অগ্নী পরীক্ষায় বিজয়ী বীর ইবরাহীম (আঃ)

জন্ম ও কৈশোর

হাজার হাজার বছর আগের কথা। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। নমরূদীয় ইরাকের ঊর নগরীতে জন্ম হয় এক শিশুর। একদিন সেই শিশুটিই হন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ। ওর বাবা আজর ছিলেন বড় একজন ধর্মীয় পুরোহিত। তিনি নিজের হাতে মূর্তি তৈরি করতেন। আর ঐ মূর্তিগুলোকেই সারা দেশের মানুষ দেবতা বলে মানতো। ওদের পূজা উপাসনা করতো। ছেলে জন্ম হওয়ায় বাবা আজর দারূন খুশি। ভাবেন, আমার পরে আমার এই ছেলেই হবে ধর্মীয় পুরোহিত। নিজ হাতে সে দেবতা বানাবে। সে রক্ষা করবে আমার ধর্মীয় ঐতিহ্য। মনের খুশিতে আজর তাঁর পুত্রের নাম রাখেন ইব্রাহিম। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন। তিনি ইব্রাহীমকে দিয়ে মূর্তি ভাংগার পরিকল্পনা করেন। আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইব্রাহিম বড় হতে থাকে। ইব্রাহীমকে তিনি নিজ ভান্ডার থেকে দান করেন অগাধ জ্ঞান, বুদ্ধি আর দূরদৃষ্টি। কারন তিনি তো তাঁকে নবী বানাবেন। তিনি তো তাঁকে এক বিরাট নেতৃত্বের আসনে বসাবেন। তাই ছোট বেলা থেকেই তাঁর জ্ঞান বুদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকে। কিশোর বয়স থেকেই ইব্রাহিম সব কিছু যুক্তি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে থাকেন।

 

চিন্তা করেন ইব্রাহিম

ইব্রাহিম ভাবেন, নিজেদের হাতে মূর্তি বানিয়ে সেগুলোকে খোদা মানা তো বিরাট বোকামি। যারা কারো উপকার করতে পারে না, কারো অপকারও করতে পারে না, তারা খোদা হয় কেমন করে? কেউ যদি ঐ দেবতাগুলির ক্ষতি করতে চায়, তা থেকেও দেবতাগুলি আত্মরক্ষা করতে পারেনা। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর পিতা ও সমাজের লোকেরা বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছে। তিনি তাঁর বাবাকে বলেন-

“বাবা, আপনি কি মূর্তিকে খোদা মানেন? আমিতো দেখছি, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা পরিস্কার ভুলের মধ্যে আছেন।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৭৪)

ইব্রহীম দেখলেন, তাঁর জাতির লোকেরা চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্রেরও পূজা করছে। তারা মনে করলো, এগুলো তো শক্তিশালী দেবতা। কিন্তু এরা যে খোদা হতে পারেনা, তা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। রাত্রি বেলা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ইব্রাহিম বলেন- তোমরা বলছো এ আমার প্রভু, অতঃপর নক্ষত্র যখন ডুবে গেলো, তখন তিনি বলে দিলেন, অস্তমিত হওয়া জিনিসকে আমি পছন্দ করিনা। এরপর উজ্জ্বল চাঁদ উদয় হলো। তিনি বললেন- তবে এই হবে প্রভু, কিন্তু যখন চাঁদও ডুবে গেলো, তিনি তখন বললেন- এতো খোদা হতে পারেনা। আসল প্রভু মহাবিশ্বের মালিক নিজেই যদি আমাকে পথ না দেখান, তবে আমিতো বিপথগামীদের দলভুক্ত হয়ে পড়বো।

অতপর সকাল হলে পুবাকাশে ঝলমল করে সূর্য উঠলো। তবে তো এই হবে খোদা। কারন এতো সবার বড়। তারপর সন্ধ্যায় যখন সূর্য ডুবে গেলো, তখন তিনি তাঁর কওমকে সম্বোধন করে বললেন- তোমরা যাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার অংশীদার ভাবছো, আমি তাঁদের সকলের দিক থেকে মুখ ফেরালাম। আমি সেই মহান প্রভুর নিকট আত্মসমর্পণ করছি, যিনি আসমান আর জমিনকে সৃষ্টি করেছেন। আমি তাঁর সাথে কাউকেও অংশীদার বানাবোনা।

 

শুরু হলো বিবাদ

এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর জাতির লোকেরা তাঁর সাথে বিবাদে লিপ্ত হলো। তিনি তাঁদের বললেন- “তোমরা কি মহান আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে বিতর্ক করছো? তিনি তো সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা যাদেরকে আল্লাহর আংশীদার মানো, আমি ওদের ভয় করিনা। আমি জানি ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।

ইব্রাহিম তাঁর বাবাকে বললেন- “বাবা আপনি কেন সেই সব জিনিসের ইবাদাত করেন? যেগুলো কানে শুনেনা, চোখে দেখেনা এবং আপনার কোন উপকার করতে পারেনা। বাবা আমি সত্য জ্ঞান লাভ করেছি, যা আপনি লাভ করেননি। আমার দেখানো পথে চলুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো। বাবা, কেন আপনি শয়তানের দাসত্ব করছেন? শয়তান তো দয়াময় আল্লাহর অবাধ্য।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪২-৪৪)

জবাবে ইব্রাহীমের পিতা বললেন- “ইব্রাহিম, তুই কি আমার খোদাদের থেকে দূরে সরে গেলি? শোণো, এই পথ থেকে ফেরত না এলে, আমি তোকে পাথর মেরে হত্যা করবো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৬)

 

মূর্তি ভাংগার পালা

কোন কিছুতেই যখন জাতির লোকেরা সত্য গ্রহনে প্রস্তুত হলোনা, তখন ইব্রাহিম একদিন ঘোষণা করলেন- তোমাদের অনুপস্থিতিতে একদিন তোমাদের এই মিথ্যা খোদাদের বিরুদ্ধে একটা চাল চালবো। ইব্রাহীমের কোথায় তারা তেমন একটা গুরুত্ব দিলোনা। একদিন সব লোক এক ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে চলে গেলো। ইব্রাহীমকেও তারা উৎসবে যেতে বলে। ইন্তু অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তিনি গেলেন না। নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি পীড়িত। আমি যাবোনা। সুতরাং তাঁকে রেখেই তারা চলে গেলো। শহর পুরুষ শুন্য হয়ে পড়লো। এই সুযোগে ইব্রাহিম ওদের ঠাকুর ঘরে এলেন। দেখলেন, সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ওদের মূর্তি দেবতাগুলো। ওদের সামনে রয়েছে দামি দামি খাবার জিনিস। ইব্রাহিম ওদের বললেন- “তোমাদের কি হয়েছে? এসব স্বাদের জিনিস খাওনা কেন? কি হলো, কথা বলছোনা কেন? তারপর তিনি মূর্তিগুলোকে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেললেন। কিন্তু ঠাকুর দেবতাটিকে ভাংলেন না। ওকে ওর যায়গায়ই রেখে দিলেন।

উরসব শেষে লোকেরা ফিরে এলো। দেবতাদের অবস্থা দেখে সবার মাথায় হাত। তারা বলাবলি করতে লাগলো- কোন যালিম আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যাবহার করলো? কেউ কেউ বললো – আমরা যুবক ইব্রাহীমকে এদের ব্যাপারে সমালোচনা করতে শুনেছি।

নেতারা গোস্বায় ফেটে পড়লো। বললো – অপরাধীকে ধরে নিয়ে এসো সবার সামনে। ইব্রাহীমকে আনা হলো। তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যাবহার কি তুমি করেছো?” ইব্রাহিম ভাবলেন, ওদের খোদাদের অক্ষমতা প্রমান করার এটাই বড় সুযোগ। তিনি বললেন- নয়তো ওদেরকেই জিজ্ঞেস করুন, কে মেরেছে ওদের? ঐ বড়টাকেই জিজ্ঞেস করুন, সে-ই ভেঙ্গেছে নাকি?

ইব্রাহীমের কথা শুনে তারা লজ্জিত হলো। মনে মনে ভাবলো, আসলে আমরাই তো অন্যায়কারী। তারপর মাথানত করে তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, দেবতাগুলো যে কথা বলতে পারেনা, তাতো তুমি ভালো করেই জানো।’

ইব্রাহিম সবাইকে সম্বোধন করে বললেন – “তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব জিনিসের পূজা উপাসনা করো, যেগুলো তোমাদের ভালোও করতে পারেনা, আবার মন্দও করতে পারেনা? দুঃখ তোমাদের জন্যে, কেন তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এগুলোর ইবাদাত করো? তোমাদের কি একটুও বিবেক বুদ্ধি নেই?” এবার তারা ইব্রাহীমকে ঘিরে ফেললো। চারদিকে হৈ হট্টগোল শুরু করে দিলো। ইব্রাহিম জোর গলায় বললেন – ‘তোমরা কি তোমাদের নিজেদের হাতে বানানো মূর্তির ইবাদাত করবে? অথচ তোমাদেরকে তো সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্‌।’

 

রাজ দরবারে আনা হলো

তারা ইব্রাহীমকে নিয়ে খুব চিন্তায় পড়লো। কী করবে তাঁকে নিয়ে? সে তো দেবতাদের আর কোন মান-ইজ্জতই বাকী রাখলোনা। তারা বিভিন্ন রকম শলা পরামর্শ করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহীমের বিষয়টি তারা রাজ দরবারে তুললো। তাঁদের রাজা ছিলো নমরুদ। নমরূদকে তারা বুঝালো, ইব্রাহীমের ব্যাপারে বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সে আমাদের ধর্মও বিনাশ করবে, আপনার রাজত্বও বিনাশ করবে।

রাজা বললেন- ইব্রাহীমকে আমার কাছে নিয়ে এসো। অতঃপর ইব্রাহীমকে নমরূদের সামনে হাজির করা হলো। নমরূদ তাঁর সাথে কথা বললেন। ইব্রাহিম তাঁকে আল্লাহর দিকে আহবান জানান। কিন্তু নমরূদ ইব্রাহীমের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করলো। বললো- তোমার প্রভু কে?

ইব্রাহিম- আমার প্রভু তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত দান করেন।

নমরূদ- আমিও মানুষকে মারতে পারি, আবার জীবিত রাখতে পারি। (নমরূদ মৃত্যুদন্ড দেউয়া দুজন কয়েদীকে এনে একজনকে হত্যা করলো, আর একজনকে ছেড়ে দিলো।)

ইব্রাহিম- ‘আমার আল্লাহ্‌ সূর্যকে পূর্বদিক থেকে উঠান, তুমি যদি সত্যি সত্যি প্রভু হয়ে থাকো, তবে সূর্যকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও তো দেখি।’ (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ২৫৮)

একথা শুনে রাজা হতভম্ব, হতবাক ও নিরুত্তর হয়ে গেলো। আল্লাহ্‌ তো যালিমদের পথ দেখান না। এভাবে ইব্রাহীমের যুক্তির কাছে রাজা প্রজা সবাই পরাস্থ হলো। ইব্রাহিম যুক্তির মাধ্যমে মূর্তিকে খোদা মানার অসারতা প্রমান করে দিলেন। চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রকে খোদা মানা ভুল প্রমান করে দিলেন। রাজা বাদশাহকে প্রভু মানার ভ্রান্তি স্পষ্ট করে দিলেন। তাঁদের ধর্ম ও সব দেবতাই যে মিথ্যা, সেকথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিলেন। সাথে তিনি তাঁদেরকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানালেন। আল্লাহর পয়গাম তিনি তাঁদের কাছে পৌছে দেন।

 

অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ

কিন্তু তারা কিছুতেই ঈমান আনলো না। বরং নৈতিকভাবে ইব্রাহীমের কাছে পরাজিত হয়ে তারা তাঁর উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। অন্ধ বর্বরতায় মেতে উঠলো তারা। সিদ্ধান্ত নিলো ইব্রাহীমকে হত্যা করার। কিন্তু কিভাবে হত্যা করবে তাঁকে? তারা ফায়সালা করলো বিরাট অগ্নীকুন্ড বানাবে। তারপর তাতে পুড়িয়ে মারবে ইব্রাহীমকে। যে কথা সে কাজ। এক বিরাট অগ্নীকুন্ড বানালো তারা। এটা ছিলো ইব্রাহীমের জন্যে এক বড় পরীক্ষা। আল্লাহও ইব্রাহিমকে বাজিয়ে নিতে চাইলেন। তিনি দেখতে চাইলেন ইব্রাহিম কি জীবন বাঁচানোর জন্যে ঈমান ত্যাগ করে, নাকি ঈমান বাঁচানোর জন্যে জীবন কুরবানী করে? কিন্তু ইব্রাহিম তো অগ্নী পরীক্ষার বিজয়ী বীর। তিনি তো জীবন বাঁচানোর জন্যে কিছুতেই আল্লাহকে এবং আল্লাহর দ্বীনকে ত্যাগ করতে পারেননা। তিনি তো আল্লাহ্‌ এবং আল্লাহর দ্বীনকে জীবনের চাইতে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসেন। কাফিররা তাঁকে অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ করার জন্যে নিয়ে এলো। তিনি তাঁদের কাছে নতো হননি। জীবন ভিক্ষা চাননি। জীবন বাঁচানোর জন্যে নিজের দীন এবং ঈমান ত্যাগ করেননি। তাঁর তেজোদীপ্ত ঈমান তাঁকে বলে দিলো- ইব্রাহিম, জীবন মৃত্যুর মালিক তো তোমার মহান প্রভু আল্লাহ্‌। তাঁর ঈমান তাঁকে বলে দেয়, আল্লাহ্‌ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে না চান, তবে গোটা পৃথিবী এক হয়েও তা থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবেনা।

নিশ্চিত মনে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি অগ্নীকুন্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষেপ করলো নিজেদের তৈরি করা নরকে। আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের প্রতি পরম খুশি হয়ে আগুনকে বলে দিলেন- “হে আগুন, ইব্রাহীমের প্রতি সুশীতল এবং শান্তিময় হয়ে যাও।”

আগুনের কি সাধ্য আছে সৃষ্টিকর্তার হুকুম অমান্য করার?

সুতরাং অগ্নীকুন্ডে ইব্রাহিম সম্পূর্ণ নিরাপদ থেকে গেলেন। আগুন তাঁর কোনই ক্ষতি করলোনা। বরং আল্লাহর হুকুমে সে ইব্রাহীমের সেবায় নিয়োজিত হলো। ইব্রাহীমের জাতি আবার তাঁর কাছে পরাজিত হলো। ইব্রাহিম আবার তাঁদের কাছে প্রমান করে দিলেন, তাঁদের দেবতারা নিজেদের রক্ষা করতেই অক্ষম। আর তিনি যে মহান প্রভুর প্রতি তাঁদের ডাকছেন, তিনি যে কোন ক্ষতি থেকে বান্দাদের রক্ষা করতে সক্ষম। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনিই একমাত্র সত্তা যার হুকুম পালন করা উচিত। যার ইবাদাত উপাসনা করা উচিত।

 

হিজরত করেন ইব্রাহিম

অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পেয়ে ইব্রাহিম আল্লাহর পথে আসার জন্যে তাঁদেরকে অনেক বুঝান। কিন্তু তারা কিছুতেই নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভুল পথ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। বরং ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে। ইব্রাহিম দেখলেন, এ মানুষগুলোর আর হিদায়াতের পথে আসার সম্ভাবনা নেই। তখন তিনি আল্লাহর হুকুমে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে রওয়ানা করলেন। সাথে ছিলেন স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লূত। জাতির লোকদের মধ্যে কেবল ভাতিজা লুতই ঈমান এনেছিলেন। প্রিয় জন্মভূমি থেকে হিজরত করেন ইব্রাহিম। এবার তিনি উন্মুক্ত বিশ্বে দাওয়াতী কাজ বিস্তার করা শুরু করেন। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে ডাকতে তিনি সিরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে চলে যান ফিলিস্তিন এলাকায়। আল্লাহর বার্তা বইয়ে নিয়ে যান তিনি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। দীর্ঘ পথের ভ্রমন, মানুষের বিরোধিতা, অত্যাচার নির্যাতন আর হাজারো রকমের কষ্ট তাঁকে ক্লান্ত করতে পারেনি। তিনি মানুষকে দাওয়াত দিয়েই চলেছেন।

এবার তিনি ফিলিস্তি থেকে যাত্রা শুরু করেন মিশরের দিকে। কেবল মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর জন্যেই এ মহামানব ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। পাড়ি দেন মরু-প্রান্তর, সমুদ্র পাথার। এসব কিছুই করেন তিনি তাঁর মহান প্রভু দয়াময় আল্লাহকে খুশি করার জন্যে। তাইতো জন্মভূমি ত্যাগের সময় প্রশান্ত দীল ইব্রাহিম বলেছিলেন-

“আমি আমার প্রভুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ৯৯)

মিশরে এসে তিনি এখানকার মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকেন আল্লাহর দিকে। সাথে তাঁর স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লুত। মিশরে এসে দেখেন এখানকার বাদশাহ বড়ই স্বৈরাচারী-যালিম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদশাহ হজরত ইব্রাহিম আর তাঁর স্ত্রীর আল্লাহ ভক্তিতে মুগ্ধ হন এবং ইব্রাহিম ও সারাহর সেবা করার জন্যে নিজ কন্যা হাজেরাকে ইব্রাহীমের নিকট বিয়ে দেন। ইব্রাহীমকে অনেক ধন-দৌলত প্রদান করেন।

 

আবার ফিলিস্তিনে

মিশর থেকে ইব্রাহিম (আঃ) আবার ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এবার ফিলিস্তিনকেই তিনি তাঁর দাওয়াতী কাজের মূল কেন্দ্র বানান। ভাতিজা লুতকে জর্ডান এলাকায় নিজের প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। আল্লাহ তায়ালা তাকেও নবুয়ত দান করেন।

ইব্রাহীমের মনে বড় দুঃখ, তিনি বৃদ্ধ বয়সে এসে উপনীত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর কোন সন্তানাদী নেই। স্ত্রী সারাহ ছিলেন একজন বন্ধ্যা মহিলা। তাঁর কোন সন্তানাদী হতো না। ইব্রাহিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেন-

“হে প্রভু, আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো।”(সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০০)

পরম দয়াময় আল্লাহ্‌ তাঁর দোয়া কবুল করেন। স্ত্রী হাজেরার ঘরে তাঁর এক সুন্দর ফুটফুটে ছেলের জন্ম হয়। তিনি পুত্রের নাম রাখেন ইসমাঈল। বৃদ্ধ বয়সে শিশু পুত্রের হাসিতে তাঁর মন ভরে উঠে। কিন্তু এই পুত্রের ভালবাসা নিয়েও আল্লাহ্‌ তাঁকে পরীক্ষায় ফেলেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে বাজিয়ে দেখতে চান, তিনি পুত্রের ভালবাসার চেয়ে আল্লাহর হুকুম পালন করাকে বড় জানেন কী-না? ঈশমাঈলকে মক্কায় রেখে আসার নির্দেশ

এবার আল্লাহ্‌ ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে মক্কার জনমানব ও ফল পানি শস্যহীন মরুভূমিতে রেখে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইব্রাহিম যে, আল্লাহকে সবার চেয়ে বেশী ভালবাসেন। তিনি যে জানেন, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা যায়না। তাইতো তিনি হাজেরা আর শিশু পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হন। আল্লাহর ইংগীতে তিনি তাঁদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আবার ফিলিস্তিন অভিমুখে রওয়ানা করেন। হাজেরাকে বলে যান, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাদেরকে এখানে রেখে গেলাম। হাজেরাকে কিছু খাদ্য ও এক মশক পানি দিয়ে আসেন। প্রশান্ত সমুদ্রের মতো প্রশস্ত হৃদয় আর হিমালয়ের মতো অটল ধৈর্যশীল ইব্রাহিম আল্লাহ্‌ প্রদত্ত পরীক্ষায় বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে।

আল্লাহর দীনের দাওয়াত নিয়ে ইব্রাহিম ঘুরে বেড়ান ফিলিস্তিন, জর্ডান আর হিজাযের বিভিন্ন এলাকায়। একাজ করাই তাঁর মূল দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের ফাকা ফাকে তিনি মক্কায় যান। স্ত্রী পুত্রকে দেখে আসেন। হাটি হাটি পা পা করে ছেলে বড় হয়ে ওঠে। সাথে সাথে ছেলের প্রতি ইব্রাহীমের মহব্বতও উপচে উঠে। ফলে আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে আবার বাজিয়ে নিতে চান।

 

পুত্র কুরবানীর হুকুম

ইসমাঈলের এখন বুঝ বুদ্ধি হয়েছে। ইব্রাহীমের সাথে এখন পুত্র ইসমাঈল ঘরে বাইরে যাতায়াত করেন। পিতা যদি বৃদ্ধ বয়সে উদীয়মান কিশোর পুত্রকে নিজের সাহায্যকারী হিসেবে পান, তবে তাঁর প্রতি যে পিতার মহব্বত কতটা বেড়ে যায়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। ঠিক এমনই এক সময়ে আল্লাহ্‌ পাক ইব্রাহীমকে স্বপ্নে ইসমাঈলকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করেন। বলে দেন, ‘ইব্রাহিম, তোমার প্রিয়তম পুত্রকে কুরবানী করো।’ আল্লাহর হুকুম লংঘন করা যায়না। তাঁর হুকুম পালন করা অবধারিত।

পুত্রের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন ইব্রাহীমকে আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারেনা। তিনি পুত্রকে ডেকে নিয়ে জানালেন- ‘পুত্রয়ামার, আল্লাহ্‌ আমাকে স্বপ্নে হুকুম করেছেন তোমাকে কুরবানী করার জন্যে। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? ’

‘যেমন বাপ, তেমন ছেলে।’ উর্দু ভাষায় বলা হয় ‘বাপকা বেটা’।   আর আরবী ভাষায় বলা হয় ‘হওয়া ইবনু আবিহী’। কথাটি যেন ইসমাঈলের জন্যে একশো পারসেন্ট প্রযোজ্য। আল্লাহর হুকুমের কাছে তিনি পিতার মতই নুইয়ে দিলেন মাথা। বললেন- ‘আব্বু, আল্লাহর হুকুম কার্যকর করুন। ইনশা’য়াল্লাহ আপনি আমাকে অটল ধৈর্যশীল পাবেন।’ দয়া ও করুনার সাগর মহান আল্লাহ্‌ তো তাঁদের পিতা পুত্র দু’জনের কথা শুনছিলেন। এসময় তাঁদের প্রতি যে তাঁর মহব্বত ও রহমতের স্রোতধারা কিভাবে বইয়ে আসছিলো তা একমাত্র তিনিই জানেন। প্রভু রহমান এ সময়টির কথা নিজ ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেন-

“ওরা দু’জনেই যখন আমার হুকুমের কাছে মাথা নত করে দিলো আর ইব্রাহিম পুত্রকে (জবাই করার জন্য) উপুড় করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাঁকে ডাক দিয়ে বললাম, ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নে দেখা তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিনত করে দেখালে পুণ্যবানদের এভাবেই আমি প্রতিফল দান করি। এটা ছিলো একটা বিরাট পরীক্ষা। অতঃপর একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি তাঁর পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর পরবর্তী লোকদের মাঝে একথা স্থায়ী করে দিলাম যে, ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০৩-১০৯)

ব্যাপারতো বুঝতেই পেরেছেন। বাপ ছেলে দুজনই আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন। ইব্রাহিম পুত্রকে কুরবানী করার জন্যে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। চোখ বন্ধ করে পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। ঠিক এমনই সময় তাঁর প্রিয়তম প্রভু ডাক দিয়ে বললেন- ইব্রাহিম থামো, তুমি আমার হুকুম পালন করেছো বলে প্রমান দিয়েছ। ইব্রাহিম চোখ খুলে দেখলেন সামনে একটি দুম্বা দাড়িয়ে আছে। আল্লাহ্‌ বলে দিলেন পুত্রের পরিবর্তে এবার এই দুম্বাটিকে কুরবানী করে দাও। আর তোমার এই কুরবানী হবে বিরাট এক ঐতিহাসিক কুরবানী।

এবার ইব্রাহিম দুম্বাটিকে যবেহ করে দিলেন। প্রিয় পুত্রকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের ঐ বিরাট কুরবানীকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মুসলিমদের মাঝে প্রতি বছর কুরবানী করার নিয়ম চালু করে দিলেন। আজো আমরা ইব্রাহিম (আঃ) এর সেই মহান কুরবানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ঐ তারিখে পশু কুরবানী করি। এভাবেই আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে বানিয়েছেন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ।

এই চরম পরীক্ষাটিতেও ইব্রাহিম যখন উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ্‌ একদিকে তাঁকে নিজের খলিল বা বন্ধু বানিয়ে নিলেন। আল কুরআনে তাঁর নেতৃত্বের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে –

“স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন ইব্রাহীমকে তাঁর প্রভু বেশ কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন আর সব ক’টিতেই সে উত্তীর্ণ হলো, তখন তিনি তাঁকে বললেন- আমি তোমাকে সন মানুষের নেতা বানাতে চাই। ইব্রাহিম জানতে চাইলো- এই প্রতিশ্রুতি কি আমার সন্তানদের ব্যাপারেও প্রযোজ্য হবে? তিনি বললেন- আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবেনা। (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৪)

এটাই আল্লাহর নীতি। তিনি কাউকেও বড় কোন দায়িত্ব ও নেতৃত্ব দিতে চাইলে তাঁকে ভালোভাবে বাজিয়ে নেন। সব পরীক্ষায় বিজয়ী হওয়ার পরে তিনি ইব্রাহীমকে শুধু নেতৃত্বই দেননি, সেই সাথে বৃদ্ধ বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহর ঘরেও একটি পুত্র সন্তান দান করেন। তাঁর নাম ইসহাক। শুধু তাই নয় মহান আল্লাহ্‌ তাঁর দুই ছেলেকেই নবী মনোনীত করেন।

 

আল্লাহর কুদরত দর্শন

ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রতি আল্লাহর এতো বড় অনুগ্রহের কারন কি? তা হলো, আল্লাহর প্রতি তাঁর পরম আস্থা ও প্রত্যয়। মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সে কারনেই তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয় আল্লাহর প্রতি মজবুত ও অটল প্রত্যয়। আল্লাহর প্রতি নিজের পরম আস্থাকে আরো মজবুত করে নেবার জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে একটা আবদার করেন। সে আবদারটি কুরআনের বর্ণনায় শুনুন-

“সে ঘটনাটি স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম বলেছিল, আমার প্রভু, তুমি কেমন করে মৃত্যুকে জীবিত করো আমাকে একটু চোখের সামনে দেখিয়ে দাও। তিনি বললেন- তুমি কি তা বিশ্বাস করোনা? ইব্রাহিম বললো- অবশ্যি বিশ্বাস করি, তবে আমার মনের সান্ত্বনার জন্যে নিজের চোখে দেখতে চাই। তিনি বললেন- তবে তুমি চারটি পাখি ধরো। সেগুলোকে নিজের কাছে ভালোভাবে পোষ মানিয়ে নাও। তারপর সেগুলিকে (যবাই করে) সেগুলোর একেকটি অংশ একেক পাহাড়ে রেঝে এসো। অতঃপর তুমি ওদের ডাকো। দেখবে ওরা তোমার কাছে দৌড়ে আসবে। জেনে রাখো, আল্লাহ্‌ বড় ক্ষমতাশীল মহাবিজ্ঞানী।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ২৬০)

কুরআনের বিবরন থেকে ঘটনাটি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। ইব্রাহিম পাখিগুলোকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন পাহাড়ে রেখে এসে ওদেরকে ডাক দেন। সাথে সাথে ওরা জীবিত হয়ে ইব্রাহীমের কাছে উড়ে আসে। আল্লাহ্‌ তাঁকে চাক্ষুস দেখিয়ে দিলেন, তিনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করতে পারেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ কিয়ামতের দিন সব মানুষকে জীবিত করবেন এবং সবাই হাশরের ময়দানে দৌড়ে এসে একত্রিত হবে। বিষয়টি ইব্রাহিম স্বচক্ষে দেখে পরম প্রত্যয় ও প্রশান্তি লাভ করেন।

 

কা’বা ঘর নির্মাণ

এবার আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয় ইব্রাহীমকে আরেকটি বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তাঁকে কা’বা ঘর নির্মাণের নির্দেশ প্রদান করেন। কোন জায়গাটিতে কা’বা ঘর নির্মাণ করতে হবে, তাও তিনি বলে দেন। সেই জায়গাটি তো এখন আমাদের সকলেরই জানা। কা’বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে। এটিতো সেই জায়গা যেখানে তিনি রেখে এসেছিলেন শিশু পুত্র ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে। এটি তো সেই স্থান, যার পাশে মিনাতেই কুরবানী করতে গিয়েছিলেন প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে। আল্লাহর নির্দেশে পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে নিপুন কারিগরের মতো কা’বার ভীত উঠালেন। তারপর নির্মাণ সম্পন্ন করলেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘরের। এ সময় দু’জনেই দয়াময় রহমানের দরবারে দোয়া করলেন-

“আমাদের প্রভু, তুমি আমাদের এই কাজ কবুল করো। তুমিতো সবই শোন এবং সবই জানো। প্রভু, আমাদেরকে তোমার অনুগত রাখো। আমাদের বংশ থেকে তোমার অনুগত একটি উম্মত সৃষ্টি করে দাও। তোমার হুকুম পালন করার নিয়ম আমাদের জানিয়ে দাও। আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তুমি তো মহাক্ষমাশীল দয়াবান। আমাদের প্রভু, এদের মধ্য থেকেই এদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিয়ো—-।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৮-১২৯)

মহান আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের তৈরি ঘরকে নিজের ঘর বলে ঘোষণা দিলেন। এ ঘরকে তিনি চিরদিন বাঁচিয়ে রাখলেন। তিনি ইব্রাহীমকে বলে দিলেন-

“এই ঘরে হজ্জ পালন করার জন্যে মানুষকে সাধারনভাবে অনুমতি দিয়ে দাও। মানুষ বহু দূর দুরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে উটে চড়ে তোমার কাছে আসবে। —এই প্রাচীনতম ঘরের তাওয়াফ করবে।” (সূরা আল হাজ্জ আয়াত ২৭-২৯)

এভাবে মহান আল্লাহ্‌ ইব্রাহিম (আঃ) এর কীর্তিসমূহকে চির স্মরণীয় করে রাখলেন। তাঁর নির্মাণ করা ঘরকে কেন্দ্র করে হজ্জ, তাওয়াফ ও কুরবানীর নিয়ম চিরস্থায়ী করে দিলেন। এই মহান ঘর ও ঘরের কাছে রেখে যাওয়া নিজ পরিবারের জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন-

“প্রভু, এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানাও। আমার প্রভু, আমার সন্তানদের একটি অংশকে তোমার এই মহাসম্মানিত ঘরের কাছে এনে পুনর্বাসিত করেছি। এটাতো পানি ও তরুলতাশুন্য এক মরু প্রান্তর। প্রভু, ওদের এখানে রেখেছি যেন, এরা সালাত কায়েম করে। সুতরাং তুমি ওদের প্রতি মানুষের মনকে অনুরক্ত বানিয়ে দাও। শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দুটি সন্তান ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। প্রভু, আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে সালাত কায়েমকারী বানাও।” (সূরা ১৪ ইব্রাহিমঃ আয়াত ৩৫-৪০)

 

কুরআনে হজরত ইবরাহীমের প্রশংসনীয় গুনাবলী

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর কিতাব আল কুরআনে ইব্রাহিম (আঃ) এর গুনবৈশিষ্টের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এখানে আমরা কয়েকটি উল্লেখ করলাম-

১। “পৃথিবীর কাজের জন্যে আমি ইব্রাহীমকে বাছাই করেছিলাম।”

২। “তাঁর প্রভু যখন বললেন- ‘আত্মসমর্পণ করো’। সে বললো- ‘সারা জাহানের প্রভুর নিকট আমি আত্মসমর্পণ করলাম।’’

৩। “সে বললো- পুত্র আমার, মৃত্যু পর্যন্ত আলালহর কাছে আত্মসমর্পিত থাকো।”

৪। “তোমরা খাটিভাবে ইবরাহীমের পথ অনুসরন করো।”

৫। “আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে তাঁর বন্ধু বানিয়েছেন।”

৬। “আমি ইব্রাহীমকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়েছি।”

৭। “সে বললো- আমি আসমান ও যমীনের স্রষ্টার দিকে মুখ ফিরালাম।”

৮। “ইব্রাহিম ছিলো বড়ই ধৈর্যশীল কোমল হৃদয় ও আমার প্রতি অনুরক্ত।”

৯। “ইব্রাহিম নিজেই ছিলো একটি উম্মাহ। সে একমুখী হয়ে আল্লাহর অনুগত ছিল।”

১০। “আল্লাহর অনুগ্রহরাজির প্রতি সে ছিলো শোকরগুজার। তিনি তাঁকে পছন্দ করেছেন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।”

১১। “ইব্রাহিম ছিলো এক অতি সত্যবাদী মানুষ এবং নবী। ”

১২। “ইব্রাহীমকে আমি সতর্কবুদ্ধি ও জ্ঞান দান করেছি।”

১৩।“আমি বললাম- হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের প্রতি সুশীতল, শান্তিময় ও নিরাপদ হয়ে যাও।”

১৪। “আমি ডেকে বললাম- হে ইব্রাহিম, তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিনত করেছো।”

১৫। “তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে ইবরাহীমের মধ্যে—–।”

জেনে নিন

এবার কয়েকটি তথ্য জেনে নিন। সেগুলো হলো- কুরআন মাজীদে ইবরাহীমের নাম উচ্চারিত হয়েছে ৬৯ বার। যেসব সুরাতে ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে- সূরা আল বাকারা, আন নিসা, আন-আম, তাওবা, হুদ, ইব্রাহিম, হিজর, আন নাহল, মরিয়ম, আম্বিয়া, আল হাজ্জ, শোয়ারা, আন কাবুত, সাফফাত, যুখরুফ, যারিয়াত, মুমতাহিনা।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!