হারাম সম্পদের কারণে কবর আযাব
মানুষ যদি হারাম পথে সম্পদ উপার্জন করে তাহলে এ কারণে কবরের আযাব হয়। আল্লামা কামাল উদ্দিন দারিমী (র.) হায়াতুল হায়াওয়ান কিতাবে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি হল, এক গ্রামের একটি কাফেলা হজ্জের জন্য সফরে বের হল। তারা হজ্জ করার পর বাড়ির দিকে রওয়ানা করল। তার মক্কা মুকাররমা থেকে কিছুটা পথ অতিক্রম করেছে। এমন সময় তাদের এক সাথীর মৃত্যু হয়ে গেল। কাফেলার সাথীরা দাফন করার জন্য কবর খনন করল। জানাজার নামাজ পড়ে যখন তাকে দাফন করতে গেল, তারা দেখল যে, কবরে ভয়ংকর আকৃতির একটি সাপ ফনা তুলে বসে আছে। সাথীরা তাকে সে কবরে দাফন না করে লাশ নিয়ে সামনে অগ্রসর হল। কিছু দূর যাওয়ার পর আরেকটি কবর খনন করে যখন লাশ কবরে রাখতে গেল, দেখা গেল সেখানেও একটি সাপ ফেনা তুলে বসে আছে।
সাথীরা ভাবল, যেখানে কবর খনন করি সেখানেই সাপ! মনে হয় এ এলাকটায় সাপের ব্যাপক বসবাস। তাই তারা লাশ নিয়ে মক্কা মুকাররমায় পৌঁছাল। কাফেলার সাথীরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে সমাধান চাইল। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তায়ালা এ ব্যক্তিকে কবরে আযাব দিতে চান। তার ভাগ্য এটাই নির্ধারিত হয়ে গেছে। তোমরা পৃথিবীর যে কোন স্থানে স্থানে করতে যাও সেখানেই তার জন্য সাপ অপেক্ষমান দেখতে পাবে। যাও তাকে কবর নিয়ে দাফন কর। সাথীরা সাপসহই মৃতকে দাফন করে দিল। দাফন করার সময় লোকেরা দেখল যে, সাপটি প্রথমে তার মুখে আঘাত করল এবং তার মুখ দংশন করে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল। লোকটি ঠোঁট, জিহ্বা সাপের দংশনে খসে পড়ল। সাথীরা জলদি কবরে মাটি দিয়ে চলে এলো।
গ্রামে এসে তারা মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনদের কাছে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের হাজী সাহেব কেমন লোক ছিলেন। সে কি কাজ করত?
স্ত্রী জবাব দিল, সে নামাজী ছিল, যাকাতও দিত। হজ্জের জন্য আপনাদের সাথে গেল। তার সব কাজই ভাল ছিল। হাজী সাহেবগণ মৃতের স্ত্রীকে তার কবরের আযাবের কথা বলল।
এ কথা শুনে স্ত্রী বলল, আমার স্বামীর একটা ব্যাপার আমার খেয়াল এসেছে, সে যখন মহাজনের জন্য গম কিনত, তখন সে গম থেকে ভালটা রেখে দিত। আর খারাপ গম সেগুলোর সাথে মিশ্রিত করে দিত। স্ত্রীর মুখে এ কথা শুনে সবাই বুঝতে পারলো, লোকটি কবরের আযাবের কারণ ছিল এটাই।
কেননা লোকটির এ পন্থাটি ছিল হারাম। সে মহাজনদের জন্য মাল কিনত, তা থেকে নিজের জন্য ব্যবহার করত। অথচ এ গম তার নিজের ছিল না। এ হারাম পথে উপার্জন এবং তা থেকে ভক্ষণ করার কারণেই তার এ শাস্তি হচ্ছে।
এ ঘটনা থেকে বুঝা যায়, কবরের আযাব কোন কোন সময় আল্লাহ পাক দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে দেন, যাতে অসতর্ক মানুষ সতর্ক হয়।
আজ সমগ্র পৃথিবীই এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে। আমরা দুনিয়াদারী নিয়ে এতই ব্যস্ত আছি যে, আখিরাতের খবর নেই। কামাই রোজগার নিয়ে এতই ব্যস্ত আছি যে, নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের হক ছিনিয়ে আনছি। আমাদের মরতে হবে। আর তার পরই আরম্ভ হবে আসল জীবন। সে এক মহা জীবন। যার শুরু আছে শেষ নেই। সে জীবনে কার কি অবস্থা হবে কেউ জানে না। যার যার আমল তার তার স্থান নির্ধারণ করে দিবে। কাউকে প্রবল বেগে ছুড়ে ফেলা হবে সীমাহীন অনন্ত আগুনে। কাউকে পরম যত্নে পৌঁছে দিবে জান্নাতুল ফেরদাউসে।
সে দিনের কথা ভাবুন, চিন্তা করুন, যে দিন মহা বিপদ থাকবে সবার উপর। কেউ কাউকে চিনবে না। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। পালাবার পথও থাকবে না। গোপন কিছুই থাকবে না। সবই প্রকাশ পাবে। সেদিন কথা বলার কেউ থাকবে না। জবাব দেওয়ার কেউ থাকবে না। সে দিন আল্লাহ পাক নিজেই জবাব দিবেন।
আল্লাহ পাক সে দিন সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন। কোথায় আজ তোমাদের রাজা বাদশারা? কোথায় দুনিয়ার জালেমরা? আজ কর্তৃত্ব কার?
(সূরা মুমিনুনঃ ১৬)
আল্লাহ নিজেই জবাব দিবেন-
পরাক্রমশালী এক আল্লাহর।
অর্থাৎ রাজত্ব এবং একমাত্র তাঁরই। তাঁর সাথে কেউ লড়তে পারবে না। তাঁর শক্তিতে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। তাঁর থেকে কেউ পালাতে পারবে না। ইরশাদ হবে-
আজ পালাবার স্থান কোথায়? (সূরা আল-হাক্কাঃ ১৮)
আরো ইরশাদ হবে-
তোমাদের কেউ ছাড়পত্র ছাড়া যেতে পারবে না। (সূরা আর রহমানঃ ৩৩)
সে দিন সে স্থানে আমাদের সম্মুখীন হতে হবে কঠিন এক পরিস্থিতির। সেখানে সবাই একাকী হবে। মা অপরিচিতি হয়ে যাবে। স্ত্রী স্বামীকে চিনবে না। সঙ্গ ছেড়ে দিবে আদরের সন্তানরা। মুখ ফিরিয়ে নিবে বন্ধু বান্ধবরা। সকলেই নিজেকে নিয়ে ভাববে। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও কথা বলবে আমাদের বিপক্ষে। হাত বলবে, আমি হাত দ্বারা যা করছি। পা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তোমার অবাধ্যতায় এ পথে চলছিলাম। পেট বলবে, হে প্রভু আমি তোমার নিষিদ্ধ বস্তু দ্বারা উদর পূর্তি করেছিলাম। সবাই সে দিন আমাকে ছেড়ে যাবে। সে দিন অপরাধীরা আক্ষেপ করে বলবে।
অপরাধী সে দিন শাস্তির বদলে দিতে চাইবে তাঁর সন্তান-সন্তুতিকে।
(সূরা মা’আরিজঃ ১১)
নিজের স্ত্রী ও ভ্রাতাকে, তাঁর জ্ঞাতি গোষ্ঠী যারা তাকে আশ্রয় দিত।
(সূরা মা’আরিজঃ ১৩)
সে দিন তারা আপনজনকে বিসর্জন দিয়ে হলেও নিজেকে মুক্ত করতে চাইবে। এও যদি কবুল না হয় তখন বলবে- এবং পৃথিবীর সকলকে।
(সূরা মা’আরিজঃ ১৪)
অপরাধী সে দিন বলবে, পৃথিবীর সকল মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে হলেও আমাকে বাঁচাও আল্লাহ। কিন্ত আল্লাহ সাফ জবাব দিবেন। না, কখনও না।
(সূরা মা’আরিজঃ ১৫)
আমার ভাইয়েরা! মানুষ কত স্বপ্ন দেখে, রঙ্গিন স্বপ্নের জাল বুনছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে তাঁর কত সাধনা। কত ত্যাগ-শ্রম, মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। অথচ মৃত্যু মুহূর্তের মধ্যে সন স্বপ্নের ইতি টেনে দেয়। মৃত্যু সকলকে একটি গর্তে ফেলে দেয়। সে গর্ত কবর। সেখানে সবাই সমান। যে ধনবান দুনিয়াতে মুজাইক করা এসি ফিট করা কক্ষে বসবাস করত, তাঁর জন্যও মাটির বিছানা। গরীব মানুষের বিছানা আর ধনবানের বিছানার মধ্যে কোন তফাত নেই। আল্লাহ পাক কোরআনে বলেছেন-
হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। (সূরা ত্বহাঃ ৫)
এ কবর থেকে তোমাদেরকে পুনরায় বের করা হবে।- (সূরা ত্বহাঃ ৫৫)
সুতরাং এ প্রতিশ্রুতি সত্য। আমরা সকলেই সেই মহান সত্যের দিকে ধাবমান। তাতে এক চুল পরিমাণও ব্যত্যয় ঘটবে না। আমরা কবরে শায়িত হব। সেখান থেকে পুনরায় উত্থিত হবো। এরপর আমাদের আশ্রয় হবে জান্নাতে, নয়ত জাহান্নাম আমাদের কর্মফল অনুযায়ী।