১৯৩২ খ্রিস্টব্দের ঘটনা- ২য় পর্ব
১৯৩২ খ্রিস্টব্দের ঘটনা- ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাদশার কাছে যেহেতু ভূ-বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট ছিল, তাই তিনি মনে করলেন, এটা স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। সুতরাং তিনি স্বপ্নের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকলেন। পরের রাতে হুযায়ফাতুল ইয়ামান (রাঃ) পুনরায় মুফতি সাহেবকে দেখা দিয়ে বললেন, আমি বার বার বলে আসছি আমাদের স্থানান্তর কর, কিন্তু তোমরা এত নিষ্ক্রিয় হয়ে আছ কেন? পরদিন সকালেই তিনি বাদশার নিকট পৌঁছেন। এবং পুনরায় তিনি স্বপ্নের নির্দেশের কথা শুনালেন।
এবার বাদশা বিরক্তির স্বরে মুফতি সাহেবকে বললেন, আপনি বলুন, আমি কি করতে পারি? আপনি নিজে সরেজমিনে উপস্থিত ছিলেন। আপনার সামনে বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট এসেছে। তাঁদের রিপোর্ট তো বলা হয়েছে, পানি তো দূরের কথা মাটিতে আর্দ্রতা পর্যন্ত দেখা দেয়নি। অতএব, আমাকেও পেরেশান করবেন না আর নিজেও পেরেশান হবেন না। মুফতি সাহেব বললেন, রিপোর্টে যা আছে তাও আমি জানি। কিন্তু এরপরেও তো আমাকে এবং আপনাকে বার বার আদেশ দেওয়া হচ্ছে। তাই আমি বলছি যাই হোক না কেন, আপনি কবরটা তুলে দিন।
বাদশাহ বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আপনি আগে স্থানান্তর করার ফাতোয়াটা দিয়ে দিন। মুফতি সাহেব সেখানে বসেই সাহাবায়ে কিরামের কবর স্থানান্তর সংক্রান্ত ফাতোয়াটা দেওয়ার পরপরই পত্র-পত্রিকায় ঘটনার বিবরণ ও ফাতাওয়াসহ বাদশাহর ছাপিয়ে দেওয়া হয় যে, আগামী কুরবানীর ঈদের দিন যোহরের নামাজের পর নবীজি (সা.)-এর সম্মানিত দুই সাহাবীর কবর খোলা হবে। সংবাদপত্রে খবরটি ছাপা ও প্রচারিত হবার পর সাথে সাথেই সমগ্র ইরাকে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। তা ছাড়া রয়টার্সসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা খবরটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়।
তখন ছিল হজ মৌসুম। বিশ্বের অসংখ্যা মুসলমান ছিলেন মক্কা নগরীতে সমবেত। তারা বাদশার কাছে আবেদন পাঠালেন, আমারাও মহান সাহাবীদের চেহারা দর্শনে আগ্রহী। অনুগ্রহ পূর্বক তারিখটা আরো কিছু দিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হোক। এদিকে ইরান, তুরস্ক, লেবানন, ফিলিস্তিন, হেজাজ, বুলগেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা, রাশিয়া, ভারত, প্রভৃতি রাষ্ট থেকে বাদশা ফয়সালের নামে অসংখ্যা তারবার্তা আসতে থাকে। সকলের একই আবেদন, আমরা সম্মানিত সাহাবা কিরামদ্বয়ের জানাযায় অংশগ্রহণ করতে চাই, দয়া করে তারিখটা আরো কয়েক দিন পিছিয়ে দেয়া হোক।
এদিকে সারা মুসলিম বিশ্বের অনুরোধ, অপর দিকে স্বপ্নে তাড়াতাড়ি করার তাগিত। সমস্যা হল, সত্যি যদি কবরে পানি চুয়ে থাকে তাহলে বিলম্ব করলে সম্মানিত সাহাবীদ্বয়ের কষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং মুফতি সাহেবের পরামর্শে কবরদ্বয় থেকে নদীর দশ ফুট দূরে একটা গভীর গর্ত খুঁড়ে সেখানে কাঁকর ফেলে ফরমান জারী করা হয় যে, মুসলিম বিশ্বের অনুরোধ ও আবেদনের প্রেক্ষিতে এ কাজ আরো দশ দিন পর করা হবে।
ঘোষণার পর কয়েক দিনের মধ্যে সালমান পার্কের ছোট বস্তি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জৌলুসের দিক দিয়ে জায়গাটা আরেক বাগদাদে পরিণত হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, মাদায়েনের সেই ঐতিহাসিক মাঠটিও তাবুতে তাবুতে ভরে যায়। সরকারি লংগরখানা ছাড়া স্থানে স্থানে পান্থশালা, হোটেল ও কফিখানা তৈরি হয়।
এই সময় ইরাক সরকার কাষ্টমসসহ শুল্কের নানা প্রকার শর্ত প্রত্যাহার করে নেন। এমনকি পাসপোর্ট ভিসার ব্যাপারেও তেমন কোন শর্ত ছিল না। বাদশা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, বহির্দেশীয় দর্শনার্থীদের শুধু নিজ নিজ দেশের অনুমতি পত্র নিয়ে আসলেই চলবে। তারপরও আগত দর্শনার্থীদের সংখ্যা ছিল অধিক। কারণ, তারা তো পূর্ব থেকেই মক্কা শরিফে এসে রয়েছেন। এই উপলক্ষে মিসর ও তুরস্ক থেকে সরকারী প্রতিনিধি দলও আসেন। সাহাবায়ে কিরামকে সালাম দেওয়ার জন্য তারা সরকারি ব্যবস্থাপনাও অবলম্বন করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী তুরস্কের সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার একজন উচ্চপদস্থ মন্ত্রী। মিশরী প্রতিনিধী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তৎকালীন যুবরাজ শাহ ফারুক। ঐ দলে বহু সংখ্যক আলিম ও মন্ত্রীবর্গও ছিলেন। মোটকথা, যে খোশনসীব বান্দাগণের কপালে সাহাবীদ্বয়কে দেখার সৌভাগ্য লেখা ছিল, তারা ততদিনে সালমান পার্কে এসে পৌঁছে গেছেন। একটা গ্রহনযোগ্য হিসাব মতে আগত দর্শনার্থীদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ এবং তাঁদের মধ্যে প্রত্যেক দেশের ও জাতীয় লোকেরাও বিদ্যমান ছিলেন।
সূত্রঃ কবরের আযাব