হারানো নদীর স্রোত-অষ্ঠম অংশ

আমারও যে তেমন মনে হচ্ছে না তা নয়। মনে হচ্ছে আরও অনেক কথা। রীনারও মনে হচ্ছিল অনেক কথা। আমার গলা জড়িয়ে রীনা সেইসব কথা বলে যাচ্ছিল। বলতে বলতে রীনা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, আমার মনের ভিতরে কোন রোশোনারা আলো জ্বালিয়ে বসে আছে কিনা। আমি যে ইকবালভাইদের কথা জিজ্ঞেস করব সেই সুযোগ দিচ্ছিল না রীনা। শেষের দিকে রীনার কথা আর শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার সামনে সিকান্দার আলি ভেসে উঠছিল। আশমানি পাঞ্জাবী, স্বাস্থ্যবান পুরুষ, চওড়া বুক, সে এখন গোবরডাঙা, মসলন্দপুরের দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা এই এতবছর বাদে জন্মভূমি ছেড়ে চলে এসেছে ভয়ে তাদের বুঝিয়ে নিজের দেশে ফেরত নিয়ে যেতে।

রীনা আচমকা বলে, দেশ ছেড়ে এলেও মনে রাখতে তো অসুবিধে হয়নি।

হয়নি তো।

রোশোনারা খুব রূপবতী ছিল?

জানি না।

রোশোনারা খুব সুন্দর ছিল?

থাক এসব কথা।

হ্যাঁ থাক। বলে রীনা আমার বুকে মুখ গুঁজল।

পরদিন নার্সিংহোমে গিয়ে আমি অবাক। নীচেই সব দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। যারা বহুদিন আগে, সেই আমার ছেলেবেলায় আমাদের বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই তারা, শৈলেনকাকা, গোবিন্দকাকা, বলরামকাকা, দুর্গাকাকা, রমেনদা, নগেনদা-খবর পেয়ে গেছে সবাই? কেউ কেউ উপরে গেছেন, বাকিরা নীচে দাঁড়িয়ে আছেন উপর থেকে কার্ড নেমে এলেই উপরে যাবেন বলে। সকলের ভিতরে বার্ধক্য এসেছে, চেহারা বদলে গেছে, কারোর মাথা সাদা, কারোর মাথায় চুল নেই, কারোর দাঁত নেই, কারোর চোখে ভীষণ পাওয়ারের মোটা কাঁচের চশমা। সবার সঙ্গে তাদের স্ত্রীরা আছে। পুত্রকন্যাও আছে। নার্সিংহোমে একজন পেশেন্টকে দেখতে পঞ্চাশজনের উপর লোক এসে গেছে। সবাই বলছে মুকুন্দদার অসুখ, না এসে পারি! কে খবর দিয়েছে? নগেনদা বলেন, কেন বলরামকাকা ফোনে জানালো। বলরামকাকা বলল, কেন দুর্গা যে তার ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠাল। দুর্গাকাকা বললেন, আমাকে তো রমেন জানালো কাল রাত্তিরে। সবাই সবাইকে জানিয়েছে। কে আগে খবর পেয়েছে, জানা গেল না কেন না রমেন দত্ত একটু আগে তার বাড়ি বিরাটির দিকে চলে গেছে। সে নাকি রাতকানা হয়ে গেছে। ভাল চোখে দ্যাখে না।

আমি অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলাম। চারপাশে অনেকজন কলরব শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে নার্সিংহোমে যত মানুষ এসেছে এই অপরাহ্ণবেলায়, সবাই দেখতে এসেছে খুলনা জেলার বেত্রবতী-কপোতাক্ষ তীরের বড়দল গ্রামের মুকুন্দ পালমশায়কে। মুকুন্দ পালমশায়ের খবর চলে গেছে সবার কাছে। আমরা তা হলে সত্যি সত্যি একা হয়ে যাইনি। রীনার মুখ আলো হয়ে গেছে। আমি উঠতে লাগলাম উপরে। আমার পিছনে পিছনে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছে আরও অনেকজন। সবাই আমার বাবাকে দেখতে এসেছে। মুকুন্দ পাল অসুস্থ এই কথা জেনে ছুটে এসেছে নবীন বার্ধক্য সঙ্গে করে। ঝুঁকে ঝুঁকে উঠছে সবাই। হাঁপাচ্ছে। শ্বাস নিচ্ছে দাঁড়িয়ে, তবু উঠে যাচ্ছে উপরে। আমার আগে আগে, আমার পিছনে পিছনে।

বাবা মুকুন্দ পাল বসে আছেন নার্সিং হোমের বেডে। সাদা ধবধবে চাদরের উপরে সাদা, ধুতি, পাঞ্জাবী পরা বাবা বসে আছেন জোড়হাতে, আমাকে দেখে ডাক দিলেন, আসুন, আসুন, আপনি বড়দলের মানুষ, আপনারা সবাই এসেছেন, আমার কী আনন্দ হচ্ছে, আপনাদের সঙ্গে আমার দেখা হল, এ আমার পরম সৌভাগ্য, এখনও সবাই আসেনি, এজাহার, মোজাহার…।

বাবা বলে যাচ্ছিলেন। নগেনদা, শৈলেনকাকু, বলরামকাকারা ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছেন বাবার সামনে। বাবা বলে যাচ্ছেন, আপনারা আসবেন তাই বাসা বাড়িটা নেওয়া, সবাই থাকুন, সবাই আবার ফিরে যেতে পারি কিনা ভাবতে হবে, ওটা তো আমাদের জন্মভূমি, কী বলেন আপনারা?

শৈলেনকাকা এগিয়ে এলেন, ও মুকুন্দদা, মুকুন্দদা?

বাবা সাড়া দিলেন না। নিজের নামটাও বোধ হয় ভুলে গেছেন। শুধু মনে আছে বড়দল গ্রামটির কথা। জল থই থই নদীর কথা। নদীতে ভাসা স্টিমার, নৌকোর কথা। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম আরও অনেকজন উঠে আসছে, ওপার থেকে নদীর স্রোতের মতো মানুষ আসছে মুকুন্দ পাল্কে দেখতে। বেত্রবতী, কপোতাক্ষ ঢুকে পড়েছে নার্সিংহোমের ভিতরে।

তখন ঘণ্টা বাজছিল। চোয়াড়ে একটা লোক ঢুকে পড়েছিল কেবিনের ভিতরে। সে ফ্যাসফেসে গলায় হুকুম করছিল, সময় হয়ে গেছে সময় হয়ে গেছে, আর না, এবার সবাই নেমে যান, চলে যান, আর দাঁড়ানোর হুকুম নেই।

বাবা একা বসে আছেন। জোড় হাত, চোখে জল। এখন সন্ধ্যা নেমেছে। বেত্রবতী কপোতাক্ষর দুই তীরে অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। শুধু নদী বয়ে যাচ্ছে আরও অন্ধকারে, দূর সমুদ্রের দিকে। আলোর শেষ বিন্দুটুকুও মুছে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। শেষ কণ্ঠস্বরটিও হারিয়ে গেছে নদীর অনন্ত স্রোতে। বাবা বসে আছেন স্তব্ধ প্রকৃতির ভিতরে একা। বাবার চারিদিকে কেউ নেই। একজনও না। অন্ধকারে বাবার চোখের জল পড়ল অন্ধকারে।

 

হারানো নদীর স্রোত-১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!