সন্ধ্যে সাড়ে ৭টা

ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে ৭টায় অফিস থেকে বের হলো আসিফ। ৫টায় অফিস শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বেসরকারী অফিসের যা অলিখিত নিয়ম—বড় কর্তার মর্জিমাফিক অফিসটাইম পালন করতে হয়। বাসায় সুমাইয়া অপেক্ষায় আছে, আর একমাত্র ছেলে আমান, বয়স ৩ বছর। একটু তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করে আসিফ। আজ সকালে আমান বায়না ধরেছিলো গাড়ির জন্যে। একটা খেলনা গাড়ি কিনতে হবে। মাস শেষের দিকে টানাটানি লেগেই থাকে। ২৫ তারিখের পর থেকে চিন্তা লেগে যায় বাকী কয়টা দিন কিভাবে চলবে। বেতন হবে আবার পরের মাসের ৭/৮ তারিখে। মাসের শেষে ধার করে চলা আর পরের মাসের শুরুতে সে ধার শোধ করে দেওয়ার প্রতি মাসের রুটিন। ছোট চাকরি আসিফের। গালভরা পদবী—সিনিয়র অফিস সেক্রেটারি। কিন্তু কাজ কেরানীর চেয়ে অধম। বড় সাহেব যে দয়া করে বাসার বাজার করায় না সেটাই বেশী।

অফিস থেকে বের হয়েই সামনের স্টেশনারী থেকে এক ব্যাটারী চালিত ছোট্ট কিন্তু চমৎকার একটি গাড়ি কিনলো। দাম নিলো ২২৫ টাকা। অফিস থেকে বাসা বেশ দূরে। হাঁটলে ২৫ মিনিটের পথ। প্রতিদিন এ পথটুকু হেটেই যায় আসিফ। পথে একটি ছোট পার্ক পড়ে। রাস্তা পার হয়ে পার্কের এক গেট দিয়ে ঢুকে, উল্টোদিকের আরেক গেট দিয়ে বের হয়ে আরেকটু হাঁটলেই বাসা। পার্কের এই শর্টকাটের কারণে পথ অনেকখানি কমে যায়। পার্কের এলাকাটা বেশ নিরিবিলি। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। পার্কের সামনের রাস্তাটা প্রায় পার হয়ে এসেছে এমন সময় ধাক্কাটা খেলো। একটু আনমনেই হাঁটছিলো সে। বামদিক থেকে সজোরে ধাক্কা লাগালো প্রাইভেট কারটি। উড়ে পার্কের দেয়ালে গিয়ে পড়লো, মাথা সজোরে ঠুকে গেলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো আসিফের।

চোখ মেলে তাকালো আসিফ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে আর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উঠে দাঁড়ালো। রাস্তায় দূরে দূরে কিছু গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যে গাড়ীটা ধাক্কা মেরেছে সেটার কোনো হদিস নেই। মনে মনে একটু হাসলো আসিফ। অনিচ্ছাকৃত অপরাধ করে পালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা সবারই আছে। কে আর চায় থানা-পুলিশের হাঙ্গামায় জড়াতে! বাবুর খেলনা গাড়ির প্যাকেটটা খুঁজলো আশেপাশে। পেলো রাস্তার একপাশ ঘেঁষে। পরম মমতায় প্যাকেটটা তুলে নিলো হাতে। ছড়িয়ে গেছে কয়েক জায়গায়, তবে বড় কোন ক্ষতি হয়নি বলেই মনে হচ্ছে।

পার্কের ভিতরে ঢুকলো আসিফ। একটু দুর্বল দুর্বল লাগছে। আঘাতটা বেশ জোরদার মনে হচ্ছে। মাথার ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা কাটছে না। সন্ধ্যার পরে পার্কটা মোটামুটি ফাঁকা। গেটের কাছে একটা বেঞ্চ দেখে বসে পড়লো। প্যাকেটটা রাখলো পাশে। একটি বিশ্রাম নিতে পারলে মন্দ হবে না। বাসার কথা আবার মনে পড়লো। সুমাইয়া আর বাবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। প্রতিদিন তো আটটায় বাসায় যায়, আজ না হয় একটু দেরী করেই গেলো। ছোট সংসার হলেও নিজের চাকরির উপরেই ভরসা। তাই একটু টানাটানি লেগেই থাকে। তবুও ৫ বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করা সংসার থেকে ভালোবাসা এখনো পালিয়ে যায়নি। দুজনের ভিতরে ভালোবাসাটা এখনো আগের মতোই অটুট আছে। আমান আসার পথে সেটা ত্রিমাত্রিক রূপ পেয়ে গেছে।

