অচেনা জগত

সবে ১৫ রোজা চলছে। ছাত্রাবাসে আজ থেকে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। সকল ছাত্র খুব তাড়াতাড়ি করে বাড়ী চলে গেলেও আমি ব্যক্তিগত ঝামেলায় ছাত্রাবাস পরিচালককে রাজি করিয়ে আরো কয়েকদিন ছাত্রাবাসে আছি। ঝামেলাটা হয়েছে রাজনীতি নিয়ে। প্রতিপক্ষের সাথে একটু বুঝাপড়া আছে তো, তাই ঠান্ডা মাথায় আমাদের দলের বড়ভাই নতুন প্ল্যান করছে আর আমাদের দলের সবাইকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে বলেছে। এইসব রাজনৈতিক বড়ভাইদের পাল্লায় পড়ে শেষ পর্যন্ত ঈদের আনন্দ মাটি হতে চলল। ঝামেলা শেষ হতে হতে বোধ হয় শবে কদর শেষ হয়ে যাবে। ঝামেলার কারণে বাড়ী যেতে পারছি না এজন্য মন খুবই খারাপ, সেই সাথে দুঃচিন্তায় রাতে ঠিকমত ঘুম আসে না। রাত হয়েছে। রুমে তথা গোটা ছাত্রাবাসে আমি একা। ছাত্রাবাসের কর্তৃপক্ষ সবাই নিজের বাসায় চলে গেছে। খুব ভয় পাচ্ছি তা নয়, দুঃচিন্তায় আছি। রাতে তাই ঘুমাতে পারছি না। অগত্যা ঘুমানোর জন্য পাশের বেডের শফিউলের ব্যক্তিগত ডায়েরিটা পড়তে লাগলাম।

“রাত প্রায় দুইটা। অন্ধকার রুমে একাকী শুয়ে আছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। ইদানিং রাতে ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না। তো একদিন ঘুমানোর আগে গোছল করেছি, এটাই কেল্লা ফতে। রাতে এত ভালো ঘুম হল কিন্তু হঠাৎ কে যেন আমাকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগাতে লাগলো আর বলতে লাগলো, ‘ঐ বেটা উঠ, যা ভাগ এখান থেকে।’ আমি লাফ দিয়ে ওঠলাম। কিন্তু এ আমি কোথায়? এযে লাকসাম রেল স্টেশন! আমার গায়েও দেখছি ছেড়া-ময়লা জামা কাপড়! আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি একটা টোকাই। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু ঐ আনসারের লাঠির গুঁতোয় যে ব্যথা পেয়েছিলাম, তা এখনো অনুভূত হচ্ছে। আচ্ছা এক কাজ করি, আমি ঢাকায় আমার ছাত্রাবাসে চলে যাই। কিন্তু এভাবে টোকাইয়ের বেশে কিভাবে যাব? যাক সে পরে দেখা যাবে। আমি এখন যে জগতে আছি, সে জগতে আমি একটা টোকাই। তাই আমাকে এখন টোকাইয়ের কাজ করতে হবে। দেখি কেমন লাগে।”

“সারাদিন মানুষের দৌড়ানি খেয়ে অনেক কাগজ টোকাইছি। এবার প্লাটফর্মে ঘুমাতে যাব। আজকে রাতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে হবে কিভাবে ঢাকায় যাওয়া যায়। কৌতূহল বশত একটি আয়নায় নিজের টোকাইরূপী চেহারা দেখার ইচ্ছে হল। আমার চেহারা দেখে আমি তো অবাক। এটা কার চেহারা, একে তো আমি জীবনেও দেখিনি। দুনিয়াটা খুব আজব লাগছে। কাল ঘুম থেকে ওঠে যেভাবেই হোক ঢাকায় আমার ছাত্রাবাসে যাব। এরকম ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।”

“ঘুম থেকে যখন উঠলাম তখন মাত্র সকাল হয়েছে। কিন্তু একি, আমি আমার ছাত্রাবাসের সীটে। আরো অদ্ভুত ব্যাপার, পত্রিকায় তারিখ দেখলাম। আমি মাত্র গতকালই গোছল করে ঘুমিয়ে ছিলাম, এবং সে ঘুম মাত্র ভেঙ্গেছে। তাহলে টোকাইয়ের ঘটনাটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু না। ঐ দিন রাতেও গোছল করে ঘুমালাম এবং ঘুম ভাঙ্গলো লাঠির গুঁতোয়। মাত্র একটি ট্রেন এসেছে। আমি এই নতুন জগত সম্পর্কে জানতে ট্রেন থেকে নামা একজন পত্রিকার হকারকে বলি আজ কয় তারিখ। জবাবে সে যেই তারিখের কথা বলে, তা আমার ঢাকার জগতের হিসেবে ভবিষ্যত কাল। এই জগতে এখনো ঈদের পাঁচদিন বাকী। আর ঢাকায় মাত্র রমজান শুরু হল। আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম।”

“হঠাৎ ট্রেন থেকে একটি কফিন নামল। কফিনে একজন ছাত্রের লাশ, ঢাকা থেকে এসেছে। রাজনীতি করতো, প্রতিপক্ষের গুলিতে গতকাল রাতে মারা যায়। লাশের কফিনটি প্লাটফর্মে পড়ে থাকে। কিছু লোক এসে কফিনটি নিয়ে লাশের বাড়ীতে রওনা হয়। আমিও গেলাম লাশ দেখতে। লাশের বাড়ীতে যাওয়া মাত্র দেখলাম, ঘর থেকে আমার রুমমেট মামুনের আব্বা ও আম্মা পাগলের মত ছুটে আসছে। তাহলে কি মামুনের কোন সমস্যা হয়েছে? কফিনের ঢাকনা সরিয়ে যেই না লাশের মুখের কাপড় সরানো হল, আমি শোকে পাথর হয়ে গেলাম। এ যে আমার রুমমেট মামুনের লাশ! তার বুকে গুলি লেগেছে। কিছুতেই নাকি তাকে বাঁচানো গেল না। আমি সারাদিন মামুনের বাড়ীতেই ছিলাম। বাড়ীর মানুষজন দয়া করে আমাকে পেট ভরে খেতে দিল। কিন্তু কেউই জানলো না যে, আমি মামুনের রুমমেট। কারণ এই দ্বিতীয় জগতে আমি একটা টোকাই।”

“ঐ রাতে আমি মামুনের বাড়ী থেকে চলে আসার সময় মামুনদের বাড়ীর পাশ থেকে একটা স্বর্ণের আংটি খুঁজে পাই। আমি কাউকে না বলে আংটিটা আমার পকেটে রাখি। কারণ আংটির কথা বললে সবাই আমাকে চোর ভাববে। ঐ রাতেও আমি স্টেশনে এসে ঘুমাই এবং যথারীতি ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি আমার ছাত্রাবাসে। দূর যতসব আজগুবি স্বপ্ন। হঠাৎ আমি আমার পকেটে ঐ আংটিটি খুঁজে পাই। মামুনকে অবশ্য আংটির কথা বলি নি। তার বাড়িতে গিয়ে আংটি টা ফেরত দেব ভাবছি। ঐ দিন রাতেও গোছল করে ঘুমাতে গেলাম কিন্তু আমি আর আমার স্বপ্নের বা দ্বিতীয় জগতে যেতে পারলাম না। তারপর দিনও কিছু হল না। আমি মামুনকে আংটির কথা ছাড়া সব খুলে বললাম কিন্তু সে হেসে সব উড়িয়ে দিয়ে বলল আমি নাকি তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরাতে এসব গল্প বানাচ্ছি। আমি তাকে আর কিছু বললাম না, শুধু সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। ঈদের ছুটিতে বাড়ীতে যাব। তবে অবশ্যই ঐ নির্দিষ্ট দিনে আংটিটি পকেটে করে লাকসাম রেল স্টেশনে থাকব।”

“আমি ডায়েরিটা পড়া শেষ করলাম। শফিউল ব্যাটা একটা চাপাবাজ এবং আংটি চোর। তবে আমি সাবধানে থাকার চেষ্টা করব। রাজনীতি মানেই রিস্ক। ২৩ রোজার দিন আমাকে শফিউল ফোন করে বলল, ‘মামুন তুই কই?’ যখন বললাম যে আমি ঢাকায়, ও পাগলের মত বলতে লাগল, ‘বন্ধু ঢাকায় থাকলে আর মাত্র একদিন তুই বাচঁবি, তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে আয়।’ আমি কল বন্ধ করে দেই। যত্তোসব ভীতুলোক। একটু পরেই আমার রাজনৈতিক দলের বড়ভাই ফোন দিয়ে বলে, ‘মামুন, কালকে সন্ধ্যায় ধোলাইখালে একটা অপারেশনে যেতে হবে। ভয়ংকর এবং চূড়ান্ত অপারেশন। আমাদেরকে অবশ্যই কঠিন লড়াই করতে হবে। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নাও। আর অপারেশনে যারা যোগ দেবে না, তাদেরকে আমি নিজ হাতে গুলি করব। তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবা।’ মূহূর্তেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। আমি ভয়ে ভয়ে বলি, ‘জ্বী, ঠিক আছে বড়ভাই।’ আমি ভালো করেই জানি বড়ভাইয়ের নির্দেশ অমান্য করলে তিনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবেন আর ‘ভয়ংকর লড়াই’তে অংশ নিলে বেশ ক’জন মারা যাবে নিশ্চিত। এখন বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে। আমি তাড়াতাড়ি ছাত্রাবাস থেকে বের হলাম। বের হয়েই দেখি বড়ভাইয়ের লোক আমাকে নিতে এসেছে। বুঝলাম, মৃত্যুর ছাড়া গতি নাই। বড়ভাইয়ের বাসায় গেলে তিনি আমার হাতে একটা রিভলভার তুলে দেন এবং টুকটাক প্রশিক্ষণ দেন। আমি অন্যমনস্ক হয়ে থাকি। তারপর যা ঘটেছিল তা খুবই মর্মান্তিক। বুকে গুলি লাগে আমার। অচেতন হয়ে যাই। তবে মারা গিয়েছিলাম কিনা জানি না। চেতনা ফিরলে নিজেকে আবিস্কার করি একটা পাগল হিসেবে যে লাকসাম রেল স্টেশনে সারাক্ষণ পাগলামি করে বেড়ায়। তবে অনেক চেষ্টা করেও আমি আমার সেই পুরোনো জগতে যেতে পারি নি। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে সেই মামুন নামধারী আমাকে এবং পরিচিতজনদেরকে আমি বহু চেষ্টা করে কোথাও খুঁজে পাইনি। এমনকি আমার বুকেও কোন গুলির চিহ্ন নেই। হয়তো আমি অতিরিক্ত ভবিষ্যতে চলে এসেছি।”

অবিশ্বাস কিন্তু সত্যি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *