হারানো নদীর স্রোত-৪র্থ অংশ

 

বাবা বললেন, তুমি মোজাহারের ছেলে না এজাহারের ছেলে কও দেখি, তোমারে তো দুজনের মতো লাগে, আহা ঠিক যেন এজাহারের মতো হাসি, মোজাহারের মতো তাকানো।

বাবার দুচোখ এতক্ষনে জলে ভরে উঠেছে। মায়ের চোখের পলকই যেন পড়ছে না, দেখছেন সিকান্দার আলিকে। সিকান্দার আলি এসেছেন বড়দল থেকে। বড়দল ছিল আমাদের পিতৃভূমি। সিকান্দারের গায়ে নীল আশমানি পাঞ্জাবি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গালে মাথায় কাঁচাপাকা দাড়ি চুল। সিকান্দার বলল, এই ঠিকানাটা আমার আব্বার ডায়েরিতে ছেল, চাচা আমার আব্বা-চাচা দুই যমজ , মনে আছে তো?

বাবা বললেন, তা আর মনে থাকবে না!

ওই জন্যি আমারে দু’জনের মতো লাগে।

তুমার বাবারা আছে?

সিকান্দার আলি মাথা নাড়ে, না অনেকদিন হল, চাচা তো খান সেনাদের হাতে মরলেন, আর আব্বা সেই শোকে পাথর হয়ে গিসলেন, শেষদানিতে কথাই বলতেন না, তারপর ফুস করে চলি গেলেন, ছিয়াত্তর সালে।

এতদিন! মা যেন কেঁদে উঠেছে।

আপনার বয়স কত হল চাচা?

একানব্বুই, তুমারে দেখব বলে বেঁচে আছি খোকা। বাবা কেঁদে উঠলেন বন্ধুর শোকে।

সিকান্দারের চোখ দুটিও ছলছল করছিল। রীনা দাঁড়িয়ে দরজায়, আমি দেওয়ালে পিঠ রেখে। সিকান্দার বলছে, এপারে তো আসা হয়, তিনি বড়দল প্রাইমারি হেডমাষ্টার, ওই স্কুল পত্তন করেছিলেন মুকুন্দ পাল মশাই, কিন্তু ঠিকানা ছিল না কোনও, তাই দেখা করা হত না, আচমকা ঠিকানা পেয়ে গেছেন তাঁর আব্বার ডায়েরিতে।

তুমি তাহলি কার বেটা হলে? মা জিজ্ঞেস করল, রোশোনারা না আঞ্জুমান, কোনডা তুমার আম্মা?

আপনের মনে আছে চাচী?

আছে, তুমার মা কোনডা? মায়ের মুখে দেশের ভাষা ফিরে এল অবলীলায়।

বলেন দেখি কোনডা?

মা বিড়বিড় করছে, আঞ্জুমান আমার সই ছেল।

সিকান্দার বলল, আর রোশোনারা?

তার খুব রূপ, একটু দেমাক ছেল।

হি হি করে হাসে সিকান্দার, তিনি আগে গেছেন, পেটে ঘা হয়েছিল, পীরতলায় পানি খেয়ে খেয়ে তাঁর ইন্তেকাল হল।

কত বয়স তখন তার?

তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন।

তা’লি তো তখন বুড়ি হয়নি।

না, কী রূপ ছেল রোশোনারার, মোজাহারের বিবি। বাবা হাসলেন, বাপের বাড়ি পলাশপোল না?

মা বলল, তোমার তো দেখি সব মনে আছে।

আছে, থাকবে না?

মা বলল, আঞ্জুমানের খবর?

তিনি আছেন।

বেঁচি আছে আঞ্জু? মা উল্লসিত হয়ে উঠেছে।

আছেন, তবে পড়ুটে হয়ে।

উঠতি পারে না?

কোমর পড়ে গেছে চাচি তাঁর।

মার চোখে জল ভরে এল, যদি দেখতি পারতাম তারে।

দেখলি কষ্ট পাতেন চাচি। সিকান্দার বলল, আপনারা যে দু’জনেই আছেন তা আমার ধারণায় ছেল না, ভেবেছিলাম আপনার ফেমিলির সঙ্গে দেখা করে যাব, আমার আব্বা-চাচার বন্ধু ছেলেন আপনি।

বন্ধু মানে, এক থালায় ভাত খাওয়া হত। বাবা বললেন।

মা বলল, আমি আর আঞ্জু, দুটো গাছ পুতিলাম, আমাদের বাগানে আঞ্জু, তুমাদের বাগানে আমি, চুষি’র আম, আছে?

সিকান্দার বলল, আপনের নাম ললিতা, ওই গাছডার নামও তাই, ললিতা আম, খুব মিঠে, ললিতা আম বড়দলে আর কারো ঘরে নেই।

বাবা বললেন, থাকবে কি করে, ও গাছের কলম কলকাতার গ্লোব নার্সারি থেকে নিয়ে গেসল এজাহার, সে কিনা এনারে খুব পছন্দ করত, এনার হাতের পান তাঁর মিঠে লাগত।

সই এর বসানো গাছডা কি হল? মা জিজ্ঞেস করল।

সে গাছ নাই, আপনাদের বাগান তো সাফ হয়ে গেছে।

সে গাছ নাই, বাগান কাটল কেন?

ওখেনে বড় মসজিদ হয়েচে, অনেক চেষ্টা করেও বাগানডা রাখতি পারলাম না আমরা কেউ।

মা বলল, তুমাদের বাগানডা রেখি দিয়ো বাপ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিকান্দার আলি। আমি বুঝতে পারছিলাম না সিকান্দার আলি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েও একটা কথার জবাব দিল না কেন? কার ছেলে, আঞ্জুমানের না রোশোনারার? এজাহারের না মোজাহারের?

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, রোশোনারা খুব কষ্ট পেয়েছিল?

পেয়েছিল চাচা। ক্যানসার হয়ে গিসিল, ঢাকায় নিয়ে গিছি, সেখেন থেকে কলকাতায়, তারপর মুম্বাই, শেষে বড়দলে ফেরত নিয়ে গেছি, ওখেনে তাঁর ইন্তেকাল হল।

তখন কেন যোগাযোগ করনি?

জানতাম না তো অ্যাড্রেস।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ইস্কুলডা পাকা হয়েছে?

হয়েচে, আপনার সই করা খাতা পত্তর এখনো আছে।

আছে, সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

তাহলে বলতেছ আঞ্জুমান একা বেঁচে?

হ্যাঁ চাচা।

সে আমাদের কথা বলে না?

আগে খুব শুনতাম, এখন আর না, আর শোনবোই না নতুন কথা কী, সব তো জানা আমার, এত শুনেছি।

মা কী যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছিল নিজে নিজে, শেষে না পেরে জিজ্ঞেসই করল, তুমার মামাঘর তো মাগরোয়?

জে চাচি।

স্টিমারে করে যেতে তো?

জে, এখন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে, নদীর ওপরে পুলও হয়েছে অনেক জাগায়।

স্টিমার তো চলে, বড়দলে আমাদের স্টিমারঘাটা। মা বলল।

ছেল এক সময়।

এখন নেই?

না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিকান্দার আলি, গাঙ সব শুকোয় যাচ্ছে চাচি।

গাঙ শুকোয় যায়, বেতনা, কপোতাক্ষ? মা যেন আর্তনাদ করে ওঠে।

 

হারানো নদীর স্রোত ৫ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!