জীবনটা অনেক অর্থবহ মনে হয় আসিফের। শুধুমাত্র যদি আয়টা আরেকটু বাড়ানো যেতো! মনে মনে ঠিক করে দু-একটা টিউশনি করাবে। যদিও এতে বাসায় একটু কম সময় দিতে পারবে, কিন্তু সংসারে টানাটানি একটু কমবে। আবার আমানের ভবিষ্যতের জন্যেও কিছু একটা ভাবতে হয়। মাথাটা আবার ঝিমঝিম করতে লাগলো আসিফের। মাথায় হাত দিয়ে নিশ্চিত হলো কোথাও কেটে যায়নি বা রক্তপাত হচ্ছে না। কিন্তু সবকিছু এমন ঝাপসা হয়ে আসতে চাচ্ছে কেন!

উঠে দাঁড়ালো আসিফ। দ্রুত বাসায় গেলে ভালো হবে। প্রায় অন্ধকার পার্কে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলে অনেক রকম সমস্যা হতে পারে। পার্কের অন্য গেটের দিকে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় পিছনের গেট থেকে একটা হট্টগোল কানে আসলো আসিফের। সাথে পুলিশের গাড়ির সাইরেনও শোনা যাচ্ছে। জটলার শব্দ বাড়ছে। কি ব্যাপার দেখতে আসিফ পিছন ঘুরে যে গেট দিয়ে পার্কে ঢুকেছিলো সেটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

অবাক হলো সে। এত লোক এসেছে কখন! ২০/২৫ জন লোক দাঁড়িয়ে আছে পার্কের দেয়াল ঘেঁসে—যেখানে আসিফ পড়েছিলো এক্সিডেন্টের পরে। রাস্তায় একটা টহল পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দুজন পুলিশের হেলমেট দেখা যাচ্ছে জটলার ভিতরে। সবাইকে দূরে সরে যেতে বলছে। আরেকজন ওয়্যারলেসে কথা বলছে। এগিয়ে গেলো আসিফ। কে যেন শুয়ে আছে জটলার ভিতরে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া রক্ত চোখে পড়লো। তার ভিতরে শুয়ে আছে—কে ও! চেনা চেনা লাগছে না?

এবার মাথাটা আবার ঝমঝম করে উঠে আসিফের। এক পুকুর রক্তের ভিতরে শুয়ে আছে আসিফ নিজেই! মাথাটা পুরো থেঁতলানো। পার্কের দেয়ালে বাড়ি খেয়েই কি থেতলে গেছে! হঠাৎ করেই সুমাইয়া আর আমানের কথা মনে হলো আসিফের। ওরা বাসায় অপেক্ষা করছে একজন স্বামী আর একজেন বাবার জন্যে। বাসার দিকে পা চালাতে চাইলো আসিফ। কিন্তু পারলো না। পা যেনো আটকে আছে চট্ চটে রক্ত স্রোতে। বুকটা হাহাকার করে উঠলো আসিফের।

চেতনা ফিকে ফিকে হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেলো অসীম শূন্যতায়। একটা অ্যাম্বুলেন্সে লাশটা তোলা হলো। তার আগে সুরৎহাল রিপোর্ট তৈরি করলো পুলিশ। ছবি তুললো কতগুলো। সাইরেন দিতে দিতে অ্যাম্বুলেন্সটা ছুটে চললো গন্তব্যের পানে। অন্ধকারে কেউ দেখলো না—পার্কে ঢোকার পর প্রথম বেঞ্চে জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়া ছোট্ট একটা প্যাকেট পড়ে আছে।

(বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে)

ইছাবনিতে তাঙ্গু

সার্কাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *