নিলয় আর নেহাল স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিলো। পেছন থেকে কে যেন ডাকলো-‘এই শোন।’ ওরা পেছন ফিরে চমকে উঠলো ভীষণভাবে। অদ্ভূত চেহারার দু’জন লোক দাঁড়িয়ে। দু’জনই লম্বায় প্রায় ছয় ফুট।
লিকলিকে গড়ন। পরনে ঢিলেঢালা পোশাক। ওরা দৌড়ে পালাবে কিনা ভাবছিলো। লোক দু’টি লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের কাছে চলে এলো। কাছ থেকে দেখে তো ওদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া। এমন অদ্ভূত চেহারার মানুষ হয়? তামাটে গায়ের রঙ। গায়ে মরা খসখসে চামড়া। মনে হয় আঙুল দিয়ে ঘষা দিলে পেয়াজের খোসার মতো উঠে যাবে। ঠোঁট জোড়া অতিশয় চিকন। রক্তের মতো লাল। চোখের পাপড়ি নেই। মণি তো নয়, যেন চোখের ভেতর দু’টি সবুজ পাথর বসানো। মুখে যে দাঁড়ি-গোঁফ ওঠেনি কখনো, তা বোঝা যায়। মাথায় নেই কোনো চুল। মাথাকে মনে হয়, একটা তামার হাঁড়ি উপুড় করে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
নিলয় পাখির ছানার মতো চিঁচিঁ করে বললো-‘আমাদের ডেকেছেন?’
তাদের একজন বললো-‘হ্যাঁ তোমাদেরকে। তোমরা কি এই স্কুলে পড়?’
– ‘জ্বি।’
– ‘কোন ক্লাসে পড় তোমরা?’
– ‘আমরা দু’জনেই ক্লাস সেভেনে পড়ি।’
– ‘আমরা তোমাদের কাছে কিছু সাহায্য চাই।’
– ‘সাহায্য! আমরা আপনাদের কী সাহায্য করবো?’
– ‘চলো, নিরিবিলি কোথাও বসি। সেখানে সব বলবো।’
তাদের উদ্দেশ্য যে ভালো না, তা নিলয় আর নেহাল দু’জনেই বুঝে ফেললো। নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে নিশ্চয়ই ওদের কোনো বিপদে ফেলবে। নেহাল বললো- ‘আপনাদের সঙ্গে আমরা কোনো নিরিবিলি জায়গায় যাবো না। যা বলার এখানেই বলেন।’
ওদের অন্যজন বললো- ‘তোমরা ভয় পেয়ো না। জানি, তোমাদের কাছে আমাদেরকে দেখতে খুব অদ্ভূত লাগছে। কিন্তু আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না। অন্যের ক্ষতি করা আমাদের নীতিতে নেই। আমরা তোমাদের সাহায্য চাচ্ছি। তোমরা যদি আমাদেরকে সাহায্য কর, আমরা তোমাদেরকে উপহার দেব।’
নিলয় একটু অন্যরকম। রহস্য উদঘাটনের নেশা ওর ভেতর। ও বললো- ‘চলুন, আপনাদের সঙ্গে কথা বলবো।’
স্কুলের মাঠের পাশে বড় একটা আমগাছ অনেকটা জায়গা ছায়া করে রেখেছে। ওরা সেখানে গিয়ে বসলো। জায়গাটা নিরিবিলি আবার নিরাপদও। মাঠের ওপরে স্কুলের দপ্তরি রহমত আলী আর নাইটগার্ড বদির বাসা। যদি কোনো বিপদ হয় তো চিৎকার দিলেই তারা শুনতে পাবে। তখনই ছুটে আসতে পারবে। আমগাছের ছায়ায় বসে নিলয় বললো ‘বলেন, আমরা আপনাদের কী উপকার করতে পারি।’
তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি লিকলিকে যে, সে বললো-‘আমরা দু’জন সিনেমার ডিরেক্টর। খুব নামকরা ডিরেক্টর।’
– ‘আপনাদের নাম কী?’
– ‘আমার নাম অক্স। আর ওর নাম বুল।’ নিলয় আর নেহাল হাসি চাপতে নাক চেপে ধরলো। ষাঁড় আর বলদ নামে এদেশে কোনো সিনেমা ডিরেক্টর নেই। ওরা নিশ্চিত হলো, সত্যি এদের কোনো খারাপ ধান্দা আছে।
অক্স বললো ‘আমরা এলিয়েনদের ওপর সিনেমা বানাবো বলে ঠিক করেছি। কোনো কল্পনার ওপর ভিত্তি করে নয়, বাস্তবে এলিয়েনদের প্রত্যক্ষ করে, তাদের জীবন-যাত্রা সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা নিয়ে তারপর সিনেমা বানাতে চাই। তাই তো আমরা তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
– ‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমরা এলিয়েন?’
– ‘হ্যাঁ।’
নেহাল তখন রাগে ফসফস করছিল। বললো- ‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আমরা অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছি?’
– ‘না, তা মনে হবে কেন?’
– ‘তাহলে আমরা এলিয়েন হলাম কিভাবে?’
– ‘তোমদের কাছে আমরা এলিয়েন, আবার আমাদের কাছে তোমরা এলিয়েন।’
– ‘বুঝলাম না কিছু।’
– ‘মানে আমাদের গ্রহের মানুষ তোমাদেরকে এলিয়েন বলে।’
– ‘আপনারা কি অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন?’
– ‘হ্যাঁ, আমরা এসেছি অ্যাপেক্সিয়ান গ্রহ থেকে।’
– ‘অ্যাপেক্সিয়ান!’
ওরা সত্যিই একটু ঘোরের মধ্যে চলে গেল। নেহাল বললো-‘বলুন, আপনাদের সিনেমা তৈরির জন্য আমরা কী সাহায্য করতে পারি।’ অক্স বললো- ‘তোমরা আমাদেরকে তোমাদের রাজধানী শহরটা ঘুরে দেখাবে।’
– ‘একটা রাজধানী শহর দেখে আপনারা এলিয়েনদের ওপর বাস্তব অভিজ্ঞতা পাবেন না। এই পৃথিবীতে অনেক-অনেক রাজধানী আছে।’
– ‘আমরা গোটা পৃথিবীর সবগুলো রাজধানী শহরই দেখবো। তোমাদেরটা দিয়ে শুরু করতে চাচ্ছি।’
– ‘এসব ঘোরাফেরার জন্য তো টাকার দরকার। আমাদের কাছে বিশেষ টাকা-পয়সা থাকে না।’
– ‘সে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আমরা আসার সময় আমাদের ওখান থেকে যথেষ্ট মুদ্রা নিয়ে এসেছি।’
– ‘অন্য গ্রহের মুদ্রা আমাদের এখানে চলবে না। আমাদের এখানে টাকা, ডলার, পাউন্ড, রুপি, মার্ক, ইউরো এই জাতীয় কোনো মুদ্রা লাগবে।’
– ‘আমরাও তাই ভেবেছিলাম। পরে দেখলাম তোমাদের এখানে আমাদের মুদ্রার অনেক দাম। একটা বিক্রি করলে যে টাকা পওয়া যায় তা দিয়ে অনেক দিন চলা যায়।’
– ‘আপনাদের মুদ্রা আমাদের এখানে বিক্রি করা যায়?’
– ‘সত্যি বলছি। আমরা একটা মুদ্রা বিক্রি করেছিলাম। তাতে যে টাকা পেয়েছি তা অনেক।’
– ‘দেখি আপনাদের মুদ্রা।’
অক্স তার ঢোলা জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে নানা সাইজের অনেকগুলো মার্বেল বের করলো। মার্বেলগুলোর রঙ সোনালি। নেহাল আর নিলয় মার্বেলগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো। সেগুলো যে কাঁচের তা মনে হলো না।
নিলয় বললো- ‘এগুলি আপনাদের মুদ্রা?’
অক্স বললো- ‘হ্যাঁ। সাইজের ওপর এগুলোর মূল্য নির্ভর করে। এখানে এসে দেখি তোমরা এগুলো সোনা বা স্বর্ণ বলো। তোমাদের এখানে এগুলোর অনেক দাম। নাও তোমাদের দু’জনকে দু’টো করে দিলাম।’
তারপর অক্স পকেট থেকে বের করলো এক বান্ডিল পাঁচশ’ টাকার নোট। বললো-‘একটা বড় মুদ্রা বিক্রি করে এগুলো পেলাম।’
নিলয় আর নেহাল মনে মনে খুব উত্তেজনা বোধ করছিল। সত্যিই খুব অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার ঘটছে। নেহাল বললো-‘আপনারা আমাদের ভাষা শিখলেন কীভাবে?’
বুল পকেট থেকে ছোট একটা ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্র বের করলো। বললো- ‘আমাদের এই সুপার কম্পিউটার যে কোনো ভাষার বর্ণমালা আমাদের ভাষায় অনুবাদ করতে পারে। আমরা খুব অল্প সময়েই তোমাদের ভাষা শিখে নিয়েছি।’
– ‘বাহ! আপনাদের মেধা অসাধারণ। তো আজ আমরা আপনাদের নিয়ে বের হতে পারবো না। কাল আমাদের স্কুল বন্ধ। কাল সকাল ঠিক দশটায় আপনারা এখানে আসবেন। আমরা আপনাদের নিয়ে বের হবো। আর শুনুন, এই টাকা আর আপনাদের মুদ্রা যেখানে-সেখানে, যার-তার কাছে বের করবেন না। তাহলে বিপদে পড়বেন।’
বুল বিস্মিত কন্ঠে বললো- ‘কেন, বিপদে পড়বো কেন?’
– ‘যা বললাম তাই করবেন। কেন বিপদে পড়বেন, কিছু দিন পর তা আপনারাই বুঝতে পারবেন।’
পথে হাঁটতে হাঁটতে নিলয় বললো- ‘তোর কি মনে হয় ওরা সত্যি এলিয়েন? আজকাল মানুষ বিভিন্নভাবে অপরাধ করছে। ওরা হয়তো এলিয়েনের বেশ ধরে অপরাধের ধান্ধা করছে।’
– ‘কিন্তু মানুষের এরকম চেহারা হয়?’
– ‘আরে মেকআপ করে চেহারা পাল্টানো যায়। নাটক-সিনেমায় দেখিস না?’
– ‘ওরা যে আমাদের চারটে সোনালী রঙের মার্বেল দিয়ে বললো এগুলো সোনা- এর মাধ্যমে ওদের পরিচয় বের করা যায়।’
– ‘কীভাবে?’
– ‘যদি এগুলো সত্যিই সোনা হয়, তাহলে বুঝবো ওরা এলিয়েন। মানুষ কখনো কাউকে এতোখানি সোনা এমনি এমনি দেবে না।’
– ‘তুই কথাটা ঠিক বলেছিস।’
– ‘আমাদের পরিচিত একটা স্বর্ণের দোকান আছে। আমার মা সেখান থেকে স্বর্ণ কেনা-কাটা করে। আমি মায়ের সঙ্গে অনেকবার সেখানে গিয়েছি। আমাকে তারা চেনে। সেখানে গিয়ে একটা মার্বেল দেখাই; দেখি তারা কী বলে।’
– ‘সেটাই ভালো হবে।’
বাসায় না গিয়ে ওরা সেই স্বর্ণের দোকানে গেল। দোকানের মালিক নেহালকে দেখেই বললো- ‘কী মনে করে আঙ্কেল? তোমার আম্মু এসেছেন?’
– ‘না আঙ্কেল, আমি একাই এসেছি।’
– ‘কেন?’
– ‘আমি আমাদের স্কুলের মাঠে একটা সোনালী রঙের মার্বেল কুড়িয়ে পেয়েছি। আমি জানতে চাচ্ছি সেটা সত্যিই সোনা কিনা।’
– ‘ধুর! সোনার মার্বেল স্কুলের মাঠে পড়ে থাকবে? তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? যাও, বাসায় যাও।’
– ‘তবু একটু দেখেন আঙ্কেল।’
– ‘দাও দেখি।’
নেহাল ছোট মার্বেলটা বের করে দিলো তার হাতে। সে মার্বেলটা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো- ‘আঙ্কেল, তুমি তো বিরাট মওকা মেরেছো। ধুম করে কয়েক লাখ টাকার মালিক হয়ে গেছো। এটা খাঁটি গিনি সোনার মার্বেল। তুমি যদি এটা বিক্রি করতে চাও, আমি এখনই ওজন করে ন্যায্য মূল্য দিয়ে দেব।’
– ‘ধন্যবাদ আঙ্কেল। এখন বিক্রি করবো না।’
– ‘ঠিক আছে, যখন বিক্রি করবে তখন আমার কাছেই এসো কিন্তু।’ অক্স আর বুল যে সত্যিই এলিয়েন, এ ব্যাপারে ওদের আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকলো না।
দশটা বাজার কিছু আগেই নিলয় আর নেহাল গিয়ে পৌঁছুলো স্কুলের মাঠে। ঠিক দশটায় একটা ট্যাক্সি করে এসে পৌঁছুলো অক্স আর বুল। এবার নিলয় আর নেহাল খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ওদের। দেখে অবাক হলো যে, ওদের প্রতি হাতে আঙুল মাত্র তিনটা করে। আঙুলে কোনো নখ নেই- গিঁটও নেই। নেহাল অবশ্য ওদের ব্যাপারে অনেকটা সন্দিহান। বললো- ‘একটা কথা বলতে চাই যদি মনে কিছু না করেন।’
বুল বললো- ‘বলো, কী বলতে চাও।’
– ‘আমাদের পৃথিবীতে একটা সংস্থা আছে নাম নাসা। এই সংস্থার কাজ মহাকাশ নিয়ে গবেষণা। এই সংস্থার বিজ্ঞানীরা ক’দিন আগে বলেছেন, একদিন এলিয়েনরা এই পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলবে। পরিবেশ দূষণের ফলে পৃথিবীতে বেড়ে যাচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ওজন স্তর। অন্য গ্রহ থেকে পৃথিবীকে মনে হয় ক্রমশ স্ফীত একটা বস্তু। এভাবে ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্থ হলে অন্য গ্রহেও এর প্রভাব পড়বে। তখন পৃথিবীতে চলে আসবে এলিয়েনরা। এসে পৃথিবীতে ধ্বংসের তাণ্ডব চালাবে।’
নেহালকে সমর্থন জানিয়ে নিলয় বললো- ‘আমিও দেখেছি খবরটা। পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং নাসার এই মতামতকে সমর্থন করেছেন।’
এ কথা শুনে বুল বললো- ‘তুমি আমাদের ওপর শতভাগ বিশ্বাস রাখতে পার। আমরা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই পৃথিবীতে আসিনি। আমরা শুধুই সিনেমা বানানোর উপকরণ সংগ্রহ করেত এসেছি।’
নিলয় বললো- ‘দেখুন, আমাদের সঙ্গে শহরটা ঘুরে দেখার আগে আপনাদের কিছু কেনাকাটা করতে হবে।’
– ‘কেনাকাটা?’
– ‘হ্যাঁ কেনাকাটা। আপনাদের দু’জনকেই প্রথমে দু’টো কালো সানগ্লাস কিনতে হবে যাতে আপনাদের ওই সবুজ পাথর বসানো চোখ সবাই খেয়াল করতে না পারে। তারপর আপনাদের পিতলের পাতিল সদৃশ মাথা ঢাকার জন্য কিনতে হবে হ্যাট। আর আপনাদের পোশাকেও পরিবর্তন আনতে হবে। এরকম অদ্ভূত পোশাক পরে চলাফেরা করলে মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। হাতের আঙুলগুলো ঢাকার জন্য গ্লাভস পরলে ভালো হয়। কিন্তু এই গরমের মধ্যে গ্লাভস পরা ঠিক হবে না। তাই আপনারা যতোক্ষণ সম্ভব, হাত পকেটে ঢুকিয়ে রাখবেন।’
ওরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ছুটলো নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে বুল আর অক্স নানা প্রশ্ন করছিলো। সব প্রশ্নই নিলয় আর নেহালের জন্য অস্বস্তিকর। যেমন- রাস্তা এতো অপরিস্কার কেন? মানুষের এতো গাদাগাদি কেন? গাড়ির এতো জ্যাম কেন? এতো শব্দ কেন? এতো দুর্গন্ধ কেন? ওদের প্রশ্ন থেকেই নিলয় আর নেহাল বুঝতে পারছিল, আমাদের রাজধানী শহর ওদের ভালো লাগেনি।
হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। বিরাট এক মিছিল আসছে। মিছিলকারিদের হাতে লাঠি-সোটা। অক্স আর বুল এই লাঠি-সোটা দেখে ভয় পাচ্ছিলো। একটু পর বিপরীত দিক থেকে এলো আরেকটা মিছিল। হঠাৎ ধুপধাপ কয়েকটা ককটেল ফাটলো। শুরু হয়ে গেল দুই মিছিলের সংঘর্ষ। গাড়িও ভাঙাভাঙি চললো। গাড়ি ভরে পুলিশ আসতে লাগলো। পুলিশ নেমে বেধড়ক পেটাতে লাগলো মিছিলকারিদের। চারিদিক থেকে ইট-পাটকেল ছুটে আসছে। পুলিশ ছুঁড়লো কাঁদানে গ্যাস। বুল আর অক্স ভয়ে দিশেহারা। ওরা গাড়ির দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে গিয়ে এলোমেলো ছুটতে লাগলো। নিলয় আর নেহাল ওদের ধরে রাখতে পারলো না। ওরা জনতার মাঝে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে।
প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা পর পরিবেশ শান্ত হল। নিলয় আর নেহাল এখানে-সেখানে অক্স আর বুলকে অনেক খুঁজলো। কিন্তু পেল না কোথাও। ওরা ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভয় পেয়ে কোথায় পালিয়েছে, কে জানে। শেষে নিলয় আর নেহাল দুঃখিত মনে বাসায় ফিরলো। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো কোনো নাম্বারও রাখেনি ওরা। নিজেদের কোনো নাম্বারও ওদের দেয়নি। আসলে এমন ঘটনা ঘটবে, তা কি ওরা ভেবেছিলো?
