আমার বেড়ানোর নেশা টা উত্তরাধিকার সুত্রে বাবার থেকে পাওয়া.বাবা ভীষণ ভ্রমনপিপাসু ছিলেন.সময় সুযোগ পেলেই আমরা বেরিয়ে পরতাম বিভিন্ন জায়গার উদ্দেশ্যে.ছোটবেলায় বাবার দৌলতে আমি আর মা ট্রাভেল বুক এর বাইরে অনেক জায়গা দেখতে পেয়েছিলাম.বাবা বলতেন” টুরিস্ট স্পট হিসেবে যে জায়গার বেশী নাম ডাক, সেখানে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই অন্য কিছু দেখা যায়না, সেখানকার মাটির গন্ধ কেমন বা মানুষগুলো কেমন সেগুলো জানা হয় না. সেই জায়গা টা দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়.অদৃশ্য সৌন্দর্য সবসময় রহস্যময়ী.”সেই বয়েসে বাবার অনেক কথার মানে ঠিকমত বুঝতাম না.তবে “ভ্রমনে মনের প্রসার বাড়ে”, বহু ব্যবহৃত এই উক্তিটা অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি করেছিলাম.
তখন আমার বয়েস দশ-এগারো.সেবার আমরা গেছিলাম উত্তরবঙ্গের একটা নামহীন জায়গায়.সেবারই আমার প্রথম উত্তরবঙ্গের সাথে আলাপ.নিউ জলপাইগুড়ি তে নেমে গাড়িতে আরো ঘন্টা চারেকের রাস্তা.জায়গাটাকে বড়জোর মফ্ফস্বল বলা যেতে পারে.মকাই বাড়ী চা বাগান সেখান থেকে আরো প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার.আমাদের জন্য বাবা আগে থেকে গেস্ট হাউসে বুকিং করে রেখেছিলেন. বলাবাহুল্য সেটার কোনো দরকার ছিলনা.পরে জেনেছিলাম, ওই গেস্ট হাউস ছাড়া সেখানে আরো দুটো হোটেল ছিল.একচিলতে ছবির মত সুন্দর শহর. বাংলো টা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে তিস্তা.তিস্তা এখানে স্থবির,শান্ত,সংযত.আসার আগে আমার মনে খুব একটা আনন্দ ছিলনা.উত্তরবঙ্গে যাব অথচ দার্জিলিং যাব না,এ আবার হয় নাকি.বাবাকে বলতে বাবা শুধু হেসেছিলেন.আমি গাইগুই করছিলাম সমানে. কিন্তু শেষ বিকেলের আলোয় চারিদিকটা দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল আমার.বাবা গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন.সুন্দর বিকেলটা পেছনে রেখে আমি আর মা বাংলো তে ঢুকলাম.
ভেতরে ঢুকে দেখলাম বাংলো টা বেশ বড়.লাউঞ্জে কয়েকটা সোফা রাখা ছিল.মা সেগুলোর একটায় বসে পাশ থেকে একটা পত্রিকা নিয়ে ওল্টাতে লাগলো.আমি অন্যদিকের দেওয়ালে কিছু ছবি টাঙানো ছিল দেখে সেদিকে গেলাম.একটুপরে মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম,
-“আচ্ছা মা,এখানে দেখার কি জায়গা আছে?”…মা একটা হাই তুলে বলল
-“আমি জানি না বাবা.তোর বাবা জানতে পারে.”
আমাদের থেকে কিছুটা দূরে আর একটা সোফায় বসে কাগজ পড়ছিলেন এক মধ্য পঞ্চাশের ভদ্রলোক.আমার প্রশ্ন টা ওনার কানে গিয়ে থাকবে.হাতের কাগজটা নামিয়ে উনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“আপনারা কি এদিকে বেড়াতে?”
মা হালকা হেসে মাথা নাড়তে ভদ্রলোক একটু অবাক হলেন.
-“উত্তরবঙ্গের এত দর্শনীয় স্থান থাকতে আপনারা এখানে.” বলেই সঙ্গে সঙ্গে যোগ করলেন,” মাফ করবেন,প্রশ্ন টা হয়ত একটু বেশী ব্যক্তিগত হয়ে গেল.”
ইতিমধ্যে বাবা এসে পড়েছেন.ওনার প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে বললেন,
-“আপনার অবাক হওয়া টা স্বাভাবিক.এটা আমার ছেলের প্রথম উত্তরবঙ্গ ভ্রমন.তাই আমি এখানে আসতে চেয়েছিলাম যাতে ও আসল উত্তরবঙ্গের স্বাদ কিছুটা হলেও পায়.এখানকার রং যাতে ওর মনে অমলিন থাকে চিরকাল.”
এরপরে আমাকে বলা আগের কথা গুলো বলতে উনি ভীষণ আশ্চর্য হয়েছেন বোঝা গেল.বাবাকে বললেন,
-“আপনার কথা গুলো শুনে খুব ভালো লাগলো.অন্যরকম চিন্তা করার মত মানুষের বড়ই অভাব আজ.”
নিজের নাম বললেন অসিতবরণ সান্যাল.সিভিল সার্ভিস এ ছিলেন.গত বছর অবসর নিয়েছেন.স্ত্রী মারা গেছেন তিন বছর আগে.ছেলে অধ্যাপক.হাতে অখন্ড অবসর.তাই ভ্রমণের শখ টা বজায় রেখেছেন.চা আসে গেছিল.বাবা জানতে চাইলেন,
-“আপনি কি আগে এসেছেন এখানে?” অল্প একটু হেসে উনি বললেন,
-“আমি জানতাম আপনি এই প্রশ্ন টা করবেন.এটা আমার উনিশতম.”
বাবা একটু আশ্চর্য হলেন.আশ্চর্য হবারই কথা.হিমালয়ের কোলের এক প্রত্যন্ত জনবিরল মফ্ফস্বলে একজন লোক যদি উনিশ বার আসে,তবে সেটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়.আমরা প্রত্যেকেই যে কথাটা ভাবছিলাম,সেটা মা শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল,
-“আপনি এখানে এতবার….মানে..”
অসিত বাবুর চা খাওয়া হয়ে গেছিল.উঠে দাঁড়িয়ে মাফলার টা ঠিক করলেন.তারপর আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন,
“আমি এখানে অক্সিজেন দেখতে আসি.”
আজ এত বছর পরেও অসিত বাবুর বলা ওই কথাকটা আমার মনে অটুট.জীবনের প্রতিটি চড়াই-উতরাই এ দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেছি “আমি কি অক্সিজেন দেখেছি?অক্সিজেন কি দেখা যায়?”.কাদাজল মেখে ফুটবল খেলা,রাত জেগে হোস্টেল এ সরস্বতী পুজোর কাজকর্ম করা,বিদেশ যাওয়ার ছাড়পত্র বা পরবর্তী কালে চাকরিতে প্রমোশন অথবা সমাজ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তথাকথিত নিষিদ্ধ কিছু কাজ…সমস্ত কিছু কেই সেই সময় গুলোতে মনে হয়েছিল অক্সিজেন.আর তার পরে নিজের মনে হেসেছি আর বুঝেছি “হেথা নয়,হেথা নয়/অন্য কোথা,অন্য কোনোখানে “.
অনিমা আমার জীবনের প্রথম নারীসঙ্গ.স্কুলে পড়ার সময় আলাপ.অনেক দিন ওর সাথে কোচিং কামাই করে গঙ্গার ধারে বসে থেকেছি .নৌকায় করে ঘুরেছি খোলা গঙ্গার ওপর.সেরকমই একদিন,সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মনে মনে বলেছিলাম,
-“অনিমা তুই আমার অক্সিজেন.আজ আমি তোকে দেখতে পেয়েছি.”
সেদিন অনেক রাত্রে গোপনে লিখেছিলাম “তোমার চোখের বিজলি উজল আলোকে/পরানে আমার ঝঞ্ঝার মেঘ ঝলকে “…..সরস্বতী পুজোর দিন সকালে দুরুদুরু বক্ষে অনিমাকে লাইন দুটো পড়ে শোনাতে সে বলেছিল,
“আমার এই লাল রঙের শাড়ী টা কি ভালো না, জানিস তো এটা না বড়পিসী দিয়েছে.”…..উধাও হয়ে গেছিল আমার সাময়িক অক্সিজেন.
অপালার সাথে দেখা হয় উনিভার্সিটি তে পড়ার সময়.তখন কলকাতায় একা থাকি.আমার লেখা কবিতা পড়তে ভালবাসত অপালা.এক পূর্নিমার সন্ধ্যে তে দুম করে ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেছিল -“ভালবাসি”.তারপর ও আসত আমার বাড়ি.ওর হাজারো অর্থহীন কথার মধ্যে আমি দেখার চেষ্টা করতাম অক্সিজেনের অবয়ব.অপালার কালো অন্তর্বাস, আমাকে হাতছানি দিত এক অদৃশ্য রহস্যময়ী দুনিয়ার.শরীরী খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর চলে যেত অপালা.আমার সারা ঘরে ছড়িয়ে থাকত ওর সুগন্ধের মাদকতা.পরদিন আবার অপালার বুকের সুগন্ধ নিতে নিতে বিড়বিড় করতাম,
-“এই তো দেখা পেয়েছি, আবার আমার অক্সিজেনের.”
অপালাও থাকেনি.হটাত একদিন না বলে কয়ে উধাও হয়ে গেছিল.এক প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরে আমার বাড়ী থেকে ফেরার সময় বাস দুর্ঘটনায় অপালা মারা যায়.খবর পেয়ে আমি যাওয়ার আগেই সব শেষ.আমার এক বন্ধু ডাক্তার পোস্ট মর্টেম করেছিল.আমাকে দেখে ,এক পাশে ডেকে বলে,
“ওনার তিনহপ্তা চলছিল.তোর ওকে একলা এমন ভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি.”..বাড়ী ফিরে সেদিন অপালার সাথে শেষ বার কথা বলি “তোমার শরীরের চোরাবালিতে আমার মৃত্যু হয়েছে আজ”…
জীবন থেমে থাকেনি.পিছু ফিরেও তাকায়নি.বন্ধুত্ব,ভালবাসা,রাগ,অভিমান…বহুবার মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছে অক্সিজেনের…কিন্তু অধরাই থেকে গেছে চিরকাল.সিগারেটের নীল ধোঁয়ায় আমার ফুসফুসের রং এখন কালো.এই বৃদ্ধ বয়েসে যখন অসিত বাবুর কথাটা নির্মম ভাবে কানে বাজে, ফেলে আসা জীবনের পাতা গুলো উল্টোতে থাকি অক্সিজেন খোঁজার প্রয়াসে.হটাত চোখে পড়ে প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া এক মলিন স্নৃতি,চিরকাল যাকে অনাদরে অথবা ভয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম.
নাম না জানা গন্ত্যব্যের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ার আনন্দ আমি কোনদিন ই ভুলিনি.তাই মাঝে মাঝে বেড়িয়ে পড়তাম অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে.সেরকম একদিন ট্রেনে যেতে যেতে জানলা দিয়ে একটা সুন্দর গ্রাম দেখলাম.কি মনে হহলো, নেমে পড়লাম.মেঠো পথ ধরে হাঁটছি.সামনে একটা বাঁক.অগোছালো ভাবে বাঁকটা পেরিয়ে সামনে দেখি….
মাঝারি মাপের একটা দীঘি.একদিকে সবুজ বাঁশঝাড় আর অন্য দিকে একসারি খয়েরি রঙের সুপুরি গাছ,দীঘির আব্রু রক্ষা করছে সযত্নে.সমস্ত দীঘি জুড়ে ফুটে আছে অজস্র পদ্মফুল.মাঝে মাঝে পদ্মপাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে দীঘির কালো জল.দিঘিটাতে একটাই মাত্র ঘাট.সেই ঘাটের পৈঠায় বসে আছে এক বিষন্ন যুবতী, হলদে একটা শাড়ী আটপৌরে ভাবে এলিয়ে আছে তার গায়ের ওপর.পায়ের কাছে পরে আছে এক গাদা বাসন.যুবতীর কাজে মন নেই.বাঁশ বনের মধ্যে দিয়ে নরম সূর্যের আলো এসে পড়ছে তার পায়ের কাছে.বোধহয় ভয় পাচ্ছে,পাছে যুবতীর শরীরের তার স্পর্শ করলে তার ধ্যান ভেঙ্গে যায়.একটা বৌ-কথা-কও পাখি দেখলাম.কিন্তু আজ সেও যেন ডাকতে ভুলে গেছে.কোথাও একটুও শব্দ নেই.বিশ্ব সংসারে সবাই যেন চুপ করে এই অশ্রুতপূর্ব গান শুনছে.আকাশে তখন কিছু অন্ভ্যাস্ত্ব মেঘের আনাগোনা.মনের মধ্যে কে যেন গুনগুন করে,
“অক্সিজেন দেখে নাও,অক্সিজেন দেখে নাও.”
-“বাবু অ বাবু,ওঠেন.ইবার যাইতে হইব.”
হটাত আহ্বানে চমকে উঠি.দেখি সামনে আমার নৌকার মাঝি.হকচকিয়ে যাই.অজান্তে বলে ফেলি,
-“কোথায় নিয়ে যাবি রে?”
-“ওই হোথায়.চলেন.আপনার লগে বইস্যা আছি.আপনাকে পার কইরা তবে মোর ছুটি.আজ আমি ঘর যাব বটেক.মোর মাইয়া টাকে দেখি নাই কতকাল….লেন, ওঠেন এবার.”
-“আর বাকিরা?মা, বাবা, অসিতবাবু….তারা সব কোথায়?”
-“সেই হক্কালে তেনাদের রাইখ্যা এসেছি গো.শুধু আপনার লগে আবার আসিতে হইলো মোকে”.
উঠে পড়ি.লেখার খাতা, পেন,চশমা,ঘুমের ওষুধ সব পড়ে থাকে.জানলা দিয়ে বিকেলের রোদ এসে পড়ে আমার আরাম কেদারায়.সেই আলোতে আর এক বার দেখে নিই সবকিছু.আচমকা চোখ যায় দেওয়ালে.মা-বাবার একসাথে একটা ছবি.প্রথমবার উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে তোলা.তিস্তার জল থেকে যে ভাঙ্গাচোরা গাড়ীটা উদ্ধার করেছিল সেনাবাহিনীর জওয়ানেরা, সেখানে দলাপাকানো কিছু মাংসপিন্ড ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিলনা.বাবার এক ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়ার আগে পর্যন্ত আমি পরিস্থিতির ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারিনি.অজান্তে একটা প্রনাম করি অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে.আর দেরী নয়.এবার প্রস্তুত হই.আমার নৌকা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে.
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।