হাতেম তাঈ’র মহানুভবতা

হাতেম তাঈ ছিলেন তৎকালীন আরবের ইয়েমেন প্রদেশের একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ও নিরহংকারী ব্যক্তি।
সাধারণ জীবন-যাপনকারী হাতেম তাঈ’র দানশীলতা, আতিথেয়তা ও মহানুভবতার কথা ছিল মানুষের মুখে মুখে।
তাঁর কথায় মানুষের হৃদয় গলে যেত, শত্রু পরিণত হতো বন্ধুতে। পরকে আপন করার এক অসম্ভব ক্ষমতা ছিল হাতেমের।
রংধনু আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প প্রচার করেছি। সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। রোমের একজন গভর্নর ছিলেন অনেক দানশীল।
তিনি জনগণের কল্যাণে কাজ করতেন এবং তাদের সাহায্য করতেন। সে সময় সেখানে ইতিহাসখ্যাত দানবীর হাতেম তাঈ বাস করতেন।
গভর্নর যখন হাতেম তাঈ-এর দানশীলতার কাহিনী জানতে পারলেন তখন তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে বললেন, আমিই সবচেয়ে দানশীল ব্যক্তি।
দানবীর উপাধি আমাকেই মানায়, হাতেমকে নয়। এ ঘটনার কিছুদিন পরের কথা।
গভর্নর রোমের সকল অভিজাত ও সাধারণ মানুষকে একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াত করলেন।
খাওয়া-দাওয়া শেষে একজন অতিথি সকলের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে হাতেম তাঈ ও গভর্নরের দানশীলতা সম্পর্কে একটি কবিতা পাঠ করলেন।
কবিতার এক জায়গায় তিনি গভর্নরের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার মেহমানদারী, ক্ষমা ও দানশীলতা ঠিক যেন হাতেম তাঈ’র মত। গভর্নর কবিতা শুনে গভর্নর রেগে গেলেন।
বললেন, গভর্নর : কে এই হাতেম তাঈ, আমি লোকদের এত কিছু করার পরও তারা হাতেম তাঈ’র সাথে আমাকে তুলনা করছে!
সে আমার চেয়ে দানশীল হয় কিভাবে? এ কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, হাতেম তাঈকে উচিত শিক্ষা দেয়ারও সিদ্ধান্ত নিলেন।
কিন্তু সবার সামনে বেশি কিছু বললেন না।
এরপর রাতের বেলায় তার সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত এক কমান্ডারকে ডেকে বললেন, গভর্নর : ‘তুমি এক্ষুনি হাতেম তাঈ’র শহরে যাও এবং তাকে হত্যা কর।
যতক্ষণ পর্যন্ত সে বেঁচে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার দানশীলতা নিয়ে কথা বলবে, আমার অবদান কিছুতেই স্বীকার করবে না।
তুমি যদি তাকে হত্যা করতে পারো তাহলে তোমাকে অনেক অনেক পুরস্কার দেবো।’
গভর্নরের কথা শেষ হওয়ার পর কমান্ডার ঘোড়া ছুটিয়ে হাতেম তাঈ’র শহরের দিকে রওনা হলেন এবং কয়েক দিন পর সেখানে হাজির হলেন।
হাতেম তাঈ’র শহরের পাশেই ছিল একটি বিরাট মরুভূমি।
রাতের বেলায় কোথায় আশ্রয় পাবেন এ চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। হঠাৎ তিনি একটি আওয়াজ শুনলেন এবং দেখতে পেলেন একটি লম্বা ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে।
কমান্ডার খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তলোয়ার বের করে নিজেকে রক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন।
এ সময় তিনি দেখতে পেলেন ঘোড়ায় চড়ে এক যুবক তারই দিকে এগিয়ে আসছে।
কমান্ডারকে দেখে যুবকটি ঘোড়া থেকে নেমে বললেন, হাতেম তাঈ : আপনি কে? এ মরুভূমিতে কি করছেন? কমান্ডার : আমি অনেক দূর থেকে এক অভিযানে শহরে এসেছি।
আমি খুব ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত এবং দিশেহারা।
হাতেম তাঈ : আপনি কিছু মনে না করলে, যতদিন খুশী আমার বাড়িতে মেহমান হিসেবে থাকতে পারেন।
রোমান কমান্ডার খুশি হয়ে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং যুবকের বাড়িতে গেলেন।
