সব এই মেয়েটার দায়িত্বে থাকল, আমাকে এখন মাঝি-মাল্লার খোঁজে যেতে হচ্ছে। কথা শেষ করে চলে গেল লোকটা।
চাবি নিয়ে জাহাজে চড়ল পরিচ্ছন্ন নারী। ওখানে দুটো জিনিস তার খুব উপকারে লাগল-একটা রাজপ্রাসাদ থেকে নিয়ে আসা ঝাড়–, আরেকটা গাংচিল সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ। জাহাজের গায়ে সেঁটে থাকা গ্যাঙপ্ল্যাঙ্ক ধরে মাত্র অর্ধেকটা উঠেছে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুৎসিত পাখিগুলো, তাদের কর্কশ চেঁচানিতে কান পাতা দায়, ঠোঁট এমনভাবে খুলে রেখেছে যেন ওখানেই খেয়ে ফেলবে মেয়েটাকে। কিন্তু ওগুলোর কোনও ধারণা ছিলো না কার সঙ্গে লাগতে গেছে। পরিচ্ছন্ন নারী হাতের বালতি নামিয়ে রাখল, চাবির গোছা গুঁজল বুকের ভাঁজে, গ্যাঙপ্ল্যাঙ্কে শক্ত হয়ে দাঁড়াল, তারপর বন বন করে চারদিকে ঘোরাল ঝাড়–টা। চিল বাহিনী পালাতে দিশে পেলো না।
জাহাজে ওঠার পর গাংচিলদের ওরকম খেপে থাকার কারণ দেখতে পেলো মেয়েটা। অনেক দিন খালি পড়ে থাকায় জাহাজের সবখানে বাসা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগ পরিত্যক্ত হলেও, অনেক বাসায় বাচ্চা ফুটেছে, আবার কিছু বাসায় ডিমে তা দেয়া চলছে। সদ্য ফোটা বাচ্চা গুলো হাঁ করে আছে-জানা কথা, খাবারের আশায়।
এসব নাহয় ঠিক আছে, কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি তো এরকম থাকলে চলবে না। তোমাদের বাসা তোমরা অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাও। জাহাজকে তো রওনা হতে হবে। শোনো তাহলে, আমরা অচেনা দ্বীপ খুঁজতে বেরোচ্ছি, বুঝলে! এটাকে মুরগির খাঁচা মনে হলে তো চলবে না।
খালি বাসাগুলো পানিতে ফেলে দিলো মেয়েটা, বাকিগুলো আপাতত থাকল। তারপর কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে ডেক পরিষ্কার করতে লেগে গেল সে। নোংরা কাজটা শেষ করার পর লকার খুলে সতর্কতার সঙ্গে পালগুলো পরীক্ষা করল। অনেক দিন ব্যবহার না করায় পালগুলোর কিনারা ভাঁজ খেয়ে গেছে, কোথাও কোথাও সুতো উঠে গেছে-সেলাই করতে হবে। পাল হলো একটা জাহাজের পেশি। আমরা শুধু ওগুলোকে বাতাসে ফুলতে আর টান টান হতে দেখি, কিন্তু সব পেশির মতো নিয়মিত ব্যবহার করা না হলে ওগুলোও দুর্বল হয়, নেতিয়ে পড়ে। যাক, সেলাইয়ের কাজ জানা থাকায় সব ঠিক করে নিতে তার কোনও সমস্যা হবে না।
কিন্তু বাকি লকার পরীক্ষা করে হতাশ হতে হলো পরিচ্ছন্ন নারীকে। গানপাউডারের লকারে গানপাউডার নেই। কালো কিছু ধুলো চোখে পড়ল, ইঁদুরের শুকনো বিষ্ঠা বলে সন্দেহ হলো তার। সবচেয়ে যেটা চিন্তার বিষয়, খাদ্যবস্তু রাখার লকারে খাবার কোনও জিনিসই নেই। চিন্তাটা নিজের জন্য না, কারণ রাজার প্রাসাদে এঁটোটাই খেতে দেয়া হতো তাকে, তাও পরিমাণে খুব কম। চিন্তা ওই লোককে নিয়ে, এই জাহাজ যাকে দেয়া হয়েছে।
একটু পরই সূর্য নেমে যাবে। পেটে প্রচন্ড খিদে নিয়ে ফিরে আসবে লোকটাÑসব পুরুষই যেমন ঘরে ফেরে খিদে নিয়ে, যেন একা শুধু তাদেরই পেট আছে, আর সেটা নিয়মিত ভরারও প্রয়োজন। তার ওপর সে যদি আবার মাঝি-মাল্লা যোগাড় করে আনে, তাহলে তো কথাই নেই। এ-ধরনের লোকজন সব সময় অসহ্য খিদেতে ভোগে। অথচ, মেয়েটা ভাবল, আমি জানি না তাদেরকে কি খেতে দেবো।
তার এত চিন্তা না করলেও চলত। সাগরে সূর্য মাত্র ডুবছে, জেটির শেষ মাথায় জাহাজ উপহার পাওয়া লোকটাকে দেখা গেল। সে একা, মনমরা, তবে তার হাতে একটা প্যাকেট রয়েছে।
গ্যাঙপ্ল্যাঙ্ক ধরে নীচে নেমে এসে তার জন্য অপেক্ষায় থাকল মেয়েটা। তবে সারাটা দিন কেমন গেছে, এ-কথা বলার জন্য মুখ খোলার আগেই লোকটা তাকে বলল, চিন্তা করো না, আমি দুজনের জন্যেই প্রচুর খাবার এনেছি।
কিন্তু মাঝি-মাল্লা? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
সেটা তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ, কেউ আসেনি।
কিন্তু তাদের দু’একজন অন্তত এ-কথা তো বলেছে যে তারা আসবে?
তারা বলেছে অচেনা দ্বীপ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আর যদি থাকেও, বাড়ির আরাম আর স্বস্তি ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই তাদের। কাজ করতে হলে যাত্রীবাহী যে জাহাজটা সমুদ্র পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেখানে কাজ করবে। অন্ধকার সাগরে ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।
তুমি তাদের বলোনি সাগর চিরকালই অন্ধকার? অচেনা দ্বীপের কথাও বুঝিয়ে বলোনি?
অচেনা দ্বীপের কথা আমি কি করে তাদের বোঝাব, বলো? যেখানে আমি নিজেই জানি না সেটা কোথায় আছে।
কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো যে ওটার অস্তিত্ব আছে।
যেমন আমি নিশ্চিত সাগর কালো। এই মুহূর্তে, এই উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে পানির বিস্তারকে মনে হচ্ছে রত্নের মতো নীলচে-সবুজ, আকাশে যেন আগুন লেগেছে, আমার কাছে তো একেবারেই কালো মনে হয় না। স্রেফ চোখের ভুল, মায়া। দ্বীপ কখনও কখনও পানির গায়ের ওপর ভাসে, কিন্তু তা সত্যি নয়।
মাঝি-মাল্লা না থাকলে কি করে সব সামলাবে তুমি?
তা এখনও আমি জানি না।
আমরা এখানে বসবাস করতে পারি, বন্দরে বন্দরে নোঙর ফেললে ধোয়ার মতো অনেক জাহাজ পেয়ে যাবো। আর তুমি…
আমি…
তুমি নিশ্চয় কিছু জানো, কাজটাজ শিখেছ, তোমারও তো পেশা আছে…
‘তা আছে, ছিলো, যদি প্রয়োজন হয় থাকবে, কিন্তু আমি চাই অচেনা দ্বীপ খুঁজে বের করি। ওই দ্বীপে পৌঁছানোর পর জানতে চেষ্টা করব আমি কে।
তুমি সেটা জানো না?
নিজের ভেতর থেকে যতক্ষণ না তুমি বেরুতে পারছ, ততক্ষণ আবিষ্কার করতে পারবে না কে তুমি।
রাজার দার্শনিক, তাঁর যখন কিছু করার থাকত না, আমার কাছে এসে বসতেন, আমাকে সেলাইয়ের কাজ করতে দেখতেন। মাঝে সাজে দর্শনও আওড়াতেন। প্রায়ই তাঁকে বলতে শুনতাম, প্রতিটি মানুষ একটা দ্বীপের মতো। কিন্তু আমি একটা মেয়েমানুষ, তাঁর এসব কথা বুঝতামও না, ভালো করে শুনতামও না। তুমি কি ভাবো? দ্বীপ দেখতে যেতে হলে দ্বীপ ছেড়ে যেতে হবে? আমরা নিজেদেরকে দেখতে পাবো না, যতক্ষণ না নিজেদের কাছ থেকে মুক্ত হতে পারছি?
তুমি বলতে চাইছ নিজেদের কাছ থেকে যতক্ষণ পালাতে না পারছ।
না, দুটো এক জিনিস হলো না।
আকাশের আগুন দ্রুতই নিভে আসছে, পানি হঠাৎ করে বেগুনি চেহারা পেয়েছে, এখন এমনকি পরিচ্ছন্ন নারীরও সন্দেহ হবে সাগর সত্যি হয়তো কালো, অন্তত দিনের নির্দিষ্ট একটা সময়ে তো বটেই।
লোকটা বলল, দর্শন রাজার দার্শনিকের কাছেই থাক, এই কাজের জন্যেই তাঁকে বেতন দেয়া হয়। এসো, আমরা খেতে বসি।
কিন্তু মেয়েটা তাতে রাজি হলো না। সে বলল, না, প্রথমে তোমাকে নিজের জাহাজ ঘুরে দেখতে হবে। তুমি শুধু বাইরে থেকে দেখেছ।
ওটাকে তুমি কি অবস্থায় পেলে?
কিছু পাল মেরামত করতে হয়েছে।
খোলে নেমেছিলে, জাহাজে কি খুব বেশি পানি আছে?
খোলের তলায় কিছু পানি আছে, কলকল ছলছল করতে শুনেছি। তবে সেটা স্বাভাবিক।
এসব তুমি শিখেছ কোথায়?
এমনি শিখে ফেলেছি।
কিন্তু কিভাবে?
তুমি যেমন বন্দর প্রধানকে বললে, সাগরে বেরিয়ে জাহাজ চালানো শিখে ফেলবে-ওভাবে।
আমরা তো এখনও সাগরে বেরোইনি।
তা বেরোইনি, তবে পানিতে আছি।
আমার বিশ্বাস, সাগরে চলাচলের ক্ষেত্রে সত্যিকার শিক্ষক আছে দুজন-একটা সাগর, আরেকটা জলযান।
তুমি আকাশের কথা ভুলে যাচ্ছ।
হ্যাঁ, অবশ্যই, আকাশও। বাতাস। মেঘ। আকাশ। হ্যাঁ, আকাশ।
গোটা জাহাজ, একটা ক্যারাভেল, ঘুরে দেখতে পনেরো মিনিটও লাগল না ওদের। খুব বেশি হাঁটার সুযোগ নেই।
ভারি সুন্দর, মন্তব্য করল লোকটা। কিন্তু এটা চালানোর মতো যথেষ্ট লোকজন আমি যদি যোগাড় করতে না পারি, বাধ্য হয়ে আমাকে আবার রাজার কাছে ফিরে যেতে হবে, বলতে হবে এটা আর আমার দরকার নেই।
একটা সত্যি কথা বলি তোমাকে। এই তুমি প্রথম বাধার সামনে পড়েছ, আর তাতেই হাল ছেড়ে দিতে চাইছ।
প্রথম বাধা ছিলো রাজার জন্যে তিনদিন অপেক্ষা করা, কিন্তু তখন আমি হাল ছাড়িনি।
আমাদের সঙ্গে যেতে আগ্রহ আছে এমন মাঝি-মাল্লা যদি নাই পাই, সেক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই ম্যানেজ করে নেবো।
তুমি পাগল, মাত্র দুজন মানুষ এরকম একটা জাহাজ চালাতে পারে না, তা সে যতই ছোট হোক। আমাকে তো সব সময় জাহাজের হুইল ধরে থাকতে হবে। আর তুমি…তুমি… আমি এমনকি ব্যাখ্যাটা শুরুই করতে পারছি না…
ঠিক আছে, পরে দেখা যাবে। এখন চলো খেতে বসি।
কোয়ার্টার ডেকে উঠল ওরা। লোকটা এখনও প্রতিবাদ করছে, বলছে মাত্র দুজন মানুষ একটা জাহাজ চালাবার কথা ভাবা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। তার সঙ্গিনী খাবারের প্যাকেটটা খুলল। তা থেকে বের হলো রুটি, ছাগলের দুধ দিয়ে তৈরি পনির, কিছু পাকা জলপাই আর এক বোতল ওয়াইন। চাঁদ এখন সাগর থেকে মাত্র এক হাত ওপরে। আশপাশের জাহাজ আর মূল মাস্তুলের ছায়া এসে পৌঁছেছে ওদের পায়ের কাছে।
আমাদের ক্যারাভেল সত্যি খুব সুন্দর, মেয়েটা বলল। তারপরই শুধরে নিলো নিজেকে: আমি বলতে চাইছি তোমার ক্যারাভেল। অনেক দিন পর্যন্ত এটা আমার ক্যারাভেল হবে না। এরকম চিন্তা করা আমার উচিত নয়। তুমি চালাও আর নাই চালাও, এটা তোমার, রাজা এটা তোমাকে দিয়েছেন।
হ্যাঁ, কিন্তু এটা আমি তাঁর কাছে এজন্যে চেয়েছি যাতে অচেনা দ্বীপের খোঁজে রওনা হতে পারি।
কিন্তু এসব কাজ মুহূর্তের মধ্যে হয় না, শুরু করতেও সময় লাগে। আমার দাদু সবসময় বলতেন কেউ যদি সাগরে যেতে চায় তাকে আগে ডাঙায় বসে প্রস্তুতি নিতে হবে, তিনি নিজে এমনকি নাবিকও ছিলেন না।
মাঝি-মাল্লা না থাকলে আমরা রওনা হতে পারব না।
তাই বলেছ তুমি।
এ-ধরনের একটা অভিযানে বেরোতে চাইলে এক হাজার একটা জিনিসের দরকার হবে তোমার, যেহেতু আমরা জানি না এই যাত্রা কোথায় নিয়ে ফেলবে আমাদের।
অবশ্যই। আর তারপর সঠিক মরশুমের অপেক্ষায় থাকতে হবে, অপেক্ষায় থাকতে হবে মনের মতো জোয়ারের জন্যে, তারপর এক সময় জেটিতে ভিড় করবে লোকজন, সবাই তারা আমাদের যাত্রা শুভ হোক বলে প্রার্থনা করবে…
গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।