নিলয় আর নেহালের কাছে আছে পাঁচটা-পাঁচটা করে মোট দশটা সোনার মার্বেল। সেগুলোর দাম অনেক। সেগুলো ওরা এখন বিক্রি করতে পারবে না। কারণ অতো টাকা ওরা রাখবে কোথায়? বড়দের জানালে প্রশ্ন করবে যে, ওরা অতো টাকা কোথায় পেল। ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী দিয়েছে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বেঁধে যাবে অনেক ঝামেলা। ওরা সিদ্ধান্ত নিলো, মার্বেলগুলো লুকিয়ে রাখবে নিজেদের কাছে। যখন ওরা বড় হবে, তখন ওগুলো বিক্রি করবে। সেই টাকা ওরা ভিনগ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যয় করবে। ভাগ্যে থাকলে ওদের সঙ্গে দেখা হতেও পারে।
তবে নিলয় আর নেহাল স্কুলে গিয়ে প্রতিদিন অক্স আর বুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ওরা যেহেতু স্কুল চিনে গেছে, সেহেতু আবার আসতেও পারে। কিন্তু না, ওরা আর এলো না। ক’দিন পরে নিলয় আর নেহালের নামে এলো একটি চিঠি। ওরা আগ্রহ নিয়ে খুলে দেখলো অক্স আর বুল লিখেছে-
প্রিয় নিলয়-নেহাল,
আশা করি, তোমরা সেদিন সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে বাসায় পৌঁছুতে পেরেছো। আমরা সেদিনই আমাদের গ্রহে ফিরে এসেছি। বাস্তবিকই তোমাদের পৃথিবীটা আমাদের কাছে খুবই বিপজ্জনক মনে হয়েছে। এই বিপজ্জনক পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা আমাদের নেই। তবে তোমাদের দু’জনকে আমাদের ভালো লেগেছে খুব। চিরদিন আমরা তোমাদের মনে রাখবো। অন্য গ্রহের প্রাণীরা তোমাদের ওখানে ধ্বংসের তাণ্ডব চালাবে বলে তোমরা যে আশঙ্কা করছো, সেটা ভুল। অন্য গ্রহের প্রাণীরা আচার-আচরণ ও নৈতিকতার দিক দিয়ে তোমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। তাই তারা কখনোই তোমাদের ওখানে গিয়ে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু করবে না। তোমাদের হিংসা, স্বার্থ, লোভ ও অবিবেচনাই তোমাদের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। আমরা অ্যাপেক্সিয়ানরা তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারতাম। কিন্তু তা করতে আমরা সাহস পাই না। তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়লে তোমরা এক সময় আমাদের সঙ্গেও ঝামেলা বাঁধাতে পারো- যুদ্ধ বাঁধাতে পারো। তখন আমাদের তৈরি করতে হবে মারণাস্ত্র। কিন্তু আমরা সেটা চাই না। যা হোক, আমরা আমাদের সিনেমার কাজ শুরু করবো শীঘ্রই। তোমরা ভালো থেকো। মন দিয়ে লেখা-পড়া করো।
তোমাদের হঠাৎ চেনা ভিনগ্রহের বন্ধু
-অক্স ও বুল
সম্ভবত যাবার আগে জিপিও থেকে চিঠিটা পোস্ট করে গেছে ওরা। আর নিজেদের কোনো ঠিকানা বা নাম্বারও লেখেনি। ওরা বোধহয় আসলেই চলে গেছে।