যুবক তাঁর বাড়ির সবচেয়ে ভাল ঘরটিতে তাকে থাকতে দিলেন, তাকে উত্তম খাবার পরিবেশন করলেন এবং তাঁর জন্য আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করলেন।
এরপর কমান্ডার ঘুমিয়ে গেলেন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে যুবককে উদ্দেশ্য করে কমান্ডার বললেন, কমান্ডার : আপনি খুবই দয়ালু।
আমার সাথে আপনি যে ব্যবহার করেছেন, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি এর প্রতিদান দিতে চাই।’
এই বলে কমান্ডার একটি স্বর্ণের থলে বের করলেন এবং বললেন, কমান্ডার : এই নিন, এতে সামান্য কিছু স্বর্ণ মুদ্রা আছে।
যুবকটি হাসিমুখে থলেটি ফেরত দিয়ে বললেন, হাতেম তাঈ : আমি আপনার কাছে কোন প্রতিদান চাই না।
কারণ আপনি আমার অতিথি। যুবকটির এ ব্যবহারে কমান্ডার আরো মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি মনে মনে বললেন, এর মত হৃদয়বান ও দয়ালু ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা যায়।
এরপর তিনি বললেন, কমান্ডার : আমি রোমান গভর্নরের আদেশে এ শহরে এসেছি একজন লোককে হত্যা করতে।
আমি যদি লোকটির শির নিয়ে যেতে পারি তাহলে গভর্নর আমাকে অনেক পুরস্কার দেবেন। হাতেম : লোকটি কে? তার অপরাধইবা কি? কমান্ডার : তার নাম হাতেম তাঈ।
তার অপরাধ-সে আমাদের গভর্নরের চেয়েও দানশীল। এ কথা শুনে যুবকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
তারপর বললেন, হাতেম : প্রিয় অতিথি আমার! আপনি যদি এজন্যই এখানে এসে থাকেন তাহলে শুনুন, হাতেম আপনার সামনেই বসে আছে।
আমিই হাতেম তাঈ। হাতেম তাঈ’র পরিচয় পেয়ে রোমান কমান্ডার হতবাক হয়ে গেছেন।
এরপর কম্পিত কণ্ঠে বললেন, কমান্পার : আ-প-নি… আপনিই হাতেম তাঈ! হাতেম : হ্যাঁ, আমিই হাতেম তাঈ।
যদি গভর্নরের পুরস্কার আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে আপনি এক্ষুনি আমাকে হত্যা করে মাথাটা নিয়ে যেতে পারেন।
একথা শুনে রোমান কমান্ডারের আরেক দফা বিস্মিত হলেন। হাতেম তাঈ’র মহত্বের কাছে নিজেকে অত্যন্ত তুচ্ছ মনে করলেন।
তিনি মনে মনে বললেন, দয়া, উদারতা ও সুন্দর ব্যবহারের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না।
এর পর তিনি হাতেম তাঈকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কমান্ডার : আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
আমি বুঝতে পেরেছি-আপনার মহত্বের কথা কেন মানুষের মুখে মুখে। হাতেম তাঈ রোমান কমান্ডারকে ক্ষমা করার পর তিনি নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
হাতেম তার সফরের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও পানি দিয়ে দিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে লোকটি সমস্ত ঘটনা গভর্নরকে খুলে বললেন।
সবশেষে তিনি বললেন, কমান্ডার : আমি তাকে হত্যা করে তার মাথা আনতে গেলাম আর তিনি তার উদারতা দিয়ে আমার অন্তরের সব খারাপ চিন্তা দূর করে দিলেন-এমন মহৎ ব্যক্তি এ দুনিয়ায় কয়জন আছে? গভর্নর অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কমান্ডারের কথা শুনলেন।
তারপর মাথা নাড়িয়ে বললেন, গভর্নর : তুমি ঠিকই বলেছো, আমি বিনা কারণে তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েছিলাম। আজ আমি বুঝতে পারছি যে, সত্যিই তিনি একজন মহান ব্যক্তি।
তার দয়া ও উদারতার তুলনা সে নিজেই।

আজ হ্যাপি হ্যালুইন নাইট!

সততার মূল্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *