেননি: তোমার কি সাগরে জাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা আছে? নাবিক হবার জন্যে ট্রেনিং নিয়েছ?
লোকটা জবাব দিলো, আমি সাগরে গিয়ে শিখে নেবো।
জেটি প্রধান বললেন, আমি এটা সমর্থন বা সুপারিশ করি না। আমি একজন ক্যাপটেন, কাজেই পুরোনো একটা জাহাজ নিয়ে কক্ষনো সাগরে যাব না।
তাহলে দেখেশুনে ভালো একটা জাহাজ…না, সেরকম না; আপনি আমাকে এমন একটা জাহাজ দিন যেটাকে আমি সমীহ করতে পারব, সেটাও আমাকে সমীহ করবে।
এই তো নাবিকের মতো কথা হলো, অথচ তুমি বাপু মোটেও নাবিক নও।
আমি যদি নাবিকের মতো কথা বলে থাকি, তাহলে নিশ্চয়ই আমি একজন নাবিক।
জেটি প্রধান রাজার চিরকুটটা আবার পড়লেন। তারপর জানতে চাইলেন, তুমি আমাকে জানাতে পারো কি কারণে একটা জাহাজ দরকার তোমার?
জাহাজ নিয়ে আমি অচেনা দ্বীপ খুঁজতে যাবো।
অচেনা দ্বীপ বলে আর কিছু নেই।
রাজাও আমাকে তাই বলেছেন।
দ্বীপ সম্পর্কে তিনি সব কিছু আমার কাছ থেকে শুনে বলেন।
এটা খুব অদ্ভুত যে আপনি সাগরের একজন মানুষ হয়ে আমাকে শোনাচ্ছেন অচেনা দ্বীপ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমি ডাঙার একজন মানুষ, অথচ আমিও জানি যে এমনকি চেনা দ্বীপও অচেনা থেকে যায় যদি না সেখানে আমরা পা না ফেলি।
কিন্তু, আমার যদি বুঝতে ভুল না হয়ে থাকে, কারও পা পড়েনি এমন দ্বীপ খুঁজতে যাচ্ছ তুমি।
হ্যাঁ, ওখানে পৌঁছালে সেটা আমি বুঝতে পারব।
যদি ওখানে পৌঁছাও।
কেন, যাবার পথে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে না? আমার বেলা সেরকম যদি কিছু ঘটে, আপনি বন্দরের প্রধান হিসেবে রেকর্ড রাখবেন-অমুক সাগরের অমুন জায়গা পর্যন্ত পৌঁছুতে পেরেছিলাম আমি।
বলতে চাইছ তুমি সব সময় কোথাও না কোথাও পৌঁছাও?
এটা যদি আপনি না জানেন তাহলে এই মানুষটা আপনি নন।
বন্দরপ্রধান বললেন, যেমনটি দরকার সেরকম একটা জাহাজ তুমি পাবে। ওই বোট অনেক কাল আগের, সবাই যখন অচেনা দ্বীপ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ত, তাই ওটার অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। এমনকি কিছু অচেনা দ্বীপ ওটা খুঁজেও দিয়েছিল। ওই যে, ওটা।
বন্দরপ্রধান হাত তুলে একটা জাহাজ দেখালেন। তারপর আবার বললেন, ওটা একটা ক্যারাভেল-হালকা, ছোট, কিন্তু ছোটে খুব জোরে।
কাকতালীয়ই বটে, এই জাহাজটাই পছন্দ করেছে পরিচ্ছন্ন নারী। বন্দরপ্রধান হাত তুলে কোন জাহাজটাকে দেখাচ্ছেন, আড়াল থেকে লক্ষ করল সে। ড্রামের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে, ‘ওটা আমার জাহাজ! ওটা আমার জাহাজ!’ বলে চেঁচাচ্ছে।
তার এই মালিকানা দাবি যতই অস্বাভাবিক আর অহেতুক হোক, সেটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখতে হবে, কারণ সত্যি সত্যি ওটার মালিকানা সে চাইছে না।
লোকটা বলল, জাহাজটা বেশ পুরোনো।
তাই মেরামতও করা হয়েছে অনেক বার, এবং প্রতিবার মেরামত করার পর দেখা গেছে ওটা আগের মতো নেই, বদলে গেছে। ওটার মাস্তুল আর পাল খুব ভালো। অচেনা দ্বীপ খুঁজতে গেলে ওগুলো ছাড়া তোমার চলবে না।
এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না পরিচ্ছন্ন নারী। সে বলল, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করো, ওটা আমার খুব পছন্দের জাহাজ।
লোকটা বলল, কিন্তু তুমি কে?
কি আশ্চর্য, আমাকে তোমার মনে নেই?
না, নেই।
আমি সব কিছু পরিচ্ছন্ন রাখি, তাই আমার নাম পরিচ্ছন্ন নারী।
তুমি কি কি পরিচ্ছন্ন রাখো?
রাজার প্রাসাদ। রাজকীয় পোশাক-আশাক। যে মেয়েটা আর্জির দরজা খুলে দেয়, আমি সেই মেয়ে।
তাহলে তুমি তোমার কাজে ফিরে যাওনি কেন? ওখানে ধোয়ামোছা আর দরজা খোলাই তো তোমার কাজ।
কারণ যে দরজা সত্যি আমি খোলা দেখতে চেয়েছিলাম সেগুলো সব ইতিমধ্যে খুলে গেছে, আর তাই এখন থেকে আমি শুধু জাহাজ পরিষ্কার করব।
তারমানে তুমি আমার সঙ্গে অচেনা দ্বীপ খুঁজতে যেতে চাও।
আমি সিদ্ধান্ত নামের দরজা দিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছি।
সেক্ষেত্রে, যাও, জাহাজটা একবার ঘুরেফিরে দেখো। কতদিন ব্যবহার করা হয় না, নিশ্চয়ই অনেক ধুলোবালি জমেছে, ভালো একটা ধোলাই হওয়া দরকার। তবে গাংচিল সম্পর্কে সাবধান, ওদেরকে বিশ্বাস করা যায় না।
তুমি আমার সঙ্গে এসে দেখতে চাও না তোমার জাহাজের ভেতরটা কেমন?
তুমি না তখন বললে ওটা তোমার জাহাজ।
কি বলে ফেলেছি, সেজন্যে দুঃখিত। কথাটা আমি বলেছিলাম ওটা আমার পছন্দ হয়েছে বলে।
মালিকানার সবচেয়ে ভালো ধরন সম্ভবত পছন্দ, আর পছন্দের সবচেয়ে বাজে ধরন মালিকানা।
ওদের আলাপে বাধা দিলেন বন্দর প্রধান। বললেন, মালিকের হাতে জাহাজের চাবি তুলে দিতে চাই আমি। সেটা কে, নির্ভর করে তোমাদের ওপর। দুজনের যেই মালিক হও, আমার খারাপ বা ভালো লাগার কোনও ব্যাপার নেই।
জাহাজেরও তাহলে চাবি আছে? জিজ্ঞেস করল লোকটা।
জাহাজে চড়তে চাবি লাগে না, না; তবে জাহাজের ভেতরে কিছু আলমারি, দেরাজ, লকার ইত্যাদি আছে, আরও আছে লগবুক সহ ক্যাপটেনের ডেস্ক।
গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।